খসরুর অদ্ভুত ম্যাজিক
বিকেলে গিটার ক্লাস থেকে ফেরার সময় সৈকতের চোখে পড়ল সাইনবোর্ডটা। সাদার ওপর লাল কালিতে লেখা।
এদিক–ওদিক তাকিয়ে এক দৌড়ে পাশের দোকান থেকে একটুকরো কাগজ নিয়ে এল সৈকত। পকেটে একটা বলপয়েন্ট ছিল। নম্বরটা টুকে নিতে লাগল কয়েক সেকেন্ড।
রাস্তাঘাটে জাদু শেখার সাইনবোর্ড বেশ স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও মনে রাখবেন, যখন আপনি কোনো জিনিস খুব করে খুঁজবেন, তখন সেটা পাবেন না। সৈকতের সঙ্গেও তা-ই হচ্ছিল। আজ কপালগুণে ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল পার হতেই পেয়ে গেছে।
ঝড়ের বেগে বাসায় এসে গিটার কাঁধে নিয়েই ল্যান্ডফোনের সামনে বসে পড়ল সৈকত। ডায়াল করল। রিং হচ্ছে… .
‘কে? ’ ঠান্ডায় বসে যাওয়া একটা কণ্ঠ।
‘সাইনবোর্ড দেখে কল করলাম, জাদু শেখানো হয় না এখানে? ’
ন্যানোসেকেন্ডের নীরবতা, ‘হুম, রাইট। বলেন। ’
‘জায়গাটা কোথায়? আমি শিখতে চাই। ’ নিজের কণ্ঠের উত্তেজনা ঢেকে রাখতে পারল না সৈকত।
‘বাসাবো চিনেন? ’ মানুষটা বিরক্ত মনে হলো কেন যেন, ‘বৈদ্ধমন্দির খুঁইজ্জা বাইর করবেন। উল্ডা দিকের গল্লির ভিত্রে। সিডির দোকানের উল্ডা দিকের সবুজ গেট। বিকাল পাঁচটার পর আহেন। ’
আর কিছু বলার সুযোগ পেল না সৈকত। কেটে গেছে লাইন।
সেদিন বিকেল যেন আর আসতে চায় না।
সৈকতের মনে হলো, জীবনের দীর্ঘতম দুপুর পার হয়ে অবশেষে ঘড়িতে চারটা দশ বাজল। বাসার কারও দুপুরের ভাতঘুম না ভাঙিয়ে জমানো সাত শ টাকা পকেটে নিয়ে চুপিসারে বেরিয়ে এল বাইরে। মাঘের শেষ বিকেলের জমাটি শীত আর হালকা কুয়াশা ঘাড়ে নিয়ে সাইকেলের প্যাডেল চাপল সৈকত। ছোট ভাই সাগরের সাইকেলটা চুপি চুপি নিয়ে এসেছে।
প্যাডেলের তালে তালে মাথায় এলোপাতাড়ি কিছু চিন্তা চলছে ওর।
বাবা না থাকায় মনে হয় কিছু সুবিধাই হয়েছে। সৈকতের জিগরি দোস্ত সুমন তো ওর বাবার ভয়েই আসতে পারল না। কিন্তু ওই বেচারার আগ্রহ আরও বেশি ছিল। কিন্তু ওর বাপ জাদুফাদু শেখার কথা শুনতেই, ‘হারামজাদা, ক্লাস নাইনে অল সাবজেক্টে পাস করে উঠতে না পারলে…। ’ অল্পের জন্য লাথিটা ফসকে গেছে।
সৈকতের বাবা কোথায়, ও জানে না। ছোটবেলায় শুনেছিল, বিদেশে থাকেন বাবা। আসবেন কোনো এক দিন। এরপর সিক্সে যখন উঠল, একদিন শুনল যে মা–বাবা আলাদা থাকেন। কিন্তু কেন, তা জানা নেই ওর। কেউ বলার প্রয়োজন মনে করে না।
একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। এই যে জাদুর প্রতি এত আগ্রহ, মাথার ওপর বাবা নামক অমন একখানা যমদূত থাকলে কি আর সম্ভব হতো আজকের এই অভিযান? নেভার!
বৌদ্ধমন্দির খুঁজে পেতে বেগ পেতে হলো না। এদিকে ক্রিকেট খেলতে আগেও বার দুয়েক এসেছে সৈকত।
সত্যিই উল্টো দিকে দেড় মানুষ সমান একটা সরু গলি চলে গেছে। সাইকেল থামিয়ে আলগোছে ডান পকেটে হাত ছুঁইয়ে নিল ও। সাত শ টাকা জমাতে আড়াই মাস সময় লেগেছে। এতে হবে তো? নাকি আরও বেশি লাগে?
ধুর, যা হয়, হবে!
প্যাডেল মেরে গলিতে ঢুকে গেল সৈকত।
পাশাপাশি দুটো রিকশা চলার মতো জায়গাও নেই গলিতে। এতই সরু। আর ভিড়ে ভিড়াক্কার। মস্কো, গুলিস্তান আর নিউইয়র্ক যেন একত্রে সেঁধিয়েছে এখানে, ঢাকার এই এক কোণে।
শ খানেক গজ যেতেই সৈকতের কানে আসে, ‘মেয়ে… তুমি কি দুঃখ চেনো? চেনো না!’
সিডির দোকান হাতের ডান দিকে। এলআরবির এই গান ওদের ওপর তলার নিক্সন ভাই শোনে জোরে জোরে।
সিডির দোকানের উল্টো দিকে রং জ্বলে যাওয়া সবুজ গেট দাঁড়িয়ে আছে প্রায় অন্ধকার একটা উঠোন পেছনে নিয়ে।
সাতপাঁচ না ভেবে গেটে টোকা দিল সৈকত।
‘কে আপ্নে?’ অজস্র ফুটোওয়ালা স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে রোগা এক লোক একটু ফাঁক করেছে সবুজ গেটটা।
‘ইয়ে... আমি ফোন করেছিলাম...’
এখানে আমার মতো অনেকেই আছে, জানেন? ঢাকা শহরেই বিভিন্ন জায়গায় এদের দেখি। আমার মতোই সারাক্ষণ দৃশ্যমান জগতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যায় এরা।
‘ওহ, ভিত্রে আহেন,’ ছোটখাটো মানুষটার লম্বাটে মুখ আর কুচকুচে কালো গোঁফ, কপালে চিরস্থায়ী ভ্রুকুটি। গোটা জগতের ওপর থেকে তার মন উঠে গেছে মনে হয়। সোজা ভেতরে আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দেয় লোকটা, ‘বারান্দায় উইঠ্যা হাতের ডাইনের ঘর। সিধা যান গা।’
সাইকেলটাকে এক পাশে ঠেস দিয়ে রেখে চারদিকে একপলক দেখে সৈকত। এক টুকরা উঠানের মতো জায়গা। সিমেন্টে বাঁধানো ছিল হয়তো একসময়। এখন জায়গায় জায়গায় তলার কালো মাটি উঁকি দিচ্ছে। সাত–আটটা বিশাল প্রাচীন গাছ অনেকখানি অন্ধকার এঁকে দিয়েছে চারপাশে। একটা গাছের নামও আন্দাজ করতে পারল না সৈকত। কিন্তু ওপর দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হলো, মাঘের আকাশ দেখা যায় না। এতই ঘন এই সব প্রাচীন মহিরুহের বিস্তার।
হলদে দেয়ালের এ রকম বাড়ি ঢাকা শহরে আর দেখেনি সৈকত। অবশ্য এ শহরের কতটুকুই বা ওর দেখা!
