কুয়াশায়

অলংকরণ: রিদম

‘…ভোর চারটা থেকেই ঢাকা পড়েছে রাস্তাঘাট, হোটেল-মোটেল, সৈকত—সবকিছু। কুয়াশা এ রকম হতে পারে, কোনো ধারণাই ছিল না কক্সবাজারের মানুষের। শীতে কুয়াশা পড়বে, লোকে উঠানে বসে খেজুরের রস খাবে, ভাপা পিঠায় ফুঁ দিয়ে কায়দা করে খেতে চেষ্টা করবে—এমনটাই শীতের স্বাভাবিক চিত্র। কিন্তু গতকাল ভোররাত থেকে কুয়াশার নামে যা দেখা যাচ্ছে, এর অপর নাম আতঙ্ক হলেও অবাক হব না…ইতিমধ্যে ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল। এ মুহূর্তে ঘড়ির কাঁটায় সময় বিকেল চারটা। ১২ ঘণ্টা হতে চলল। তবে শহরের অনেক জায়গায় দেখা যাচ্ছে, তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোরেরা বেশ উপভোগ করছে বিষয়টি। কারণটা আর কিছুই না। দীর্ঘদিন পরে কুয়াশার অজুহাতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সবকিছু এক দিনের জন্য আজ বন্ধ ছিল...’

রেডিও বন্ধ করল ইলোরা।

ওদের স্কুলের একটু সামনেই এখানকার একমাত্র বইয়ের দোকানটা। ওরা ছোট থেকেই দেখে আসছে একটুকরো খোলা জায়গা আর গোটা বিশেক বড় বড় গাছ নিয়ে ছায়াঘেরা এই মায়াবী বইয়ের দোকান—সোলারিস।

সারা দিন ধরেই এ ধরনের খবর চলছে রেডিওর চ্যানেলে চ্যানেলে। স্কুল বন্ধের সুযোগে অনেকে বাইরে টো-টো করলেও ইলোরা ঘরে বন্দী। বাবা কিছু বলেননি, কিন্তু মা একদম মার্শাল ল জারি করেছেন। কাজেই ঘরে বসে খবর শুনে আর বই পড়ে সময় কাটছে।

‘এই নে চা।’ সন্ধ্যায় আর সকালে মায়ের নিয়ম করে চা খাওয়া চাই। আর ইলোরা দুবেলাতেই পার্টনার।

চা নিয়ে জানালার পাশে প্রিয় চেয়ারটায় এসে বসে ইলোরা।

স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা আর কদিন পরেই।

কক্সবাজারে পর্যটন সিজনও শুরু আর কদিন পরে। পুরো শহর তৈরি হচ্ছিল সেটার জন্য, এর মধ্যেই শুরু হলো এই কাণ্ড।

ইলোরাদের বাড়িটা সৈকতের ওপর, ছোট্ট একটা পাহাড়ের গায়ে। একসময় সরকারি রেস্টহাউস ছিল। পরে নিলামে ওর বাবা আফজাল সাহেব এটা কিনেছেন। মাত্র তিনজন প্রাণী ওরা। কাজেই সিজনে ভদ্র কাউকে গেস্ট হিসেবে পেলে ওরা ভাড়াও দেয়। আয় খারাপ না।

এখন এই কুয়াশা যদি সিজনজুড়ে থাকে, তাহলে আর দেখতে হবে না…

আরও পড়ুন

এই জানালাটা খুব প্রিয় ইলোরার। সাগরের বুকে অনেক দূরের নৌকাগুলো পর্যন্ত দেখা যায় এখানে থেকে। আজ কিচ্ছু না…স্রেফ কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। এক্কেবারে নিরেট কুয়াশা!

অজানা আশঙ্কায় বুকটা ধক করে উঠল মেয়েটার।

৪৮ ঘণ্টা পার হওয়ার পর আতঙ্ক কী জিনিস, টের পেল কক্সবাজারের মানুষ।

সারা দেশে তো বটেই পৃথিবীর বড় বড় দেশেও হইচই পড়ে গেছে ব্যাপারটা নিয়ে। সামুদ্রিক অঞ্চলে এমনিতেই কুয়াশা হয়। কিন্তু এ রকম টানা দুই দিনব্যাপী কুয়াশায় চারদিক ঢাকা পড়ে যাওয়ার ঘটনা ইতিহাসে প্রথম।

রাস্তাঘাট ফাঁকা। বাড়িঘর থেকে কেউ বের হচ্ছে না।

টুঁ শব্দ নেই কোথাও। মনে হয় হঠাৎ করে গোটা শহরটা যেন হারিয়ে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে। ঘোলা একটা চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে যেন অনেক ওপর থেকে।

পেট্রলপাম্প দুদিন ধরে শূন্য। একটা গাড়িও আসেনি।

সারা দিন ঝিমিয়ে কাটিয়ে লোকমান যখন ঘড়িতে দেখল রাত সাড়ে নয়টা বাজে, তখন মনে মনে কাকে যেন গালাগালি করতে করতে পাম্পের সব বাতি নিভিয়ে দোতলায় চলে এল। এখানেই ছোট্ট একটা কামরায় ও ঘুমায়।

এখন দিন আর রাত সমান। রাত সাড়ে নয়টা যা, সকাল সাড়ে দশটাও তা।

বিছানায় শোবার পর কেটে গেল এক ঘণ্টা। ঘুম আসার নাম নেই।

আগাগোড়া লেপমুড়ি দিয়ে চোখ বুজে পড়ে থেকেও ফায়দা হচ্ছে না।

২৪ বছর ধরে এই শহরে বাস করে লোকমান। এই পাম্প আগে চালাত ওর বাবা। ২৪ বছর ধরে চালাচ্ছে ও। এ রকম কবরসম নিস্তব্ধতা কখনো দেখেনি লোকমান। মনে হচ্ছে রাস্তায় একটা পলিথিন উড়ে গেলেও বুঝি শোনা যাবে।

এর মধ্যে শুরু হয়েছে আরেক যন্ত্রণা। থেকে থেকেই কোথা থেকে যেন জাহাজের ভেঁপুর মতো শব্দ ভেসে আসছে। ইংরেজিতে যাকে বলে ফগহর্ন। এই গাঢ় কুয়াশায় অজানা-অদেখা জায়গা থেকে ভেসে আসা এই গুরুগম্ভীর শব্দে বুকে ধাক্কার মতো লাগে।

আজ সারা দিনে কম করে হলেও ২৫-৩০ বার বেজেছে এই হতচ্ছাড়া শব্দ।

লোকমানের একটু পরপর মনে হচ্ছে, গোটা কক্সবাজারে ও ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই। আচ্ছা, বাকি সবার কি একই কথা মনে হচ্ছে?

ফগহর্নটা যখন থেমে যায় তখন আবার কবরের নিস্তব্ধতা নেমে আসে। এ কারণেই নিচতলায় জানালার কাচ ভাঙার শব্দটা বোমা ফাটার মতো কানে বাজল লোকমানের। মুহূর্তে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসল ও।

চোর!

এই কুয়াশায় যদি সত্যিই কেউ চুরি করতে বেরিয়ে থাকে তবে সম্মানস্বরূপ তাকে এমনিতেই কিছু দিয়ে দেওয়া উচিত।

অন্ধকারে টর্চটা দরকার। চট করে হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে দিল ও। কিন্তু… তবু অন্ধকার।

মানে বিদ্যুৎ চলে গেছে।

আরও পড়ুন

এবার একটু ভয় পেল লোকমান। অন্ধকারে চোরের মুখোমুখি হওয়া কি ঠিক হবে?

পরমুহূর্তেই মনে পড়ল, ক্যাশে টাকা আছে। প্রায় ৯ হাজার। দ্রুত জুতা পায়ে দিয়ে টর্চ হাতে নিয়ে নামল লোকমান। টেবিলের ওপরেই পাওয়া গেছে ওটা, ভাগ্যিস।

লোকমান তখনো জানে না নিচতলা ছেয়ে গেছে আদিম, গাঢ়, অভিশপ্ত এক সামুদ্রিক কুয়াশায়…

পরদিন সকাল সাতটার পর থেকে কুয়াশা কেটে গিয়ে ঝকঝকে রোদ উঠল। স্কুল-কলেজ না খুললেও রাস্তায় জনমানুষের চলাচল দেখা যাচ্ছে। একত্র হয়েছে ইলোরা, রোমানা, রবিন, আলমাস আর জেরিন। ঘড়িতে বেলা দুইটা বাজে।

