‘দেখে এগোন!’ চেঁচিয়ে সাবধান করলেন আমার কনডাক্টর, ‘সিঁড়ি আছে সামনে!’
পায়ে–পায়ে নেমে এলাম সুবিশাল বেজমেন্টে। ইলেকট্রিক রিফ্লেক্টরের চোখধাঁধানো আলোয় আলোকিত এখানটা। আওয়াজ বলতে কেবল আমাদের পায়ের শব্দ।
কোথায় এসেছি আমরা? কেনই–বা এসেছি? কে এই রহস্যময় পথপ্রদর্শক? উত্তর অজানা।
রাত্রিকালীন লম্বা এক সফরের পর, একের পর এক লোহার ফটক পেরিয়েছি আমরা; ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো আবার লেগে গেছে ঘটাং করে; অগুনতি সিঁড়ির ধাপ যেন নেমে গেছে পৃথিবীর গহিন অভ্যন্তরে—অন্তত এমনটিই মনে হচ্ছে আমার। যাহোক, ওসব চিন্তাভাবনার সময় এটা নয়।
‘নিশ্চয়ই ভাবছেন, কী আমার পরিচয়?’ আবার মুখ খুললেন গাইড, ‘কর্নেল পিয়ার্স নাম এই অধমের। আর, আছেন কোথায়? আমেরিকায়। বোস্টনের এক স্টেশনে।’
‘স্টেশন?’
‘হ্যাঁ, স্যার। বোস্টন টু লিভারপুল নিউম্যাটিক টিউব কোম্পানির সূচনাবিন্দু এটি।’
বোঝানোর ভঙ্গিতে সুদীর্ঘ এক জোড়া লোহার সিলিন্ডার দেখালেন আমাকে কর্নেল। দেড় মিটারের মতো ব্যাসওয়ালা সিলিন্ডার দুটি মাটিতে স্থাপন করা কয়েক কদম দূরে।
ভালো করে দেখলাম ওগুলো। ও-দুটির ডান প্রান্ত দেয়ালের সঙ্গে গাঁথা আর বাঁ দিকের প্রান্ত ভারী, ধাতব ঢাকনা দ্বারা আটকানো। সেখান থেকে একগুচ্ছ নল চলে গেছে ছাদের দিকে।
এক লহমায় বুঝে ফেললাম, কাজ কী এসবের।
কয়েক ঘণ্টা আগেই না আমেরিকান এক পত্রিকায় পড়লাম এই অসাধারণ প্রজেক্ট সম্পর্কে, অতিকায় দুই সাবমেরিন টিউবের মাধ্যমে যা কিনা ইউরোপের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে নতুন পৃথিবীর? আপাত অসম্ভব এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি তুলেছেন জনৈক বিজ্ঞানী আর সেই উদ্ভাবক, কর্নেল পিয়ার্স, এখন আমারই পাশে দাঁড়িয়ে!
খবরের কাগজের লেখাগুলো ভেসে উঠল মনের পর্দায়।
খুব সুন্দর করে উদ্যোগটির খুঁটিনাটি নিয়ে লিখেছেন রিপোর্টার। ৩০০০ মাইল লম্বা লোহার টিউব নাকি প্রয়োজন এই প্রকল্পে, যার ওজন হবে সব মিলিয়ে ১৩০০০০০০ টনের বেশি। এগুলো বহন করার জন্য জাহাজও লাগবে ২০০টির মতো, একেকটি জাহাজ প্রায় ২০০০ টনের। কম করেও ৩৩ বার করে সমুদ্রযাত্রা করতে হবে জাহাজগুলোকে। বিশেষ দুটি জলযানের কাছে ইস্পাতের যন্ত্রাংশগুলো পৌঁছে দেবে নৌবহর, যেখানে টিউবগুলোজুড়ে দেওয়া হবে একে অপরের সঙ্গে। এরপর লবণপানির ছোঁয়া থেকে বাঁচাতে সেগুলো আবার মুড়ে দেওয়া হবে রজনমাখা তিন পরত লোহার জালি দিয়ে।
এই উদ্ভাবন কতখানি কার্যকর হবে, সেই প্রশ্নে প্রতিবেদক লিখেছেন: অন্তহীন দৈর্ঘ্যের ব্লোপাইপে রূপ দেওয়া হচ্ছে টিউবগুলোকে, শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে যার ভেতর দিয়ে একখান থেকে আরেকখানে যাবে যাত্রীবোঝাই ক্যারিজ। নতুন ও সাহসী এই আবিষ্কারের সম্ভাবনা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন তিনি। জানিয়েছেন, যাত্রাকালে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই যাত্রীদের। ইস্পাতের টিউবগুলোর ভেতরের পৃষ্ঠ মসৃণভাবে পলিশ করা। তাপমাত্রার সমতা রক্ষা হবে বায়ুপ্রবাহের সাহায্যে। মৌসুমভেদে নিয়ন্ত্রণ করা হবে এই তাপমাত্রা। ভাড়াও হবে অবিশ্বাস্য রকমের কম। তদুপরি দুর্ঘটনার আশঙ্কা নেই বললেই চলে।
সব মনে পড়ে গেছে আমার।
এখন তো দেখা যাচ্ছে, সত্যিই বাস্তবে রূপ নিয়েছে কল্পনা; লোহার এই সিলিন্ডার দুটি আটলান্টিকের নিচ দিয়ে পৌঁছে গেছে সুদূর ইংল্যান্ডের উপকূলে!
কিন্তু চোখের সামনে প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কেন যেন। টিউবগুলো যে মিথ্যে নয়, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে ওগুলোর ভেতর দিয়ে যে মানুষ যেতে পারবে, সেটিই অবিশ্বাস্য!
‘এদ্দূর অবধি বাতাস চালনা কি সম্ভব আদৌ?’ সন্দেহ প্রকাশ করি গলা চড়িয়ে।
‘সহজই বরং,’ জবাব দিতে দেরি হলো না কর্নেলের, ‘প্রচুর পরিমাণে বাষ্পীয় ফ্যান লাগবে এর জন্য...ওই যে ব্লাস্ট ফার্নেসে ব্যবহার করা হয় যেগুলো। অমিত শক্তির বাতাস পাওয়া যাবে এসব ফ্যান থেকে, ঘণ্টায় যার গতি হবে ১৮০০ কিলোমিটার। অর্থাৎ প্রায় কামানের গোলার সমান। অতএব, ক্যারিজবোঝাই যাত্রী নিয়ে ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিটে বোস্টন-লিভারপুল যাওয়া-আসায় কোনো সমস্যাই হওয়ার কথা নয়।’
‘ঘণ্টায় ১৮০০ কিলোমিটার?’ শুনেই চোয়াল ঝুলে পড়েছে আমার।
‘একবিন্দু বাড়িয়ে বলছি না। লিভারপুলের সময় তো আমাদের থেকে ৪ ঘণ্টা ৪০ মিনিট এগিয়ে। সাধারণ ট্রেনে সকাল ৯টায় যাত্রা করলে বেলা ৩টা ৫৩-তে বোস্টন থেকে ইংল্যান্ড পৌঁছাচ্ছেন আপনি। মানে যদি লেট-টেট না করেন আরকি। আর এই নতুন ট্রেনগুলোতে...ধরুন, লিভারপুল থেকে দুপুর ১২টার ট্রেনে উঠল কেউ, এখানে সে এসে পৌঁছাবে সকাল ১০টা নাগাদ! মানে যাত্রাকালীন সময়ের আগেই...হা হা হা!’
কী বলব, ভেবে পেলাম না। পাগলের সঙ্গে আলাপ করছি না তো? নাকি মেনেই নিতে হবে ভদ্রলোকের অস্বাভাবিক দাবিগুলো?
‘দারুণ ব্যাপার, বলতেই হবে!’ স্বীকার করি আমি, ‘কিন্তু এই গতিতে চললে, যখন থামতে হবে আপনাকে, তখন তো ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে সবকিছু!’
‘মোটেই না।’ কাঁধ ঝাঁকালেন কর্নেল, ‘টিউব দুটির মধ্যে একটি হচ্ছে যাওয়ার এবং আরেকটি ফেরার জন্য। বিপরীতমুখী বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে দুটিতে। ট্রেন থামানোর প্রয়োজন হলে স্রেফ একটি হাতল ঘুরিয়েই সমান্তরাল অন্য টিউবটি থেকে উল্টোমুখী বাতাস টেনে নিতে পারব পাশের টিউবে। সেই হাওয়ার চাপে আস্তে আস্তে কমে আসবে ট্রেনের গতি। কিন্তু এতসব ব্যাখ্যার প্রয়োজন কী, যখন ট্রায়ালই দিতে পারছি আমরা?’
জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই এক টিউবের পাশ থেকে বেরিয়ে থাকা পিতলের চকচকে নবটি ধরে হ্যাঁচকা টান দিলেন বৈজ্ঞানিক। মসৃণভাবে একটি প্যানেল সরে গেল ওটার খাঁজের মধ্যে।
সারি সারি আসন দেখতে পেলাম খোলা মুখটি দিয়ে। প্রতিটি সারিতে আরাম করে দুজন বসতে পারবে পাশাপাশি।
‘আসুন আমার সঙ্গে!’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন বিজ্ঞানী।
বিনা আপত্তিতে অনুসরণ করলাম তাঁকে।
ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আবার লেগে গেল প্যানেলটি।
ছাদে লাগানো বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম সবকিছু।
সমান্তরাল ২৫টি সারিতে জোড়ায় জোড়ায় আরামকেদারা রয়েছে। ক্যারিজের দুই মাথায়ই ভালভ আছে বায়ুমণ্ডলীয় চাপ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। দূরেরটি দিয়ে শ্বাসযোগ্য বাতাস ঢোকে ভেতরে আর কাছেরটি স্বাভাবিক চাপের চাইতে অতিরিক্ত বাতাস বের করে দেয় বাইরে।
অধৈর্য হয়ে উঠলাম দেখেটেখে, ‘যাত্রা শুরু হোক তবে!’
‘যাত্রা শুরু হবে!’ চোখ কপালে তুললেন কর্নেল, ‘যাত্রা তো শুরু হয়ে গেছে!’
শুরু হয়ে গেছে! কোনো ধরনের ঝাঁকুনি ছাড়াই? কান পাতলাম বাতাসে। চাপা একটি গুঞ্জন ছাড়া আর কোনো আওয়াজ আসছে না কানে। সীমাহীন বিস্ময়ে অস্বীকার করতে ইচ্ছা করল বাস্তবতাকে।
ঘণ্টায় ১৮০০ কিলোমিটারের ব্যাপারে যদি বাগাড়ম্বর না করে থাকেন কর্নেল, এতক্ষণে তাহলে স্টেশন থেকে বহুদূরে, সাগরের তলায় চলে এসেছি আমরা! বিরাট-বিশাল সব ফেনায়িত তরঙ্গ ভাঙছে হয়তো আমাদের মাথার ওপর। কে জানে, এ মুহূর্তে অজানা কোনো দানবীয় সি-সার্পেন্ট কিংবা অতিকায় তিমি পাশ কাটাচ্ছে কি না এই লৌহকারার!
চুপচাপ বসে রইলাম বিমূঢ়ের মতো।
ঘণ্টাখানেক পর ঠান্ডা এক অনুভূতি সক্রিয় করে তুলল আমাকে।
ভ্রু স্পর্শ করতেই ভেজা ঠেকল আঙুলে।
ভেজা কেন?! পানির ভয়ানক চাপে কি ফেটে গেছে টিউব? মহাসাগর কি ভেঙে পড়তে চলেছে আমাদের ওপর?
ভয়ে আঁকড়ে এল শরীরটা। আতঙ্কিত চিৎকার ছাড়তে যাচ্ছি, নিজেকে আবিষ্কার করলাম বাগানের মধ্যে। বৃষ্টি পড়ছে গায়ে। বড় বড় ফোঁটার আঘাতেই ঘুমটা ভেঙে গেছে আমার।
জনৈক কর্নেল পিয়ার্সের বিস্ময়কর প্রজেক্টের ওপর মার্কিন রিপোর্টারের লেখা আর্টিকেলটি পড়তে পড়তে কখন যে ঘুম নেমে এসেছে চোখে, নিজেও বলতে পারব না।