মিশুর মেজাজ খারাপ। বেশ খারাপ। স্কুলে যাচ্ছে। স্কুলে আজ না গেলেই বোধ হয় ভালো ছিল। কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই। তার সায়েন্স প্রজেক্টের খাতাটা—যেখানে সুন্দর করে ছবি এঁকে দেখানো হয়েছে আগ্নেয়গিরি কীভাবে কাজ করে...ইত্যাদি, সেই খাতাটা ভুল করে ক্লাসে ফেলে এসেছে সে। সেটা সংগ্রহ করতে হবে। না করে উপায় নেই; কারণ, আগামী সপ্তাহে স্কুলে সায়েন্স ফেয়ার শুরু হবে। বিভিন্ন জেলার বারোটা স্কুলের ছেলেমেয়েরা সবাই তাদের সায়েন্স প্রজেক্ট নিয়ে আসবে। আর আজ মিশুদের স্কুল থেকে কার কার সায়েন্স প্রজেক্ট যাবে আর কারটা যাবে না, সেটা ফাইনাল করবেন মালেক স্যার। তিনিই এই কমিটির প্রধান। যদিও তিনি পড়ান ইতিহাস। বিজ্ঞানের বি–ও জানেন না। কিন্তু কায়দা করে বিজ্ঞান স্যারকে বাদ দিয়ে তিনি কমিটির প্রধান হয়ে বসে আছেন। শুধু তা–ই না, বেছে বেছে মিশুর প্রজেক্টটাই তিনি বাদ দিয়ে দিয়েছেন। কেন বাদ দিয়েছেন, বেশ বুঝতে পারছে মিশু। স্যারের একটা ব্যাপারে একবার হালকা একটু প্রতিবাদ করেছিল সে। তাতেই সে এখন স্যারের ব্যাড লিস্টের ১ নম্বরে। তা ছাড়া এই স্যার স্কুলে বেশ প্রভাবশালী। কারণ, স্কুল কমিটির চেয়ারম্যান তাঁর মামা।
মিশুর প্রতিবাদটা কিন্তু খুবই যুক্তিযুক্ত ছিল। সেদিন স্কুল ছুটির পর স্কুলের লাইব্রেরিতে ঢুকতে যাচ্ছিল সে। তখন মালেক স্যার তাকে আটকালেন!
‘এই কই যাস?’
‘স্যার, লাইব্রেরিতে।’
‘কেন?’
‘স্যার, একটা বইয়ের শেষ দুই পাতা পড়া বাকি আছে, ওটা শেষ করব ভাবছিলাম।’
‘কী বই?’
‘হাকলবেরি ফিনের দুঃসাহসিক অভিযান।’
‘কার লেখা?’
‘স্যার, মার্ক টোয়েন।’
‘ও, বিদেশি লেখকের আজগুবি বই পড়তে খুব ভালো লাগে, না? কেন দেশের লেখকদের বই পড়তে পারো না?’
‘পড়ি তো স্যার। আমাদের লাইব্রেরিতে দেশের সব লেখকের সব বই পড়া শেষ।’
‘আমার লেখা আত্ম উন্নয়নের ১০১টি জরুরি পন্থা বইটা পড়েছিস?’
‘অ্যাঁ...ইয়ে স্যার, ওই বইটা তো মানে...মানে...’
‘আর মানে মানে করতে হবে না। গেট আউট...!’
সেই শুরু। তারপর একদিন স্যারের ক্লাসে ব্ল্যাকবোর্ডে কে যেন লিখে রেখেছিল ‘আত্ম উন্নয়নের ১০১টি জরুরি ডিগবাজি’। ব্যস, তারপর তো কেয়ামত শুরু হয়ে গেল ক্লাসে। স্যারের ধারণা, এই কাজ মিশুই করেছে। যাহোক, এগুলো নিয়ে মিশু আর ভাবতে চায় না।
স্কুলের গেটে এসে অবাক হলো মিশু। স্কুলের গেটে বেশ বড়সড় একটা চায়নিজ তালা ঝুলছে। দারোয়ান চাচা গেটের সামনে একটা টুলে বসে চোখ বন্ধ করে কান চুলকাচ্ছেন।
‘স্কুল বন্ধ নাকি আঙ্কেল?’
‘স্কুল বন্ধ হইব ক্যা?’ চোখ না খুলেই উত্তর দিল দারোয়ান চাচা।
‘কেউ নেই, আপনি একা বসে আছেন। গেটে তালা মারা।’ এবার দারোয়ান আঙ্কেল চোখ খুলে লম্বা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
‘ক্যা? কিছু হুনো নাই?’
‘কী শুনব?’
‘আমগো ইস্কুলে বাঘ ঢুকছে!’
‘কী বলছেন?’
‘হ, ঠিকই কইতাছি। তোমগো সেভেন বি ক্লাসে একটা আলিশান বাঘ বয়া আছে।’
‘বলেন কী!’
‘হ...যাও বাড়ি যাও। একটু বাদে পুলিশ, দমকলের লোক, সাম্বাদিকেরা সব আয়া পড়ব। হুনছি ঢাকা থাইকাও বাঘ ধরার ইস্পিশাল লোকজন আইতাছে।’
‘সত্যি বলছেন?’
‘হ হ, সত্য কইতাছি বাড়ি যাও। এইখানে ভিড় কইরো না।’
মিশু অবশ্য বাড়ি গেল না। সে স্কুলের পেছনে এসে দাঁড়াল। এখানে কাঁটাতার ছেঁড়া আছে বেশ কয়েক জায়গায়, এদিক দিয়ে দিব্যি স্কুলে ঢোকা যায়। যারা নিয়মিত স্কুল পালায়, তারা এদিক দিয়ে চম্পট দেয় মাঝে মাঝেই। মিশুও এক–দুবার চম্পট দিয়েছে।
মিশু চট করে ছেঁড়া কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ে, তারপর সাবধানে সেভেন বি ক্লাসের জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। এটা তাদেরই ক্লাস। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল কোথায় বাঘ কোথায় কী! দেয়ালে একটা নিরীহ টিকটিকি বসে আছে। সে জানালা টপকে ভেতরে এসে একদম জমে গেল। তার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। হ্যাঁ...কোনো সন্দেহ নেই, ঠিক তার সামনে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে একটা বিশাল ডোরাকাটা বাঘ...দ্য রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
‘এই ছেলে এখানে কী?’ কথাটা কে বলল, তা বুঝতে একটু সময় লাগল মিশুর। ‘কথা আমিই বলছি।’ বলল বাঘটা।
‘আ-আপনি মানুষের মতো কথা বলতে পা-পারেন?’ কথা আটকে গেল মিশুর।
‘হ্যাঁ, পারি তো। এখানে এসেছ কেন?’
