ননী ভৌমিকের অনুবাদ গল্প 'যশের খেয়াল'

'সাহসী, বেপরোয়া সন্ধানীদের জয়!' লোকে যখন অনায়াসে মহাজগতে ভ্রমণ করবে তখন বলবে এ কথা। বলবে, "ধন্যবাদ তোদের চারপেয়ে ব্যোমযাত্রীরা! প্রথম স্পুৎনিকের কথা লোকে জানবার আগেই তোরা যাত্রা করেছিলি রকেটে। নিজের জীবন তুচ্ছ করে তোরা পরখ করে দেখেছিস কেবিন আর ফ্লাইং স্যুটের মজবুতি, ধূর্ত শক্তির আঘাত তোরা মাথা পেতে নিয়েছিস প্রথম, ভরসা রেখেছিলি ভারহীন অবস্থার রহস্যময় নৈঃশব্দে, সে অবস্থা কেবল কল্পনার মতো, স্বপ্নের মতো, আর কখনো সখনো মাটিতে নেমেও বহুক্ষণ অপেক্ষা করে থাকতে হয়েছে, কখন হেলিকপ্টার এসে খোঁজ নেবে তোদের। তারপর ফের সব শুরু হয়েছে প্রথম থেকে ট্রেনিং, যাত্রা, ফের ট্রেনিং। তোদের বুকের প্রতিটি স্পন্দন রেকর্ড' হয়ে আছে মহাজাগতিক ডাক্তারির বইয়ে; সে বই বৃহৎ, মানবের পক্ষে অতি জরুরী। এই সব রেকর্ড থেকে বৈজ্ঞানিকেরা বার করেছেন নিরাপদ উড্ডয়নের নিয়ম, সে নিয়ম এনে দিয়েছেন মহাকাশযাত্রীদের জন্যে। ধন্য তোরা!'

রকেটড্রোম থেকে ইনস্টিটিউটে ফিরে এই সব কথা ভাবছিল ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ। তার ভাবনায় বাধা দিলে দ্রোনভ। বললে, 'জানেন হে বন্ধুদল, আপনাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবি: একেবারে ছেলেমানুষ আপনারা!'

'কী বলছেন?' অবাক হল ভালিয়া।

'খুবই সোজা কথা,' বললে দ্রোনভ, 'পরস্পরের দিকে একবার চেয়ে দেখুন। দেখছেন তো নাকে ছুলি ফুটে উঠেছে। লোকে বলে বসন্ত এলে বাচ্চাদের নাকেই কেবল ঐ ধরনের ছুলি দেখা যায়। আর সত্যি বসন্তই এসে গেছে!' জানলার দিকে দেখাল দ্রোনভ।

তাপ আর আলোয় ভরা শহরের মধ্য দিয়ে মোটরে করে যাচ্ছিল ওরা। বসন্তের বরফ গলা জলের মধ্যে লাফালাফি করছিল বাচ্চারা, জলের মধ্যে সূর্যের ছটা। লোকজনের আশেপাশে সবকিছুই চমক দিচ্ছে, ঝলক দিচ্ছে। চোখ মিটমিট করতে হচ্ছে সবাইকে, আর আকাশের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে যেন ঝকঝকে নীল পটের ওপর কোন এক বেপরোয়া শিল্পী কালো

কালিতে কলমের এক এক টানে এ'কে দিয়েছে কতকগুলো ক্রেনের সিল্যুয়েট।

আধঘণ্টা পরে ওরা গিয়ে আসন নিলে প্রফেসরের সামনে। রিপোর্ট দিলে দ্রোনভ:

'কুকুরদুটো উঠেছিল ২১২ কিলোমিটার উচুতে। যাত্রার সক্রিয় অংশটায় নাড়ীচলাচল, নিঃশ্বাস, রক্তচাপ বেড়ে ওঠে। ভারহীনতার অবস্থায় তা ক্রমশ নেমে আসে, কিন্তু ল্যাবরেটরির চেয়ে ধীরে। বোঝা যায়, ভারহীনতার অবস্থায় অবাক হয়ে যায় ওরা।'

'আপনার মন্তব্য কী?' জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।

'রকেট নামার সময় ব্রেকটা আমার মনে হয় খুব মসৃণভাবে কাজ করেনি। আমাদের প্রায় কোনো রেকর্ডই নেই, যন্ত্র বিগড়ে যায়। ত্রাণ ব্যবস্থাটা আরো উন্নত করতে হবে কনস্ট্রাকটরদের। কোনো রকম একটা স্প্রিং টিং গোছের কিছু আবিষ্কার করা দরকার। নইলে 'শুইয়ে-দিলেই- উঠে- বসে' পুতুলগুলোর মতো একটা কেবিনের ব্যবস্থা, যেটা উল্টে যাবে না।'

'ঠিক কী করবে সেটা ওদের ব্যাপার,' প্রফেসর বললেন, 'তবে আপনার বক্তব্যটা কাজে লাগাবার মতো। কনস্ট্রাকটরদের ওটা অবশ্যই জানিয়ে দেব... কুকুরদের গায়ে কোনো রকম ক্ষত বা রক্তক্ষরণ কিছু দেখা যায়নি?'

'আমাদের দরকার ফিলিং, বুঝলেন না, ভাবাবেগ!' বেশ দৃঢ় স্বরেই বললে কুলিক, 'দুজনেই লাফাতে শুরু করুক। নইলে খুব নীরস হবে ফিল্মটা। আপনি একটু সাহায্য করুন ভাই।'

'না, কোনো ক্ষতি হয়নি ওদের। জানেন তো,' হেসে ফেলল দ্রোনভ, 'খে'কুরেটা দেখা গেল বেশ বাহাদুর। আমরা ওর নাম বদলে দেব বলেই ঠিক করেছি। নাম রাখব বেপরোয়া। আপনি কী বলেন?'

'ইনস্টিটিউটে তার জন্যে কোনো বিশেষ নির্দেশপত্র জারী করা হবে না,' রহস্য করে বললেন প্রফেসর, 'তবে এমন কাজ দেখিয়েছে যখন, তখন বেশ, আপত্তি নেই। অবশ্য ভালোই শোনাবে। সংবাদপত্রের পক্ষেও কৌতূহল জাগাবার মতো। ওদিকে সব এসে পড়েছে সাংবাদিকরা: লাইকার বোনটিকে দেখিয়ে দেবেন আমাদের নতুন যশস্বিনী। কাজ করার আর উপায় নেই। ভালো কথা, ফিল্মও তুলছে ওরা। ক্যামেরাম্যানকে একটু সাহায্য করবেন যেন, অন্তত আপনি এটা দেখবেন, ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ।'

আরও পড়ুন

এই আলাপের কিছু পরেই ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচকে এসে ধরল একজন অপরিচিত লোক, গায়ে একটা হলদে মৃগচর্ম জ্যাকেট, মাথায় স্পোর্টসম্যান টুপি।

'আপনিই তো আসছেন রকেটড্রোম থেকে?' জিজ্ঞেস করল সে, 'পরিচয় দিয়ে নিই: আমি ক্যামেরাম্যান কুলিক। আপনি আগেই হয়ত শুনেছেন। আপনাকে আমাদের ভারি দরকার। কুকুরদুটো কোথায় আপনার? নিশ্চয় সাহায্য করবেন আমাদের।'

লোকটার গলার স্বরে এতটুকু দ্বিধা নেই। এমন কি প্রশ্নের মধ্যেও এমন একটা সুর যে আপত্তি করার জো নেই।

ইওলকিন কুকুরদুটোকে নিয়ে এল। কালকের ব্যোমনাবিকরা সানন্দেই ছুটোছুটি করতে লাগল আঙিনায়, শকে বেড়াতে লাগল কাঠ, বাড়ির আনাচ কানাচ, পথ।

'শিষ্ট শান্ত জন্তু নিয়ে কাজ করে আরাম আছে,' কিনো ক্যামেরা বাগিয়ে বললে কুলিক, 'একবার ইয়াল্ল্তায় বাঁদরের ছবি নিতে হয়েছিল। জালিয়ে মেরেছিল একেবারে। ভয়ানক বদখেয়ালী "বাঁদরটা। আমার ক্যামেরার ঝিঝি ডাকা শব্দে ক্ষেপে উঠছিল কেবলি। প্রতি মুহূর্তে ভাবছিলাম, এই বুঝি এসে কামড় দেয় আমার নাকে। ভয়ানক হিংস্র। খাঁটি একখান ঝুলডগ!'

'আপনার ফিল্মটা আমি দেখেছিলাম, মনে হচ্ছে,' বললে ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ 'নামটা বোধ হয় "মহাজগতে রেনা", তাই না? ফিল্মটা ভালোই লেগেছিল। ওতে খুব সঠিকভাবেই ধরে নেওয়া হয়েছে যে মহাজগতের সন্ধানে বাঁদর উপযুক্ত।'

'ও সবই ঠিক, তবে তারপর থেকে বাঁদর আমার আর সহ্য হয় না,' একটা গোপন কথা বলার মতো করে বললে কুলিক, 'আপনারা কুকুর বেছে ভালোই করেছেন। আমেরিকানরা কিন্তু বাঁদরকে ট্রেনিং দিয়ে আকাশে ছাড়ছে...'

'হ্যাঁ, বাঁদরই ওদের পছন্দ।'

'আন্দাজ করতে পারছি, কী ঝামেলায় না পড়তে হচ্ছে বেচারিদের।'

'বাঁদরকে ট্রেনিং দেওয়া বেশি কঠিন,' সমর্থন করলে ইওলকিন, 'বাঁদরের রক্তের চাপ মাপতে হলে ওদের বসাতে হয় সচল দেওয়ালের খাঁচায়, নইলে ইনস্ট্রুমেন্টই ভেঙে দেবে। আপনি ঠিকই ধরেছেন যে বাঁদর ভারি রগচটা স্নায়ুনির্ভর প্রাণী। স্টিমারের জোরালো শব্দে শিম্পাঞ্জি মরে গেছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে।'

'আমাদের ডাক্তারি বিদ্যা,' উপসংহার টানল ক্যামেরাম্যান, 'অন্য মহাকাশসন্ধানীদের বেছে ভালোই করেছে। এবার কুকুরগুলোকে কাছে ডাকুন একবার।'

বাধ্যের মতো ছুটে এল কুকুরদুটো।

'এটা হল বেপরোয়া,' পরিচয় দিলে ডাক্তার, 'আর এই যে কালো কান- এটার নাম পাম।'

'পরিচয় হয়ে গেল,' ক্যামেরা তুললে কুলিক, 'এবার ধরুন এই রকম: ওরা যেন মহাকাশ- যাত্রার পর সদ্য সদ্য ফিরেছে। কী করবে ওরা? আনন্দে লাফ দেবে তো। একটু লাফাতে বলুন ওদের।'

আরও পড়ুন

'মাপ করবেন,' হাত নেড়ে বাধা দিল ডাক্তার, 'ওরা তো সার্কাসের কুকুর নয়। তাছাড়া, বেপরোয়া অবশ্য সত্যিই লাফালাফি করেছিল, কিন্তু পাম অনেকক্ষণ ধরে ধাতস্থ হতে পারেনি, কোনো কিছুর দিকেই তার মন ছিল না।'

'আমাদের দরকার ফিলিং, বুঝলেন না, ভাবাবেগ!' বেশ দৃঢ় স্বরেই বললে কুলিক, 'দুজনেই লাফাতে শুরু করুক। নইলে খুব নীরস হবে ফিল্মটা। আপনি একটু সাহায্য করুন ভাই।'

'বলছেন যখন, বেশ' নিস্পৃহ গলায় সায় দিল ডাক্তার, 'খে'কুরে, পাম আয় আমার কাছে।'

'এখানে খেকুরে আবার কে?' ব্যস্ত হয়ে উঠল কুলিক।

'ভাবনা নেই,' ওকে শান্ত করল ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ, 'এটা হল বেপরোয়ার আগেকার নাম। নতুন নামটা ওর এখনো অভ্যেস হয়নি।'

'ভূত নেমে গেছে বলে অভিনন্দন জানাই,' মন খুলেই বললাম সোফিয়া লেপকে,' বলে চলল কুলিক, 'সোফিয়া বললে, 'ধন্যবাদ, কিন্তু এখন আমি কাকাতুয়াদের ট্রেনিং দিচ্ছি। আর ওদের ঠোঁট ঠিক বাঘের থাবার মতোই বিপজ্জনক।' সত্যি সাহস আছে মেয়েটার!'

