মনের অসুখ (শেষ পর্ব)

পাঁচ

‘আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না,’ বললেন মিসেস মার্সডেন, ‘আমার আপন ভাইপো...যাকে আমি এত ভালোবাসতাম, যাকে আমি এত বিশ্বাস করতাম...সে-ই এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করল আমার সঙ্গে!’

সকাল আটটা। বাড়ির ডাইনিংরুমে ব্রেকফাস্টে বসেছে সবাই—মিসেস মার্সডেন, লিজা, অয়ন আর জিমি। ক্যাথারিনও আছেন। পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়ে থানা থেকে খানিক আগে ফিরে এসেছে ওরা, ক্যাথারিনও ওখানেই যোগ দিয়েছিলেন ওদের সঙ্গে। মাইকেল আর মিলি আপাতত পুলিশের পাহারায় হাসপাতালে রয়েছে, সুস্থ হলেই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

‘লোভ,’ বৃদ্ধার কথা শুনে ভারিক্কি গলায় বলল অয়ন। ‘লোভ মানুষকে কতটা নিচে নামাতে পারে, তারই উদাহরণ দেখলাম আমরা।’

‘তা তো বটেই,’ যোগ করল জিমি। ‘ওপরে ওপরে আপনাকে ভালোবাসার অভিনয় করেছে মাইকেল, এমন ভাব দেখিয়েছে যেন ডাক্তার দেখাতে চায় না, হাসপাতালে ফেরত পাঠাতে চায় না; অথচ তলেতলে ষড়যন্ত্র করেছে আপনাকে পুরোপুরি মানসিক রোগী বানানোর। শেষে তো খুনও করতে চাইল! কী জঘন্য একটা লোক!’

‘কিন্তু ব্যাপারটা তোমরা বুঝলে কী করে?’ জানতে চাইল লিজা। ‘মাইকেলকে সন্দেহই–বা করলে কীভাবে? ওর বা মিলির সঙ্গে তো দেখাই হয়নি তোমাদের।’

‘যাহোক, বাকিটা তো আপনারা জানেনই। সবকিছু বুঝে ফেলার পর গত রাতে ফাঁদ পাতলাম আমরা। নিশ্চিত হলাম, যা যা ভেবেছি, সব সঠিক কি না। তারপর হাতেনাতে ধরলাম ওদের।’

‘গোড়া থেকে বলি?’ বলল অয়ন। ‘মিসেস মার্সডেনের মধ্যে যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই, তা তো আমরা সবাই বুঝতে পেরেছি। তাই খতিয়ে দেখতে হলো ষড়যন্ত্রের আশঙ্কাটা। বলে রাখি, বাড়িটা দেখামাত্রই খটকা লেগেছিল। চারকোনা একটা বাড়ির এক পাশ ঠেলে বের হয়ে আছে একটা গোল অংশ...কারণ কী? বাড়ির সৌন্দর্য বাড়ায়নি ওটা; বরং কুৎসিত করে তুলেছে। ভেতরে এসে রুমটা দেখার পর খটকা আরও বাড়ল। খোলামেলা রুম তো বর্গাকারও হতে পারে, বৃত্তাকার বানানো হলো কেন? এই একটা রুম কেন বাকি সব রুমের চেয়ে আলাদা? যেভাবে রুমের ভেতরটা সাজানো হয়েছে, তা-ও সন্দেহ জাগানোর মতো। নানা রকম ফার্নিচার দিয়ে ভরিয়ে ফেলা হয়েছে রুম; ফাঁকা জায়গাগুলোতে রাখা হয়েছে ফুলের টব। আসলে মেঝে আর দেয়ালের সংযোগস্থলটা যেন দেখা না যায়, সে জন্য করা হয়েছে কাজটা।

আরও পড়ুন

‘টব সরিয়ে সেখানে আমরা দেয়াল আর মেঝের মাঝে ফাঁক আবিষ্কার করলাম। বুঝলাম, মেঝেটা আলাদা; ওটাকে টার্নটেবিলের মতো ঘোরানো যায়; আর ঘোরানোর সুবিধার জন্যই বানানো হয়েছে বৃত্তাকার ঘর। বাড়িতে বেজমেন্ট নেই জেনে আরেকটু দৃঢ় হলো ধারণাটা। মেঝে ঘোরানোর জন্য নিশ্চয়ই বড়সড় যন্ত্র আছে নিচে; বেজমেন্ট থাকলে ওখানে ঢুকে দেখা যাবে মেকানিজমটা...হয়তোবা শব্দও শোনা যাবে...তাই বেজমেন্টই বানানো হয়নি। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য মেঝের দুই দিকে দুটি দাগ টেনে দিয়ে গেলাম। পরের দিন জানলাম, দাগ দুটি এক রেখায় নেই, তার মানে রাতে মেঝেটা ঘুরেছিল। পরে যখন আগের জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে, তখন পুরোপুরি নিখুঁতভাবে করা যায়নি, তাই দাগ দুটি ঠিক থাকেনি। মিসেস মার্সডেনও জানালেন, ফার্নিচারগুলো পজিশন বদলালেও সিরিয়াল ঠিক থাকে। এত কিছুর পর তো আর সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না, কীভাবে করা হচ্ছে কাজটা।

‘ভুতুড়ে আওয়াজের ব্যাখ্যা তো আরও সহজ। লুকানো স্পিকার দিয়ে অনায়াসে করা যায় কাজটা। এ রকম ঘটনা আগেও দেখেছি আমি আর জিমি। ধারণা করছি, মি. ডেভিড মার্সডেনের পুরোনো কোনো ভিডিও থেকে নেওয়া হয়েছে কথাগুলো; তারপর এডিট করে, কিছুটা সাউন্ড ইফেক্ট দিয়ে বাজানো হয়েছে প্রতি রাতে।

আরও পড়ুন

‘এবার সন্দেহভাজনের প্রসঙ্গে আসা যাক। সামান্য লজিক খাটিয়ে খুব সহজেই বোঝা গেল, কাজটা মাইকেল বেনেট ছাড়া আর কারও নয়। লিজার মুখেই শুনেছি, সে একজন আর্কিটেক্ট। অতএব বাড়ির ডিজাইন নিশ্চয়ই সে নিজে করেছে। বাড়ির ডিজাইনার ছাড়া কারও পক্ষে গোপনে মেঝে ঘোরানোর যন্ত্র বা দেয়ালে স্পিকার বসানো সম্ভব নয়।

‘মাইকেলের মোটিভটাও বুঝতে অসুবিধা হলো না। কেয়ারটেকার হিসেবে গত পাঁচ বছর যাবৎ মহা আরাম-আয়েশে ফুফুর সম্পত্তি ভোগ করছে সে। কে জানে, হয়তো টাকাপয়সাও নয়ছয় করেছে। তিনি ফিরে আসায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি তার, বিশেষ করে মিসেস মার্সডেন যেহেতু খুব শিগগির অফিসে বসতে চাইছেন। সম্পত্তির ভোগদখল তো হারাবেই, যত দুনম্বরি করেছে, সব ধরা পড়ে যাবে। তবে এমন কিছু যে ঘটতে পারে, তা সে আগেই আন্দাজ করেছিল। সে জন্যই এত সব কলাকৌশল খাটিয়ে তৈরি করেছে বাড়িটা। যাতে উনি ফিরে এলেই আবার পাগল সাব্যস্ত করতে পারে, ফেরত পাঠাতে পারে মানসিক হাসপাতালে।

‘যাহোক, বাকিটা তো আপনারা জানেনই। সবকিছু বুঝে ফেলার পর গত রাতে ফাঁদ পাতলাম আমরা। নিশ্চিত হলাম, যা যা ভেবেছি, সব সঠিক কি না। তারপর হাতেনাতে ধরলাম ওদের।’

আরও পড়ুন

‘মোটামুটি ক্লিয়ার,’ বললেন মিসেস মার্সডেন। ‘তবে এখনো কয়েকটা বিষয় অস্পষ্ট। যেমন ধরো, ওরা বেড়াতে যাওয়ার ভান করল কেন? এর আগে তো বাড়িতে থেকেই শয়তানি চালিয়ে গেছে।’