‘আ-আমার সায়েন্স প্রজেক্টের খাতা নিতে।’
‘আচ্ছা, নিয়ে বিদেয় হও। আর যাওয়ার সময় ফ্যানটা একটু বাড়িয়ে দাও। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে এখানে এসেছি। পাহাড়ের জঙ্গলে আর টেকা যাচ্ছে না।’
‘ইয়ে বা-বাঘ আ-আঙ্কেল। এটা আমাদের ক্লাস তো, আমি জানি এই ফ্যান আর বাড়বে না। আপনার বেশি গরম লাগলে মালেক স্যারের রুমে চলুন, ওখানে এসি আছে।’
‘মালেক স্যার তোমাদের হেডস্যার নাকি?’
‘জি না। হেডস্যারের রুমে এসি নেই।’
‘এটা কেমন কথা? হেডস্যারের রুমে এসি নেই, মালেক স্যারের রুমে এসি!’
‘মালেক স্যার খুব প্রভাবশালী। ওনার মামা স্কুল কমিটির চেয়ারম্যান, তাই...’
‘বুঝেছি। ঠিক আছে আমাকে ওনার রুমটা দেখিয়ে দাও।’
‘জি চলেন, আমারও ওনাকে দরকার একটু। অবশ্য স্যার রুমে আছেন কি না। আপনি এসেছেন শুনে স্কুল তো একেবারেই খালি। মেইন গেটে তালা মারা। কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না।’
‘তাই নাকি? সবাই কি জেনে গেছে আমি তোমাদের স্কুলে?’
‘জি আঙ্কেল।’
‘কী মুশকিল।’ মিশুর অবশ্য ভয়টা এখন আর নেই। কথা বলা বাঘটাকে বেশ ফ্রেন্ডলি মনে হচ্ছে। বাঘটা মানুষের মতো দিব্যি কথা বলছে কী করে, এটা জানতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু বেশি প্রশ্ন করা ঠিক হবে না হয়তো।
বাঘ আর মিশু মালেক স্যারের রুমের সামনে এসে দেখে স্যারের রুমের দরজা খোলা। খোলা দরজা দিয়ে দিব্যি এসির ঠান্ডা হাওয়া আসছে। ভেতরে মালেক স্যারের গলা শোনা যাচ্ছে। তিনি রীতিমতো চেঁচাচ্ছেন—
‘অ্যা? কে এসব গুজব রটিয়েছে? স্কুলে বাঘ ঢুকেছে? আমি তো আমার রুমে বসে আছি...কোথায় বাঘ? একটা মেনি বিড়ালও তো দেখলাম না। যত সব ফালতু কথা...আজ স্কুল কমিটির সায়েন্স ফেয়ারের ফান্ড নিয়ে জরুরি মিটিং...আর আজ কিনা...’
এই সময় মাথা ঢোকাল মিশু।
‘স্যার?’
‘কে? এই ছোঁড়া এখানে কী?
‘স্যার, আমার সায়েন্স প্রজেক্টটা যদি একটু বিবেচনা করতেন...’
‘শাটআপ! যত সব ফালতু...বেরো বলছি...’
এই সময় বাঘ আঙ্কেল আস্তে করে রুমে ঢুকে ঘ্রাউক করে একটা হুংকারও দিল। বাইরে গরম বোধ হয় তার সহ্য হচ্ছিল না। মালেক স্যারের হাত থেকে রিসিভারটা ছিটকে পড়ল। স্যার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর ‘বাপ রে!’ বলে লাফ দিয়ে ঢুকে গেলেন তাঁর অ্যাটাচড রুমের অ্যাটাচড টয়লেটে। ঢুকে ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন। বাঘ আঙ্কেলও লাফ দিয়ে টেবিলের ওপর উঠে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। তার দুই থাবার মাঝখানে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বলল—
‘এই ছেলে, তোমাকে ধন্যবাদ। কী যেন নাম তোমার?’
‘জি...মিশু।’
‘মালেক স্যারের এসি ঘরে নিয়ে আসার জন্য। তবে তোমাদের মালেক স্যার লোকটা সুবিধার না মনে হচ্ছে। টয়লেটে ঢুকে আবার পটল তুলল না তো!’ মিশু টয়লেটের কাছে গিয়ে দু–একবার ডাকল, ‘স্যার? মালেক স্যার? স্যার আমার সায়েন্স প্রজেক্টটা...’ কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। বাঘটা বলল,
‘ঠিক আছে, তুমি যেতে পারো।’
‘জি বাঘ আঙ্কেল, আমি তাহলে যাই।’
‘যাও। এসিটা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে যাও। ২২–এ আছে ১৬–তে দিয়ে যাও।’
‘জি আচ্ছা। আচ্ছা বাঘ আঙ্কেল আরেকটা কথা, ইয়ে...কিছু যদি মনে না করেন...’
‘বলো বলো।’
‘ইয়ে...আপনি কখন যাবেন?’
‘যাব যাব, একটু ঠান্ডা হয়ে নিই আগে। আর শোনো, তুমি আরেকটা কাজ করো। আরও দুটো সায়েন্স প্রজেক্ট রেডি করো।’
‘কী বলছেন, মালেক স্যার আমার একটা প্রজেক্টই বাদ দিয়ে দিয়েছেন, আপনি বলছেন আরও দুটো প্রজেক্ট রেডি করতে।’ বাঘ আঙ্কেল ঘ্রাউক করে আবার একটা হুংকার দিল। ‘ওই মালেক বাদ দেওয়ার কে? তুমি প্রজেক্ট রেডি করো। আমি চাই সায়েন্স ফেয়ারের ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড তিনটা পুরস্কারই তুমি পাও। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আচ্ছা যাও। ’
ওদিকে বাঘ আঙ্কেলের হুংকার শুনে বাথরুমের ভেতর মালেক স্যারের ভীত গলা শোনা গেল...‘ওরে বাবা রে...কে আছ বাঁচাও...মিশু বাপ তুমি কই?’