কুকুরদুটো প্রথমে বোঝেনি কী চাওয়া হচ্ছে তাদের কাছ থেকে, বোকার মতো পেছনের পায়ে দাঁড়াল ভর দিয়ে। তারপর নড়ে চড়ে লাফালাফি শুরু করলে বটে, কিন্তু সবুজ ঘাস দেখে খেকুরে যে উদ্দাম আনন্দে মেতে উঠেছিল, মোটেই সে রকম হল না। বোঝা গেল ক্যামেরাম্যান নিজেও তার ছবিতে খুব খুশি হতে পারল না। তাহলেও মিষ্টি প্রাণীদুটোর তারিফ করলে সে, আগের মতোই গাল দিলে বাঁদরকে।

পরের দিন সকালে ইওলকিনের ঘরে উজ্জল মুখে এসে হাজির হল কুলিক, চ্যাঁচালে:

'এমন রত্নটিকে আপনি লুকিয়ে রেখেছেন কী বলে! অভিনন্দন ভাই, অভিনন্দন! এ যে একেবারে চিত্রলোকের তারকা! বুঝতে পারছেন?'

'কার কথা বলছেন?' ঠিক বুঝে উঠতে পারল না ডাক্তার।

'চলুন, ভাই, উঠুন! খানিকটা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দিন। মস্ত এক প্ল্যান ফেদেছি। দর্শকদের হাততালি একেবারে অবধারিত।'

আরও পড়ুন

প্রতিবাদ করা নিষ্ফল। গাধাবোটের মতো ডাক্তারকে পেছন পেছন টেনে নিয়ে এল কুলিক। যেতে যেতে তার আবিষ্কারের বর্ণনা দিলে খুব রঙীন করে। তাহলেও কার কথা বলা হচ্ছে ডাক্তার কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না, যতক্ষণ না খাঁচার মধ্যে লম্ফমান গুবরের সামনে গিয়ে তারা থামল।

বিজয় গর্বে সে বললে, 'এই যে! ফিল্মকে ধন্য করে দেবে এটি। চেয়ে দেখুন: খাঁটি একটি চিত্রতারকা নয় কি? আপত্তি করতে পারে কেউ?'

সেই মুহূর্ত থেকে কুলিক একেবারে সমারোহে কাজ শুরু করল। ইনস্টিটিউটে সে আসত তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে। ডাক্তারদের বলত, ওর দিকে কোনো মন দেবার দরকার নেই, নিজের নিজের কাজ করে যান তাঁরা। আর আসলে নিজে সব কাজেই ব্যাঘাত ঘটাত বৈকি। ক্যামেরা নিয়ে শুয়ে দেখত মেঝেতে, নয়ত উঠে যেত একেবারে সিলিঙের কাছে, সবচেয়ে অসাধারণ একটা অ্যাঙ্গেল নেবার চেষ্টা করত, বলত এটা সরান, ওটা নিয়ে যান, সম্ভব হলে অমুক অমুক ছাড়া আর সকলে যেন এক মিনিটের মতো ল্যাবরেটরি ছেড়ে চলে যায়। ওর ওপরে রাগ করত না কেউ, মন ঢেলেই ছবি তুলত সে।

গুবরের ছবি ও তুলল সবচেয়ে বেশি, তার ন্যাকামির মধ্যেই অদ্বিতীয় এক একটা মুহূর্তের সন্ধান করত সে। ডাক্তররা বৃথাই তাকে বললে যে ওর চেয়েও বেশি গুণী ক্যান্ডিডেট আছে, ওদের মতে ছবির নায়ক হওয়া উচিত চারপেয়ে মহাকাশযাত্রীদের এই গোটা দলটা। কিন্তু অটল সংকল্প কুলিকের, মনোরম মুখ আর ব্যঞ্জনাভরা লেজওয়ালা একটি নতুন চিত্রতারকা সে বিশ্বকে উপহার দেবেই।

'প্রতিশোধ নেওয়া গেছে!' একদিন সে বললে ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচকে। ইওলকিন বললে, 'ঠিক বুঝলাম না।'

'রেনা - সেই বদখেয়ালী ধূর্ত জীবটির এবার উচিত শাস্তি হয়েছে। এবার বুঝতে পারছেন?' বলে উঠল কুলিক। তারপর ডাক্তারের মুখে বিস্ময়ের ভাব দেখে বোঝালে: 'না, না, আমার সঙ্গে এর কোনো সংস্পর্শ নেই। রাস্তায় সোফিয়া লেপের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আর কি। রেনার ট্রেনার। তার কাছ থেকেই শুনলাম, ন্যায়ের জয় সর্বদাই।'

কুলিকের কাহিনীটা এই:

সিনেমায় ছবি তোলার পর দিনের পর দিন রেনার চরিত্র নষ্ট হতে থাকে। খুব খিটখিটে হয়ে যায়, রিহার্সালের সময় ট্রেনারের কথা শুনত না, দর্শকদের সামনে ওকে দিয়ে খেলা দেখাতে হয়রান হয়ে যেত সোফিয়া। রেনার সার্কাসী জীবন একদিন শেষ হয়ে গেল কারণ অনুষ্ঠানের সময় সে ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে তিনজন খালাসী ও সার্কাসের ডিরেক্টরকে কামড়ে দেয়। কী করা যায় ওকে নিয়ে? সংশোধনের বাইরে চলে যাওয়া এই জীবটিকে দিয়ে দেওয়া হয় চলমান পশু-সার্কাসের কাছে। তারপর থেকে ভূতপূর্ব মনিব তাকে আর দেখেনি। বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে সোফিয়া লেপ শুনেছে যে বুড়ো বুড়ো সিংহ, খোঁড়া খোঁড়া হাতি আর ক্যাঁককে'কে সব কাকাতুয়ার দঙ্গলের সঙ্গে খাঁচায় করে রেনা নানান শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাঁদরটা মুখ ভ্যাঙচায়, নানান ধরনের কসরত দেখিয়ে বাচ্চাদের কাছ থেকে লজেন্স চায়। বাচ্চারা ওকে সানন্দেই লজেন্স খেতে দেয়, ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করে না যে এই ভেঙচি-কাটা বাঁদরটাই হল সেই রেনা যে একদা সিনেমার পর্দায় হেলমেট পরে গগলস্'এর মধ্যে দিয়ে তাকাত তাদের দিকে...

আরও পড়ুন

'ভূত নেমে গেছে বলে অভিনন্দন জানাই,' মন খুলেই বললাম সোফিয়া লেপকে,' বলে চলল কুলিক, 'সোফিয়া বললে, 'ধন্যবাদ, কিন্তু এখন আমি কাকাতুয়াদের ট্রেনিং দিচ্ছি। আর ওদের ঠোঁট ঠিক বাঘের থাবার মতোই বিপজ্জনক।' সত্যি সাহস আছে মেয়েটার!'

এই আলাপটার পর সোরগোলে ক্যামেরাম্যানটিকে ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ আর দেখেনি: ইনস্টিটিউটে ছবি তোলার কাজ তার হয়ে গিয়েছিল। কুকুরগুলোকে নিয়ে ইনস্টিটিউটের চিরাচরিত কাজ আবার চলতে থাকল দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ। তোড়জোড় হচ্ছিল নতুন মহাকাশযাত্রার।

কিন্তু নতুন যাত্রার দরকারটা কী? লাইকা যা আবিষ্কার করে দিয়ে গেছে সে কী কম? বেপরোয়া, পাম ও অন্যান্য কুকুর যে নিরাপদে মাটিতে ফিরে এল তাতেও হল না? ডাক্তারদের কাছে এখনো এটা যথেষ্ট নয়, যদিও মহাজাগতিক ডাক্তারি বিদ্যার বহু

