দৃষ্টি

চারদিকে বেশ হুল্লোড়। একদল মানুষ আছে, যাদের হুল্লোড় পছন্দ। চারপাশ মাতিয়ে রাখতে পছন্দ করে; বন্ধুদের নিয়ে হইচই করতে ভালোবাসে। এ রকম মানুষদের জন্য সুন্দরপুরের বার্ষিক এই মেলা একদম আদর্শ জায়গা। আবার যারা একটু নির্জনতা পছন্দ করে, নীরবে-নিভৃতে বসে ভাবালু চোখে আকাশের পানে তাকিয়ে থাকতে চায়, তাদের একদমই ধাতে সইবে না। অর্ক প্রথম দলের বিধায় তার কাছে দারুণ লাগছে। বাবার সরকারি চাকরির কল্যাণে এই এগারো বছর বয়সেই দেশের চৌষট্টি জেলার আটটায় থাকা হয়েছে। পরিবারের বাকি সদস্য—মা, আপু আর বাবার সঙ্গে সরকারি কোয়ার্টারেই থেকেছে সারা জীবন। তবে সুন্দরপুরের কোয়ার্টারটার মতো সুন্দর আর কোনোটাই ছিল না। ছিমছাম দোতলা একটা বাড়ি। নিচতলায় ড্রয়িং-ডাইনিং আর রান্নাঘর। ওপরতলায় ছবির মতো তিনটি শোবার ঘর। এই মুহূর্তে নিজের ঘরের বারান্দায় বসে বাইরের মাঠটার দিকে তাকিয়ে আছে অর্ক। সব শোরগোলের উৎস ওই মাঠই। সুন্দরপুর পাইলট হাইস্কুলের মাঠ। এখানে আসার পর থেকেই স্কুলে সহপাঠীদের মুখে মেলার কথা শুনেছে। সত্যি বলতে, তখন সে রকম বিশেষ কিছু মনে হয়নি। এ রকম একটা মফস্বলের মেলা আর কেমনই–বা হবে, এমনটাই ভেবেছে।

কিন্তু এখন স্বীকার করতেই হবে। বি-শা-ল আয়োজন। সুন্দরপুরের বিকেলটাও বেশ সুন্দর। ওদের বাড়ির সামনের বাগানে বিভিন্ন ধরনের গাছগাছালি। হেমন্তের মখমলি রোদে চারপাশ বেশ প্রাণবন্ত। উঠানের পাশে চিলতেমতো জায়গায় খেলা করছে অল্প বয়সী দুটো ছেলে–মেয়ে। ওদের চেনে অর্ক। বাগানের মালি আশরাফ চাচার সন্তান। টুনটুনি আর বল্টু। ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে। ছেলে-মেয়েকে সব সময় তাই চোখে চোখে রাখেন আশরাফ চাচা। অন্য সময় হলে অর্ক ওদের সঙ্গে গিয়ে খেলত বা পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখত। কিন্তু আজ ছেলে-মেয়ে দুটোর কী যেন হয়েছে। দেখেও না দেখার ভান করছে অর্ককে। কাউকে কোনো কাজে একবারের বেশি দুবার অনুরোধ করতে বাধে অর্কের। তাই কথা না বাড়িয়ে চলে এসেছে ওপরতলায়। আজ সবাই যেন একটু বেশি বেশিই করছে। ওদের বিড়াল কুট্টুসের কথাই ধরা যাক না কেন! বাইরের ছাউনির চালে গম্ভীরভাবে বসে আছে সে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তাকেও দু–একবার কাছে ডেকেছিল অর্ক, কিন্তু জবাবে স্বভাববিরুদ্ধভাবে হিসিয়ে উঠেছে বিড়ালটা।

