ডাকটিকিট সংগ্রহকে বলা হয়ে থাকে ‘শখের রাজা’। একজন সংগ্রাহক শুধু ডাকটিকিট সংগ্রহ করেই বসে থাকেন না, খোঁজ রাখেন ডাকটিকিটের খুঁটিনাটি সবকিছুর। ডাকটিকিট নিয়ে করেন বিস্তর পড়াশোনা। ডাকটিকিট সংগ্রহের এ চর্চাকে বলে ‘ফিলাটেলি’। অসংখ্য বিষয় থাকে ডাকটিকিটে—ফুল, পাখি, রাজা–রানি, জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ। তেমনই একটি বিষয় ‘লোকগল্প’। এই লোকগল্পকে ইংরেজিতে বলে ‘ফোকটেল’। লোকগল্পনির্ভর ডাকটিকিট পাঠকে তাই বলা হচ্ছে ‘ফিলাটেল’। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ তাদের লোকগল্প নিয়ে ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশ ভিয়েতনামও তাদের ডাকটিকিটে নিয়ে এসেছে বেশ কিছু লোকগল্প। ‘সোনার কামরাঙা’ নামে তেমনই একটি গল্প নিয়ে ভিয়েতনাম ডাক বিভাগ ২০২২ সালে চারটি ডাকটিকিট ও একটি স্যুভেনির শিট প্রকাশ করে। তোমাদের জন্য গল্পটি অনুবাদ করা হলো। সংগ্রহ ও রূপান্তর করেছেন নিজাম বিশ্বাস।
অনেক দিন আগে ভিয়েতনামের এক ছোট্ট গ্রামে বাস করত একজন ধনী লোক। মৃত্যুর পর তার অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে গেল তার দুই ছেলে। সেই দুই ভাইয়ের মধ্যে বনিবনা ছিল না মোটেও। এক ভাইয়ের চেয়ে আরেক ভাই স্বভাব–চরিত্রে ছিল একেবারেই আলাদা। বড়টি ভীষণ লোভী, চতুর আর আলসের ঢেঁকি। অন্যদিকে ছোট ভাই ছিল এক্কেবারে মাটির মানুষ।
বাবার রেখে যাওয়া সম্পদের ভাগ–বাঁটোয়ারা হলো। প্রায় সব সম্পদই নিজের বলে দাবি করল বড় ভাই। পাকা ঘর, ফসলি জমি, গবাদিপশু, ঘাটবাঁধা পুকুর থেকে শুরু করে দামি দামি সবকিছু নিয়ে নিল সে। ছোট ভাইকে দিল মোটে একটি কামরাঙাগাছ। যদিও গাছটিতে বছরের প্রায় ১২ মাসই সোনালি রঙের কামরাঙা ধরে থাকে থোকায় থোকায়। তবু এ যে বড় অন্যায় হয়ে গেল ছোটর সঙ্গে। সহজ–সরল ভাইটি সাতপাঁচ না ভেবে কামরাঙাগাছটির পরিচর্যা করতে লাগল। নিয়ম করে প্রতিদিন গাছের গোড়ায় জল ঢালে। পরিষ্কার করে দেয় আগাছা, ঝরাপাতা আর শুকনা ডাল। তারপর সেই সোনালি কামরাঙা অনেক দূরের হাটে নিয়ে বিক্রি করে। এভাবেই কষ্ট করে দিন চলে তার। অন্যদিকে বাবার রেখে যাওয়া অঢেল সম্পদ বিক্রি করে দিয়ে বড় ভাই চলে গেল শহরে। সেখানে সে গড়ে তুলল এক আলিশান প্রাসাদ। এখন সে এতই সম্পদের মালিক হয়ে গেছে যে তাকে আর নতুন করে কিছুই করতে হয় না। পায়ের ওপর পা তুলে আরাম–আয়েশে তার দিন চলে যায়।
ছোট ভাইটি সত্যিই খুব বোকা। বড় যা বলল, তা–ই মেনে নিল নির্বিবাদে। এ নিয়ে তার স্ত্রী প্রায় প্রতিদিনই তাকে কথা শোনায়, ‘এমন বোকা লোক আমি আমার জীবনে দেখিনি, বড় ভাইকে সবকিছু দিয়ে মোটে একটা কামরাঙাগাছ নিল, আর এই টক ফল সবই তো পাখি খেয়ে ফেলে…।’ ছোট ভাইয়ের স্ত্রী একদিন যখন এ কথা বলছিল, ঠিক তখনই মস্ত বড় এক কাক গাছের ওপর বসে বসে খুব মজা করে কামরাঙা খাচ্ছিল। ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর কথা শুনে কাকটি সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কণ্ঠে বলে উঠল, ‘হুম, আমি তোমাদের সব কামরাঙা খেয়ে ফেলি? ঠিক আছে, তাহলে তিন হাত লম্বা একটা বস্তা জোগাড় করো। কামরাঙার পরিবর্তে আমি তোমাদের জন্য সোনা–রুপা–হীরা–জহরতের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’ এ কথা বলেই মস্ত বড় সেই কাকটি ডানা ঝাপটে উড়ে চলে গেল। ছোট ভাইয়ের স্ত্রী কাকের মুখে মানুষের মতো কথা শুনে ভীষণ ভড়কে গেল। একদৌড়ে সে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। তার স্বামীকে সব বলল। তারপর অনেক চিন্তাভাবনা করে তারা তিন হাত লম্বা এক বস্তা সেলাই করল।
একদিন যায়, দুই দিন যায়, কাকের দেখা নেই। বেশ কদিন পর কাকটি আবারও উড়ে এসে বসল তাদের কামরাঙাগাছে। একে একে সব কটি পাকা পাকা সোনালি রঙের কামরাঙা চেটেপুটে খেয়ে নিল। তারপর ছোট ভাইটিকে বস্তা নিয়ে তার পিঠের ওপর বসতে বলল। সহজ সরল লোকটি ভয়ে ভয়ে কাঁধে বস্তা হেলিয়ে কাকের পিঠে উঠে বসল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল কাকের গলা। মুহূর্তের মধ্যেই কাকটি সাঁই করে তাকে নিয়ে আকাশে উড়ে গেল।
কাকটি উড়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। ছোট ভাই ভয়ে তার চোখ বুজে আছে। অবশেষে গ্রাম থেকে অনেক দূরের এক দ্বীপে এসে তারা নামল। ছোট ভাই এবার চোখ খুলে দেখল, এই দ্বীপে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে অসংখ্য সোনাদানা আর হীরা–জহরত। নিজের চোখকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছে না সে। সোনাদানা–হীরা–জহরত ভরে নিল তার বস্তায়। তারপর উঠে বসল কাকের পিঠে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল কাকের গলা। কাকটি উড়ে উড়ে আবার তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এল তার বাড়িতে। এত ধনরত্ন পেয়ে দ্রুতই তাদের ভাগ্য বদলে গেল। তারা রাজপ্রাসাদের মতো এক আলিশান বাড়ি বানাল। আর গ্রামের গরিব মানুষকে দুহাতে করল দান। ছোট ভাইটিও বাবার মতোই এখন অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে গেল।
বেশ কিছুদিন পর পিতার মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বড় ভাই তার স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে এল ছোট ভাইয়ের বাড়িতে। এসে তো তাদের চোখ উঠে গেল কপালে। সোনায় মোড়ানো গেট, পথের ওপর দামি কার্পেট, আর সেকি আলিশান প্রাসাদ রে বাবা! ছোটর সম্পদের কোনো হিসাব নেই। কী করে এমন পরিবর্তন হলো, জানতে চাইলে ছোট ভাই সরল মনে সব ঘটনা তাকে বলল।
বড় ভাই প্রস্তাব দিল, তুমি তাহলে আমার সম্পদ নাও, আর আমি তোমারটা নেব। ছোট ভাই আগের মতোই এবারও কোনো রকম প্রতিবাদ না করেই বড় ভাইয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেল ভাইয়ের শহরের বাড়িতে। আর বড় থেকে গেল ছোট ভাইয়ের বাড়িতে। এখন বড় ভাই আর তার স্ত্রী কামরাঙাগাছটির যত্ন করতে করতেই সারা দিন পার করে দেয়। কিছুক্ষণ পরপরই গাছের গোড়ায় ঢালে জল। শুকনা পাতা, মরা ডাল আর আগাছা পরিষ্কার করে দেয়। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে অধীর আগ্রহে বসে থাকে সেই বড় কাক কখন এসে বসবে তাদের গাছে।
একদিন যায়, দুই দিন যায়, অবশেষে একসময় সেই বিশাল আকারের কাকটি এসে কামরাঙাগাছের ওপর ধপাস করে বসল। দুই পাশে বিশাল দুই পাখনা ছড়িয়ে ইচ্ছেমতো খেতে শুরু করল সোনালি রঙের পাকা পাকা কামরাঙাগুলো। ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর মতো বড় ভাইয়ের স্ত্রীও কাকটির উদ্দেশে বলল, ‘…কাক আমাদের গাছের সব কামরাঙা খেয়ে শেষ করে দিচ্ছে।’ এ কথা কাকের কানে যাওয়ামাত্র সে আগের মতোই মানুষের কণ্ঠে বলে উঠল, ‘হুম, আমি তোমাদের সব কামরাঙা খেয়ে ফেলি? ঠিক আছে তাহলে তিন হাত লম্বা একটা বস্তা জোগাড় করো। কামরাঙার পরিবর্তে আমি তোমাদের জন্য সোনা–রুপা–হীরা–জহরতের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’ বড় ভাই আর তার স্ত্রী ছিল ভীষণ লোভী। তারা তিন হাতের পরিবর্তে বানাল ছয় হাত লম্বা দু–দুটি বড় বড় বস্তা।
কয়েক দিন পর কাকটি আবার এসে বসল কামরাঙাগাছে। একে একে সব কটা পাকা পাকা সোনালি কামরাঙা খেয়ে শেষ করল। তারপর বড় ভাইকে পিঠে নিয়ে উড়ে গেল সেই দূরের দ্বীপে, যে দ্বীপে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে অসংখ্য সোনাদানা আর হীরা–জহরত। বড় ভাই দুটি বস্তায় গাদাগাদি করে ইচ্ছেমতো ঢোকাল ধনরত্ন। গলায় জড়িয়ে নিল দুই ডজন হীরার নেকলেস, কোমরে বেঁধে নিল কয়েকটি সোনার বাজু—এভাবে শরীরের একতিল জায়গাও তার ফাঁকা রইল না। এমনকি মুখেও কামড়ে ধরল কয়েকটি মুক্তার মালা। তারপর দু–দুটি ভারী বস্তাসহ উঠে বসল কাকের পিঠে। কাকটি তাকে নিয়ে উড়ে চলল। একটু ওড়ার পরই কাকটি ক্লান্ত হয়ে গেল। এত বড় বড় দুই বস্তা ধনরত্নের ওজনের কারণে কাকটি ঠিকমতো উড়তেই পারছিল না। তাই একসময় কাকটি তার পিঠ থেকে সেই লোভী বড় ভাইটিকে বস্তাসহ ফেলে দিল জলে। সেটা ছিল সাগরের মাঝখানে। বড় ভাই তার দুটি ভারী ভারী বস্তাসহ টুপ করে ডুবে গেল গভীর জলে। তাকে আর কখনোই খুঁজে পাওয়া গেল না।