পাতাই ভরে উঠেছে রেকর্ডে। এর প্রথম পাতাটা ডাক্তারেরা ভর্তি করেছিল ১৯৪৯ সালে যখন চারপেয়ে পরীক্ষাধীন প্রাণী নিয়ে আমাদের দেশে প্রথম রকেট ছাড়া হয়েছিল। মহাজাগতিক ডাক্তারি বিদ্যা তারপর বছরের পর বছর পর্যবেক্ষণ আর রেকর্ড মিলিয়ে দেখেছে, বার করেছে নতুন বিজ্ঞানটির নিয়মাদি - মহাকাশযাত্রায় নিরাপত্তার সূত্র। মানবজাতির জন্যে অত্যন্ত জরুরী এই সব নিয়মের পেছনে ছিল আমাদের পরিচিতদের ভাসিলিয়েভিচ, ভালিয়া - এদেরও মেহনত। দ্রোনভ, ভাসিলি

ডাক্তাররা এখন ভালোই জানে অদৃশ্য শত্রুর সামনে ভাইব্রেশনের কাঁপুনির সামনে, অতিভারের সামনে, নিম্ন চাপের সামনে কী আচরণ করেছে কুকুরেরা। এই প্রতিটি ব্যাপারকে আলাদা আলাদা করেই শুধু তারা খতিয়ে দেখেনি। কিনো ক্যামেরার ফিল্মে আর অটোমেটিক রেকর্ডিং'এর টেপে তারা যাত্রার পুরো ছবিটাই পেয়ে গেল শত্রু যখন পরীক্ষাধীনকে নিঃশ্বাস ফেলার সময় না দিয়ে একের পর এক এসে আক্রমণ করে। এ সিদ্ধান্ত করা যেতে পারত যে মোটের ওপর মহাকাশযাত্রা স্বাস্থ্যের প্রতিকূল নয়, আর মহাকাশযাত্রীর সবচেয়ে বড়ো শত্রু হল ভারহীনতার পরে, রকেটের ব্রেক কষার সময়কার অতিভার।

কিন্তু তখনো ডাক্তাররা জানত না মহাকাশযাত্রীর পাঁচ নম্বর শত্রু মহাজাগতিক রশ্মির বিপদ কতটা। ব্যালিস্টিক রকেটে মহাকাশযাত্রীরা এ রশ্মির যতটুকু সাক্ষাৎ পেয়েছে সেটা খুবই সংক্ষিপ্ত, কোনো লক্ষণীয় চিহ্ন তা রেখে যায়নি। লাইকা উড়েছিল দ্বিতীয় স্পুৎনিকে, মহাজাগতিক রশ্মিতে সে স্নান সেরেছে বললেই হয়, কিন্তু ডাক্তাররা তার ফলাফল কিছু জানে না, পৃথিবীতে ফিরে আসেনি লাইকা। তা জানতে হলে যাত্রার পর ল্যাবরেটরিতে মহাকাশযাত্রীকে দীর্ঘ সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। তাই এই সুদূর অদৃশ্য শত্রুটা অজ্ঞাতই থেকে গেল।

'আস্তে,' বাধা দিলে ভালিয়া, 'আমার গুণী কর্মীকে নষ্ট করবেন না। যেই আপনার গলা শুনেছে অমনি মানিকের পেছনে লেগেছে। ও বেচারী এখনো কাঁপছে।'

মাটিতে ফিরিয়ে আনা দরকার নতুন লাইকাকে। কেউ জানত না কী তার নাম, কত জন যাত্রী থাকবে স্পুৎনিকে, কবে তা ছাড়া হবে। কিন্তু প্রতিটি সাফল্যেই এগিয়ে আসছিল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার শুভক্ষণ।

ইনস্টিটিউটের জানলার ওপাশে তখন ফুটে উঠছে রসালো গন্ধভরা পাতা, উড়ে আসছে পপলারের রোঁয়া; লাইম গাছের কুড়ি ভাঙার সময় এসে গেছে, মধুগন্ধে ভরে উঠেছে বাতাস।

জুলাইয়ের এমনি এক দিনে গেট খুলে বেরল ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ তার চেন বাঁধা পোষ্যদের নিয়ে, তার পেছু পেছু ভালিয়া এল একটা খাঁচা নিয়ে, তার ভেতরে ধূসর একটা খরগোস মনমরার মতো রোমন্থন করে চলেছে।

