ভয়াল প্রতিফলন
গ্রামের এককোনায় দাঁড়িয়ে ছিল একটি পুরোনো আর ভুতুড়ে স্কুল। একসময় এখানে লেখাপড়া করত শিশুরা। কিন্তু এখন তা পরিত্যক্ত। অযত্নে পড়ে থাকা সেই স্কুলের জানালা দিয়ে ঝিলিক দেওয়া একটা লাল আলো মাঝেমধ্যে রাতের অন্ধকারে দেখা যেত। গ্রামের মানুষ বলত, রাতে সেই আলো যে দেখবে, তার জীবন বদলে যাবে।
আরিফ নামের এক যুবক শহর থেকে গ্রামে এসেছিল। লোকমুখে সে শুনেছিল এই পরিত্যক্ত স্কুলের কথা। ভীষণ কৌতূহল জেগেছিল তার। গ্রামের বৃদ্ধরা সাবধান করে দিয়েছিল আরিফকে, ‘এই জায়গা থেকে দূরে থাকো, একবার ভেতরে ঢুকলে ফিরে আসা সহজ নয়।’
বেশ সাহস ছিল আরিফের। সে ভাবল, এসব পুরোনো গল্প শুধু ভয় দেখানোর জন্য। রাতে একাই স্কুলটির দিকে পা বাড়াল সে। গুমোট বাতাসে মনে হচ্ছিল যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তাকিয়ে আছে আরিফের দিকে। কিছু দূর এগিয়েই দেখতে পেল সেই লাল আলো। স্কুলের ভেতর থেকে আসছিল আলোটা।
স্কুলের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল আরিফ। অস্বাভাবিক কিছুই মনে হলো না তার। শুধু পুরোনো ডেস্ক ও চেয়ারগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল এদিক–সেদিক। তবে, একটা অদ্ভুত ঠান্ডা অনুভূতি আচ্ছন্ন করে ফেলছিল তাকে। হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে তার পেছনের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। দ্রুত দরজা খোলার চেষ্টা করল আরিফ। কিন্তু কোনোভাবেই খোলা গেল না দরজা। তখনই ঘরের কোণে পড়ে থাকা পুরোনো একটি আয়না দেখল সে।
আরিফ যতই আয়নাটির দিকে এগিয়ে গেল, ততই তার মনে হলো যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তাকে টেনে নিচ্ছে। আয়নায় তার প্রতিবিম্ব নড়ছে ধীরে ধীরে। খটকা লাগল আরিফের। তার প্রতিবিম্বের মুখ সাদা, চেহারায় কোনো অনুভূতি নেই। চোখগুলো খালি। এর মধ্যেই পেছন থেকে ফিসফিস একটা আওয়াজ শুনতে পেল সে, ‘আমার মতো হয়ে যাও।’
আরিফ ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল, স্কুলের চেয়ারগুলো একে একে নিজে নিজে নড়ছে। ফিসফিস আওয়াজ আরও বাড়ল। বিকৃত হয়ে উঠল আয়নার প্রতিবিম্ব। প্রতিবিম্বের মুখের দিকে একটা সাদা ছায়া এগিয়ে আসছে, যেন তাকে নিজের মধ্যে শুষে নিতে চায়। ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল আরিফ। কিন্তু কোনো আওয়াজ বের হলো না তার গলা দিয়ে। হঠাৎ আয়না থেকে বেরিয়ে আসে সেই ছায়া। আছড়ে পড়ে তার ওপর।
আরিফের শরীর সোজা হয়ে যায়। তার চোখগুলো ঢেকে যায় অন্ধকারে। শূন্যতায় মিলিয়ে যায়। তার প্রতিবিম্ব এখন সেই আয়নায় স্থির হয়ে গেছে। সেই মুহূর্তে তার মনে হয়, সে আর কখনো বাইরে বের হতে পারবে না।
গ্রামের মানুষ পরদিন সকালে দেখল, স্কুলের সামনে একটি নতুন জানালা খুলে গেছে। তবে আরিফ কোথাও ছিল না। শুধু আয়নায় তার ছায়া পড়ে ছিল, আর তার মুখে অদ্ভুত এক হাসি।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইবনে তাইমিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কুমিল্লা