‘ওটা নিজেদের ওপর থেকে সন্দেহ সরানোর একটা কৌশল, ম্যাম,’ বলল জিমি। ‘সব সময় যদি ওদের উপস্থিতিতে আপনার হ্যালুসিনেশন হয়, কিছুটা সন্দেহ জাগতে পারে। তাই প্রমাণ করতে চেয়েছে, ওরা না থাকলেও ভুলভাল দেখেন আপনি। সে জন্যই বেড়ানোর কথা বলে দুই দিনের জন্য বাড়ি ছেড়েছে। আসলে যায়নি কোথাও, চুপিসারে ফিরে এসে ওই কটেজে ঘাপটি মেরেছিল।’

‘কটেজে যে ওরা থাকতে পারে কিংবা ওখানে কন্ট্রোল প্যানেল থাকতে পারে, সেটা বুঝলে কীভাবে?’

‘সিম্পল, ম্যাম,’ বলল অয়ন। ‘বাড়ির ভেতরে প্যানেলটা রাখা রিস্কি। যে কেউ দেখে ফেলতে পারে। বাড়ির বাইরে রাখার মতো জায়গা তো ওই একটাই—কটেজটা। ওটা দেখেও সন্দেহ জেগেছিল। এইটুকু একটা বাড়ির জন্য আলাদা সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের দরকার কী? আসলে কন্ট্রোল প্যানেল লুকানোর জন্যই বানানো হয়েছে ওটা।’

আরও পড়ুন

‘কী শয়তান!’ মন্তব্য করল লিজা। ‘তবে তোমরাও কম যাও না। শয়তানটাকে দারুণ শিক্ষা দিয়েছ। আচ্ছা, জিমিকে পেছনে রেখে গেলে কেন?’

‘ওদের একজন যে বাইরে থাকতে পারে, সেটা অনুমান করেছিলাম। জানালা দিয়ে মিসেস মার্সডেনের ঘরে তাকে উঁকি দিতে দেখেছি আমরা...নিশ্চিত হতে চেয়েছে, উনি শুয়ে পড়েছেন কি না। কাজ শেষে সে যদি কটেজে না ফিরে গিয়ে থাকে, তাহলে বিপদ হতে পারে ভেবে সতর্ক হয়েছি। আফটার অল, অপরাধীদের মোকাবিলা এই প্রথম করছি না আমরা।’

‘বাব্বাহ্‌!’ বললেন ক্যাথারিন। ‘তোমাদের দেখছি কোনো কিছুই নজর এড়ায় না। গতকাল কেন অত আত্মবিশ্বাসী ছিলে, তা বুঝতে পারছি এবার।’

‘কিন্তু এখন আমার কী হবে?’ মনমরা গলায় বললেন মিসেস মার্সডেন। ‘আমার আপন মানুষই বেইমানি করল, আমি তো একা হয়ে গেলাম। এই বিশাল সম্পত্তি, ব্যবসা...এসব একাকী সামলাব কী করে? আমাকে সঙ্গ দেবে কে?’

‘শুধু রক্তের সম্পর্ক দিয়েই কি মানুষ আপন হয়?’ তাঁকে বলল অয়ন। ‘কাজ বা আবেগ দিয়ে আপন হওয়া যায় না? প্রমাণ করা যায় না বিশ্বস্ততার? আপনার চরম বিপদে যে মানুষটা সবচেয়ে বেশি চিন্তিত হয়েছে, সাহায্য করার জন্য আমাদের ডেকে এনেছে, তার চেয়ে বিশ্বস্ত আর আপন মানুষ আপনি কোথায় পাবেন? তাকেই সঙ্গী করে নিন না।’

কথাটা যেন স্পর্শ করল বৃদ্ধাকে। ঘাড় ফিরিয়ে লিজার দিকে তাকালেন তিনি, তারপরই তাকে জড়িয়ে ধরলেন দুহাতে।

(শেষ)

আরও পড়ুন