মিশু তখন বাইরে। কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে স্কুলের গেটের কাছে এসে দেখে হুলুস্থুল ভিড়। পুলিশ, দমকলের লোকজন, সাংবাদিক সবাই ভিড় করে হাউ মাউ খাউ করছে। দারোয়ান আঙ্কেল একটা প্রাইভেট চ্যানেলকে গম্ভীর হয়ে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন।
‘আপনিই তাহলে প্রথম বাঘটাকে দেখলেন?’
‘জি হ, সেভেন বি কেলাশে গিয়া দেখি বাঘ হুইয়া রইছে।’
‘তারপর?’
‘আমারে দেইখা বাঘটা ঘ্রাউক কইরা চিক্কুর দিয়া থাবা দিয়া দুইডা বেঞ্চ ভাইঙ্গা ফালাইল।’
‘বলেন কী? দুটো বেঞ্চ একসাথে?’
‘হ একলগে। সেগুন কাঠের বেঞ্চ এক থাবায় দুই টুকরা।’
‘আপনি ভয় পেলেন না?’
‘কিসের ভয়, আমি চিক্কুর দিয়া কইলাম, ওই বাঘের ব্যাটা জলদি বাইরা...১০টায় কইলাম কেলাশ শুরু হইব...’
মিশুর ভীষণ হাসি পেল। দারোয়ান আঙ্কেল চান্স পেয়ে উল্টাপাল্টা কী সব বলে যাচ্ছে। হঠাৎ মিশু দেখে আরেক দিকে পৃথিবী বিখ্যাত দুই শিকারি জিম করবেট আর পচাব্দী গাজী। সাংবাদিকেরা ওনাদের ভিড় করে ঘিরে ধরেছে।
‘ওনারা এখানে এলেন কী করে, ওনারা তো অনেক আগেই মারা গেছেন।’ চিৎকার করে বলেই ফেলে মিশু!
‘বিখ্যাতরা সব সময় অমর, বইয়ে পড়োনি? তাই ওনারা এসেছেন।’ পাশ থেকে কে একজন বলে। মিশুর মনে হচ্ছে, সে স্বপ্ন দেখছে না তো। গায়ে দুবার চিমটি কাটল। তারপর ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল মিশু। দেখে তাদের স্কুলের আরও কয়েকজন অটোগ্রাফ নেওয়ার চেষ্টা করছে। জিম করবেটকে সবাই বলছে বাঘটাকে মারার জন্য। তিনি বলছেন—
‘দেখুন, আমি নরখাদক বাঘ মেরেছি। এই বাঘটা তো মনে হচ্ছে গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পাশের পাহাড় থেকে চলে এসেছে। এটা নরখাদক বাঘ নয়। একে ট্রাঙ্কুলাইজার গান দিয়ে অজ্ঞান করে পাহাড়ে পৌঁেছ দিতে হবে।’
সবাই সায় দিল তার কথায়। পচাব্দী গাজীও তা–ই বললেন, ‘না না, আমি বাঘ মারব কি চোখেও দেখি না। ছানি পড়েছে চোখে। তা ছাড়া এখন প্রাণী হত্যা পরিবেশবিরোধী কাজ, এটা করা ঠিক হবে না। জিম ভাই যা বললেন, ওটাই করো তোমরা। জলদি একটা ট্রাঙ্কুলাইজার গান জোগাড় করো।’
‘জি, ঢাকায় লোক গেছে।’
এই ফাঁকে মিশুও স্কুলের অঙ্ক খাতায় দুজনের অটোগ্রাফ নিয়ে ফেলল। তারপর বাড়ির পথ ধরল। বাসায় গিয়ে আরও দুটো প্রজেক্ট নিয়ে একটু ভাবা যাক। বাঘ আঙ্কেলের কথা যদি সত্যি হয় মন্দ কী, ভাবে মিশু। পথে সিঅ্যান্ডবির মোড়ে ভাঙা ব্রিজটার ওপরে কিংশুকদাকে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো। কিংশুকদা হচ্ছে শখের বেকার। এমএ পাস করে বেকার বসে আছেন। মাঝে মাঝেই তিনি চাকরি পান, তারপর চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিয়ে প্লেন বানিয়ে এই ব্রিজ থেকে নিচে ছুড়ে দেন।
‘কিংশুকদা তুমি এখানে?’ বলল মিশু।
‘তুই কি দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই ছবিটা দেখেছিস?’
‘না।’
‘নাম শুনেছিস?’
‘না।’
‘তুই যেন কোন ক্লাসে?’
‘সেভেন।’
‘হুম...তাহলে অবশ্য এ ছবি তুই বুঝবিও না। খুবই ক্ল্যাসিক মুভি।’
‘হঠাৎ এই ছবির কথা বলছ কেন?’
‘আরে ওই ছবির শুটিং হয়েছে এই ব্রিজে, ভাবতে পারিস? আমি তখন তোর মতো সেভেন কি এইটে পড়ি।’
‘তুমি শুটিং দেখেছ?’
‘দেখেছি মানে? আমি তো ডিরেক্টর ডেভিড লিনের সাথেই ছিলাম। উনি বললেন তাঁর নেক্সট ছবিতে নামভূমিকায় কাজ করব কি না।’
‘তুমি কী বললে?’
‘রাজি হইনি। কারণ, তখন ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। আচ্ছা তুই এখন কোত্থেকে এলি?’
‘স্কুল থেকে। কেন তুমি জানো না স্কুলে বাঘ ঢুকেছে?’
‘জানি জানি। মতি ঢুকেছে।’
‘মানে! মতি কে?’
‘ওই বাঘের নাম মতি। আমার ক্লাসমেট ছিল। ক্লাস এইট পর্যন্ত আমরা একসঙ্গেই ছিলাম।’
‘কী বলছ, ওই বাঘ আঙ্কেল তোমার ক্লাসমেট ছিল? কীভাবে সম্ভব?’
‘সম্ভব সম্ভব। আসলে তখন সে মানুষই ছিল, তারপর একদিন ক্লাসে আমরা ঠিক করলাম বড় হয়ে কে কী হব। রাজীব বলল, সে ইঞ্জিনিয়ার হবে। আমি বললাম, ডাক্তার হব। রাফি বলল, সে কবি হবে...আর মতি হুট করে বলল, সে বড় হয়ে বাঘ হবে...হা হা হা।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কী, আমরা কেউ আমাদের কথা রাখতে পারিনি। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লেখক, কবি কিছুই হতে পারিনি। কিন্তু মতি বাঘ হবে বলেছিল, সে ঠিকই বাঘ হয়েছে। ও কথা রেখেছে। আচ্ছা ও এখন ঠিক কোথায়, বল তো?’