তবে পানাম সিটিতে বেড়াতে গিয়ে এ রকম কয়েকটা বাড়ি দেখেছিল সৈকত গত বছর। আর…ও হ্যাঁ, পুরান ঢাকায় দেখেছিল মনে হয়! বাড়িটা একতলা আর বেশ ছড়ানো বারান্দা থেকে চওড়া দুই ধাপ সিঁড়ি নেমে এসেছে পরিত্যক্ত উঠোন পর্যন্ত।
গোটা জায়গাটার পরিপূর্ণতা ফুটিয়ে তুলতেই বোধ হয় একটা কুচকুচে কালো বিড়াল সিঁড়িতে বসে বাটি থেকে চুকচুক করে দুধ খাচ্ছে। সৈকত পাশে গিয়ে দাঁড়াতেও মুখ তুলে তাকাল না ও।
‘কানা বিলাই। আপনে ভিত্রে যান।’ পেছন থেকে বলে ওঠে মহা বিরক্ত গেটম্যান।
কানা বিড়াল!
অন্ধ বিড়াল এই প্রথম দেখল সৈকত। শোনেওনি কখনো এর আগে।
বারান্দায় উঠে হাতের ডান দিকে শেষ মাথায় সাদার ওপর ছোট ছোট খয়েরি ফুল ছাপা পর্দা দেখে সেদিকে এগোয় সৈকত। একটা কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে বারান্দায়।
বেশ সাধারণ একটা বসার ঘর।
বেতের ছোট্ট একটা টেবিল ঘিরে তিন দিকে সোফা। দুটো সিঙ্গেল আর একটা ডাবল। আর একদিকে বুকশেলফ। মেঝে থেকে সৈকতের বুকসমান হবে তার উচ্চতা! আর তাতে ঠেসে রাখা আছে শ তিনেক বই।
সৈকত নিজে বইয়ের পোকা হওয়ায় চট করে চোখে পড়ে দারুণ দারুণ বিষয়ের ওপর বেশ ভালো কিছু বই। প্রাচীন সভ্যতা ও জ্যোতির্বিদ্যা, হয়তো অজানা কোনো গ্রহ, ফারাও রাজসভা ও জাদুকরের আদ্যোপান্ত ইত্যাদি সব নাম সৈকতের রক্তে রোমাঞ্চের সুর তুলে দেয়। আরও একটা ঢাউস বই চোখে পড়ে ওর। সম্ভবত সবচেয়ে পুরোনো আর সবচেয়ে মোটা ইরাক, আফ্রিকা ও ল্যাজারাস পিট!
‘এ রকম কিছু বই আমার কাছে আছে, লোকে জানতে পারলে আমাকে খুন করে হলেও ওসব বাগাবে, বুঝলে?’ ভরাট একটা কণ্ঠ আচমকা সৈকতকে চমকে দিয়েছে। মনে হলো, চমকের ধাক্কায় আরেকটু হলে দেহ থেকে চামড়া আলাদা হয়ে যেত ওর!
সাদা পাঞ্জাবি–পাজামা পরা বেশ লম্বা এক মানুষ বসে আছেন সিঙ্গেল সোফাটায়। হাত দুটো জড়ো করে রেখেছেন কোলের ওপর। কিন্তু কোন ফাঁকে তিনি এলেন, খেয়াল করল না কেন সৈকত?