এমন সময় উঠোনের ঈশান কোণে একটা অবয়ব দেখতে পেল ও। সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট মুখটা কালো হয়ে গেল। বল্টু আর টুনটুনির মা আসমানি চাচি। ও হ্যাঁ, একটা কথা আগে বলা হয়নি। অর্ক মৃত মানুষদের দেখতে পায়। যাকে বলে ভূত বা আত্মা। যখন কেউ বলে ভূত-টুত বলে কিছু নেই, মুচকি হাসে অর্ক। তবে সব মানুষই যে মরলে ভূত হয়ে যায়, এমনটা নয়। বরং খুব কম মানুষই ভূত হয়ে ঘোরাফেরা করে মৃত্যুর পর। ওর পরিচিত যারা মারা গেছে, তাদের পরবর্তীকালে কখনো দেখেনি ও। কোথায় যেন পড়েছিল, অপঘাতে যাদের মৃত্যু হয়, একমাত্র তাদের আত্মাই ঘুরপাক খায় প্রিয়জনদের আশপাশে। আসমানি চাচির মৃত্যু ঠিক কীভাবে হয়েছিল, তা অবশ্য বলতে পারবে না অর্ক। কিন্তু এর আগেও বল্টু-টুনটুনির আশপাশে তাকে দেখেছে সে।

বেশ লম্বা একটা সময় অর্ক পার্থক্য করতে পারত না, সে যাকে দেখছে, সে আসলে ভূত নাকি রক্ত–মাংসের মানুষ। তবে একটা পর্যায়ে গিয়ে আর সমস্যা হয়নি। মানে, ভূতেদের ঠিক খাটো করে দেখে না ও। কিন্তু তাদের ঘটে বুদ্ধিসুদ্ধি একটু কমই বটে। কেউ তাদের শুনতে পায় না, তবু কথা বলেই যায়। অর্ক যখন ছোট ছিল, তখন আশপাশের সবাই ভাবত, একা একা কথা বলার বদভ্যাস আছে ওর।

এক সন্ধ্যাবেলায় ওর নিজের সমান একটা বাচ্চা ভূতের সঙ্গে ওকে কথা বলতে দেখে ফেলে বাবা। এরপর কয়েক দিন ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি। তখনই ভুলটা ভাঙে অর্কের। সে বাদে আর কেউ দেখে না তাদের। ভূতেরা আদতে বুঝতে পারে না যে তারা ভূত। সিনেমা বা গল্পে ভূতেদের যে রকম বর্ণনা দেওয়া হয়, তার সঙ্গেও বাস্তবে কোনো মিল নেই। চেহারায় সার্বক্ষণিক বিরাজ করে ভীষণ রকম বিহ্বলতা। যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারে না যে কী হচ্ছে তাদের সঙ্গে।

এখন অর্কের সয়ে গেছে। ভূতেদের নিয়ে কখনো সে রকম কোনো ভয়ও কাজ করেনি ওর মধ্যে। স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছে তাদের অস্তিত্ব। তবে ভয় একবার পেয়েছিল। সেবার নাটোরের এক উপজেলায় পোস্টিং হয়েছিল ওর বাবার। ফলে তল্পিতল্পাসহ ওদেরও কিছুদিনের মধ্যে চলে যেতে হয় ওখানে। নতুন জায়গায় গেলে সচরাচর যা হয়। কিছুদিন চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকার পর একা একাই আশপাশে ঘুরতে বের হতো অর্ক। বাড়ির পেছন দিকেই বিশাল একটা মাঠ। সেই মাঠের কাছ ঘেঁষে বিরাট বড় বাঁশঝাড়। ঝাড়টা যেখানে, সেখানে একসময় দাঁড়িয়ে ছিল পেল্লায় এক জমিদারবাড়ি। কিন্তু সেই বাড়ির মালিকানা নিয়ে অনবরত মামলা–মোকদ্দমা হওয়ায় সম্পত্তিটা কখনোই কারও হয়ে ওঠেনি। কেউ বাঁশ কাটত না, তাই ভেতরটা কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার। অর্কের সাহস বরাবরই বেশি। সাতপাঁচ না ভেবে বাঁশঝাড়টার ভেতর পা রাখে সে। মাটিতে বাঁশগাছের পাতা পড়ে বেশ নরম নরম হয়ে ছিল। সেখানেই পা পিছলে পপাত ধরণিতল। ঠিক তখনই কেমন যেন একটা অনুভূতি জেঁকে বসে ওর মনে। কেবলই মনে হচ্ছিল কেউ যেন দেখছে আড়াল থেকে। কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়েই দৌড়। কিছুক্ষণ পর হঠাৎই একটা পুকুরের সামনে আবিষ্কার করে নিজেকে। পুকুরটার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল বিশাল এক বটগাছ। এ রকম গাছ আগে কখনো দেখেনি অর্ক। তবে বটগাছটাকে দেখে যতটা না অবাক হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি অবাক হয় গাছতলায় ঘাসজমিতে একটা ছেলেকে শুয়ে থাকতে দেখে। ভাঁজ করা হাতের ওপর মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ছিল ছেলেটা। যেন অর্কের পায়ের শব্দ শুনেই ঘুম ভেঙে যায় ছেলেটার। চমকে উঠে দাঁড়িয়ে সে-ও দৌড় দেয়, ঠিক যেমনটা কিছুক্ষণ আগেই দৌড় দিয়েছিল অর্ক। চিৎকার করে তাকে থামতে বলে ও। কিন্তু শোনে না ছেলেটা। ওর চোখের সামনে পুকুরে পড়ে তলিয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে।