‘উনি এখন মালেক স্যারের রুমে এসির ঠান্ডা হাওয়া খাচ্ছেন।’
‘মালেক স্যার? ওই বদটার রুমে কেন?’
‘কারণ, একমাত্র ওনার রুমেই এসি আছে তাই।’
‘হুম...তাহলে মতি গরম সহ্য করতে না পেরে তোদের স্কুলে ঢুকেছে?’
‘তা–ই তো বললেন। উনি বলছিলেন কোথাও বাতাস নেই এক ফোঁটা। গরমে অসহ্য লাগছিল জঙ্গলে।’
‘বাতাস তো সব তোদের ওই চিপসের প্যাকেটের ভেতর। বাতাসটা আসবে কোত্থেকে? চল তো, ওর সঙ্গে দেখা করে আসি।’
‘ওদিকে যাওয়া যাবে না।’
‘কেন?’
‘কেন আবার? স্কুলগেটে এখন হুলুস্থুল অবস্থা। পুলিশ, দমকলের লোকজন, সাংবাদিক—সবাই চলে এসেছে। জিম করবেট আর পচাব্দী গাজীও চলে এসেছেন।’
‘তাই নাকি। আমি তো ওনাদের ফ্যান। ওনাদের সঙ্গে একটা সেলফি তুলতে হবে।’
‘আমি অটোগ্রাফ নিয়েছি।’
‘ভালো করেছিস। আচ্ছা, তাহলে মেইন গেট দিয়ে ঢুকতে দেবে না?’
‘না, কেউই ঢুকছে না।’
‘কেন? তোদের স্কুলের পেছনে তারকাঁটা ছেঁড়া কিছু জায়গা আছে না? ওদিক দিয়ে ঢোকা যায় তো।’
‘সেটা দিয়ে আমি ঢুকতে পারব। তুমি পারবে না।’
‘আরে পারব, চল তো আগে। তার আগে চল স্কুলগেটে। পরিস্থিতি কী বোঝা যাক।’
স্কুলের গেটে এসে দেখে ভিড় আরও বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি ভিড় জিম করবেট আর পচাব্দী গাজীকে নিয়ে। সবাই সেলফি তুলছে, নইলে অটোগ্রাফ নিচ্ছে। স্কুল কমিটির চেয়ারম্যানও এসেছেন। কিন্তু তাকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। সবাই দেশি–বিদেশি বিখ্যাত দুই শিকারিকে নিয়ে ব্যস্ত। বোঝাই যাচ্ছে, চেয়ারম্যানের বেশ মেজাজ খারাপ। তিনি হঠাৎ চিৎকার করে বললেন, ‘বন্ধুগণ, আপনারা একটু সুস্থির হন। আমার কথা শুনুন।’ কেউ তার কথা শুনল না।
তিনি বলতে লাগলেন, ‘স্কুলে বাঘ ঢুকেছে এটা আসলে গুজব...আমি বলব ষড়যন্ত্র। একটি মহল আমাদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে...যেকোনো মূল্যে এটা প্রতিহত করতে হবে। আমরা এখন স্কুলে ঢুকব এবং প্রমাণ করব স্কুলে বাঘ ঢোকেনি...’ ঠিক তখন ঠাস করে একটা ডিম এসে চেয়ারম্যানের মাথায় পড়ে ফেটে গেল। লাল কুসুম বের হয়ে আটকে গেল তার চশমায়; চারদিকে হো হো হাসি শুরু হয়ে গেল। আর হঠাৎ করেই একটা ঠেলাঠেলি শুরু হলো। সেই ঠেলাঠেলির ধাক্কায় চেয়ারম্যান সাহেব ঝপাৎ করে পাশের ড্রেনে পড়লেন। নতুন করে একটা হাসির হুল্লোড় উঠল যেন।
ওদিকে ট্রাঙ্কুলাইজার গান চলে এসেছে ঢাকা থেকে। কিন্তু এই গান নিয়ে ভেতরে ঢুকতে কেউ সাহস পাচ্ছে না। শেষমেশ বন বিভাগের এক বন্দুকবাজকে আনা হয়েছে, তিনি ঢুকতে রাজি আছেন। তাঁর সঙ্গে দেনদরবার চলছে। তিনি জানতে চাচ্ছেন, ঠিক কোন ঘরটায় আশ্রয় নিয়েছে বাঘ। সেটা জানার জন্য দুটো অত্যাধুনিক ড্রোন ছাড়া হয়েছে। ড্রোনগুলো উড়ে উড়ে প্রতিটা ক্লাসরুমে উঁকি মারছে। কিন্তু কোথায় বাঘ, কোথায় কী? তবে ঢাকা থেকে একটা বড় টিম আসার কথা। সেটা এখনো এসে পৌঁছায়নি।
কিংশুকদা বললেন, ‘চল রে মিশু, পেছন দিয়ে স্কুলে ঢোকা যাক।’
‘চলো।’
‘কিন্তু ওর জন্য কিছু নেওয়া দরকার না?’
‘কার জন্য?’
‘আর কার জন্য? তোর বাঘ আঙ্কেলের জন্য। মানে আমাদের মতির জন্য।’
‘কী নেবে?’
‘একটা ছাগলের রান নিয়ে নিই। কাচ্চি বিরিয়ানি ওর পছন্দ ছিল।’
‘নিলে তো ভালোই হয়। ওনার নিশ্চয়ই খিদে লেগেছে।’
‘লাগারই কথা, চল।’
তারা দুজন বাজারের মোড়ের কসাইখানায় এসে দাঁড়াল। কিন্তু কসাইখানা বন্ধ। শহরে বাঘ ঢুকেছে শুনে সব দোকানপাটই বন্ধ। এ সময় তাদের কাছে কাঁঠালপাতা চিবাতে চিবাতে একটা ছাগল এগিয়ে এল।
‘ছাগলের রান খুঁজছেন?’
‘হ্যাঁ।’ বললাম আমি।
‘তুমিও দেখি মতির মতো কথা বলতে পারো।’ কিংশুকদা বললেন।
‘জি, পারি। আসলে আমি প্রাণিজগতের একজন হরবোলা...মানুষের ভাষা পারি।’
‘বাহ্! ভালো তো।’
‘আমাকে বাঘ মামার কাছে নিয়ে যান।’ ছাগলটা বলল।
‘কেন?’