‘ঘাবড়ে গেলে নাকি? বসো।’ ভরাট কিন্তু নরম কণ্ঠেই বললেন ভদ্রলোক।
কুচকুচে কালো ব্যাকব্রাশ করা চুল, ঘন ঝোপের মতো এক জোড়া ভুরু আর তার নিচে অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ এক জোড়া চোখ। জ্বলজ্বল করছে। সৈকতের মনে হলো, ঠিক যেন গভীর সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানো কোনো ডুবোজাহাজের সার্চলাইট। ওর আরও মনে হলো, এই চেহারা কোথায় যেন সে দেখেছে…
‘অমন করে কী দেখছ? জাদু শিখবে বলে এসেছ? একটা সিগারেট খাই?’ গোল্ডলিফের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ার মেঘ তৈরি করলেন ভদ্রলোক।
‘আপনি জাদুকর?’ সামলে নিচ্ছে সৈকত।
‘জাদু কেন শিখতে চাও সৈকত?’ লোকটার চোখের কোণে হাসি খেলে যায়, ঠোঁটে নয়। কণ্ঠে কী যেন আছে…
‘ছোটখাটো জাদু আমি শিখতে চাই না। আমি বড় কিছু চাই… কপারফিল্ড বা…’ কিন্তু একবারও ভাবল না, ওর নাম তো এই লোকের জানার কথা নয়।
‘কখনো শেখার চেষ্টা করেছ এর আগে?’
উৎসুক সৈকত দ্রুত পকেটে হাত দিয়ে একটা এক টাকার পয়সা বের করে কিছু হাতসাফাই দেখায়। সবই সস্তাদরের জাদু। পামিংয়ের নানা কৌশল। পি সি সরকার আর জুয়েল আইচের বই পড়ে শেখা।
‘এগুলো? এগুলো জাদু?’ সিনেমার অভিনেতাদের মতো একঝটকায় মাথা পেছনে হেলিয়ে হেসে উঠলেন জাদুকর। কিন্তু নিচু আওয়াজে। সাধারণত এ রকম হাসি উচ্চ স্বরেই হাসে লোকে।
তারপরই আচমকা তড়িৎগতিতে ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন বুকশেলফের দিকে।
আর ওমনি সৈকতের চোখ ছানাবড়া করে দিয়ে ঢাউস আকারের সবচেয়ে মোটা বইটা ছিপে টানা মাছের মতো উড়ে এসে জাদুকরের হাতে সেঁটে গেল।
‘শোনো, জাদু কি খেলা? যাকে–তাকে যখন–তখন এক–দুই হাত দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়ার নামই কেবল জাদু?’ এতক্ষণে সৈকত টের পেল যে ওনার কণ্ঠে রয়েছে তিরস্কার! নিখাদ ঘৃণামিশ্রিত তিরস্কার। যেন সৈকত খুব নিচু শ্রেণির কোনো প্রাণী। বড় স্পর্ধা দেখিয়ে ফেলেছে।
একটু ঘাবড়ে গিয়ে কী যেন বলতে নেয় সৈকত, কিন্তু তার আগেই...
‘এই, এই ছেলে! তাকাও এদিকে…’ বারান্দা থেকে পর্দা ঠেলে প্রবেশ করেছে আরও একজন…দেখতে হুবহু…মানে যাকে বলে জেরক্স কপি…সামনে বসে থাকা মানুষটার ক্লোন যেন! এ রকমও কি সম্ভব?
চুল, চেহারা, চোখ, পোশাক, গড়ন—ঠিক যেন আয়নায় কোনো প্রতিবিম্ব!
সৈকত টের পেল, পিঠের দিকটা ঘেমে গেছে ওর। ঘরের কম পাওয়ারের বাল্বে ভুলভাল দেখছে নাকি? নিজেরই সন্দেহ হচ্ছে ওর।
‘এই ছেলে তাকাও এদিকে!’ প্রথমজন কথা বলে উঠল এ সময়।
নিজেকে ফাঁদে আটকে পড়া জানোয়ার মনে হলো সৈকতের।
‘তোমার জীবনের সেরা জাদুটা তোমাকে দেখাব আমি, তাকাও এদিকে।’
‘এদিকেও তাকাও একবার, এই যে... ’
এ রকম অভিজ্ঞতা আর কারও কখনো হয়েছে কি না, সৈকতের জানা নেই, কিন্তু ও পরিষ্কার বুঝতে পারছে যে ও ভয় পেয়েছে। দুদিক থেকে দুজন একই রকম মানুষ, একই সুরে ওকে ডাকছে। যেন প্রতিবিম্ব থেকে প্রতিবিম্ব হয়ে চলেছে অশুভ কোনো প্রতিধ্বনি।
সামনের জনের দিকেই তাকাল সৈকত। কিন্তু সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। তাকাতে সে চায়নি। যেন অদৃশ্য কেউ সুতা টেনে তাকে বাধ্য করেছে তাকাতে। সেই অদৃশ্য শক্তির উৎস কি সামনে বসে থাকা মানুষটা? যে অদ্ভুত কোনো ক্ষমতাবলে নিজের একাধিক সত্তা তৈরি করতে পারে?
সৈকত টের পাচ্ছে, চিন্তার স্থিরতা হ্রাস পাচ্ছে ওর। দৃষ্টিশক্তি অস্বচ্ছ হয়ে আসছে।
মাঘের শেষ বিকেল কি বিদায় নিচ্ছে? শীতের সন্ধ্যা নেমে এসেছে? কেন যেন মনে হলো, শীতের মায়াবী সন্ধ্যা ওর আর দেখা হবে না। শীতকালটা ওর বড্ড পছন্দের যে…
আবছাভাবে কী যেন একটা কানে আসে সৈকতের। সুর করে নামতার মতো কী যেন পড়ছে কেউ। গুনগুন করে… না, না। নামতা বলা ঠিক হলো না। কবিতার মতো। ছন্দ আছে।
নেফুরাত আলাজিয়াত
নাজারেথ ইয়াহা
বাবিল্যাথ ইয়াবাত
বারজাখে গায়্যাবা…
ঘোর লাগা সুর, ক্রমে ফিসফিস থেকে পর্দা উঁচুতে উঠে আবার ধীরে ধীরে নেমে যায় ফিসফিসে। ষড়যন্ত্র আর শয়তানিতে ভরা! কলিজায় ভয় ধরে যায় সৈকতের। কিন্তু কিসে যেন গেঁথে ফেলেছে ওকে। একচুল নড়ার শক্তি নেই।
চারদিকে আলো আরও কমে এসেছে। প্রায় বুজে আসা চোখ বার দুয়েক মিটমিট করে আবার মেলতে চাইল সৈকত। একই রকম দুটি মানুষ, যেন আয়নার প্রতিবিম্ব দুই দিক থেকে এসে ওর হাঁটু ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।
চোখ মেলে রাখা প্রায় অসম্ভব…মায়ের মুখটা মনে পড়ল সৈকতের…
আমি সৈকত।
সেই যে জাদু শিখতে গেলাম যে… মনে পড়েছে নিশ্চয়ই!
অনেকেই কিন্তু আমাকে ভুলে গেছে। খুব কাছের একজন কি দুইজন বন্ধু বাদে কেউই মনে রাখেনি। যেমন সুমন আর ইকরামকে দেখলাম, সেদিনও স্কুলের মাঠে গাছের নিচে বসে আমার কথাই আলোচনা করছে।
মা আজও আমার অপেক্ষায় বারান্দায় দাঁড়ান। সময় পেলেই। চোখ দুটো অস্থির হয়ে আমার মুখটা খুঁজে ফেরেন অন্য ছেলেদের মুখে মুখে।
আজ ১৫ মাস পেরিয়ে গেছে আমি পৃথিবীর জীবন থেকে হারিয়ে গেছি। টিকে আছি অদৃশ্য এক জগতে। দেখি সবকিছুই। থাকি আশপাশেই। কিন্তু আমাকে কেউ দেখে না।
স্কুলের মাঠে সুমন আর ইকরাম যখন আমাকে নিয়েই কথা বলছিল, কত চেষ্টা করলাম ওদের একটু ডাকার, কাঁধে হাত দেওয়ার! পারলাম না!
মা যখন বুকে পাথর নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে, আমি তো পাশেই থাকি। কিন্তু প্রাণপণে লড়েও পারি না মাকে একটু ছুঁয়ে দিতে। বলতে পারি না, মা, এই যে আমি! তাকাও এদিকে!
রাগে, হতাশায় বুক ফাটিয়ে কাঁদি। চেঁচাই আকাশ কাঁপিয়ে। তবু কেউ শোনে না।
জাদুকর আমাকে অদৃশ্য করে দিয়েছে।
এখানে আমার মতো অনেকেই আছে, জানেন? ঢাকা শহরেই বিভিন্ন জায়গায় এদের দেখি। আমার মতোই সারাক্ষণ দৃশ্যমান জগতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যায় এরা। ফার্মগেটের ওখানে একটা ছেলে আছে। আমার চেয়ে কয়েক বছর বড়ই হবে হয়তো। প্রতিদিন ওভারব্রিজ থেকে লাফিয়ে পড়ে। কখনো বাস চলে যায় ওর গায়ের ওপর দিয়ে। হাত–পা ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। পাজর ফেটে যায়। ইশ্! কী যন্ত্রণা! কী সেই আর্তনাদ!
কিন্তু মৃত্যু আসে না।
সেই আর্তনাদও কেউ শোনে না।
কমলাপুরের ব্রিজ থেকে আমিও একদিন চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি। সাহসে কুলায় না।
বয়স্কমতো এক লোক এগিয়ে এসে বলল, ‘লাভ নেই। এই জগতে মৃত্যু নেই। পারো তো দূরে কোথাও চলে যাও। আমি তো বেশ ঘুরেটুরে বেড়াই। গত পরশু দিল্লি থেকে ফিরলাম।’
ক্রমাগত কয়েক মাস চেষ্টা করে একটা কলম ধরতে পেরেছি। অদৃশ্য হয়ে গেলে অনেক ক্ষমতাই হ্রাস পায়। ছোঁয়া যায় না কিছু, কথা কওয়া যায় না কারও সঙ্গে! তবে অদম্য ইচ্ছা আর দিনের পর দিন চেষ্টা করে এটুকু পেরেছি। এক দোকান থেকে দুই পাতা কাগজ আর একটা কলম নিয়ে লিখে ফেললাম আমার অভিজ্ঞতা।
যাতে জাদু শিখতে আর কেউ এই অভিশাপের কবলে না পড়ে। অনেকেই তো এসব বিজ্ঞাপন দেখে আমার মতো দৌড়ে যায়। একটু বিস্ময়কর ক্ষমতা, একটা বাহ্বা আর ‘বহুত আচ্ছা’র লোভে মানুষ কত কী–ই না করতে যায়। হ্যাঁ, লোভ!
লোভই আজ আমাকে এই জগতের বাসিন্দা বানিয়েছে।
খবরদার! ঢাকা শহরের কোথাও জাদু শেখার ওই সাইনবোর্ড দেখলেই দৌড়ে যাবেন না।
খসরু তার নাম। খসরু দ্য ম্যাজিশিয়ান।
ভয়ংকর সব অশুভ ক্ষমতার অধিকারী। জাদু শেখানোর নাম করে আমার মতো অসংখ্য মানুষকে এই ফাঁদে ফেলেছে এই লোক।
কে সে, কোথা থেকে এল, কেউ জানে না। শুধু এটুকুই জানা যায় যে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে একই কাজ করে বেড়ায়। এর কোনো স্বার্থ নেই। নেই কোনো উদ্দেশ্য।
একটা গাছের নিচে বসে এই লেখা লিখে চলেছি। মনে আশা, দূর থেকে কেউ হয়তো দেখবে, শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে কাগজ আর কলম। দৌড়ে আসবে কাছে। কথা বলবে। একটু ছুঁয়ে দেখতে চাইবে।
কিন্তু আফসোস, মানুষ ভূত ছাড়া কিছু কল্পনা করতে পারে না।