ফুয়াদরা সাততলা একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। মানে ওর বাবা–চাচা–ফুফুরা সবাই মিলে থাকে ওই অ্যাপার্টমেন্টে। ফুয়াদের দাদুর খুব শখ ছিল তার ছেলেমেয়েরা সব একসঙ্গে থাকবে, তা–ই ঘটেছে। সবাই একসঙ্গেই আছে, কিন্তু ফুয়াদের দাদু সেটা দেখে যেতে পারেনি। ফুয়াদের রিটায়ার্ড বড় চাচা থাকে দোতলায়, মেজ চাচা থাকে তিনতলায়, ছোট ফুফু থাকে চারতলায়...ফুয়াদরা পাঁচতলায়, ছয় আর সাততলায় অন্য দুই ফুফু।
বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন সবাই মিলে আবিষ্কার করল, ফুয়াদের ছোট ফুফুর বাসার উত্তরমুখী বাথরুমের বাইরের সুয়ারেজ পাইপের ফাঁক দিয়ে বিশাল এক বটগাছ গজিয়ে উঠেছে। ছোট ফুফুর ধারণা, এই বটগাছ তার বাসায় নির্ঘাত ফাটল ধরাবে। তারপর তার ফ্ল্যাট বরবাদ হয়ে যাবে। এ নিয়ে মিটিং বসেছে ফুয়াদদের বাসায়। ছোট ফুফু কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল—
‘তোমরা কেউ গাছটা কাটার ব্যবস্থা করছ না। আমার ফ্ল্যাটটা তো নষ্ট হতে বসেছে। সেদিন বাজে স্বপ্ন দেখলাম...’
‘কী দেখলে ফুফু?’ বড় ফুফুর বড় মেয়ে জানতে চাইল। সে আবার লেখালেখি করে। সে নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনো গল্পের গন্ধ খুঁজে পেয়েছে।
‘দেখলাম যেন ওই গাছের শিকড়টা ঘরের ভেতর অজগর সাপের মতো এসে আমার গলা চেপে ধরেছে। আমি শ্বাস নিতে পারছি না।’
‘তারপর?’
‘তারপর আরকি, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল।’
‘নিশ্চয়ই তখন দেখলে বালিশটা তোমার মুখের ওপর পড়েছিল, শ্বাস নিতে পারছিলে না? এ রকম স্বপ্ন আমিও দেখি...’ সবজান্তার মতো বলল বড় চাচার ছোট ছেলে অনীক।
‘আহ, তোরা চুপ কর।’ মোটামুটি একটা ছোটখাটো হুংকার দিলেন বড় চাচা। তারপর ঘুরে বসলেন ফুয়াদের বাবার দিকে। ‘মতিন, তুই গাছটা কাটার ব্যবস্থা কর। গাছটা যত বড় হয়েছে, এটা বিল্ডিংয়ের ক্ষতি করতে পারে, বাসার ইনফ্রাস্ট্রাকচারে সমস্যা করতে পারে।’
‘কাটা তো দরকার আমিও বুঝতে পারছি। কিন্তু ওই জায়গায় গিয়ে কাটবেটা কে? প্রফেশনাল লোক লাগবে। দড়ি দিয়ে বেঁধে কাউকে নিচে নামাতে হবে। আর যদি পিছলে পড়ে, তাহলে নির্ঘাত মার্ডার কেসে পড়তে হবে, নিচে সলিড কংক্রিট।’
‘সত্যিই কাজটা বিপজ্জনক।’ পাশ থেকে সাপোর্ট দিল কেউ একজন।
‘কাটার দরকার কী? থাকুক না।’ কথাটা বলল বড় ফুফুর ছোট মেয়ে নীপা। সে আবার সিরিয়াস পরিবেশবাদী। ‘জানো তো, একটা গাছ কাটলে ওই জায়গায় আরও চারটা গাছ লাগাতে হয়। ওই গাছ কেটে আবার ওখানে চারটা গাছ লাগানো চাট্টিখানি কথা?’
‘উফ... আমি উঠলাম। তোদের এই সব উদ্ভট আলোচনায় আমি নাই। আমার কাজ আছে।’ গটগট করে বের হয়ে গেলেন মেজ চাচা। এতে অবশ্য কেউ কিছু মনে করল না। মেজ চাচা এমনই। যেকোনো অনুষ্ঠানেই তিনি এ কাজ করেন। তাঁর ছেলের গায়েহলুদের দিন হঠাৎ মাঝখানে উঠে বললেন, ‘উফ...আমি উঠলাম। তোদের এই সব উদ্ভট কাণ্ডকারখানায় আমি নেই।’ তার কাছে সবকিছুই উদ্ভট। তিনি নিজেও যে উদ্ভট, সেটা কিন্তু তিনি জানেন না।
এর মধ্যে ছোট চাচা একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন। তিনি অবশ্য পারিবারিক যেকোনো আলোচনায় কথা কম বলেন। তারপরও যখন যা বলেন, তা সবাইকে ভাবনায় ফেলে। যেমন তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন—
‘তোমরা মলির (ছোট ফুফু) বাসার বটগাছ নিয়ে তুলকালাম করছ, এদিকে যে দুদিন পরপর বাসার ছাদ থেকে কাপড়চোপড় চুরি হচ্ছে, সে খেয়াল আছে কারও? আমার দু–দুটো নতুন লুঙ্গি হাওয়া হয়ে গেল ছাদ থেকে।’
‘আমার মনে হয় চুরি হয়নি। হাওয়ায় উড়ে গেছে তোর লুঙ্গি। মাঝে মাঝে ছাদে যে বাতাস ওঠে।’ পান চিবাতে চিবাতে বলল মেজ ফুফু।
‘না, না, ছটকু ঠিকই বলেছে, আমার একটা পেটিকোট আর ওর বাবার পাঞ্জাবি পাওয়া যাচ্ছে না, ছাদে শুকাতে দিয়েছিলাম।’ বড় ফুফুর মন্তব্য।
‘তার মানে তোরা বলতে চাচ্ছিস ছাদে চোর উঠে কাপড়চোপড় চুরি করছে? কিন্তু সাততলার ছাদে উঠছে কীভাবে চোর?’ বড় চাচাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে।
‘কেন, ওই সুয়ারেজের পাইপ বেয়ে। ওই বটগাছের পাশ দিয়ে নিশ্চয়ই ওঠে। বেটা নিশ্চয়ই ওই গাছের ডাল ধরে কিছুক্ষণ জিরিয়েও নেয়।’
‘তাহলে একটা কাজ করলে কেমন হয়?’ এবার ফুয়াদ বলল। আইডিয়াটা তার মাথায় হঠাৎই এসেছে।
‘কাজ?’ সবাই তাকাল ফুয়াদের দিকে। পারিবারিক আলোচনায় ছোটদের অংশগ্রহণও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
‘আমরা একটা কাগজে ছোট্ট একটা নোটিশ লিখে ওই গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখব, যেখানে লেখা থাকবে—‘ভাই চোর, আপনি পাইপ বেয়ে ছাদে ওঠার সময় গাছটা কেটে দিন দয়া করে।’ একমুহূর্তের জন্য পিনপতন নিস্তব্ধ হলো যেন ফুয়াদদের ড্রয়িংরুম। তারপর সবাই একসঙ্গে হো হো করে হেসে উঠল।
তবে সেদিনকার মতো আলোচনা স্থগিত হলো। ফুয়াদের আম্মু দারুণ পেঁয়াজু বানান। সবাই পেঁয়াজু–চা খেয়ে বিদেয় হলো। তবে বড় ফুফুর ছোট মেয়ে মিলা রয়ে গেল। সে আবার খাওয়াদাওয়ায় খুবই ঢিলা। একটা পেঁয়াজু খেয়ে শেষ করতে তার ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। সে ফিসফিস করে বলল, ‘ফুয়াদ ভাইয়া, তোমার আইডিয়াটা দারুণ।’
—কিন্তু সবাই তো হেসেই উড়িয়ে দিল।
—না, না, আমার মনে হয় এতে কাজ হবে। কিন্তু একটা সমস্যা আছে, চোরটা যদি বাংলা পড়তে না পারে?
—সে ক্ষেত্রে আমরা বাংলা–ইংরেজি দুটোই রাখব। নোটিশের এক পাশে বাংলা, আরেক পাশে ইংরেজি। ইংরেজিটা নিপাপুকে দিয়ে লিখিয়ে নেব।
—উফ! ফুয়াদ ভাইয়া, তুমি না আসলে একটা গাধা।
—কী! আমাকে গাধা বললি?
—তো গাধার মতো কথা বললে তাকে কী বলব? ঘোড়া?
তবে না, শেষ পর্যন্ত ঝগড়া ভুলে তারা দুই ভাই–বোন মিলে গেল। একটা নোটিশ লিখল ওরা। তাতে লেখা হলো, ‘প্রিয় ভাই চোর, আপনি দয়া করে কাপড় চুরি করার জন্য যখন ছাদে উঠবেন, তখন পাঁচতলার পাইপের পাশে যে বটগাছটি গজাইয়া উঠিয়াছে, সেটি একটু কাটিয়া দিবেন। তাহলে আমাদের অনেক উপকার হয়। ইতি এই বাসার ভুক্তভোগী অধিবাসীগণ।’
নোটিশ তো লেখা হলো। কিন্তু এখন এই নোটিশ ওই গাছে লাগানো হবে কীভাবে? বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে? মিলাই এবার বুদ্ধি বের করল। তার চুলের ক্লিপের সঙ্গে নোটিশটা লাগিয়ে সুতা দিয়ে ঝুলিয়ে সত্যি সত্যি কীভাবে যেন ঠিক ওই গাছের একটা ডালে আটকে দিল। অনেকটা বড়শি দিয়ে মাছ ধরার মতো একটা ব্যাপার আরকি। ভেতরে-ভেতরে খুবই মুগ্ধ হলো ফুয়াদ। তবে তা প্রকাশ করল না। প্রশংসা করলে মিলা আবার মাথায় উঠে যেতে পারে, দরকার কী। তবে এ ঘটনা অবশ্য বাসার কেউ জানল না।
তারপর অপেক্ষা ...অপেক্ষা এবং অপেক্ষা।
আর কিমাশ্চর্যম! তিন দিনের মাথায় সবাই আবিষ্কার করল, পাইপের পাশে গজিয়ে ওঠা বটগাছটা গোড়া থেকে কাটা অবস্থায় নিচে মাটিতে পড়ে আছে। ফুয়াদ–মিলার লেখা নোটিশটা তখনো সুতা দিয়ে বাঁধা। তবে ছাদ থেকে আবার একটা প্যান্ট, দুটো গামছা আর একটা ফতুয়া উধাও। তা যাক, কাজ তো হয়েছে। রক্ষা পেয়েছে ছোট ফুফুর ফ্ল্যাট। খুশির চোটে ছোট ফুফু ঘোষণা দিল, তার ফ্ল্যাটে শিগগিরই এ উপলক্ষে পার্টি হবে। এটাই–বা মন্দ কী!