দ্য কুইন স্যাক্রিফাইস

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

‘জ্বালিয়ে দাও সবকিছু!’ গর্জে উঠল রেন তুংয়ের গলা। ‘পুড়িয়ে দাও সব!’

‘মা...’ কথা বলতে চাইল লিলা। সুযোগ পেল না। ওর মুখ চেপে ধরলেন মা। ইশারা করলেন চুপ থাকতে।

হঠাৎ করে কী ঘটে গেল বুঝতেই পারল না ছোট্ট লিলা। পুরো ইয়াতুসক শহরে দাঙ্গা লেগে গেছে। সরকার পতনের পর যে যেভাবে পারে লুট করছে জিনিসপত্র। বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় আত্মসমর্পণ করেছে সেনাবাহিনী। কয়েক দিন ধরে তিনবেলা খেতে পারে না ছোট্ট লিলা। কোনোরকম শুকনো ছোলা আর পানি খেয়ে টিকে আছে ও।

বিদ্রোহীদের নেতা রেন তুং। একের পর এক বাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে সে আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা। এবার এসেছে লিলাদের বাড়িতে। ঘরের এককোণে কাপড়ের স্তুপের নিচে লুকিয়ে আছে মা-মেয়ে। শয়তানগুলোর হাত থেকে বেঁচে গেলেও আগুনে পুড়ে মরতে হবে, বুঝে গেছে সেটা। হঠাৎ বিনা মেঘে বৃষ্টিপাত শুরু হলো ইয়াতুসকে। এমন বৃষ্টি কখনো দেখেনি শহরবাসী। প্রবল বৃষ্টিতে সব আগুন নিভে গেল, বিদ্রোহীরা পনেরো দিন ধরে চলা বৃষ্টির সময়টা নিজেদের ঘরে বসেই কাটায়।

পুরো দিনটা স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে জানাতে চলে গেল লিলার মায়ের। ছোট্ট মেয়েটা পৃথিবীর এত কিছু বোঝে না, কোনো কঠিন বিষয়ে তার আগ্রহ নেই, দাবা ছাড়া।

আরও পড়ুন

সময় পেলেই দাবা নিয়ে বসে যেত সে। আজ তেমনটা হচ্ছে না। ঘরের অবস্থার বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে রেন তুংয়ের লোকেরা। দাবার ঘুঁটি-বোর্ড যে কোথায় গেছে, তার কোনো খবর নেই। একাকী জানালার ধারে বসে আছে লিলা। বাইরে বৃষ্টি দেখছে সে। মা ঘর গোছাতে ব্যস্ত। তখনই কোথা থেকে শোনা গেল তীক্ষ্ণ একটা শব্দ। জিনিসটা কেমন, ঠিক করে ব্যখ্যা করতে পারবে না লিলা। শব্দের উৎসের খোঁজে পেছনে তাকাল সে। বিস্মিত চোখে দেখতে পেল, পুরোনো কাঠের টেবিলটার ওপর একটা দাবার বোর্ড রাখা। ঘুঁটিগুলোও সাজানো সুন্দর করে। এমন চমৎকার বোর্ড এর আগে কখনোই দেখেনি সে, তাই ছুটে যায় টেবিলের দিকে।

সামনে গিয়ে প্রথম চালটা দিতেই অদ্ভুত একটা ব্যপার লক্ষ করে সে। শোনা যায় গায়েবি আওয়াজ, ‘এটা ব্যবহার করো। ইয়াতুসককে বাঁচাও।’

বোকা হয়ে গেল লিলা। দাবার সঙ্গে শহরের সম্পর্ক কী?

কিন্তু শিগগিরই সে জানতে পারল, সম্পর্ক আছে।

অনেক বড় সম্পর্ক।

*

এক সন্ধ্যায় লিলা দেখতে পেল, তার দেওয়া চালে বদলে যাচ্ছে আশপাশের অনেক কিছু। সে যখন নিজের মাকে চেকমেট করল, তখনই বৃষ্টিটা শেষ হলো। হেসে উঠল রোদ। সে যখন ঘোড়ার চাল দেয়, তখনই দূরে কোথায় যেন ঘোড়ার ডাক শোনা যায়। ময়লা হয়ে যাওয়া ঘুঁটিগুলো পরিষ্কার করলে সে দেখতে পায় যে শহরের অসুস্থ মানুষেরা সুস্থ হয়ে গেছে। তার বুঝতে বাকি থাকে না যে এই বোর্ডে জাদু আছে।

সেদিন রাতে ওদের বাসায় হঠাৎ হামলা চালাল একদল বিদ্রোহী। সঙ্গে রেন তুংয়ও আছে। বাকিদের বাইরে রেখে ভেতরে গিয়ে বসল সে। মা-মেয়ে ভয়ে সিঁটিয়ে গেল, বুঝতে পারল না কী করা উচিত।

কিন্তু তারা আবিষ্কার করল, রেন তুং কাউকে খুন করতে আসেনি। লিলাকে একদান দাবা খেলার আমন্ত্রণ জানাল সে। তার ভদ্র ভাষা শুনে কেমন যেন হাসি পেল দুজনের, কিন্তু তারা হাসল না।

প্রথম দিকে বেকায়দা অবস্থায় পড়ে গেল লিলা। গেম প্রায় শেষ। লিলার রানি আর দুটো সৈন্য ছাড়া সব ঘুঁটিই চলে গেছে। এমন মুহূর্তে ভাবতে শুরু করল সে। ভাবতে ভাবতে মিনিটের পর মিনিট চলে গেল। শেষে হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। নিজের রানিকে বিসর্জন দিয়ে দিল সে। হেসে রানিকে কেটে ফেলল রেন তুং এবং নিজের সবচেয়ে বড় ভুলটা করল।

আরও পড়ুন

পরের চালে চেক হলো সৈন্য দিয়ে। রাজা সেটাকে খেতে পারল না, কারণ পেছনে আরেক সৈন্য সেটাকে ডিফেন্ড করছে। তাকে বাধ্য হয়ে সরে যেতে হলো। পরের চালে লিলা সৈন্যকে শেষ র‌্যাঙ্কে পাঠিয়ে নতুন একটা রানি বানিয়ে ফেলল। খেলা ঘুরে গেল সঙ্গে সঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হেরে গেল কালো।

মুখ তুলে তাকাল রেন তুং। কেমন একটা অস্বস্তি দেখা গেল তার চেহারায়। লিলা তার হাত দিয়ে কালো রাজাকে ফেলে দিল। রেন তুংয়ের শরীর কাঁপতে শুরু করল। একসময় প্রচণ্ড শব্দ হলো আর লাখ লাখ ছাইয়ের কণায় রূপান্তরিত হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল সে। আকাশে মেঘ কেটে চাঁদ উঠল। ইয়াতুসকবাসীদের মুখে মুখে এখনো প্রচলিত আছে যে সেই রাতে সব বিদ্রোহী হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন