বিপদ যখন আসে
ক
‘যত হাসি তত কান্না...বলে গেছেন রাজেশ খান্না!’
না, ভুল হলো। এখানে রাজেশ খান্না নয়, অন্য কারও নাম হবে। নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। অবশ্য এখন কী কারণে আমি আপনাদের এসব বলছি, তা নিজেও জানি না। আমার আসলে বলা উচিত, বিপদ যখন আসে, তখন চারদিক থেকেই আসে। একেবারে ধেয়ে আসে। আর তা না হলে আজকের রাতের মতো এমন বিভীষিকাময় কোনো রাত আমার জীবনে হয়তো কখনো আসত না।
নতুন গল্প জমা দিতে হবে, সেটা নিয়ে বেশ অস্থির হয়ে আছি। একবার ভেবেছি, গল্প লেখাটা আমাকে দিয়ে আর হবে না; সবার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নেব। কিন্তু রফিকুল ভাইয়ের বিশেষ অনুরোধে সেটা সম্ভব হলো না। এই প্রথম নিজের সম্পাদনায় একটা গল্প সংকলন বের করবেন তিনি, আমি নিজে লেখক হলেও তাঁর লেখার অসম্ভব বড় ভক্ত। তাই সন্ধ্যায় তিনি যখন ফোন করে বললেন, ‘কায়সুল, গল্প কিন্তু আপনাকে দিতে হবে। কোনো ওজর আপত্তি শুনব না।’ তখন রীতিমতো বিপদে পড়ে গেলাম। লকডাউনের কারণে আমার মাথা প্রায় অচল হয়ে আছে, এ বছর তিনটা উপন্যাস লিখতে হবে, একটাও এগোতে পারিনি। সারাক্ষণ একধরনের বিপন্নতা আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে রেখেছে মনটাকে।
কী লিখব যখন ভাবছি, তখন রফিকুল ভাইযের পরামর্শের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বললেন, ‘আপনার প্রিয় জনরা নিয়েই গল্প ফাঁদেন, খুনখারাবি...সমস্যা নাই।’ কিন্তু সেটাও এ মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না। কোনোভাবেই জুতসই প্লট খুঁজে পাচ্ছে না মস্তিষ্কের সেলগুলো। তা ছাড়া ইদানীং আমার একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে, কেন যেন এখন আর ছোটগল্প লেখায় আগ্রহ বোধ করি না। মনে হয়, এটাকেই একটু ডালপালা ছড়িয়ে লেখাটা উপন্যাসিকার আকার ধারণ করানো যায়। তখন লেখাটাকে মলাটবন্দী করে ফেলা যাবে। আর কে না জানে, সময়টা এখন ‘কোয়ালিটির থেকে কোয়ান্টিটি’র বেশি!
যাহোক, যেটা বলছিলাম...ওই যে, বিপদ যখন আসে, তখন চারদিক থেকেই আসে। রাতের বেলা, বিছানায় শুয়ে বাদাম আর মটরভাজা খাচ্ছি; আলগোছে চলছে ফেসবুক ব্রাউজিং। কিন্তু কোনো কিছুতেই মন বসছিল না। মাথায় লেখার চাপ, সবকিছু অসহ্য লাগছে। এর মধ্যে হঠাৎ এক জুনিয়র লেখক কল করতে শুরু করেছে। বাপরে, একে আমি ভীষণ ভয় পাই। একবার কথা শুরু করলে হেমেন্দ্রকুমার রায় থেকে স্টিফেন কিংয়ের লেখায় কী কী ভুল খুঁজে পেয়েছে, সব বিস্তারিত আলোচনা শুরু করবে। জীবনে অনেক পণ্ডিত দেখেছি, কিন্তু কম বয়সে এমন মহাপণ্ডিত কখনোই দেখিনি।
ঝামেলা সহ্য হচ্ছিল না, তাই আস্তে করে ফোনটা বন্ধ করে রাখলাম। অদ্ভুত একটা রাগ দলা পাকিয়ে উঠল গলার কাছে। আবারও মনে পড়ল কথাটা, বিপদ যখন আসে, চারদিক থেকেই আসে।
আধো অন্ধকার ঘর। একটা চার্জার লাইট জ্বালিয়ে রেখেছি। মাইনাস সেভেন পাওয়ারের চশমাটা নাক থেকে নামিয়ে রেখেছি বিছানার পাশে। হঠাৎ মনে হলো, কী যেন একটা সড়াৎ করে আমার পায়ের ওপর দিয়ে চলে গেল। শরীরের সব নার্ভ একনিমেষে অসাড় হয়ে গেল আমার, প্রায় চিৎকার করে উঠলাম গলা ফাটিয়ে।
আরে, এটা কী!