উপায়ান্তর না দেখে পুকুরে লাফিয়ে পড়ে অর্ক। ঠিক তখন প্রথমবারের মতো মনে হয় যে ছেলেটা আদতে জীবিত কি না, সেটা ও জানে না। বড় একটা শ্বাস নিয়ে পুকুরে মাথা ডোবাতেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড় হয়। টলটলে পরিষ্কার পানির তলদেশ থেকে ১৫–২০ জনের মতো ছেলে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। অর্কের মনে হয়, কেউ বুঝি ওর হৃৎপিণ্ডটা শক্ত করে চেপে ধরেছে। এরপর কী করে পুকুর থেকে উঠে বাসায় ফিরেছিল, তা এখনো বলতে পারবে না। আর কখনো ওমুখো হয়নি।

ঘটনাটা মনে পড়তেই আরও একবার শিউরে উঠল অর্ক। মাথা নেড়ে সেই ভয়ংকর দৃশ্য ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করল দূরে। সামনের মাঠের মেলার হুল্লোড় আর ওর মনটা ভালো করে দিতে পারছে না। আসলে মনখারাপের শুরুটা গতকাল থেকে। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরছিল ও। রাকিবদের আমবাগানের ভেতর দিয়ে শর্টকাটটা আবিষ্কার করেছে কিছুদিন আগেই। বাগানের এক পাশে অনেক দিনের পুরোনো একটা কুয়া। ওদিকটা সচরাচর সবাই এড়িয়ে চলে। তাই রাকিবকে কুয়ার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে যায়। ভেবেছিল বন্ধুকে একটু চমকে দেবে। পেছন থেকে গিয়ে খোঁচা দিতেই আঁতকে ওঠে রাকিব। চেঁচিয়ে ওঠে তারস্বরে। এদিকে পেটে হাত দিয়ে হাসতে শুরু করে অর্ক। ততক্ষণে ভয় কেটে গিয়ে রাকিবের চেহারায় জায়গা করে নিয়েছে ক্রোধ। প্রবল আক্রোশে অর্ককে জোরে ধাক্কা দেয় ছেলেটা। টাল সামলাতে পারে না অর্ক। পা আটকে যায় কুয়ার পাশে নিচু দেয়ালটায়। এরপর আর সে রকম কিছু মনে নেই ওর।

নিচতলায় ওর মা–বাবা অনেকক্ষণ ধরেই কাঁদছে। অর্ক অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করে তাদের সঙ্গে, কিন্তু কেউ ওর কথা শোনে না। গত রাতে নিশ্চয়ই কোনোভাবে মারা গেছে তারা। নতুন ভূতেরা সাধারণত অর্কের সঙ্গে কথা বলতে সময় নেয়। ওদের বাড়ির সামনে যারা ভিড় করে আছে, তারাও নিশ্চয়ই মারা গেছে। ওর স্কুলের টিচার, সহপাঠী, তাদের মা-বাবারা। কিন্তু কেউই অর্কের সঙ্গে কথা বলে না। একসঙ্গে এত ভূত এক জায়গায় আগে কখনো দেখেনি ও।

দোতলার বারান্দায় বসে থাকা অর্কর চোখের কোণে পানি জমে। কেউ কেন কথা বলছে না ওর সঙ্গে?

(বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে)