‘জানিস, আমার দাদুর একটা পালা ভূত আছে।’
‘সত্যি?’
‘আমার দাদু খুব ভালো মানুষ। তাকে নিয়ে মিথ্যা কথা বলব কেন?’
‘তোর দাদুর ভূত কী করে? ভয় দেখায়?’
কথা হচ্ছিল মাহিন ও সাকিবের মধ্যে। তারা পাড়ার দুই বন্ধু। আজ স্কুল ছুটি বলে বাড়ির খোলা বারান্দায় বসে গল্প করছিল।
‘না, ঠিক ভয় দেখায় না, তবে দাদুকে হেল্প করে।’
‘কী রকম হেল্প?’
একটা চিত্কার দিল, ঘর্ঘর শব্দ হলো ওর গলায়। সব কটি ভেড়া একসঙ্গে তাকাল তার দিকে, যেন বলছে, ‘সমস্যা কী? বাসায় যাও...দেখছ না আমরা একটা জরুরি কাজে ব্যস্ত!’
‘অনেক রকম হেল্প। এই ধর দাদুর ঘুম পাচ্ছে না। তখন দাদু ঘুম আসার জন্য ভেড়া গোনে, সেই ভেড়ার হিসার রাখে ওই ভূতটা। দাদুর হিসাবে গোলমাল হয়ে যায় তো, তাই।’
‘বলিস কী? আমি তোর দাদুর ভূত দেখতে চাই।’
‘সব দিন তো ভূত আসে না।’
‘কবে আসে?’
‘এই ধর শনি আর মঙ্গলবারে ভূতটা আসে।’
‘আজকে তো শনিবার, আজকে আসবে?’
‘আসতে পারে যদি দাদুর ঘুম না আসে। তারপর দাদু যখন ভেড়ার পাল গুনতে শুরু করবে, তখন ভূতটা আসবে ভেড়ার হিসাব রাখতে।’
‘শনি আর মঙ্গলবারে তোর দাদুর ঘুম আসে না?’
‘অনেকটা ওই রকমই।’
মাহিন বেশ বুঝতে পারছে গুল মারছে সাকিব। মাহিন খেয়াল করেছে, সাকিব আজকাল প্রচুর গুল মারে। যেমন ওই দিন বলল, তাদের স্কুলের ড্রিল স্যার নাকি একটা নতুন ৫ নম্বর ফুটবল কিনছে খেলার জন্য। আগের ঢ্যাড়ঢ্যাড়া বলটা নিয়ে আর খেলতে হবে না ওদের। কিন্তু কিসের কি, সেদিন গিয়ে দেখে সবাই ওই ঢ্যাড়ঢ্যাড়া বলটা দিয়েই খেলছে। যেটাতে লাথি দিলে ঢপ করে অদ্ভুত একটা শব্দ হয়। কিংবা আরেক দিন সাকিব বলল, নেহালদের বাসার পেয়ারাগাছে টসটস করছে সব পেয়ারা। সবাই নাকি পেড়ে খাচ্ছে, ওদের দারোয়ান কিছু বলছে না। শুনে একদিন গেল মাহিন। গিয়ে দেখে কিসের কি? পেয়ারাগাছ পুরা ফকফকা। ও পেয়ারাগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে দেখে নেহালদের দারোয়ান খেঁকিয়ে উঠল, ‘ওই ছোঁড়া, ওখানে ঘুরঘুর করছিস কেন?’ এত মেজাজ খারাপ হয়েছিল মাহিনের। কাজেই ওর দাদুর ভেড়া গোনার ভূত যে একটা আজগুবি গল্প, তা আর বলতে। তারপরও মাহিন বলল:
‘আজ তো শনিবার।’
‘হুঁ, আজ শনিবার।’
‘আজ ভূতটা আসবে ভেড়া গুনতে?’
‘আসতে পারে, যদি দাদুর ঘুম না পায়।’
‘আমি আসব তাহলে।’
‘আসিস। ঠিক ১০টার মধ্যে চলে আসিস। দাদু ৯টায় শুয়ে পড়ে।’
‘সত্যি আসব কিন্তু।’
‘আসিস।’
‘তোর দাদু আবার রাগ করবে না তো?’
‘নাহ্। আসিস।’
১০টার সময় বেরোল মাহিন। পাশের বাসাটাই সাকিবদের। আগে অবশ্য সাকিবরা একটু দূরে ছিল, মাসখানেক হলো ওরা মাহিনদের পাশের বাসাটায় এসে পড়েছে। কাজেই রাতবিরেতে ওদের বাসায় যেতে এখন আর কোনো বাধা নেই। তারপরও মা চেঁচালেন—
‘এত রাতে কই যাস?’
‘সাকিবদের বাসায় যাব একটু, এখনই চলে আসব।’ মাহিনের অবশ্য বলতে ইচ্ছা হলো, ‘ওর দাদুর ভূতটা দেখেই চলে আসব’, কিন্তু বলল না।
সাকিবদের বাসার কাছে আসতেই একটা বোঁটকা গন্ধ নাকে এল মাহিনের। কিসের গন্ধ! তার মাথার ভেতর কেউ যেন বলল, ‘ভেড়ার গন্ধ’ আর তখনই মাহিনের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। তাকিয়ে দেখে সাকিবদের বাসার সামনে অনেকগুলো ভেড়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অনেক মানে অনেক...শত শত...হাজার হাজার। এবং তারা দাঁড়িয়ে আছে সাকিবের দাদু যে ঘরটায় থাকেন, ঠিক তার জানালার নিচে। এবং তার চেয়েও আশ্চর্য হচ্ছে হঠাৎ একটা ভেড়া লাফ দিয়ে জানালা দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে দাদুর ঘরে। একটা, তারপর আরেকটা...তারপর আরেকটা...তারপর আরেকটা...। মাহিনের পা দুটো যেন গাছ হয়ে গেঁথে গেছে মাটিতে, সে আর নড়তে পারছে না। একটা চিত্কার দিল, ঘর্ঘর শব্দ হলো ওর গলায়। সব কটি ভেড়া একসঙ্গে তাকাল তার দিকে, যেন বলছে, ‘সমস্যা কী? বাসায় যাও...দেখছ না আমরা একটা জরুরি কাজে ব্যস্ত!’
পরদিন স্কুলের মাঠে সাকিবের সঙ্গে দেখা হলো মাহিনের। সাকিব বলল,
‘কিরে কাল এলি না যে?’
‘ইয়ে...একটু কাজ ছিল।’ মাহিন খেয়াল করল, নতুন একটা বল নিয়ে খেলছে সবাই। ঢ্যাড়ঢ্যাড়া বলটা মাঠের এক পাশে অবহেলায় পড়ে আছে।
‘খেলবি?’ সাকিব মাঠের ভেতর নতুন বলটার পেছনে ততক্ষণে ছুটতে শুরু করেছে।
‘না।’ বলে ঢ্যাড়ঢ্যাড়া বলটার দিকে এগিয়ে যায় মাহিন। কেন যেন ওই বাতিল বলটার জন্য ওর মায়া হচ্ছে।