বুদুর দও

অলংকরণ: আরাফাত করিম

শীত গাঢ় হয়ে নেমেছে। কুয়াশায় জবুথবু মধ্য পৌষের ভোর যেমন হয়, আজকের দিনটাও ঠিক তেমনি। ইতিমধ্যে সমস্ত জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। অনাবৃত মাঠগুলোতে হুটোপুটি খাচ্ছে স্বাস্থ্যবান মেঠো ইঁদুরের দল। খিয়ার অঞ্চলের সাঁওতাল কিশোরেরা সাতসকালে ইঁদুর ধরতে বেরিয়েছে। আওলাদ মিয়ার ঘুম অত সকালে ভাঙে না। ওরা আসবে শুনে গতকাল রাত থেকে তার মেয়ে শারমিন বায়না ধরেছে ইঁদুর ধরা দেখবে। মেয়ের পীড়াপীড়িতে সূর্যোদয়ের আগেই উঠে পড়তে হলো।

আওলাদ মিয়া এসেছে এক বিয়েবাড়িতে। পলাশবাড়ীর এক কাপড়ের দোকানের মালিক প্রদীপের বিয়েতে বরযাত্রী হয়ে তারা সপরিবার এসেছে তেলশুকানি গ্রামে। হিন্দু বিয়ের হাজারটা আচার, সেগুলো শেষ করে নিমন্ত্রিতদের আহারাদি শেষ হতে হতে রাত তিনটা বেজে গেল। আওলাদ মিয়ার ইচ্ছা ছিল, বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে স্ত্রী রত্না ও মেয়ে শারমিনকে নিয়ে পলাশবাড়ী ফিরে যাবে। কিন্তু তা আর হলো কই? গোল বাঁধিয়েছে কনের ভাতিজা সুকুমার। ছোকরা রংপুরের এক কলেজে পড়ে। কিন্তু মুখে সারাক্ষণ খই ফোটে। বিয়ের আসরে কথায় কথায় বলে ফেলেছে, তাদের গ্রামে খাওয়ার জন্য ইঁদুর ধরা হয়। সে কথা শারমিনের কানে গেছে। সাত বছরের একমাত্র মেয়ে শারমিন, তার জন্য আওলাদ মিয়ার পিতৃস্নেহ সীমাহীন। একরকম নির্ঘুম রাত কাটিয়েই সে ও শারমিন গ্রামের মাঠের দিকে রওনা দিল। সঙ্গী হলো সুকুমার।

হাঁটতে হাঁটতে সুকুমার বকবক করতে লাগল। তেলশুকানি গ্রাম ও তার নানা রকম কেচ্ছাকাহিনি সে রসিয়ে বর্ণনা করতে লাগল। আওলাদ মিয়া এমনিতে গল্পের পাগল। কিন্তু সারা রাত জেগে সকালের ঘুমটুকু না ঘুমিয়ে তার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। নতুন কুটুম্ব বলে নেহাত ভদ্রতা করে কিছু বলছে না।

তেলশুকানি গ্রামটা নামে বদখত হলেও দেখতে ভীষণ সুন্দর। গ্রামের এক পাশে প্রকাণ্ড পাইথনের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে ঘাঘট নদ। রাস্তার দুই পাশে বহু পুরোনো খেজুরগাছে ফোঁটা ফোঁটা রস জমে মাটির কলস ভর্তি হচ্ছে। বাড়ির উঠানে চটের পোশাক গায়ে জড়ানো গরুরা শিশিরে ভেজা খড় পরম আলস্যে চিবুচ্ছে। চুলা দখল করে ঘুমিয়ে থাকা বিড়াল তাড়িয়ে গৃহবধূ চোঙা ফুঁকে উনুন ধরানোর চেষ্টা করছে। শুকিয়ে আসা ডোবার ধারে আলসেমি করে দাঁড়িয়ে আছে জলচর হাঁসের দল। সদ্য জন্মানো মুরগির ছানারা মায়ের শরীরের ওম ছেড়ে বেরোতে চাইছে না। এমন সব দৃশ্য দেখতে দেখতে আওলাদ মিয়ার মনটা ভীষণ ভালো হয়ে গেল। মনে মনে ঠিক করল, এখন থেকে সকালে উঠবে। রোজ শারমিনকে নিয়ে হাঁটতে বের হবে। রত্না হয়তো উঠতে চাইবে না। তাকে রেখেই তারা বাপ-মেয়ে ঘুরে বেড়াবে পলাশবাড়ীর পথে–প্রান্তরে।

তারা গ্রামের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে। এখান থেকে মাঠের শুরু। গ্রামের লোকেদের ভাষায়, ‘খালি ভিটা’। ইরি ধান কাটার পর মাঠগুলো বড় নিঃস্ব পড়ে আছে। শুধু বিঘার পর বিঘা খেতজুড়ে ধানের মুড়ো পড়ে আছে। উঁচু–নিচু জ্যামিতিক আকৃতির মাঠগুলো বিভিন্ন প্রস্থের আলে বিভক্ত। সুকুমার একটা আলে নামলে আওলাদ মিয়াও তার পিছু নিতে গিয়ে থেমে গেল। তার চোখ পড়েছে এক প্রকাণ্ড ছাতিমগাছের দিকে। কুয়াশায় বহুদিনের পুরোনো গাছটি যেন আরও ঝুঁকে এসেছে। ঘন পাতার আড়ালে আগুন জ্বালিয়ে বসে আছে এক অশীতিপর বৃদ্ধ। আওলাদ মিয়া সুকুমারকে বলল, ‘ওই লোকটা কে?’