পরক্ষণে হারামজাদাগুলোর কথা মনে পড়তে ঘৃণায় রি রি করে উঠল আমার শরীর।
বেশ কিছুদিন ধরে আমার নিঃসঙ্গ জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে ওগুলো। ইঁদুর। বড় বড় ধেড়ে আকৃতির একেকটা ইঁদুর। গতকাল রাতেই বিস্কুটের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে ছড়িয়ে রেখেছিলাম, দুটি বাচ্চা আকৃতির ইঁদুর মরে ভূতও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আসলগুলোকে মারতে পারিনি, এই নিয়ে আফসোসের সীমা ছিল না। আজ রাতে দেখি, শয়তানগুলো আমার বিছানায় উঠে এসেছে!
লম্বা করে শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করতে চাইলাম, বাঁ হাত পেছনে রেখে ঘুরে বসার চেষ্টা করছি। ঠিক তখনই মট করে একটা শব্দ হলো।
চমকে ঘুরে তাকালাম। কী পড়েছে এটা হাতের নিচে?
ইয়াল্লাহ্! এটা তো আমার চশমা। হাতের চাপে গুঁড়িয়ে গেছে চশমার দুপাশের ফ্রেম!
রাগে-দুঃখে প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা হলো, বন্ করে চক্কর দিয়ে উঠল মাথা। আমার কাছে এক্সট্রা কোনো চশমা নেই, এই লকডাউনের বাজারে এখন আমি চশমার দোকান কোথায় খোলা পাব?
কী করব ভাবছি, চশমা ছাড়া আমি প্রায় অন্ধ, গোটা দুনিয়াটাকেই অস্পষ্ট মনে হচ্ছে। এখন তাহলে কী হবে?
বিপদ যখন আসে, চারপাশ থেকেই আসে...
বিছানা ছেড়ে উঠতে যাব, হঠাৎ পায়ের রগে টান লাগল। আমি জানি না, আপনারা কে কবার এই বিপদে পড়েছেন, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হলো ভয়াবহ। একে তো বাসায় একা, তার ওপর তীব্র, অসহনীয় ব্যথা। পা চেপে ধরে গলা ফাটাচ্ছি, মনে হলো হাঁটুর নিচ থেকে কেউ মাংস ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে চিৎকার করে আল্লাহকে ডাকলাম, আল্লাহ, এবারের মতো উদ্ধার করুন, কাল সকালেই আমি একজন পারমানেন্ট কাজের লোক জোগাড় করে ফেলব!
কিন্তু আমার মতো একজন পাপীর কথা কি আর আল্লাহ শুনবেন! বরং বিপদের ষোলোকলা পূর্ণ করে চট করে চারপাশটা কালিগোলা অন্ধকারে ডুবে গেল। বুঝলাম, ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে।
পা চেপে ধরে বসে আছি, ঘামছি দরদর করে। ধীরে ধীরে চাপ কমছে শিরায়, নিশ্বাস বন্ধ করে রেখেছি; শ্বাস ফেললেও যেন টান লাগছে জায়গাটায়। এবং...
এবং বিপদ যখন আসে, চারপাশ থেকেই আসে।
কিচেনের ওদিক থেকে মৃদু খসখস শব্দ ভেসে এল।
ঝট করে মুখ তুলে তাকালাম।
গোটা ফ্ল্যাটে আমি ছাড়া আর কেউ থাকে না। ব্যাচেলর মানুষ, সারা দিন লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। তা ছাড়া ছোটবেলা থেকেই আমি একটু নির্জনতাপ্রিয়, কোলাহল কখনোই আমাকে টানে না। তাহলে এত রাতে কিচেনের ওদিক থেকে কিসের শব্দ এল?
