নাম

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

সামনে কাগজ আর পেনসিল। গালে হাত দিয়ে বসে আছে ঈশান। চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে গভীর চিন্তায় মগ্ন। দৃশ্যটা দেখে কেউ ভাবতে পারে, ঈশান বুঝি কবিতা লিখতে বসেছে। কিংবা একটা গল্প। অথবা সে হয়তো জটিল কোনো অঙ্ক কষছে।

এসবের কোনোটিই নয়। ঘটনাটা বুঝতে হলে ঈশানের বিছানার দিকে তাকাতে হবে। এত বড় একটা বিছানা দখল করে সেখানে শুয়ে আছে ফুটফুটে একটা বাচ্চা। বয়স মাত্র ১২ দিন।

ঈশান এত দিন একাই ছিল। এখন তার একটা ভাই হয়েছে। ঘরে নতুন একজন যোগ হলে ব্যাপারটা কেমন হয়, এ সম্পর্কে ঈশানের কোনো ধারণা নেই। ওর বন্ধু অমির অবশ্য একটা ছোট বোন আছে। মহা দুষ্টু। ঈশানকে দেখলেই চিমটি দেয়। আবার ছড়াও বলে, ‘চিমটি চিমটি চিমটি, পরীক্ষায় পাবে তুমি ডিমটি।’

ঈশানের ছোট ভাইও কি এমন দুষ্টু হবে? ভেবেই তার মুখ গোল হয়ে গেল।

ঈশানের মায়ের নাম নিতু, বাবার নাম শাহীন। মা বলেছেন, ‘আমাদের সবার নামেই যেহেতু “ন” আছে, অতএব নতুন মানুষটার নামের সঙ্গেও “ন” থাকতে হবে।’ কী নাম হবে ওর? ঈশান ঠিক করেছে, অন্য কেউ নাম রাখার আগেই সে একটা নাম রেখে ফেলবে। তাহলে অন্তত সারা জীবন ছোট ভাইটাকে এ নিয়ে কথা শোনানো যাবে। কী কথা শোনাবে, সেটাও ঈশান ঠিক করে ফেলেছে, ‘বেশি কথা বোলো না। আমি না তোমার বড়? তুমি যখন ছোট ছিলে, তখন স্কুল থেকে ফিরে আমিই তো তোমাকে দেখে রাখতাম। তোমার নামটাও কিন্তু আমার রাখা। বিশ্বাস না হলে আম্মুকে জিজ্ঞেস করো...’ কী কী বলা হবে, সব ঠিকঠাক, শুধু নামটাই এখনো ঠিক করা হয়নি। তাই কাগজ-পেনসিল হাতে নিয়ে ভাবতে বসেছে ঈশান।

কিন্তু ‘ন’যুক্ত কোনো নামই তো মাথায় আসছে না। এই মুহূর্তে শুধু মনে আসছে ঝুনঝুনির নামটা। ঝুনঝুনি ঈশানের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। ওর নামটা কী সুন্দর! নামের মধ্যে একটা ছন্দ আছে। একটা না, দুইটা ‘ন’ ওর নামে। ঝুনঝুনি মেয়েটাও খুব ভালো। এই কথাটা ভাবতে গিয়ে অবশ্য ঈশানের একটু লজ্জা লজ্জা লাগল!

মুশকিল হলো একটা ছেলের নাম তো আর ঝুনঝুনি রাখা যায় না। কী হতে পারে নামটা?

ঈশান একবার ভেবেছিল, ওর নাম রাখবে ‘সাইরেন’। নামের মধ্যে ‘ন’ আছে। তা ছাড়া নামটা পিচ্চিটার সঙ্গে যায়। সারা রাত সে প্যাঁ পুঁ করে কান্না করে, বাসার কাউকে ঘুমোতে দেয় না। মার ঘুম হয় না একেবারেই। তাই দুপুরবেলা মা একটু ঘুমিয়ে নেন। এই সময় ছোট্ট মানুষটাকে দেখে রাখার দায়িত্ব পড়ে ঈশানের ওপর।