সুকুমার মেঠো ইঁদুরের গল্প বর্ণনা করতে এমনই ব্যস্ত ছিল যে আওলাদ মিয়ার কথা ভালো করে শুনতেই পেল না। বাপ-মেয়েকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ওটা তো হরি কাকা। ভালো নাম হরেশ্বর দাস। একসময় মাছ ধরার ওস্তাদ ছিলেন। ঘাঘট নদের বুদুর দওয়ের নাম শুনেছেন? কেউ কোনো দিন বুদুর দওয়ের তলদেশে পৌঁছাতে পারেনি। শুধু ওই হরি কাকা বাদে। কাকার ত্রিভুবনে কেউ নেই। একাই থাকেন ওই বাঁশঝাড়ের পাশে একটা চালাঘরে।’

নদীতে কিছু গভীর খাত আছে, যেগুলো বছরভর পানিভর্তি থাকে। নদী শুকিয়ে গেলেও খাতগুলো শুকায় না। এগুলোকেই বলে দও। জেলেরা দওগুলোতে গাছের ডালপালা, কচুরিপানা ইত্যাদি আটকে পালো বা মাছের বাসা বানায়। নদী শুকিয়ে গেলে চারপাশের সমস্ত মাছ এসে জমা হয় পালোতে। তখন জেলেরা বেড়জাল দিয়ে চারপাশ ঘেরাও করে মাছ শিকার করে। আওলাদ মিয়া শৈশবে অনেকবার ওভাবে পালো তোলা বা মৎস্য শিকার করতে দেখেছে। নদীর দও বা খাত নিয়েও তার আগ্রহ আছে। এত দিন গল্পের আড্ডায় অনেক লোকের গল্প শোনা হলেও কখনো কোনো ভালো ডুবুরির গল্প শোনা হয়নি। গল্পের নেশা তাকে হঠাৎ পেয়ে বসল।

প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে সাঁওতাল কিশোরেরা কোদাল দিয়ে গর্ত কুপিয়ে ইঁদুর ধরছে। গ্রামের শেষ উঁচু ভিটা থেকে সেখানে পরিষ্কার দেখা যায়। শারমিনকে সুকুমারের সঙ্গে সেখানে যাওয়ার জন্য বলে আওলাদ মিয়া ছাতিমগাছটির দিকে এগোল। যেখানে বৃদ্ধ ডুবুরি শুকনা কাঁঠালপাতার কুণ্ড জ্বালিয়ে শীতে জমে আসা হাত সেঁকছে।

আওলাদ মিয়া বুড়োর সামনে গিয়ে বলল, ‘কাকা, আদাব। একটু বসা যাবে আপনার সঙ্গে?’

বুড়ো আওলাদ মিয়াকে বসার ইঙ্গিত করল। মাটির ওপর উবু হয়ে বসে বৃদ্ধের দিকে ভালোভাবে তাকাল আওলাদ মিয়া। বুড়োর পরনে বহুদিনের পুরোনো নেভি ব্লু রঙের সোয়েটার। যার জায়গায় জায়গায় ফুটো। বোধ হয় ইঁদুরে কেটেছে। নিম্নাঙ্গে আধা ময়লা লুঙ্গি। মাথায় বানর টুপি। বুড়োর পিঁচুটি ধরা চোখে অগ্নিকুণ্ডের স্পষ্ট প্রতিফলন দেখে আওলাদ মিয়া ধারণা করল, চোখজোড়ায় বহু বছর ধরে ছানি পড়ে আছে।

‘ঘণ্টাখানেক নৌকা চালিয়ে গা গরম হয়ে গিয়েছিল। বুদুর দওয়ে পৌঁছে দেখি, ইজারাদার হাজির হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে গ্রামের কৌতূহলী অনেক মানুষ। তারা মাছ ধরা দেখার জন্য ভিড় করে আছে। মনে মনে বিরক্ত হলাম। মানুষের হাউকাউ মাছের অপছন্দ।

কিছুক্ষণ অস্বস্তিকর নীরবতায় কেটে গেল। বুড়ো যেন গভীর ধ্যান থেকে জেগে উঠে বলল, ‘কে? আজিবর?’

আওলাদ মিয়া হেসে বলল, ‘আজিবর নয়। আমার নাম আওলাদ মিয়া। একটা বিয়ের দাওয়াত খেতে আপনাদের গ্রামে এসেছি। আমার বাড়ি পলাশবাড়ীতে।’

বুড়ো যেন কোথায় হারিয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অস্পষ্ট গলায় বলল, ‘পলাশবাড়ী? কার বিয়ে খেতে এসেছেন?’

আওলাদ মিয়া মেয়ের বাবার নাম বললে বুড়ো বোধ হয় চিনতে পারল না। খানিক কেশে নিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল, ‘মোর কাছে কী চান?’

এবার আওলাদ মিয়া সরাসরি প্রসঙ্গে এল। বলল, ‘গল্প শুনবার আসছি বাহে। আপনি নাকি বুদুর দও জয় করেছেন? কেউ যেখানে কোনো দিন পৌঁছাতে পারেনি, আপনি নাকি সেখানে পৌঁছাইছেন?’

বুড়ো অবাক হয়ে আওলাদ মিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখের ভাঁজ পড়া ত্বক শঙ্কায় যেন আরও কুঞ্চিত হলো। বিড়বিড় করে বলল, ‘সেই সব দিনের কথা কি আজকের মানুষের মনে আছে? সেই রাম নাই, অযোধ্যাও নাই। কী হইবে ওই সব গল্প শুনিয়া?’

আওলাদ মিয়া জানে, বৃদ্ধের একান্ত কোনো কষ্টের স্মৃতি জড়িয়ে আছে বুদুর দওয়ের সঙ্গে। বহুদিনের চাপা ক্ষত সে উসকে দিয়েছে। আঘাতটা হরি বুড়োর জায়গামতো লেগেছে। কিছুক্ষণ অতীতে ডুব দিয়ে সে ঠিকই ভুস করে ভেসে উঠবে।

হলোও তা–ই। কিছুক্ষণ অস্বস্তিকর নীরবতায় কাটানোর পর বুড়ো অগ্নিকুণ্ডে এক আঁটি খড় ছড়িয়ে দিয়ে আগুনটাকে বড় করল। পেছন থেকে একটা ক্ষয়ে যাওয়া পিঁড়ি টেনে নিয়ে আরাম করে বসল। তারপর বলতে শুরু করল, ‘ঘাঘট নদ এখন যেমন দেখা যায়, তেমনটা চিরকাল ছিল না। ঘাঘট কখনো শুকাত না। নদের স্বচ্ছ পানি ভেদ করে অনায়াসে তলদেশ দেখা যেত। বর্ষাকালে নদ একেবারে খেপে উঠত। আবার শীতে একেবারে শান্তশিষ্ট হয়ে যেত। তবে নদে কিছু কিছু জায়গা ছিল, যেখানে পানি কখনো শুকাত না। সেগুলোকে বলে দও। মানে গর্ত। সাধারণ কোনো গর্ত নয়, ইয়া বড় বড় খাত। আজকের ঘাঘট নদকে দেখলে বিশ্বাস হবে না, দওগুলো কী রকম ভয়াবহ ছিল। লোকজন নানা নামে দওগুলোকে ডাকত। বুদুর দও, গাজির দও, মাসানের দও, আটষট্টির দও—এই রকম বিভিন্ন নাম ছিল। তখনকার দিনে সরকার থেকে নদী নিলাম করে ইজারাদারদের দেওয়া হতো। ইজারাদার হয়তো দমদমা থেকে চরকাবাড়ি পর্যন্ত পুরো নদী নিলামে ডেকে নিত। নদীতে মাছ ধরার অধিকার ছিল শুধু ইজারাদারদের। শীতকালে পানি কমে গেলে নদীতে মাছ ধরার ধুম পড়ে যেত। ইজারাদারেরা শুষ্ক মৌসুমে দওগুলো ঘিরে পালো বসাত। বিচিত্র সব মাছ পালোতে পাওয়া যেত। আজকালকার লোকেরা সেগুলোর নামও শোনেনি। একেকটা মাছ পানির একেকটা স্তরে বাস করে। কোনোটা ওপরে, কোনোটা মাঝে, আবার কোনোটা ঠিক পানির নিচে কাদায় লুকিয়ে থাকে। দওয়ের গভীরতা ও আয়তনের ওপর নির্ভর করে মাছ পালোতে জড়ো হয়। ঘাঘট নদে যতগুলো দও ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ও গভীর দও ছিল বুদুর দও।’

এই পর্যন্ত এসে বুড়ো কিছুক্ষণ বিরতি নিল। লুঙ্গির প্যাঁচ থেকে একটা নেতিয়ে পড়া বিড়ি বের করে ধরাল। বাতাসে ভাসল সস্তা বিড়ির কটু গন্ধ।

আওলাদ মিয়া বলল, ‘বুদুর দও আলাদা কেন?’

হরি বুড়ো একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে কিছুক্ষণ কেশে বলল, ‘বুদুর দও কবে কীভাবে তৈরি হয়েছিল, কেউ জানে না। আয়তনে পাঁচটা ফুটবল মাঠের সমান হবে। দৈর্ঘ্য, প্রস্থে, গভীরতায় যেন একই সমান। ঘাঘট এমনিতে অত প্রশস্ত নদ নয়। কিন্তু বুদুর দওয়ে এসে হঠাৎ যেন এর স্বাস্থ্য বিরাট বেড়ে গেছে। দেখলে মনে হয়, পদ্মা বা যমুনা থেকে এক অংশ কেটে এনে ঘাঘটে জোড়া দেওয়া হয়েছে। বর্ষাকালে নদ যখন পানিতে টইটম্বুর, তখন বুদুর দওয়ে স্রোত ঘূর্ণির মতো পাক খেত। ডিঙিনৌকা তো বটেই, বড় বড় নৌকার অভিজ্ঞ মাঝিরাও বুদুর দওয়ের ধারেকাছে যাওয়ার সাহস পেত না। এমনিতে ঘাঘট নদের পানি স্বচ্ছ। তলদেশের বালু ওপর থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু বুদুর দওয়ের তলদেশ দেখা তো দূরের কথা, কয়েক ফুট নিচেও সূর্যের আলো পৌঁছাত না। একটা গভীর কালো অন্ধকার সব সময় গর্তটাকে ঘিরে রাখত। দেখে মনে হতো, নদের বুকে একটা গভীর কালো ঘা।

‘গভীরতার কারণে নানা রকম মাছ বুদুর দওয়ে আশ্রয় নিত। উড়ুয়া, বৈরালি, চ্যালা, খলসে, পুঁটি, খাকিলা, ট্যাংরার মতো ছোট মাছ তো ছিলই, সঙ্গে বাগাড়, আইড়, চিতল, বোয়াল, রুইয়ের মতো বড় মাছ সেখানে পাওয়া যেত। ইজারাদারদের কাছে বুদুর দওয়ের মূল্য ছিল অন্য রকম।

‘আমি তখন জোয়ান। বয়স ৩০ কি ৩৫। আমি জেলের ছেলে। বাপ-দাদা সারা জীবন ঘাঘটে মাছ ধরেছে। আমিও ছোটবেলা থেকে খালি হাতে কি জাল পেতে কি বড়শি দিয়ে ঘাঘটে মাছ ধরে বড় হয়েছি। সাঁতার কাটতে পারি ঘড়িয়াল কি উদবিড়ালের মতো। কাছিমের মতো একবার দম নিয়ে সাত মিনিট পর্যন্ত ডুবে থাকতে পারি। বেড়জালে পালো ঘেরাও করে মাছ ধরায় আমি তখন ওস্তাদ। আট-দশজনের একটা দল ছিল আমাদের। আমিই তাদের নেতা। ঘাঘট ছাড়াও অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থদের পুকুরে মাছ ধরতে আমাদের ডাক পড়ত। মাছ ধরা আমাদের যেমন নেশা ছিল, তেমনি ছিল আমাদের জীবিকা।

‘সেবার অগ্রহায়ণ মাসে ইজারাদার মোজাফফর হোসেন আমাদের খবর দিয়ে পাঠালেন। বুদুর দওয়ের পালো তোলা হবে। আমরা যেন যাই।

‘আটজনের দল নিয়ে একটা ছোট্ট নৌকায় জাল ও মাছ ধরার অন্য সরঞ্জাম এককাট্টা করে ভোরবেলায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের দলের ক্ষিতীশদা খুব ঈশ্বরভক্ত মানুষ। তিনি বুদুর দওয়ে মাছ ধরা হবে শুনে পূজার সরঞ্জাম নিলেন। আমি খেটে খাওয়া মানুষ। ঈশ্বরে অত ভক্তি তখন ছিল না। গায়ের রক্ত গরম থাকলে ঈশ্বরকে কে স্মরণ করে? আমিও ছিলাম তাদের দলে। তবে ক্ষিতীশদাকে আমি বাধা দিইনি। তিনি যা ইচ্ছা করুন।

‘ঘণ্টাখানেক নৌকা চালিয়ে গা গরম হয়ে গিয়েছিল। বুদুর দওয়ে পৌঁছে দেখি, ইজারাদার হাজির হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে গ্রামের কৌতূহলী অনেক মানুষ। তারা মাছ ধরা দেখার জন্য ভিড় করে আছে। মনে মনে বিরক্ত হলাম। মানুষের হাউকাউ মাছের অপছন্দ। তারা শোরগোল যথাসম্ভব এড়িয়ে যেতে চায়। শব্দ পাওয়ামাত্র নীরবে সরে পড়ে। ভাগ্য ভালো নদের পানি অত্যন্ত কমে গেছে। কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও–বা কোমর ছুঁই ছুঁই করছে। শুধু বুদুর দওয়ে পানির তল নেই। সেখানে স্বচ্ছ পানিতে আকাশের ছায়া পড়ে সবুজ রং ধারণ করেছে।

‘মোজাফফর হোসেনকে আমরা চাচা বলতাম। তিনি একটা কাঠের হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে আমাদের কাণ্ডকীর্তি দেখতে লাগলেন। ক্ষিতীশদা পূজার থালা সাজিয়ে কিছু মন্ত্র পাঠ করে আমাদের সবার কপালে সিঁদুরের লাল টিকা লাগিয়ে দিলেন। কালো চামড়ায় লাল রং ভালো করে বোঝা যায় না। ক্ষিতীশদা বললেন, ওতেই কাজ হবে।

সেই মুহূর্তে হুদা তার চাচার কানে কানে কী যেন বলল। মোজাফফর চাচার মুখ নিমেষে যেন রক্তশূন্য হয়ে গেল। আনন্দের বদলে দেখা দিল ক্রোধ। নিশ্বাসের সঙ্গে যেন ঝরতে লাগল।

‘বুদুর দও আয়তনে এত বড় যে একটা পালো বসানো সম্ভব নয়। বরং দও ঘিরে ছয়-সাতটা পালো বসিয়েছিল মোজাফফর চাচার লোকেরা। আমরা জেলে মানুষ। পানিতে হাত দিলেই বুঝতে পারি কতটা ও কী কী মাছ আছে। নৌকায় বসে আমরা বেড়জাল খুলে তার নিচে সোতি জাল বিছালাম। ঘাঘট উড়ুয়া ও চ্যালার মতো ছোট মাছের জন্য বিখ্যাত। বেড়জালের ফাঁস গলে ছোট মাছ বেরিয়ে যায়। সে জন্য সাবধানতার জন্য সোতি জাল বিছানো।

‘প্রথম পালোতে আমরা ভালোই মাছ পেলাম। একটা সাড়ে তিন ফুটের বোয়াল মাছ দেখে মোজাফফর চাচার মুখে হাসি ফুটল। সেই সাথে কার্পিও পেলাম ছয়-সাতটা, একটা চিতল ও দুটি মাঝারি আকারের আইড় মাছ দেখে ভিড়ের মধ্যে আনন্দের হিল্লোল উঠল। এই মানুষগুলোর মাছ কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই। দর্শনসুখই তাদের বড় সুখ। বড় মাছ কখনো খেয়ে দেখেছে কি না, সন্দেহ। কিন্তু শান্ত, সবুজ ঘাঘটের এসব মাছের গল্প করে তাদের আগামী এক সপ্তাহ কাটবে। সবাই গল্পের ঝোলা ভরিয়ে নিতে চায়। অন্যদিকে মোজাফফর চাচার মুখের হাসি চওড়া হয়।

‘আমরা জেলেরা কিন্তু খুব সাধু নই। মাছ ধরে তখন মাছ দিয়েই মজুরি দেওয়া হতো। সেই মাছও কিনে নিত ইজারাদার। সামান্য কিছু পয়সার বিনিময়ে। বাবা মারা যাওয়ার পর আমি তখন সংসারের হাল ধরেছি। বিয়েথা করে সন্তানের বাবা হয়েছি। সামান্য পয়সায় আমাদের অন্ন জুটবে কোথা থেকে? এ জন্য প্রায়ই তক্কে তক্কে থাকতাম মাছ চুরি করার জন্য।

‘মাছ চুরির কৌশল খুব সহজ। পালোতে জাল বিছানোর জন্য চারপাশে খুঁটি পুঁততে হয়। দলের একজন জাল থেকে বড় মাছ সরিয়ে এক ডুবে খুঁটির সঙ্গে দড়ি দিয়ে মাছের কানকো বেঁধে রেখে আসে। মাছ ধরা শেষে যখন শেষ দর্শকটি চলে যায়, তখন নদীতে নেমে হাত সাফাইয়ের মাছগুলো তুলে আনা হয়। এই কাজে ঝুঁকি অনেক। অসংখ্য দর্শকের তীক্ষ্ণ চোখের সামনে কাজটা করা নেহাত সহজ নয়। হাত সাফাইয়ের কাজ জানা লোক ছাড়া চুরি করতে যাওয়া বিপদের। কারও চোখে ধরা পড়লে মজুরি তো কাটা যাবেই, বরং ইজারাদারের লোকদের হাতে মারধরের শিকার হওয়ার সমূহ আশঙ্কা আছে।

‘আমাদের দলের হয়ে কাজটা করত কালীপদ। সে আমার ছোটবেলার বন্ধু। একসাথে নদীতে ডুব দিয়ে আমরা বড় হয়েছি। পাশাপাশি বাড়ি বলে সারা দিন একসাথে চলাফেরা করি। তবে কালীপদ হাত সাফাইয়ে যতটা ওস্তাদ, ওর দম ততটা নেই। মোটে দেড় কি দুই মিনিটের বেশি সে পানির নিচে ডুবে থাকতে পারে না। অন্যদিকে আমি তখন এক ডুবে পানির নিচে পুরো সাত মিনিট কাটাতে পারি। সে জন্য কালীপদসহ অন্যরা আমাকে সমীহ করে। তবে পালো থেকে মাছ চুরি করতে বেশি দমের প্রয়োজন নেই। দরকার দর্শকের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। সেই কাজটা আমরা করতাম। কখনো জীবিত মাছ লোফালুফির কসরত দেখিয়ে, কখনোবা ডুবসাঁতারের পাল্লা দিয়ে।’

আরও পড়ুন

আমরা শুধু বেড়াজাল তুলেছিলাম। সোতি জাল পেতে রেখেছিলাম চুপ করে। তোলার চেষ্টাও করিনি। কিন্তু মোজাফফর চাচা পাকা লোক। সোতি জালের কথা ভোলেননি। তিনি আমাকে হাঁক দিয়ে বললেন, ‘কিরে হরি, ছোট মাছগুলা বাড়িত ধরি যাবু নাকি? জাল ক্যাম্বা তুলিস না?’

আমি জিব কেটে বললাম, ‘বাড়িত ধরি যামো ক্যান চাচা? জুইত করি বিছানু যাতে মাছ ভালোমতো আইসে। এলায় টান দেতোছোঁ জালত।’

কালীপদ বেড়াজাল থেকে একটা বড় মাছ সোতিতে পাচার করে দিয়েছিল। আমরা জাল গোটানোর প্রস্তুতি নেওয়ার মাঝেই সে পানিতে ডুবে মাছটা পাচার করল জালের বাইরে। চোখের পলকে বেঁধে ফেলল খুঁটির সঙ্গে।

ব্যাপারটা সবার দৃষ্টি এড়ালেও ইজারাদারের ভাতিজা হুদার দৃষ্টি এড়াল না। সোতি জাল তোলা পর্যন্ত সে চুপ করে রইল।

সোতি জাল টেনে ওঠাতেই উপস্থিত দর্শকদের মুখে বিস্ময়ের ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল। আমরা নিজেরাও বিস্মিত হলাম। এক পালোতে এতগুলো ছোট মাছ আগে কখনো পাইনি। জালটা ছোট মাছে সাদা হয়ে আছে। জীবিত, সদ্য পাকড়ানো মাছগুলো উন্মাদের মতো লাফাচ্ছে। ক্ষিতীশদা বিড়বিড় করে বললেন, ‘এক মণের কম হবে না।’

জাল ডাঙায় তোলামাত্র দর্শকেরা হই দিয়ে মাছ দেখতে লাগল। সবই দেশি মাছ। উড়ুয়া, চ্যালা, বৈরালি, কাকিলা ইত্যাদি। মোজাফফর চাচা উল্লসিত হয়ে বললেন, ‘আজকে তোদের জন্য বকশিশ আছে।’

সেই মুহূর্তে হুদা তার চাচার কানে কানে কী যেন বলল। মোজাফফর চাচার মুখ নিমেষে যেন রক্তশূন্য হয়ে গেল। আনন্দের বদলে দেখা দিল ক্রোধ। নিশ্বাসের সঙ্গে যেন ঝরতে লাগল।

তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘মুই দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করো চোরক। চুরির শাস্তি আল্লাহ ঠিক করছে হাত কাটি দেওয়া। যাতে চোর সাবধান হয়। মানুষও বোঝে যে এই লোকটা চোর।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘মুই তোমার কথা কিছু বোঝতোছো না চাচা মিয়া। কে চুরি করছে? কী চুরি করছে?’

মোজাফফর চাচা কালীপদর দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘এই কালীপদ চুরি করছে। মোর পালো থাকি মাছ মোক না কয়া নেছে।’

ইজারাদারের ইশারায় তার লোকজন নদে নেমে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা একটা সাত কেজি ওজনের পাঙাশ মাছ তুলে আনল। চুরি করা মাছ দেখে দর্শকের মুখে বিস্ময়ের ধ্বনি ফুটল। জেলেরা যে চোরের জাত, কীভাবে তারা চুরি করে, সেটিই এখন দর্শকের আলোচনার বিষয়। ছেলে-ছোকরাদের মুখে বিচারের দাবি খইয়ের মতো ফুটছে। মুহূর্তের মধ্যে এক মস্ত হাঙ্গামা শুরু হলো নদের পাড়ে।

ক্ষিতীশদা ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কালীপদকে বল মোজাফফর চাচার কাছে মাফ চাইতে।’

আমার বলার প্রয়োজন হলো না। কালীপদ নিজেই মাফ চাইল ইজারাদারের কাছে; কিন্তু পানি ততক্ষণে অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। উপস্থিত জনতা কোনোভাবেই ক্ষমা করতে চাইল না। তারা মাছ ধরা দেখতে এসে নাটকের গন্ধ পেয়ে গেছে। তারা আরও মজা দেখতে চায়।

কালীপদর শাস্তি ঠিক হলো, বুদুর দওয়ে ডুব দিয়ে তলদেশের মাটি তুলে আনতে হবে। তার আগে উঠে এলে তীর থেকে মোজাফফর সাহেবের চেয়ার পর্যন্ত নাকে খত দিয়ে যেতে হবে। সেই সঙ্গে এ বছর ঘাঘট নদে আমাদের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হবে।

আরও পড়ুন

মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। কালীপদকে আমার চাইতে বেশি কেউ চেনে না। ও মোটে দেড় কি দুই মিনিটের বেশি আজ অবধি পানিতে ডুবে থাকতে পারেনি। আজ বিচারের মুখে তার আত্মবিশ্বাস তলানিতে ঠেকেছে। চোখের ওপর ভয় ছায়া ফেলেছে। আজ পর্যন্ত কেউ বুদুর দওয়ের তলদেশ দূরে থাক, মাঝামাঝিও যেতে পারেনি। এতগুলো মারমুখী লোকের সামনে, শাস্তির খড়্গ মাথার ওপর নিয়ে বুদুর দওয়ের রহস্যভেদ করা তার পক্ষে অসম্ভব।

কালীপদর করুণ দৃষ্টি দেখে আমার মায়া হলো। চুরি সে নিজের জন্য করেনি। আমাদের সবার জন্য করেছে। মাছ বেচে যে কয়টা টাকা পাওয়া যেত, তার ভাগ আমরা প্রত্যেকে পেতাম। শাস্তি হলে আমাদের সবার হবে। এই নদ আমাদের শুধু জীবন নয়, জীবিকার জোগানও দেয়। এক বছর নদে নামতে না পারলে আমাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাবে। আমাদের খেত-খামার নেই। বাড়ি–ভিটাও নেই বললে চলে। গ্রামের সাহা কি চক্রবর্তী হলে হয়তো সব বেচে দিয়ে ওপারে চলে যাওয়া যেত। কিন্তু আমাদের সেখানেও ঠাঁই হবে না। ভগবানের পৃথিবীতে সর্বত্র ক্ষুধা আমাদের দিকে লাল চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টির বাইরে যাওয়ার সাধ্য আমাদের নেই।

মোজাফফর চাচাকে বললাম, ‘কালীপদর বদলে মুই বুদুর দওত নাইমবার চাও। অনেক দিন ধরিয়া মোর স্বপ্ন, এই দওয়ের তলত কী আছে দেখা। চাচা মিয়া, উয়ার বদলে মোক নামার অনুমতি দেন।’

ইজারাদার সরু চোখে আমাকে মেপে নিয়ে বললেন, ‘যাবার চাচ্ছিস যা। এই দওয়ের কিন্তু মেলা দুর্নাম আছে। তুই মাছুয়া মানুষ, খুলি কওয়ার কিছু নাই। কালীপদর পাপ যদি তুই মাথাত নিবার চাইস, তাইলে মোর কওয়ার কিছু নাই। মনে রাখিস, পাপ অয় করছে। তোর প্রতি মোর গোস্‌সা নাই।’

ক্ষিতীশদা পূজার থালা থেকে এক টুকরা বাতাসা আমার মুখে তুলে দিলেন। কালীপদর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তার দুই চোখ অশ্রুতে ছলছল করছে। হাজার হলেও ছোটবেলার বন্ধু। আমার প্রতি আগাগোড়া টান আছে। বুদুর দওয়ের মতো কুখ্যাত দওয়ে নামার বিপদ তার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।

ততক্ষণে নদের পাড়ে দর্শকের সংখ্যা কয়েক শ পেরিয়ে গেছে। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসছে মজা দেখার জন্য। জেলেদের মাছ চুরি ও শাস্তির গল্প দাবানলের মতো পাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা ভিড় করে আছে নদের পাড়ে। দমবন্ধ করে দেখছে হরি জেলের বুদুর দও অভিযান।

আমাকে একটা টেঁটা সঙ্গে নিয়ে নামার অনুমতি দেওয়া হলো। পানির নিচে পানিই প্রধান শত্রু। তার সামনে টেঁটার কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু তারপরও ক্ষিতীশদার কাছ থেকে টেঁটাটা পেয়ে আমার সাহস খানিকটা বাড়ল।

কালীপদ ভয়ে জড়সড় হয়ে ছিল। তাকে ডেকে বললাম, ‘চিন্তা করিস না। মুই ঠিক উঠি আসিম। ১০ মিনিটেও যদি উঠি আইসপার না পাও, তাইলে তোরা নামিয়া মোর লাশটা খুঁজি আনিস।’

কালীপদ ঠোঁট কামড়ে কেঁদে উঠল। আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘গোলাপির দিকে খেয়াল রাখিস।’

সে মাথা নেড়ে সায় দিল। গোলাপি আমার স্ত্রী। তীর থেকে বুকভরা দম নিয়ে বুদুর দওয়ে লাফানোর সময় তার কথাই শেষবার মনে পড়ল।

পানিতে ডুব দেওয়ামাত্র আমার শরীর হালকা হয়ে এল। আমি জেলের সন্তান, নদই আমাদের সব। পূর্বপুরুষের আত্মার কাছে সাহায্য চাইলাম প্রাণপণে। ধীরে ধীরে একটা ছোট্ট পাথরের টুকরার মতো বিশাল বুদুর দওয়ে ডুবে যেতে লাগলাম।

সূর্যের আলো কমতে লাগল। দওয়ের ভেতরটা সবুজাভ অন্ধকার। কিছুক্ষণ আমার কানে দর্শকের উল্লাসের রেশ লেগে ছিল। খানিক পর কেবলই নিস্তব্ধতা। পানির গভীরে একটা নিজস্ব শব্দ আছে। দুই কানে সেই শোঁ শোঁ শব্দ শুনতে পেলাম।

হাতের টেঁটাটা শক্ত করে ধরলাম। কোনো ভয় নেই। আমরা এই নদের সন্তান। আমরা কোনো অপরাধ করিনি। এই নদের ওপর আমাদের অধিকার সবচেয়ে বেশি। কতবার এই নদের পাড়ে আমরা জন্ম নিয়েছি, আবার এখানেই চিতায় জ্বলে ভস্ম হয়ে গেছি। অথচ সরকার এই নদে আমাদের অধিকার স্বীকার করে না। অর্থলিপ্সায় উন্মাদ হয়ে সামান্য পয়সার বিনিময়ে ইজারাদারের কাছে নদকে বিক্রি করে দিয়েছে। ভগবান সব জানেন। পালো থেকে মাছ চুরি করে আমরা অন্যায় করিনি। ওই সব মাছে আমাদেরও অধিকার আছে।

আরও পড়ুন

কতক্ষণ ধরে ডুবে আছি জানি না। ওপরের দিকে তাকালে আলোর ক্ষীণ রেখা দেখা যাচ্ছে। যেন একটা গোল বৃত্ত। তার বাইরে সবকিছু অন্ধকার। নিচে যেন কালিগোলা অন্ধকার ভয়ংকর রহস্য নিয়ে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কূলকিনারা নেই, যেন বিশাল একটা শূন্যের মধ্যে আমি উড়ে বেড়াচ্ছি। ডানার বদলে দুই হাত ঝাপটাচ্ছি আর উড়তে উড়তে কেবলই চলছি নিচের দিকে।

আমার দম কমে আসছে। চোখ খোলা রাখতে পারছি না। অনবরত পানি ঢুকে জ্বালা করছে। বাতাসের অভাবে মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না। বুকের ভেতরের ধুকপুক ধ্বনিটি যেন মাথায় উঠে এসেছে। অনবরত ঘড়ির মতো টিকটিক করে বাজছে। দুই কানে অসহ্য যন্ত্রণা হতে শুরু করল। বিশ্রী একটা পুঁউউ ধ্বনি কানের ভেতর একটানা বাজছে। আমার দুই ছেলের মুখ মনে পড়ল। সেই সঙ্গে গোলাপির মুখ। কখনো ওদের ভালো খেতে দিতে পারিনি। ভালো কাপড় পরাতে পারিনি। বাবা ও স্বামী হিসেবে আমি ব্যর্থ।

আমার শরীর নিস্তেজ হতে শুরু করেছে। হাত-পা পাথরের মতো ভারী হয়ে গেছে। একটা আঙুল নাড়াতে যেন প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাচ্ছে। শরীরের ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় কেবলই ডুবে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি জানি না।

চোখের সামনে মৃত্যুকে দেখতে পাচ্ছি। আহ্‌, এটাই বোধ হয় মরণ। চোখের সামনে মরা বাপ-মায়ের মুখ দেখতে পেলাম। ওরা আমাকে ডাকছে। একি! ওদের হাত-পা বাঁধা কেন? চোখমুখে সেলাই করা কেন? তারা যেন প্রাণপণে ইশারা করে আমাকে চলে যেতে বলছে। কোথায় যাব আমি?

ওপরের দিকে তাকালাম। আলো দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে ঘন, নিবিড় অন্ধকার। আমার মৃত বাবা, মা, ঠাকুরদা, ঠাকুরমা সবাইকে দেখতে পেলাম। আমার চারপাশে তারা ঘুরে ঘুরে প্রেতাত্মার মতো নাচছে। বড় নিয়ন্ত্রণহীন সেই নৃত্য। কে যেন তাদের পুতুলনাচের মতো নাচাচ্ছে। চোখেমুখে শঙ্কা নিয়ে তারা আমাকে ফিরে যাওয়ার জন্য আদেশ করছে।

আমার তখন শরীরের সব বায়ু বেরিয়ে গেছে। নিথর হয়ে আসছে স্নায়ু। শরীরে কোনো বোধ নেই। মৃত্যু বোধ হয় এমনই। শরীর নিঃসাড় হয়ে যেন দুর্গাপূজার মহিষাসুরের মূর্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।

হঠাৎ একরাশ আলোর ঝলকে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আমার চারপাশ স্পষ্ট দেখতে পেলাম। পানির ভেতরে যেন মাছের মতো দম নিতে পারছি। চারপাশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। ক্রমে ভারী হয়ে ওঠা হাত-পায়ে বল ফিরে পেলাম। ঠিক সে সময় দেখতে পেলাম মাছটাকে।

এমন মাছ আমি আগে কখনো দেখিনি। শুধু শুনেছি মাছটার গল্প। যুগের পর যুগ ধরে ঘাঘটের জেলে পরিবারগুলোতে এই মাছের গল্প কিংবদন্তির মতো ছড়িয়ে আছে। আমি আজ তাকে চাক্ষুষ দেখলাম। এ হলো বামুশ মাছ। কেউ কেউ বলে রাজ বাইম মাছ। পুরো পাঁচ ফুটের চেয়ে কম হবে না। ওজনে ১০-১২ কেজি হবে। প্রকাণ্ড অজগরের মতো পানিতে কিলবিল করে সাঁতার কাটছে।

আমার স্নায়ু উত্তেজনায় টান টান হয়ে গেল। মাথার ভেতরে চেপে বসা ভয় হালকা হয়ে কর্পূরের মতো উবে গেল। ডান হাতে টেঁটাটা শক্ত করে ধরে বামুশের পিছু নিলাম। বামুশ আমাকে দেখতে পেয়েছে। জানে সে, আমি তার বিপদের কারণ। প্রাণভয়ে মাছটা ছুটতে শুরু করল। আমি তার পিছু নিলাম দ্বিগুণ গতিতে।

শুরু হলো আমাদের লুকোচুরি। সে ডানে গেলে, আমিও ডানে যাই। বাঁয়ে গেলে, আমিও বাঁয়ে যাই। কখনো নিচুতে, কখনো ওপরে গিয়ে মাছটা জীবন রক্ষার চেষ্টা করছে। আমাকে যেন মাছ শিকারের নেশায় পেয়েছে। তলদেশের মাটি খোঁজার অভিযান ত্যাগ করে আমি কেবলই উন্মত্তের মতো মাছটার পেছন পেছন ছুটছি। টেঁটা বাগিয়ে অপেক্ষা করছি, কখন মাছটার বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করব।

অবশেষে সে মাহেন্দ্রক্ষণ এল। ছোটাছুটিতে মাছটা ক্লান্ত হয়ে এল। বিশ্রাম নিতে যে–ই না স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে, অমনি আমি সর্বশক্তি দিয়ে মাছটার মাথা বিদ্ধ করলাম টেঁটায়। আশ্চর্যের ব্যাপার, মাছটাসহ টেঁটা গিয়ে বিঁধল নরম মাটির সঙ্গে। আমি পেরেছি, আমি পেরেছি। বুদুর দওয়ের তলদেশের রহস্য ভেদ করেছি। টেঁটার সঙ্গে বামুশ মাছ ও এক খাবলা মাটি তুলে নিয়ে আমি চললাম ওপরের দিকে।

মনে আমার যুদ্ধজয়ের আনন্দ। ঈশ্বরের কৃপায় আজ অসম্ভবকে সম্ভব করেছি। প্রথম মানুষ হিসেবে বুদুর দওয়ের তলদেশে পৌঁছেছি। সেই সঙ্গে কিংবদন্তির বামুশ মাছ শিকার করেছি। ঘাঘটের পাড়ে পুরো গ্রামে আমার নাম ছড়িয়ে পড়বে। জেলেপাড়ার খুপরি ঘরগুলোতে আমার নামে গান বাঁধা হবে। সর্বোপরি, ইজারাদার মোজাফফর সাহেবের মুখ বন্ধ হয়ে যাবে। জলের ওপর জেলের অধিকার যে সবার আগে।

পানির ওপরে ভেসে উঠতেই লোকজনের আতঙ্কিত মুখ দেখতে পেলাম। আমি এক হাতে তলদেশের মাটি ও আরেক হাতে টেঁটায় বিদ্ধ বামুশ মাছ তুলে দর্শককে দেখালাম। কেউ যেন আমাকে লক্ষই করল না। বুদুর দওয়ের ওপর অনেকগুলো ডিঙিনৌকা কী যেন খুঁজছে। সবার মনোযোগ নৌকাগুলোর দিকে। এক প্রান্তে আমার দিকে কারও মনোযোগ নেই।

চিৎকার করে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করলাম। দর্শক ও জেলেরা আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। ভিড়ের মধ্য থেকে আতঙ্কিত গোঙানি শোনা গেল। আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, ‘কী হইলো? মোক দেখি তোরা ভয় পান কীসক?’

সাহস করে ক্ষিতীশদা আমাকে পানি থেকে টেনে তুলল। আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ভগবানের কৃপা, তুই ফিরি আসছিস। হামরা মনে করছি, তুই আর বাঁচি নাই। পানির নিচত কাঁইও এক দিন বাঁচি থাইকপার পারে?’

আমি বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। বললাম, ‘এক দিন মানে? মুই না একনা আগে ডুব দিছনু। কিসের এক দিন? মোর সাথে মজাক করেন?’

ক্ষিতীশদা বললেন, ‘মজাক নয়রে। তোর বউ-ছাওয়ার ভিতি দেখ।’

আমি অবাক হয়ে গোলাপি ও আমার ছেলের দিকে তাকালাম। গোলাপির পরনে সাদা শাড়ি। হাতে শাখা নেই। সিঁথিতে সিঁদুর নেই। ছেলে দুটি এখনো মাথা কামায়নি। তবে পিতৃবিয়োগের শোকে তারা পাথর হয়ে গেছে।

আমি দৌড়ে গিয়ে গোলাপি ও বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরলাম। ততক্ষণে ভিড় আবারও বাড়তে শুরু করেছে। হরি জেলের লাশ দেখতে যারা দূরদূরান্ত থেকে এসেছিল, ডুব দেওয়ার এক দিন পর জীবিত হরিকে ফিরে পাওয়ার গল্প তারা দ্বিগুণ গতিতে ছড়িয়ে দিচ্ছে। মানুষের ঢল নেমেছে বুদুর দওয়ের পাড়ে।

ইজারাদার মোজাফফর চাচা এসে আমার হাত ধরে মাফ চাইলেন। আমার পুরো শরীর কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে তার হাতে কাদা লেপটে দিয়ে বললাম, ‘এই নেন আপনার কাদো। বুদুর দওয়ের তল থাকি তুলি আনছি।’

উপস্থিত দর্শক ততক্ষণে আমাকে ঘিরে ফেলেছে। আমাকে ঘিরে তাদের বৃত্ত ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে। তাদের চোখেমুখে বিস্ময়। নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো তারা হাঁ হয়ে আমাকে দেখছে। তাদের চমকে দিতে আমি টেঁটাটা শক্ত করে ধরলাম। মিছিলের মশালের মতো সর্বশক্তি দিয়ে তুলে ধরলাম টেঁটাবিদ্ধ বামুশ মাছটা। বিস্মিত, আনন্দিত জনস্রোত যেন কিছুক্ষণ বাক্‌রুদ্ধ হয়ে রইল। তারপর চিৎকার করে উঠল তুমুল আনন্দে।’

গল্পটা শেষ করে বৃদ্ধ থামল। আওলাদ মিয়া মুগ্ধ হয়ে হরি বুড়োর দিকে তাকিয়ে রইল। মাঝেমধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত জায়গায় এমন সব গল্প শোনা যায়, যেগুলো তার হোটেলের আড্ডায় শোনা যায় না। সে বুড়োকে বলল, ‘আপনার গল্প শুনে বুদুর দও দেখতে যেতে ইচ্ছা করছে। আমাকে নিয়ে যাবেন?’

বুড়ো হরেশ্বর দাস কিছুক্ষণ হেসে বলল, ‘বুদুর দও কি আর আছে? ১৯৮৮ সালের বন্যাত হঠাৎ ঘাঘটত বান ডাকিল। দুনিয়ার সব পলি পড়ি বুদুর দও হয়া গেল ভরাট। এখন দেখলে আর কিছু বুঝবার পাবার নন।’

সুকুমার ও শারমিনকে আল ধরে হেঁটে আসতে দেখা গেল। শারমিনের মুখে হাসি। খাওয়ার জন্য ইঁদুর ধরা দেখে খুব আনন্দ পেয়েছে বোঝা যাচ্ছে। আওলাদ মিয়া বৃদ্ধের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে শেষ প্রশ্নটা করল, ‘আপনার পর আর কেউ বুদুর দওয়ে তলদেশে যায়নি?’

হরি বুড়ো শূন্য চোখে আওলাদ মিয়ার উঠে যাওয়া দেখে বলল, ‘না। কেউ আর সাহস পায় নাই। অতগুলা মাছ পাওয়ার পরও ইজারাদার আর কোনো সমে বুদুর দওত পালো বসায় নাই।’

শারমিন দৌড়ে এসে আওলাদ মিয়াকে জড়িয়ে ধরল। মাঠে কী কী দেখছে, তা-ই বর্ণনা করতে শুরু করল। বুড়োর কাছে বিদায় নিয়ে আওলাদ চলল বিয়েবাড়ির দিকে। তার চোখে আর এক ফোঁটাও রাত জাগার ক্লান্তি নেই।

আরও পড়ুন