দৃষ্টি অস্বচ্ছ, ডান পায়ে মাত্রাহীন যন্ত্রণা। তার ওপর ঘুটঘুটে চারপাশে অন্ধকার। চার্জার লাইটের যা অবস্থা, তাকে শোচনীয়ই বলা যায়, সেই কবিতাটার মতো অবস্থা, ‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি...’ মানে এতক্ষণ বাতি নিভিয়ে, ঘর অন্ধকার করে চার্জার লাইট জ্বালিয়ে বসেছিলাম, এখন সেই আলোর অবস্থা নিবু নিবু। চার্জ প্রায় শেষের পথে। বাসায় কোনো মোমবাতি আছে বলেও মনে হয় না।
‘কে? কে ওখানে?’ একবার গলা তুলে চিৎকার করে উঠলাম।
কেউ সাড়া দিল না। মৃদু খসখস শব্দটা আবার ভেসে এল ওপাশ থেকে।
বুকের ভেতর কাঁপুনিটা বেড়ে গেল। ঘাড়ের পেছনের চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেল সরসর করে।
কিসের শব্দ ওটা? মনে হচ্ছে কেউ যেন হেঁটেচলে বেড়াচ্ছে ওপাশের ঘরে।
চার্জার লাইটটাকে বাগিয়ে ধরলাম; যা থাকে কপালে, এটা নিয়েই এগোতে হবে। হাতের কাছে আত্মরক্ষার মতো আর কিছু নেই।
বিছানা থেকে নেমে পা টিপে টিপে এগোতে লাগলাম। কিছুদূর যেতে অসহায়ের মতো ফিরে তাকালাম বিছানায় পড়ে থাকা চশমার ভাঙা ফ্রেমটার দিকে। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না প্রায়। সব অস্বচ্ছ।
ঠিক তখনই মাথায় শক্ত একটা কিছুর আঘাত এসে পড়ল। তীব্র যন্ত্রণায় চোখে শর্ষের ফুল দেখলাম। মানুষের খুলির হাড় নাকি খুব বেশি চোট সহ্য করতে পারে না, ভেতরের ক্রুদ্ধ মানুষটা মাথা তুলে দাঁড়ানোর আগেই খুলির অক্সিটাল আর প্যারাইটালের চার ইঞ্চির মতো অংশ চৌচির হয়ে গেল। ঢুকে গেল ব্রেনের আধা ইঞ্চি গভীরে।
কাটা কলাগাছের মতো মেঝেতে পড়ে গেলাম আমি। অনেক আগেই জ্ঞান হারিয়েছি।
খ
কে এসেছিল আমার ঘরে? চোর?
শুনেছি, করোনার প্রাদুর্ভাবে সারা দেশে দুর্ভোগ বেড়েছে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অনটন। তাহলে কি চোরই ঢুকেছিল ঘরে চুরি করতে? তারপর ধরা পড়ে যাওয়ায় আমাকে আঘাত করে...
যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে মাথাটা, হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছি। কতক্ষণ পর জ্ঞান ফিরেছে জানি না, এখনো চারপাশ কবরের মতো নিস্তব্ধ। এবং...
এবং বিপদ যখন আসে, তখন চারদিক থেকেই আসে।
একটু পরই চোখের সামনে দেখতে পেলাম ওটাকে। একটু দূরে, কেমন যেন গুঁড়ি মেরে লেগে আছে মেঝের সঙ্গে।
কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব। আমি কঠিনভাবে হোম কোয়ারেন্টিন পালন করছি, বাজারঘাট যা করার দারোয়ানকে দিয়ে করাই, নিজের কোনো কাজে বাইরেও যাই না। তাহলে এটা কীভাবে এল আমার ঘরে?
মনে পড়ে গেল চোরের কথা। নিশ্চয়ই ওই ব্যাটার পায়ে জড়িয়ে এনেছে। ওই লোকের স্যান্ডেলে হয়তো লেগেছিল মরণব্যাধি ভাইরাস করোনা!
এ কী! আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে কেন? পেটের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা, নাড়িভুঁড়ি সব ছিঁড়ে আসতে চাইছে। মনে হচ্ছে, কিছু একটা যেন বুক ঠেলে ওপরে উঠে আসতে চাইছে, অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় মোচড় খাচ্ছে শরীর।...গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরোচ্ছে গলা দিয়ে...হে খোদা, একেই কি বলে করোনায় মৃত্যু? এভাবেই কি সারা বিশ্বে নির্মমভাবে মৃত্যু হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের? কিন্তু আমাকে তো এখনো করোনা আক্রমণ করেনি...ওই যে একটু দূরে, মেঝেতে জড়িয়ে আছে ওটা। তাহলে আমি কেন...
বিপদ যখন আসে, চারপাশ থেকেই আসে।
একটু পরই টের পেলাম, মৃত্যু-আতঙ্কে পাগল হয়ে যেতে বসেছি আমি। সে কারণেই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি অদৃশ্য ভাইরাসকে!
যখন ভাবতে বসেছি চোরটা ঘরে ঢুকল কীভাবে, ঠিক তখনই বিস্ফারিত হলো আমার চোখ। শ্বাসের জন্য গলাকাটা পশুর মতো ছটফট করতে লাগলাম, খাঁকারি দিয়ে কণ্ঠনালির ভেতর থেকে বের করে দিতে চাইলাম ভাইরাসটাকে। কিন্তু কিছুতেই পারলাম না। মুখের ভেতর কেমন যেন আগুন ধরে গেল...মৃদু কিচকিচ শব্দ ভেসে এল গলার ভেতর থেকে। অসহায় রাগে একবার চিৎকার করার চেষ্টা করলাম, ঠিক তখনই মুখ দিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে এল কিছু একটা। না, ওটা কোনো ভাইরাস ছিল না, ছিল দু-দুটি জলজ্যান্ত নধর সাইজের ধেড়ে ইঁদুর।
মুখের ভেতরটা ভরে উঠল নোনা রক্তে। মৃত্যুর কয়েক সেকেন্ড পূর্বে মনে হলো, প্রতিহিংসার আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে ওদের দুজোড়া চোখ। চেয়ে আছে আমার দিকে। ওগুলোর ক্ষুদ্র ঠোঁটে লেগে আছে আমার নাড়িভুঁড়ি...রক্ত। আমাকে নীরবে স্থির হয়ে যেতে দেখে আবারো নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরা কায়সুল কবিরের নাদুসনুদুস শরীরটার ওপর।
বিপদ যখন আসে, তখন...
গ
‘আপনি তাহলে বলছেন এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না, রফিকুল সাহেব?’
‘আমার তো এসব নিয়ে কিছু জানার কথাও না, ইন্সপেক্টর সাহেব।’
‘কিন্তু গল্পটা পড়ে আপনার কী মনে হচ্ছে? একজন লেখককে স্রেফ তার গল্পের মতো করে হত্যা করল দু-দুটি ইঁদুর...’
‘এ ব্যাপারে আমার আসলে কিছু জানা নেই, ইন্সপেক্টর। কায়সুল কবির আমার বন্ধু মানুষ। লেখালেখির বাইরে তার সঙ্গে আমার খুব বেশি খাতিরও ছিল না। তবে শুনেছি, একেবারে একা থাকত। কারও সঙ্গে খুব একটা মিশতটিশত না...’
‘ড্রিপেশন বলছেন?’
‘হয়তো তা–ই। তবে আমি ভাবছি অন্য কথা।’
‘কী ভাবছেন, বলুন তো।’
রফিকুল চৌধুরী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর কপালে সামান্য ভাঁজ ফেলে ধীরে ধীরে বলতে আরম্ভ, ‘আমি ভাবছি, কায়সুল কবির গল্পটা লিখল কখন? তার মৃত্যুর আগে, নাকি মৃত্যুর পর?’
রফিকুল চৌধুরীর কথা শুনে সদ্য পুলিশে জয়েন করা তরুণ ইন্সপেক্টর কুদরত-ই-এলাহি দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল। দেখা যাচ্ছে, কথাটা আসলেই সঠিক। বিপদ যখন আসে, তখন চারদিক থেকেই আসে।...তা না হলে আর দুদিন পর যখন ইন্সপেক্টর কুদরতের বিয়ে, ঠিক তখনই কেন এমন বাজে একটা কেস তার কপালে এসে জুটবে!
ধুর, ভালো লাগে না কিছু। কিচ্ছু ভালো লাগে না!