শেষ পর্যন্ত তানিম রবিন মামার সঙ্গে রওনা দিল ঢাকার উদ্দেশে। যাওয়ার সময় ছটকু মামা ৫০০ টাকার একটা কচকচে নোট তানিমের বুকপকেটে ঢুকিয়ে দিলেন। রবিন মামাই গাড়ি চালাচ্ছেন। পথে টুকটাক আলাপ হলো দুজনের। রবিন মামা জানতে চাইলেন, তানিমের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী। রেজাল্ট বের হলে পর তানিম কোন কলেজে ভর্তি হবে ইত্যাদি। এসব গল্প করতে করতে একসময় হঠাৎ রাস্তার একপাশে গাড়ি দাঁড় করালেন রবিন মামা।
—কী হলো মামা?
—চাকায় কেমন একটা শব্দ হচ্ছে।
মামা নেমে গেলেন। তানিমও নামল। দেখা গেল, পেছনের চাকায় একটা সাদা পলিথিন বিশ্রীভাবে পেঁচিয়ে আছে...সেই পলিথিনটা? তানিমের ভেতরটা কেঁপে উঠল। এসব কী হচ্ছে? আবার সেই পলিথিন!
—কোনো মানে আছে? এই পলিথিন কোত্থেকে এসে চাকায় আটকাল?
বিরক্তিতে চুল খামচে ধরলেন রবিন মামা। অনেকটা সময় নিয়ে ঝামেলা করে পলিথিনটা সরানো গেল চাকা থেকে। তানিমের ইচ্ছা হলো, পুরো ঘটনাটা রবিন মামাকে বলতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলল না।
বাকি রাস্তা নির্ঝঞ্জাট গাড়ি চলল। খুব একটা যানজটেও পড়তে হলো না। সন্ধ্যার দিকে তানিম বাসায় পৌঁছাল। রবিন মামা তানিমকে নামিয়ে দিয়েই চলে গেলেন। বাসায় ঢুকলেন না। তাঁর হাতে একদম সময় নেই। তানিমকে দেখে মা ভীষণ অবাক হলেন!
—কী রে, এত তাড়াতাড়ি চলে এলি যে! শ্রীমঙ্গল ভালো লাগেনি?
—লেগেছে, অনেক সুন্দর।
—তাহলে চলে এলি যে!
—মামার এক বন্ধুর গাড়িতে চলে এলাম। তুমি চিনবে হয়তো, রবিন মামা।
—ও, রবিন! ও বাসায় এল না?
—না, ওনার অনেক কাজ। সময় নেই। সিঙ্গাপুরে যাবেন বললেন।
—তা এসে তুই ভালোই করেছিস। কাল রাতে একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছি তোকে নিয়ে। ছটকু ভালো আছে তো?
—হুম। কী স্বপ্ন মা?
—থাক, শুনে কাজ নেই। যা চট করে গোসল করে নে। আমি টেবিলে ভাত দিই। ক্ষুধা লেগেছে নিশ্চয়ই?
—তা লেগেছে।
অনেকক্ষণ ধরে গোসল করল তানিম, পুরো ঘটনাটা কি কাউকে বলবে? ভাবতে লাগল। না, বলবে না। বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। কিছু কিছু রহস্য নিজের কাছেই থাক বরং।
গল্পটা এখানে শেষ হয়ে গেলেই হয়তো ভালো হতো। কিন্তু আরেক দিন আরেকটা ঘটনা ঘটল। আরেফিনদের বাসা থেকে ফিরছিল তানিম, আরেফিন তার সহপাঠী। সন্ধ্যা হয়ে আসছে প্রায়, হঠাৎ বাসার কাছের একটা টং দোকানে দেখল সেই লোকটাকে। সেই বুড়ো হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে, তার দুই হাতে দুই কাপ চা। তানিম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, শরীরে একটা শিরশিরে অনুভূতি হলো তার। তখনই লোকটা চাসহ এক হাত তুলে ডাকল তাকে, ভাবটা এমন, এসে চা খেয়ে যাও...। তানিম অবশ্য লোকটার ডাকে সাড়া দিল না। তার প্রচণ্ড ভয় হলো। সে দ্রুত পা চালিয়ে টং দোকানটা পার হয়ে গেল। অনেকটা দূরে এসে তাকিয়ে দেখল, লোকটা আর সেখানে নেই।
এসব কেন হচ্ছে? তানিমের মনে হলো, বিষয়টা মা–বাবার সঙ্গে আলাপ করা দরকার। যে লোকের মেঘালয়ে যাওয়ার কথা, সে তানিমের পিছু পিছু শ্রীমঙ্গলে নেমে গেল, মামার বাসা পর্যন্ত! আবার তার পিছু পিছু ঢাকায় চলে এসেছে! একবারে তার বাসার কাছে! কেন? কী চায় লোকটা? বাবাকে বিষয়টা বললে বাবা বলবেন, ‘আগেই বলেছিলাম, পাগলা ছটকুর ওখানে যাওয়ার দরকার নেই। তোর মাথা খারাপ করে দেবে। এখন হলো তো?’ আর মাকে বললে মা সঙ্গে সঙ্গে তার ফুফাতো ভাই, যিনি পুলিশের বড় অফিসার; তাকে ফোন করা শুরু করবেন এবং উনিও নিশ্চয়ই সঙ্গে সঙ্গে তানিমকে ডেকে পাঠাবেন তার অফিসে।
তার চেয়ে বরং বিষয়টা কিংশুকদার সঙ্গে আলাপ করা যাক। কিংশুকদা তাদের পাড়ার বড় ভাই, একটা কলেজের বিজ্ঞানশিক্ষক। তাঁর অনেক পড়াশোনা। সব বিষয়ে তিনি জানেন। পরদিন তাঁর কাছেই যাবে, এটা ভেবে মনটা শান্ত হলো তানিমের। অবশ্য কিংশুকদাকে তাঁর বাসায় পেলে হয়!
পরদিন সকালে নাশতা খেয়েই ছুটল তানিম। কিংশুকদার বাসা খুব দূরে নয়। একটা ছোট্ট একতলা বাসায় তিনি একাই থাকেন। ভাগ্য ভালো, কিংশুকদাকে পাওয়া গেল।
—কী রে, তুই হঠাৎ!
—কিংশুকদা, একটা জরুরি বিষয় নিয়ে এসেছি।
—তোর আবার জরুরি বিষয় কী রে? কোথাও যাসনি বেড়াতে? তোর বন্ধুরা তো মনে হয় কেউ নেই পাড়ায়।
—গিয়েছিলাম শ্রীমঙ্গলে। ওখানে গিয়েই বিরাট সমস্যায় পড়লাম।
—কী সমস্যা? চা খাবি?
—তুমি খেলে খাব।
কিংশুকদা চা বানাতে বানাতে বললেন, ‘শুরু কর তোর কাহিনি।’
তানিম একেবারে ট্রেনে কাটলেট খাওয়া থেকে শুরু করে সব খুলে বলল। বুড়ো লোকটার মেঘালয়ে না গিয়ে শ্রীমঙ্গলে নেমে যাওয়া, হঠাৎ ঘরের ভেতর ফ্রিজের সামনে দেখা পাওয়া, ঢাকায় ফেরার পথে গাড়ির চাকায় পলিথিন পেঁচিয়ে যাওয়া...তারপর ঢাকায় টং দোকানে দুই কাপ চা নিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা; সব একে একে খুলে বলল তানিম। মাঝখানে কিংশুকদা কোনো প্রশ্ন করলেন না। তানিম থামলে পরে বললেন, ‘এক কাজ কর।’
—কী?
—পুরো ঘটনাটা তুই লিখে ফেল।
—লিখে কী হবে?
—দারুণ একটা ভৌতিক গল্প হবে। তারপর কোনো ছোটদের পত্রিকায় পাঠিয়ে দিবি।
—ঠাট্টা নয়! ব্যাপারটা কেন হচ্ছে কিংশুকদা?
—দাঁড়া, একটু ভাবতে দে। বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোঁয়া দিতে হবে তো।
এ কথা বলে বারান্দায় চলে গেলেন কিংশুকদা।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন, ‘আচ্ছা, তোর করোনা হয়েছিল না?’
—হ্যাঁ, দুবার। প্রথমবার তো আইসিইউতে থাকতে হয়েছিল তিন দিন। জান নিয়ে টানাটানি।
—হুম। আমার মনে হয় কি জানিস, করোনা যাদের হয়েছে, তাদের প্রায় প্রত্যেকের কিছু না কিছু শারীরিক ক্ষতি হয়েছে। যেটা হয়তো এখন টের পাচ্ছি না, সময়মতো টের পাওয়া যাবে। তোর যেটা হয়েছে, সেটা হচ্ছে স্মৃতিক্ষয়। তুই আবার সিরিয়াসলি নিস না, আমি আমার ধারণার কথা বলছি।
—তুমি ঠিক বলেছ। আজকাল অনেক কিছু আমি ভুলে যাই। মনে করতে পারি না।
—আমাকে শেষ করতে দে। মানুষের মস্তিষ্ক হচ্ছে একটা নিউরাল নেটওয়ার্ক। খুব সম্ভবত তোর মস্তিষ্কের কিছু কিছু স্মৃতি মুছে গেছে করোনার সময়। মস্তিষ্ক যেহেতু শূন্যস্থান রাখে না, তাই সেই মুছে যাওয়া জায়গায় নতুন কিছু ঘটনা ঢুকে গেছে। এ ঘটনা কিন্তু তুই নিজেই তৈরি করেছিস। মস্তিষ্ক সুযোগ পেলেই শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলে, নতুন গল্প তৈরি করে। সুযোগটা তুই–ই করে দিয়েছিস। ঠিক তুই না, তোর অবচেতন মন। এই বুড়ো লোকের গল্পটা তোর শূন্যস্থান পূরণ করা গল্প। তোর মামার ফ্রিজের গল্পটাও এর সঙ্গে জুড়ে বসেছে। অনেকটা অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে বলতে পারিস।
—তার মানে তুমি বলতে চাইছ, বুড়ো লোকটা সত্যি নয়?
—হুম।
—আমার কল্পনা?
—হ্যাঁ তা–ই...
—অসম্ভব। লোকটা তো ট্রেনের ভেতর আমার সামনে এসে বসল, কথা বলল!
—তোর হয়তো তা–ই মনে হচ্ছিল। আসলে ব্যাপারটা সত্যি নয়। ব্যাপারটা অনেকটা জেগে স্বপ্ন দেখার মতো একটা ব্যাপার।
—মানে?
—যেমন ধর, প্লেন যখন মেঘের অনেক অনেক ওপর দিয়ে উড়ে যায়, তখন পাইলটরা দেখেন শুধু নীল, নীল আর নীল আকাশ। তখন মস্তিষ্ক ভাবে, লোকটা মানে পাইলটটা বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। তখন তাদের স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। চিন্তা করে দেখ, একটা লোক দুই চোখ খোলা রেখে বসে আছেন, জেগে আছেন, কিন্তু স্বপ্ন দেখছেন। অনেক পাইলট শুনেছি প্রথম প্রথম ভয়ও পান। পরে অভ্যস্ত হয়ে যান। রয়্যাল পাইলটদের ক্ষেত্রে এটা বেশি ঘটে; যাঁরা অনেক উঁচু দিয়ে রাজসিক প্লেন চালান।
—কিংশুকদা, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি কী করব?
—তুই এক কাজ কর।
—কী?
—এরপর ওই বুড়োর সঙ্গে দেখা হলে এড়িয়ে যাবি না। ভয় পাবি না। বরং এগিয়ে যাবি।
—তারপর?
—তারপর তার সঙ্গে একটা সেলফি তুলবি। পারবি না?
—পারব।
—ব্যস এটাই তোর সমস্যার সমাধান। ভালো কথা, আমি কিন্তু মনোবিজ্ঞানী নই বা মানসিক রোগের চিকিৎসকও নই। আমার মাথায় যে ব্যাখ্যা এসেছে, সেটাই তোকে বললাম, মানে শেয়ার করলাম আরকি! তুই বরং একজন ভালো মনোবিদকে দেখাতে পারিস। অধ্যাপক হেদায়েতকে দেখা। আমাদের দেশের বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী। উনি খুব সম্ভবত ধানমন্ডি ১৫ নম্বরে বসেন।
না, তানিম মনোবিজ্ঞানীর কাছে যায়নি। কারণ, ওই বুড়োকে আর দেখাও যাচ্ছে না। বুড়ো যেন পুরো গায়েব হয়ে গেছে। কিন্তু হঠাৎ একদিন ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটল। সেদিনও সে আরাফাতদের বাসা থেকে ফিরছিল। ওদের বাসা থেকে বের হতেই একটা শর্টকাট রাস্তা আছে। সেদিক দিয়েই আসছিল। রাস্তাটা একটা সরু চিপা গলির ভেতর দিয়ে গিয়ে আবার মূল রাস্তায় আসে। গলিটা খুব বড় নয়, দুই পাশে উঁচু দেয়াল। হেঁটে আসছিল তানিম। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। দেখে, সামনের দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে আছে বুড়োটা। বাচ্চাদের মতো পা দোলাচ্ছে। মুখটা হাসি হাসি। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল তানিম। সেই ‘ফাইট অ্যান্ড ফ্লাইট’ অবস্থা! তখনই মনে পড়ল কিংশুকদার কথা। একটা সেলফি তুলতে হবে বুড়োটার সঙ্গে। সে কাঁপা কাঁপা হাতে পকেট থেকে ফোনটা বের করল। বলল, ‘আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চাই।’
বুড়োটা পা দোলানো বন্ধ করে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। মুখে আগের সেই হাসি নেই। কাঁপা হাতে টপাটপ কয়েকটা সেলফি তুলল তানিম। তারপর খুব ধীরে হেঁটে বের হয়ে গেল গলিটা থেকে। একবারও পেছনের দিকে তাকাল না।
বাসায় এসে ছবিগুলো পরীক্ষা করল। একটাতেও বুড়োটা নেই। পেছনে শুধু উঁচু দেয়াল, দেয়ালের ওপাশে নীল আকাশ। তাহলে কি কিংশুকদার কথাই ঠিক? সবই তানিমের কল্পনা? বুড়োটা তার মস্তিষ্কের হারিয়ে যাওয়ার স্মৃতির মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল...ফিল ইন দ্য ব্ল্যাঙ্ক হিসেবে? কে জানে!
এরপর ওই বুড়োকে আর কোথাও কখনো দেখেনি তানিম। বিষয়টা নিয়ে সে আর ভাবতেও চায় না।
(শেষ)