ফের একটা বিশেষ করে নির্দিষ্ট শাদাটে বিমান উড়ল আকাশে আর তার যাত্রীদের জন্যে মাঠের মধ্যে অপেক্ষা করে রইল সুঠাম ছাঁদের এক রুপোলী রকেট।

সেই একই রকম উ'চুতে উঠল বেপরোয়া, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থবার, আরো সফলভাবেই নিষ্পন্ন হল যাত্রা: ব্রেক কষার ব্যবস্থাটা এবার আরো সাবলীল। ডাক্তাররা বললে যাত্রীদের ত্রাণের ব্যবস্থায় দেখা যাচ্ছে ভরসা করা চলে।

অভিজ্ঞ মহাকাশযাত্রীর মতো ব্যবহার করলে বেপরোয়া। ইঞ্জিন গর্জন করে উঠতেই ওর মনে পড়ে যেত অদৃশ্য চাপের কথা, তাই আগে থেকেই সে তার লম্বাটে মুখখানা নামিয়ে আনত থাবার ওপর, সবচেয়ে সুবিধাজনক ভঙ্গিতেই শুয়ে থাকত। ওপরে উঠে আগের মতোই খেলত রোদ্দুরের ছোপটার সঙ্গে, গবাক্ষ দিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখত উজ্জ্বল সূর্যের দিকে; খানিক পরে আবিষ্কার করত যে অদৃশ্য বকসারটার ঘুসি কিছু নরম হয়ে এসেছে, তারপর মাটিতে নেমে আনন্দের নাচ নাচত, লজেন্স আর হালুয়া খেত, ফোটো তুলত আর জিব দেখাত ফোটোগ্রাফারকে।

রকেটে করে গিয়েছিল আরো দুটি কুকুর - তুষারিকা আর মানিক, আর শান্ত একটি খরগোস মারফুশকা। কুকুরদুটো অনেক অনভিজ্ঞ। এদের মধ্যে কেউ যখন নার্ভাস হয়ে পড়ত বা খিটিমিটি করত, তখন শৃঙ্খলা বজায় রাখত বেপরোয়া, গোঁ গোঁ করে আস্তে করে কান টেনে সমঝে দিত অন্য কুকুরদের। তারাও কথা শুনত তার।

'এত বুদ্ধি ওর হল কোথা থেকে?' ভালিয়াকে বলেছিল ইওলকিন, 'মানে মারফুশকা এটা একটা নির্বিকার প্রাণী: সব সময় কেবল মুখ নেড়ে চিবোয়। এটির কান মলে দিলেও কোনো নালিশ শুনবেন না। কিন্তু ছোট্টো একটা কুকুরের মধ্যে এমন সাহস দেখে অবাক লাগে। তাছাড়া আর একটা জিনিস দেখেছেন, ভালিয়া, আমাদের খেকুরে এখন শুধু এক চমৎকার মহাকাশযাত্রীই নয়, খাঁটি দলপতি! প্রতিভা আছে বটে!'

'আস্তে,' বাধা দিলে ভালিয়া, 'আমার গুণী কর্মীকে নষ্ট করবেন না। যেই আপনার গলা শুনেছে অমনি মানিকের পেছনে লেগেছে। ও বেচারী এখনো কাঁপছে।'

ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ কিন্তু আরো বেশি করেই গলা চড়াল:

'হায়রে কুলিক, আসল নায়িকাকেই তুই পায়ে ঠেললি!..'

ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ কিন্তু জানত না যে সেই সকালেই মস্কোর সিনেমা হলগুলোতে ক্যামেরাম্যান কুলিকের নতুন ফিল্মের প্রদর্শন শুরু হয়েছিল আর পর্দা থেকে দর্শকদের দিকে তাকিয়েছিল গুবরের বিস্ময়কর মুখচ্ছবি। বৈজ্ঞানিক ইনস্টিটিউটে ফোন করলে কে একজন বিদেশী:

'আপনাদের ওখানে গুবরে নামে কেউ আছে? খবরের কাগজের জন্যে তার ফোটো নিতে চাই।' 'সানন্দে, আসুন না,' টেলিফোনে জবাব দিয়ে মনে মনে হাসলেন প্রফেসর, 'গুবরেকে চিত্রতারকাদের দলেই ছেড়ে দিতে হবে।'

আরও পড়ুন