ওদের স্কুলের একটু সামনেই এখানকার একমাত্র বইয়ের দোকানটা। ওরা ছোট থেকেই দেখে আসছে একটুকরো খোলা জায়গা আর গোটা বিশেক বড় বড় গাছ নিয়ে ছায়াঘেরা এই মায়াবী বইয়ের দোকান—সোলারিস।

এখানেই একত্র হয়েছে বইয়ের পোকা এই খুদে দলটা।

‘পেট্রলপাম্পের লোকমান সাহেবের মুণ্ডু ধড় থেকে আলাদা করে ফেলেছে কে যেন। শুনেছিস?’ আইসক্রিম খেতে খেতে এমনভাবে খবরটা দিল রবিন, যেন বাংলাদেশ টেস্ট সিরিজ জিতে গেছে।

‘একফোঁটা রক্তও নেই কোথাও।’ গম্ভীর সুরে বলে জেরিন। ওর বাবা সাংবাদিক। অনেক গোপন খবর আসে ওর কাছে।

দোকানের এক কোণে বসে বই পড়ার জন্য সুন্দর ব্যবস্থা। ওখানেই বসেছে ওরা।

‘আরও তিনটা মার্ডার হয়েছে। তোমরা জানো কেউ?’ চশমা চোখে আলমাস প্রশ্ন করেছে। জেলা পুলিশের বড় কর্তা ওর বাবা আয়নাল হক।

‘সত্যি? কই শুনিনি তো...’

‘ডিটেইলস জানো তুমি?’

একসঙ্গে প্রশ্ন করে ইলোরা, জেরিন, রোমানা।

‘খ্রিষ্টানদের যে গোরস্তানটা আছে হিমছড়ির ওখানে, ওটার কেয়ারটেকার পল আঙ্কেলের লাশ পাওয়া গেছে। মাথা নিচে আর পা ওপরে দিয়ে ঝোলানো ছিল একটা পুরোনো গাছের সঙ্গে।’ আঁতকে উঠে ঢোক গিলল বাকিরা। ‘হলি চিলড্রেন স্কুলের প্রিন্সিপাল ইসমাইল স্যারের দেহ পাওয়া গেছে সাগরসৈকতে। কী যেন ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গেছে। চোখ, নাক, ঠোঁট—কিচ্ছু নেই। উঁহ!’ মুখ বাঁকায় আলমাস।

‘কী সাংঘাতিক। টরমেন্টিং!’ শব্দটা বড় আপুর কাছে শুনেছে রোমানা। এর মানে কি জঘন্য যন্ত্রণাদায়ক।

‘বাবা আজ সকালে আমাকে একটা বই পড়তে বলল। জানি না কেন। কিন্তু বাবার কথা শুনে মনে হলো এই বইটায় আমাদের জন্য—’

কথা শেষ করতে পারে না রবিন। ওর বাবা বিখ্যাত থ্রিলার রাইটার। একনামে চেনে দেশের মানুষ।

‘নাম বল। জলদি।’ হুড়ো দেয় রোমানা আর আলমাস। বইয়ের বেলায় ওদের আগ্রহ সীমাহীন। রহস্যের বই পেলে তো কথাই নেই।

‘দাঁড়াও একটু তোমরা।’

একটু খুঁজেই শেলফ থেকে একটা বই নামিয়ে আনে রবিন।

আরও পড়ুন

উঁকি দিয়ে সবাই ওরা বইয়ের নামটা পড়ল—শত বৎসর পরপর।

‘কী অদ্ভুত নাম…’

‘গল্পের বই নাকি ইতিহাস?’

‘এটা কার লেখা?’

‘কী হবে রে এই বই পড়লে?’

রবিন ছাড়া সবাই-ই প্রশ্ন করতে থাকে একে একে।

‘ভূমিকায় কিছু কথা লেখা আছে। পড়ি—’

শুরু করে রবিন, ‘বইটি যখন ছাপা হচ্ছে, তখন ১৯৮৩ সাল। পৃথিবীর নানা জায়গায় গত ১০০ বছরে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে এই বইয়ে। ঘটনাগুলো মোটেও প্রীতিকর নয়। নিতান্তই কিছু অমানবিক, কুৎসিত, ঘৃণ্য ও জঘন্য ঘটনা। নিতান্তই অন্যায় অবিচারও বলা যায় এবং এসবের কোনো বিচারও হয়নি। লোকমুখে ও শতবর্ষীয় একাধিক সূত্রমতে জানা যায়, এসব ঘটনার প্রতিফলন সেসব জায়গায় আগামী ১০০ বছর পর ঘটবে। আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় তাই চেষ্টা করলাম সেসব অঞ্চল ও সেখানে ঘটে যাওয়া ঘটনার একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা এই বইয়ে উল্লেখ করতে। কারণ, সামনের বছরই পূর্ণ হতে যাচ্ছে সেই শত বৎসর। সময় ঘনিয়ে আসছে সেই অদৃশ্য প্রতিশোধের…’

ঠিক এ সময় বিদ্যুৎ চলে গেল।

চমকে উঠে মেয়েরা একে অন্যের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে আর চোখ ফেরাতে পারছে না বইটার ওপর থেকে।

‘…সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী আজ বিকেল চারটা থেকে আবার কুয়াশায় সব ঢাকা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। ইতিমধ্যে আমাদের উপকূলীয় বেশ কিছু অঞ্চল কুয়াশায় ছেয়ে গেছে…সময় থাকতে সবাইকে যার যার জায়গা থেকে নিরাপদ স্থানে সরে পড়তে অনুরোধ করা হচ্ছে…বিশেষ ঘোষণা…’

সোলারিসের মালিক ফারুক আঙ্কেলের ব্যাটারিচালিত রেডিও পৌঁছে দিল এই সতর্কবাণী।

পাঁচ জোড়া চোখ একত্রে চাইল বাইরের দিকে। ইতিমধ্যে আবারও চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করেছে। মায়ের কথা মনে পড়ল ইলোরার।

‘কী হলো রবিন, থেমে গেলে কেন? দ্রুত তালিকা দেখে বের করো আমাদের এ অঞ্চল সম্পর্কে কী বলা হয়েছে…তোমার বাবা কীভাবে যে এই বইয়ের নাম জানলেন…’ তাগাদা দিল আলমাস। ওর চশমার ওপাশে চোখ দুটি ইয়া বড় দেখাচ্ছে।

দ্রুত পাতা উল্টাচ্ছে রবিন…অধীর আগ্রহ আর ভয় মেশানো উত্তেজনায় ঠকঠকিয়ে কাঁপছে বাকি চারটা ছেলেমেয়ে...এই সময় আবার ফগহর্ন।

গুরুগম্ভীর, ভৌতিক, আতঙ্ক-জাগানিয়া অভিশপ্ত ফগহর্ন কাঁপিয়ে দিয়ে গেল ছোট্ট শহরটা। বইয়ের দোকানের জানালাগুলোও কেঁপে উঠেছে।

পড়তে শুরু করল রবিন—

‘১৮৮৪ সালে কক্সবাজারের এক সৈকতে ভিড়েছিল আল্পস নামে এক বিদেশি জাহাজ। কী এক অজানা রোগে জাহাজের অনেকেই মারা গেছে। অল্প কজন শিশু আর নারীসহ ২৫ জন যাত্রী তখন জীবিত। তবে এরাও ধুঁকছে। দরকার বিশুদ্ধ পানি আর পুষ্টিকর খাবার। নিরাপদ আশ্রয়ে কটা দিন বিশ্রাম। কিন্তু সেসব দেওয়া তো দূরের কথা নিহতদের দেহগুলো পর্যন্ত দাফন করতে দেয়নি এই অঞ্চলের মানুষ। একফোঁটা পানি বা খাবার না দিয়ে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল জাহাজটা ওরা। সেই রাতেই মারাত্মক ঝড়ে পড়ে এখানেই ডোবে আল্পস। শিশুগুলোর মৃত্যু বড় মর্মান্তিক আর…’

পড়া থামিয়ে হঠাৎ মুখ তুলে আশপাশে কাউকেই দেখতে পেল না রবিন। কোথায় বইয়ের দোকান? ওর বন্ধুরা সব কোথায়?

সব ঢেকে গেছে ঘন কুয়াশায়….

আরও পড়ুন