‘আর কেন? এই জীবন আমি রাখব না। বাঘ মামা যদি আমাকে খায়, তাহলে আমার জীবন ধন্য হবে।’
‘কিন্তু কেন এই আত্মাহুতি দিচ্ছ?’
‘সত্যি কথা বলতে কি, এই ছাগলজীবন আর ভালো লাগছে না। আমার ভাষা এখন সবার মুখে মুখে। সবাই সবাইকে মামা ডাকে। আমি ম্যা ম্যা করতাম...আমাদের আর নিজস্ব কোনো আইডেনটিটি নাই। তাই ভাবলাম হরবোলা হয়ে মানুষের ভাষা শিখি। শিখলামও। কিন্তু...’
‘কিন্তু?’
‘কিন্তু ফেসবুকে কমেন্টে সবাই যে ভাষায় কথা বলেন আপনারা মানুষেরা উফ্...সত্যি নেওয়া যায় না। তাই ভাবলাম এই জীবন আর রাখব না। চলেন বাঘ মামার কাছে। উনি যদি দয়া করে আমাকে তার পাকস্থলীতে গ্রহণ করেন...’
‘ওফ! তোমার তাহলে ফেসবুক অ্যাকাউন্টও আছে!’
‘জি, আছে। আপনাদের মানুষদের ভাব বোঝার জন্যই একটা অ্যাকাউন্ট খুলেছি।’
‘বেশ বেশ...চলো তাহলে।’
স্কুলের পেছনে এসে দাঁড়াল তিনজন। মিশু দিব্যি ঢুকে গেল, দিব্যি ঢুকে গেল ছাগলও। কিংশুকদার অবশ্য ঢুকতে বেশ কষ্ট হলো। তিনজনে সাবধানে পেছন দিয়ে হেঁটে মালেক স্যারের রুমের সামনে এসে হাজির হলো। বাইরে থেকে চেঁচাল কিংশুকদা।
‘দোস মতি, তুই কি ভেতরে আছিস?’
‘কে, কিংশুক নাকি?’ মালেক স্যারের রুমের ভেতর থেকে আওয়াজ এল।
‘হ্যাঁ, আমিই।’
তিনজনে আর দেরি করল না। মালেক স্যারের রুমে ঢুকে গেল। দুই বন্ধুর বহুদিন পর দেখা। ছাগলের আত্মাহুতির কথা শুনে বাঘ আঙ্কেলের চোখে পানি চলে এল। বলল, ‘না, না, এটা হয় না। আজ থেকে তুমি আমি এক ঘাটে বসে মিনারেল ওয়াটার খাব। আমরা বন্ধু হয়ে থাকব বাকি জীবন...’ পানি চলে এল ছাগলের চোখেও। নতুন করে বাঁচার একটা পথ যেন খুঁজে পেল সে।
বাঘ আঙ্কেল এক ফাঁকে মিশুকে বলল, ‘কী মিশু, নতুন দুটো সায়েন্স প্রজেক্ট কি রেডি করেছ?’
‘জি, না। এখনো করিনি। ভাবছি...’
‘করো করো। তোমার মালেক স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে।’ বলেই ঘ্রাউক করে একটা হুংকার দিল বাঘ। সঙ্গে সঙ্গে টয়লেটের ভেতর থেকে আর্তনাদ করে উঠলেন মালেক স্যার, ‘ও মাগো, মাগো...কে আছ বাঁচাও...মিশু বাপ আছিস? তোর যয়টা সায়েন্স প্রজেক্ট লাগে নিয়ে আয়...আমি আর কমিটিতে থাকব না, বিজ্ঞান স্যারকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেব। এসি রুমটা হেডস্যারকে দিয়ে দিব। স্কুল ফান্ডের কিছু টাকা হাতিয়েছিলাম, সব ফেরত দিব...সায়েন্স প্রজেক্টের টাকা কিছু নয়ছয় করার তালে ছিলাম...সব বাদ...ইইই (কান্না)।’
এই যখন চলছিল মালেক স্যারের রুমে, বাইরে মানে স্কুলের মাঠে তখন একটা বিশাল ড্রোনের মতো কিছু নামতে লাগল...সবাই ভাবল বাঘ ধরার জন্য ঢাকা থেকে যে বিশেষ টিমটা আসার কথা সেটা বোধ হয় এখন বিশেষ কোনো হেলিকপ্টারে করে চলে এসেছে। স্কুলের গেট তখনো বন্ধ। শূন্য মাঠে ড্রোনটা নামল, মানে ড্রোনের মতো জিনিসটা নামল। আসলে সত্যি কথা বলতে কি, ওটা কোনো ড্রোন ছিল না। ওটা ছিল একটা ইউএফও...আন আইডেনটিফায়েড অবজেক্ট। ১০ লাখ আলোকবর্ষ দূরের একটা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলকে সুইং-বাই করে হাইপার ডাইভ দিয়ে এইমাত্র পৃথিবীতে ল্যান্ড করল।
গোল জিনিসটার ওপর একটা সবুজ লাইট জ্বলছিল নিভছিল। ওটা বন্ধ হতেই জিনিসটার পেটের ভেতর থেকে সড়াত করে ডিএনএ স্ট্রাকচারের মতো একটা প্যাঁচানো সিঁড়ি নেমে এল। সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল একটা ছোটখাটো এলিয়েন। সরু পা, মাথাটা বড়, কপালের ওপর একটিমাত্র সুরমা লাগানো চোখ, মাথায় দুটো সরু অ্যানটেনা। হাতে একটা বিদঘুটে যন্ত্র। সে নেমেই তার হাতের যন্ত্রটা চালু করল...যন্ত্রটা বিপ বিপ করে শব্দ করতে লাগল। তারপর এলিয়েনটা হাঁটা দিল মালেক স্যারের রুমের দিকে।
এদিকে স্কুলের গেট থেকে তখন সবাই বুঝে ফেলেছে, এইমাত্র মাঠে নামা বিশাল ড্রোনটা আসলে ড্রোন নয়, কোনো অত্যাধুনিক হেলিকপ্টারও নয়, ওটা একটা ইউএফও। সেখান থেকে একটা এলিয়েন নামল। সঙ্গে সঙ্গে প্রাইভেট চ্যানেলগুলো সোচ্চার হয়ে উঠল—
‘অ্যাঁ অ্যাঁ...দর্শকমণ্ডলী, আমি মোতালেব ওরফে মফিজ লাইভে আছি...অ্যাঁ অ্যাঁ...দর্শকমণ্ডলী, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন এইমাত্র একটা ইউএফও নিউ মডার্ন স্কুলের মাঠে নামল অ্যাঁ অ্যাঁ...দর্শকমণ্ডলী, এবং তার ভেতর থেকে একজন এলিয়েন নেমে এলেন এবং তিনি হেঁটে স্কুলের অফিস কক্ষের দিকে গেলেন। পরিস্থিতি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবে পরিস্থিতি যে ভালো না তা স্পষ্ট অ্যাঁ অ্যাঁ...দর্শকমণ্ডলী...সম্ভবত পৃথিবী এখন হুমকির মুখে...!
এদিকে সারা বিশ্বে তখন খবর হয়ে গেছে যে বাংলাদেশের মোকসেদপুর উপজেলায় নিউ মডার্ন স্কুলের মাঠে গরমে অতিষ্ঠ হওয়া বাঘ ঢোকাকে কেন্দ্র করে নানা কিছু ঘটে চলেছে...সেই স্কুলের মাঠে একটা সত্যি ইউএফও এসেছে এবং সেই ইউএফও থেকে একজন সত্যি এলিয়েন নেমে এসেছে এবং এইমাত্র সেটি স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক মালেক স্যারের রুমে ঢুকেছে। মালেক স্যার অবশ্য বাঘের ভয়ে টয়লেটে আত্মগোপন করে আছেন। তবে তার রুমে এই মুহূর্তে রয়েছে একটি এলিয়েন, একটি বাঘ, একটি ছাগল আর দুজন মানুষ—ক্লাস সেভেনের মিশু আর এমএ পাস শখের বেকার তরুণ কিংশুক রায়।
ওদিকে স্কুলের গেটের বাইরে রাস্তায় তখন বাজার বসে গেছে। বিদেশ থেকে বিশেষ জেট প্লেনে চলে এসেছে নাসার লোকজন, ন্যাশনাল জিওগ্রাফির প্রাইভেট হেলিকপ্টারে তাঁদের বিশেষ টিম চলে এসেছে। আর দেশের প্রাইভেট চ্যানেলগুলো তো আছেই। পুলিশ রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। শত শত ক্যামেরার তারের প্যাঁচে আছড়ে পড়ে দুজন উপস্থাপক ও তিনজন ক্যামেরা ক্রু জ্ঞান হারিয়েছেন। স্কুলের গেটের সামনের রাস্তায় তিল ধারণের জায়গা নেই। তার মধ্যে একজন জায়গা করে নিয়ে বস্তায় করে তিল বেচছেন। কেজি দুই শ টাকা। আর ছোটখাটো দোকানের তো কোনো অভাব নেই। ফুচকা, চটপটি, ভেলপুরি, ডালপুরি, খ্যাতা পুরি...একটা সেই রকম হইচই চলছে যেন। বাঘের ইস্যু এখন চাপা পড়ে গেছে। সামনে চলে এসেছে এলিয়েন ইস্যু। স্কুলের গেট ভেঙে সবাই ঢুকে পড়েছে। ইউএফওর চারদিকে সবাই নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছে। দেশি–বিদেশি বিভিন্ন চ্যানেলের উপস্থাপকেরা তখন খুবই ব্যস্ত। সবার মুখেই তুবড়ি ছুটছে...
‘অ্যাঁ অ্যাঁ...দর্শকমণ্ডলী, আমি মোতালেব ওরফে মফিজ লাইভে আছি...অ্যাঁ অ্যাঁ...আমি এখন স্কুলের ভেতর মাঠে ...’
‘অ্যাঁ অ্যাঁ...দর্শকমণ্ডলী, আমি মিস সানজিদা লাইভে আছি ...অ্যাঁ অ্যাঁ...’
‘ইয়েস আই এম ক্রিস্টিনা...ফ্রম ন্যাশনাল জিওগ্রাফি...লাইভ...এ সসার জাস্ট ল্যান্ডেড...’
‘আই অ্যাম ম্যাকলিন...ফ্রম নাসা...লাইভ...’
মালেক স্যারের রুমে তখন রীতিমতো ইন্টার গ্যালাকটিক মিটিং শুরু হয়েছে।
কিংশুক: আপনি বলছেন আউটার স্পেস থেকে এসেছেন আপনি? এবং আপনি একজন এলিয়েন?
এলিয়েন: হ্যাঁ।
কিংশুক: কিন্তু কেন এসেছেন?
এলিয়েন: এইখানে একটা সায়েন্স ফেয়ার হচ্ছে, সেখানে অংশগ্রহণ করতে এসেছি।
কিংশুক: বলেন কী?
মিশু: কিন্তু এটা তো ইন্টার ডিস্ট্রিক্ট সায়েন্স ফেয়ার ছিল। ইন্টার গ্যালাকটিক সায়েন্স ফেয়ার না যে আপনি সায়েন্স প্রজেক্ট জমা দেবেন।
এলিয়েন: তোমাদের সায়েন্স ফেয়ার কমিটির প্রধান কোথায়? তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চাই একটু...
মিশু: উনি টয়লেটে লুকিয়ে আছেন।
এলিয়েন: কেন?
মিশু: আর কেন, ওই যে বাঘ আঙ্কেলের জন্য।
এলিয়েন এবার তার সবুজ চোখে টেবিলের ওপর শোয়া বাঘের দিকে তাকাল। ‘আমি কি তোমাদের সায়েন্স প্রজেক্টের লিস্টটা দেখতে পারি একটু?’