নাম ভাবতে ভাবতে বিছানার দিকে তাকাল ঈশান।

সর্বনাশ! এ কী, বাবুটা তো বিছানায় নেই! ওর কাঁথা, কোলবালিশ উল্টেপাল্টে দেখল ঈশান। বিছানা থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল না তো? বিছানার নিচে তাকাল, সেখানেও নেই। কোথায় গেল? চিৎকার করে মাকে ডাকতে যাচ্ছিল সে, এই সময় একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

‘এই যে বস, এদিকে তাকান। হ্যালো, এই দিকে।’

ঈশান চট করে ফিরে তাকাল।

অবিশ্বাস্য! আলমারির ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে ঈশানের ছোট্ট ভাইটা। গায়ে কোনো কাপড়চোপড় নেই। কিন্তু বসে থাকার মধ্যে বেশ একটা স্টাইল আছে।

ঈশানের মুখ হাঁ হয়ে গেল।

‘আরে বস মুখ বন্ধ করেন। শান্ত হয়ে বসেন। গল্পগুজব করি। কান্নার অভিনয় করতে করতে টায়ার্ড হয়ে গেছি...উফ!’ বলল বাবুটা।

ঈশানের তখনো চোখের পলক পড়ছে না। কোনোমতে সে বলল, ‘তু...তু...তুমি ওখানে উঠলে কী করে?’

‘কীভাবে আবার? লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম।’ বলেই টুক করে লাফ দিয়ে সে বিছানার ওপর নেমে এল। ভয়ে ঈশানের মুখ দিয়ে প্রায় একটা আর্তচিৎকার বেরিয়ে আসছিল। কিন্তু দেখা গেল, বাবুটা নিরাপদেই বিছানায় ‘ল্যান্ড’ করেছে।

‘তারপর বস বলেন, কী কী নাম ভাবলেন?’ কোলবালিশের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল পিচ্চিটা। সে কী ভাব!

‘ইয়ে...তোমাকে কি একটা প্যান্ট পরিয়ে দেব? মানে...দেখতে ভালো দেখা যাচ্ছে না।’

‘ইশ্! সারা দিন আমাকে নেংটু করিয়ে রাখো, তখন কিছু হয় না? আমি যখন কথা বলতে শুরু করলাম, তখনই তোমার সমস্যা হয়ে গেল। প্রতিদিন একগাদা মানুষ আসে আমাকে দেখতে। তাদের সামনে যখন তখন তোমরা আমার প্যান্ট খুলে ফেলো। ছি! আমার বুঝি লজ্জা লাগে না?’

‘স্যরি স্যরি, আর হবে না। আমি মাকে বলব...’

‘থাক থাক। মাকে কিছু বলতে হবে না। এটা তোমার আর আমার সিক্রেট। খবরদার, কাউকে বলবে না যে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলেছি। আর বললেও অবশ্য কেউ তোমার কথা বিশ্বাস করবে না।’ বলতে বলতে ছোট্ট মানুষটা নিজে নিজেই কোমরে একটা তোয়ালে জড়িয়ে নিল। ‘তা বলেন বস, কী কী নাম ভাবলেন?’

‘বস’ সম্বোধনের সঙ্গে ঈশান তখনো ধাতস্থ হতে পারেনি। সে বলল, ‘আমার কোনো নাম মাথায় আসছে না।’

‘আচ্ছা এটা কি ঠিক, বলো? একটা মানুষের জীবনে তার নাম একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। সারা জীবন এই নাম বহন করতে হয়। অথচ নামটা রাখে আরেকজন। আশ্চর্য! আমি নামটা পছন্দ করছি কি না করছি, সেটা কেউ জিজ্ঞেসও করবে না। অদ্ভুত নিয়ম।’

এতটুকু একটা মানুষ কথা বলছে, সেটাই এখনো ঈশানের হজম হয়নি। তার ওপর কথার যে ধার, ঈশান রীতিমতো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। বলল, ‘কিন্তু সব বাবু তো তোমার মতো কথা বলতে পারে না। বাবুদের মতামত বড়রা নেবে কীভাবে?’

‘তোমাকে কে বলেছে, সব বাবু কথা বলতে পারে না?’

‘কই, জন্মের পর আমি তো কথা বলতে পারতাম না। আম্মু-আব্বু, বড়রা মিলে আমাকে কথা শিখিয়েছেন।’

‘সেসব কথা তোমার মনে আছে?’

‘না। তবে আমি আম্মুর কাছে শুনেছি।’

‘কচু শুনেছ। শোনো, আমি মনে করি জন্মের পর সব মানুষের নামের বদলে একটা কোড নম্বর থাকা উচিত। ধরো ক৬৪২ কিংবা চ১২৪, গাড়ির নম্বরের মতো। বাচ্চা বড় হলে নিজের পছন্দমতো নাম রেখে নেবে। ব্যস!’

কথাবার্তা শুনে ঈশানের মাথা ঘুরিয়ে গেল। বলল, ‘তাহলে তুমি কি চাও আমরা তোমার নাম ক৬৪২ রাখি? অবশ্য মা বলেছেন তোমার নামের সঙ্গে “ন” রাখতে। আমরা তাহলে ন৬৪২ও রাখতে পারি। তুমি বড় হয়ে না হয় বদলে নিলে।’

‘নামের সঙ্গে “ন” থাকতে হবে কেন? কী অদ্ভুত যুক্তি! যাকগে, তোমরা চেয়েছ যখন, কী আর করা। তা তুমি “ন” দিয়ে নাম খুঁজে পাচ্ছো না?’

‘না’।

‘কত নামই তো হতে পারে। যেমন ধরো ইভান, ইনু, আয়ান। মিতুন, আমিন এসবও মন্দ না। এনাম, কাঁকন, কিংবা একটু আধুনিক কিছু চাইলে টাইটান রাখতে পারো। কমন কিছু নাম আছে—ইমন, রায়হান। আবার একটু কাব্যিক নাম চাইলে বেনজির, কুন্তল বা জীবনও রাখতে পারো।’

পিচ্চিটা যখন একের পর এক নাম বলছে, ঈশান চট করে নামগুলো কাগজে টুকে নিল। বাহ্, বেশ কয়েকটা নাম পাওয়া গেছে! ‘থ্যাংক ইউ।’ বলল সে। যদিও মনে মনে খুব একটা খুশি হতে পারল না। ভেবেছিল ছোট ভাইয়ের নাম রেখে বেশ একটা ভাব নেবে, ছোট ভাই তাকে ‘ভাইয়া’ বলে ডাকবে...তা না। এই পিচ্চি তাকে ডাকছে ‘বস’!

ঈশান বলল, ‘কিন্তু...ইয়ে মানে, তুমি এত নাম কীভাবে জানো? আর তোমাকে হাঁটতে শেখাল কে? তুমি...মানে...’

‘আহ্হা! আমতা আমতা করছ কেন?’ পিচ্চিটা মনে হলো খুবই বিরক্ত। ‘শোনো, মা ঘুম থেকে উঠে যাবে। আমি এখন শুয়ে পড়ব। খবরদার, মাকে কিছু বলবা না। তোমাকে যে নামগুলো বলেছি, সেগুলোর মধ্যে তোমার জন্য একটা মেসেজ আছে। যদি মেসেজটা ডিকোড করতে পারো, তাহলে তোমাকে আমার একটা সিক্রেট বলব। দেখি তোমার কেমন বুদ্ধি।’

‘কিন্তু মেসেজটা...’ ঈশান বলার আগেই পিচ্চিটা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। গুটিসুটি মেরে সে এমনভাবে চোখ মুদে রইল, যেন কিচ্ছু বোঝে না।

আশ্চর্য! নামগুলোর মধ্যে কী মেসেজ লুকিয়ে আছে?

উত্তর

ছোট বাবুটা যে নামগুলো বলেছে, প্রতিটা নামেই ‘ন’ আছে। প্রতিটি ‘ন’ এর আগের বর্ণগুলো পর পর সাজালেই পেয়ে যাবে লুকানো ম্যাসেজ—‘ভাইয়া তুমি একটা মহা বেকুব’।