‘অবশ্যই।’ বলল মিশু। ‘স্যার, লিস্টটা কোথায়?’ টয়লেটের দরজার কাছে গিয়ে চেঁচাল মিশু।
‘ওই যে টি-টেবিলের পাশের ছোট্ট টুলটার ওপর হলুদ খাম, ওটার ভেতরে রেখেছিলাম।’ মিনমিন করে বলেন মালেক স্যার। খাম নিতে গিয়ে হায় হায় করে উঠল মিশু।
‘কী হলো?’ কিংশুকদা জানতে চান।
‘ছাগল আঙ্কেল লিস্টটা এইমাত্র চিবিয়ে খেয়ে শেষ করেছেন।’ এই যখন চলছিল, তখন আচমকা টয়লেটের দরজা খুলে ছুটে বেরোলেন মালেক স্যার। এক দৌড়ে সোজা স্কুলের মাঠে। ‘ঘ্রাউক’ করে বিকট গর্জন করে তাঁর পিছু পিছু ছুটে বেরোল বাঘ আঙ্কেলও। ধুরন্ধর মালেক স্যার ততক্ষণে পড়িমরি করে ছুটতে ছুটতে মাঠের হাজার জনতার ভিড়ে মিশে গেলেন। আর আচমকা বিশাল বাঘ দেখে সবাই যে যেদিকে পারল ছুটে পালাল। মুহূর্তে মাঠ খালি। শুধু শূন্য মাঠে দাঁড়িয়ে রইল ১০ লাখ আলোকবর্ষ দূর থেকে হাইপার ডাইভ দিয়ে আসা ইউএফওটা।
শেষমেশ যেটা ঘটল সেটা হচ্ছে, এলিয়েন তার প্রজেক্টটা কিংশুকদার কাছে রেখে গেল। যেন তিনি তার হয়ে এটা সায়েন্স ফেয়ারে জমা দেন। জিনিসটার নাম ‘স্টপার’।
‘এটা দিয়ে কী হয়?’ জিজ্ঞেস করলেন কিংশুকদা।
‘এটা তোমাদের পৃথিবীর মানুষদের জন্য স্পেশালি ডিজাইন করা।’
‘এটার কাজ কী?’
‘তোমরা মানুষেরা আসলে জানো না কখন থামতে হয় বা থামা উচিত, এটা তোমাদের সঠিক সময়ে থামতে সাহায্য করবে। তাই এটার নাম স্টপার।’
‘আচ্ছা, ইন্টারেস্টিং কিন্তু এটা কীভাবে কাজ করে?’
‘সিম্পল, এটার সামনে দাঁড়াবে, স্টপার নিজ থেকে সিগন্যাল দিয়ে তোমাকে বুঝিয়ে দেবে তোমার থামা উচিত কি অনুচিত...আচ্ছা গুডবাই, আমি চললাম...’
‘আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমি আমাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলছিলে কীভাবে?’
‘কেন, আমার সঙ্গে ল্যাঙ্গুয়েজ কনভার্টার আছে...চলি...’
‘শেষ একটা প্রশ্ন...’
কিন্তু এলিয়েনটা হুট করে অদৃশ্য হয়ে গেল বলে মনে হলো। আসলে ওরা মুহূর্তে তাদের শরীরের সব অ্যাটমের বন্ডিং খুলে ছুটতে পারে...ফের রি–অ্যারেঞ্জ করে নেয়। ঠিক সেভাবেই যেন অদৃশ্য হয়ে গেল স্কুলের মাঠে নামা বিশাল আকারের ড্রোনটা, মানে ইউএফওটাও।
পত্রপত্রিকায়, টিভিতে এসব নিয়ে সপ্তাহখানেক বেশ মাতামাতি হলো। তারপর হঠাৎ সব চুপ। সবাই যেন একসঙ্গে সব ভুলে গেল। মিশুদের স্কুলে সায়েন্স ফেয়ার শুরু হবে। আর কী আশ্চর্য, মালেক স্যার আবার তার স্বমূর্তিতে ফিরে এলেন যেন! সেই আগের মালেক স্যার। তারপরও মিশু একদিন গিয়ে হাজির হলো স্যারের রুমে।
‘স্যার, আমার প্রজেক্টটা কি যাচ্ছে?’
‘কিসের প্রজেক্ট?’ স্যার দাঁত–মুখ খিঁচিয়ে উঠলেন। ‘গেলি এখান থেকে তুই?’
‘কী আশ্চর্য, স্যার কি সব ভুলে গেলেন...! বাঘ আঙ্কেল, এলিয়েন, কিংশুকদা, সেই কথা বলা ছাগল, সবাই মিলে আপনার রুমে...’
‘হুহ! কোথাকার কোন ছাগল এনে আমার সব গুরুত্বপূর্ণ ফাইলপত্র খাইয়ে শেষ করে এখন এসেছ সায়েন্স প্রজেক্ট নিয়ে?’
‘কিন্তু স্যার এলিয়েনের স্টপার প্রজেক্টটা থাকবে তো? কিংশুকদা আপনাকে বুঝিয়ে বলেছে নিশ্চয়ই; ওটা খুব জরুরি।’
‘আরে ধুর ধুর। ওটা একটা ফালতু জিনিস। খালি বিপ বিপ করে...একটা খেলনা বার্গলার অ্যালার্ম...’
স্যারকে কিছুই বোঝাতে না পেরে মন খারাপ করে বাসায় ফিরে যাচ্ছিল মিশু। এই সময় পথে স্কুলের ক্লিনার ছদরুল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা।
‘ছদরুল ভাই?’
‘বলো।’
‘আচ্ছা মালেক স্যারের রুমের জিনিসপত্র তো আপনিই পরিষ্কার করেন।’
‘হ, করি তো।’
‘স্যারের রুমে একটা তিন কোনা যন্ত্র ছিল।’
‘হ হ ওইটা ফালায়া দিছি। স্যারেই কইছে ফালাইতে। ভাঙারির দোকানে নিছিলাম বেচতে; নগদে কিছু যদি পাওয়া যায়, হেরা কয় পেলাস্টিক মাল চলব না। হেষে ডাস্টবিনে ফেলায়া দিছি।’
‘হায় হায়। কোন ডাস্টবিনে ফেলছেন?’
‘হেই উত্তর মুখের বড় ডাস্টবিনটায়।’
মিশু আর দেরি করল না। ছুটে গেল স্কুলের উত্তরে বড় ডাস্টবিনটার কাছে। একরকম ঝাঁপিয়ে পড়ল ডাস্টবিনের ভেতর। পাগলের মতো ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগল ডাস্টবিনের ময়লা। ময়লার পূতিগন্ধ কিছুই তার নাকে লাগছে না যেন। কই, সেই তিন কোনা স্টপার? কই? কই?? কই???
ওদিকে মিশুর ক্লাসের দুই বন্ধু সোহেল আর তারেক যাচ্ছিল ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে। তারা হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মিশুকে ডাস্টবিনের ভেতর দেখে!
‘মিশু তুই ডাস্টবিনের ভেতর কী করছিস?’ সোহেল চেঁচিয়ে ওঠে।
‘দেখতেই পাচ্ছিস ডাস্টবিনের ময়লা ঘাঁটাঘাঁটি করছি।’
‘মানে? কেন?’ এবার তারেক চেঁচায়!
‘কারণ, আমি সিটি করপোরেশনে পার্টটাইম চাকরি নিয়েছি।’ রেগেমেগে বলে মিশু। ‘তোরা এখান থেকে যাবি? আমি এখানে একটা জরুরি কাজে ব্যস্ত আছি।’ ভয় পেয়ে সোহেল আর তারেক শটকে পড়ল। মিশুর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বড় কোনো গন্ডগোল হয়েছে। মিশুর বাসায় জানানো দরকার।
ওরা চলে যাওয়ার পরও অনেক খুঁজেও কিছুতেই স্টপারটা পেল না মিশু। কিন্তু একটা অদ্ভুতদর্শন সবুজ বোতল পেল। সেটা পরিষ্কার করতে গিয়ে বোতলটায় হাতের ঘষা পড়ল। তাতেই একটা আশ্চর্য কাণ্ড শুরু হলো...হঠাৎ ডাস্টবিনটা যেন ধোঁয়ায় ভরে গেল! মানে কী? ভয় পেয়ে গেল মিশু। বোতলটা ফেলে লাফ দিয়ে বের হয়ে এল ডাস্টবিন থেকে। তখনই দেখা গেল বিরাট পাগড়ি পরা একজনকে...! গম্ভীর গলায় পাগড়ি পরা মানুষটা বলল—
‘হুকুম করুন মালিক, কী চাই আপনার?’
‘আ-আপনি কে?’
‘আমি আপনার গোলাম।’
‘মা–মানে আপনি নিশ্চয়ই সেই আলাদিনের জিনি?’
‘আলাদিন না, আমি এখন আপনার জিনি...হুকুম করুন মালিক, আপনার কী লাগবে?’
‘স্টপার...স্টপার নামে একটা যন্ত্র একজন এলিয়েন দিয়ে গেছে, ওটা খুঁজে দিন জলদি। এটা এই ডাস্টবিনেই আছে...’
‘মালিক, এটা এই ডাস্টবিনে নেই।’
‘তাহলে কোথায়? যেখানেই থাকুক খুঁজে দিন প্লিজ।’
‘মালিক, এটা এখন স্কুল কমিটির চেয়ারম্যানের বাসায়...তারপর যাবে মালেক স্যারের কাছে।’
‘কী আশ্চর্য! ওখানে গেল কীভাবে? আপনিই–বা ওনাদের চেনেন কীভাবে?’
‘মালিক, আমরা সব বুঝতে পারি; তা ছাড়া এটা মারাত্মক এক ডিভাইস। মানব সম্প্রদায়কে সঠিক সময়ে থামায় এটা। তাই এর নাম স্টপার। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এটা যদি কেউ ব্যবহার না করে, তখন এটা আপনা–আপনি চালু হয়ে যায় এবং জায়গা বদল করে। এর অ্যাটমগুলো আশপাশের কোনো ছোটখাটো ব্ল্যাকহোল খুঁজে নিয়ে তার ইভেন্ট হরাইজনে হকিং রেডিয়েশনের মতো করে অ্যাটমগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর ছুটে যায়...তারপর ফের ওখানে জোড়া লেগে কাজ শুরু করে দেয়।’ জিনির কথা শুনে মিশুর মুখ হাঁ হয়ে যায়। সুযোগ বুঝে একটা এডিস মশা ঢুকেও যায় ওর মুখে। মশাটা গিলে মিশু বলে—
‘আপনি এত সায়েন্স জানলেন কীভাবে?’
‘আমি পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করেছি ইন দ্য ইয়ার নাইটিন হানড্রেড থার্টি টুতে...। আমার বিষয় ছিল ব্ল্যাকহোল; স্টিফেন হকিং তো আমার ক্লাসমেট ছিল।’
‘কিন্তু আপনি একজন পিএইচডি হয়ে ওই বোতলটায় ঢুকলেন কীভাবে?’
‘সে বিরাট কাহিনি, আমার পিএইচডির সুপারভাইজারও ছিল একজন মানুষের ছদ্মবেশী জিনি। তার সঙ্গে আমার একটা ঝামেলা হয়।’
‘কী ঝামেলা?’
‘মালিক, বাদ দিন এসব পুরোনো বিষয় নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। তার কারণেই আমাকে বোতলে ঢুকতে হয়েছিল। তবে মালিক আপনি চিন্তা করবেন না। এই স্টপার এক এক করে সবার কাছে যাবে। যাদের সঠিক সময়ে থামার দরকার তাদের থামাবে। এটা এখন আর কারও কন্ট্রোলে নেই। এটা এখন নিজে নিজে কাজ করতে থাকবে। মানবজাতির জন্য ভালো হয়ে যাওয়ার এটা একটা বিরাট সুযোগ।’
‘উফ...’ মিশু মাথায় হাত দিয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়ে।
তবে মিশু জানে না, এই পর্যায়ে স্টপার মেশিনটা এই লেখার লেখকের কাছে এসে হাজির হয়েছে এবং বলছে, এই আজগুবি আষাঢ়ে লেখাটা এখানেই স্টপ করতে হবে। নইলে নাকি সমস্যা হতে পারে। তবে লেখক কিশোর পাঠকদের বিনীতভাবে বলতে চায়, এই লেখার আরও চার পাতা আছে, আই মিন লেখা হয়ে গেছে...যাকে বলে শেষ এপিসোড আরকি। কিন্তু স্টপার সেই চার পাতা অদৃশ্য করে দিয়েছে যেন পাঠকেরা পড়তে না পারে এবং লেখককে এমন একটা ধারণা দিচ্ছে যেন লেখক আসলে ওই চার পাতা লেখেন; এই মুহূর্তে লেখক নিজেও কনফিউজড...কনফুসিয়াসের মতো করে বলতে হয়, খড়ের গাদায় হারিয়ে যাওয়া সেই সুইটা খুঁজে বের করা...যে সুইটা আসলে খড়ের গাদায় নেই!
(প্রিয় কিশোর আলোর পাঠক–পাঠিকারা, ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার করে বললে বলতে হয়...আমি এতক্ষণ যা লিখেছি, সেটা আসলে আমি নিজেই পড়তে পারছি না। কারণ, ওটা আসলে আমি লিখিইনি)