দানব

অলংকরণ: আরাফাত করিম

আমার পরিবারের লোকজন যে দানব, এটা বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছে।

পরিবারের লোকজন বলতে আমার বাবা-মা, তিন ভাই, আমার বোন শেফালি, এক বিধবা পিসি, যিনি আমাদের সঙ্গেই থাকেন আশ্রিত হয়ে, আমাদের বৈকুণ্ঠ মামা, আর আমার দাদু, যার বয়স নব্বইয়ের ওপরে।

ডিমেনশিয়ায় দাদু সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন। তার শৈশব-কৈশোর-যৌবনের কিছুই তার মনে নেই। একেবারে ব্ল্যাংক স্লেট। শুধু একটা কুয়া খোঁড়ার আবছা স্মৃতি তার মনে পড়ে মাঝেমধ্যে: বাড়ির বাইরের দিকে খোলা উঠানের এক কোনায় একটা কুয়া খোঁড়া হচ্ছে। ঠিক খোঁড়া নয়, সিমেন্টের রিং পরানো হচ্ছে কুয়ায়। কপিকল দিয়ে দড়ি বেঁধে সবাই কুয়ায় নামাচ্ছে রিংগুলো। নিচে কুয়ার ভেতর একজন কেউ সেটা জায়গামতো বসিয়ে সিমেন্ট লাগিয়ে দিচ্ছে। বড় কুয়া। সে কারণে রিংগুলোও বড় আর ভারী। সেগুলো নামাতে বেশ কিছু লোককে শোরগোল করতে হচ্ছে। এটুকুই স্মৃতি দাদুর। নব্বই বছরের জীবনে একটা কুয়ায় রিং বসানোর হট্টগোল। বাকিটা নিঃসীম অন্ধকার।

আমাদের বাড়িটা একতলা। ইটের দেয়াল। ওপরে টিন। বৃষ্টির দিন চটরপটর শব্দ তুলে তাতে বৃষ্টি পড়ে। শিলাবৃষ্টির সময় ধুন্ধুমার আওয়াজ ওঠে। দুপুরে ভাতঘুমের সময় মাঝেমধ্যে বিড়াল হেঁটে যাওয়ার মোলায়েম আওয়াজ পাই। আর নানা রকম পাতা পড়ার খচমচ শব্দ। আমাদের বাড়ির চারপাশে বড় বড় গাছ। প্রতিবেশী বাড়ির গাছ ঝুঁকে এসে আমাদের বাড়ি ছায়া করে রাখে। এতে আমাদের কাপড় শুকাতে কষ্ট হয়। তবু আমরা কাউকে কিছু বলি না। ওই সব উঁচু গাছের মধ্যে একটা ছিল গামারি। গাছও যে গম্ভীর আর বিমর্ষ হতে পারে, সেটা গামারি গাছ না দেখলে জানতাম না। সেটার পাতা পড়ত আমাদের চালে টুপটাপ করে, সঙ্গে পড়ত ছোট্ট গোল গোল ফল। গামারি ফল পাখি খায় না। ফলে সেগুলো স্তূপ হয়ে জমে থাকে আমাদের চালের ওপর।

আমার শৈশবস্মৃতির প্রায় পুরোটা জুড়ে টিনের চালে এসব বিচিত্র আওয়াজ। কারণ, আমার শৈশবের বড় অংশই কেটেছে অসুস্থ অবস্থায়, বিছানায়। আমার যক্ষ্মা হয়েছিল মেরুদণ্ডে। সে কারণে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতাম না। সারা দিন বিছানায় শুয়ে দাঁতে দাঁত পিষে থাকতাম। ব্যথার চোটে জ্বর এসে যেত। জ্বরে আমি কাঁপতাম সুপারিপাতার মতো।

পাশ ফিরে শুলে ব্যথা আরও বাড়ত। তবে আমি গোঙাতাম না। কাউকে জানতে দিতে চাইতাম না, আমার কষ্ট হচ্ছে। তবু কেমন করে যেন পিসি টের পেতেন। রান্নাঘরে ডাল বাগার দেওয়া অর্ধেক রেখে তিনি নিঃশব্দে স্টোররুমে এসে আমার কপালে হাত রাখতেন, কিছু বলতেন না, চুপ করে বসে থাকতেন। একটা হলুদবাটা মসলার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত ঘরজুড়ে।

বাসায় পিসি সবচেয়ে কম কথা বলতেন। আর কাজ করতেন সবচেয়ে বেশি। তিনি যে আশ্রিত, হয়তো সে জন্যই। বাড়িতে তিনি সবার আগে ঘুম থেকে উঠতেন, ভোরের আলো ফোটার মুহূর্তে। উঠে উঠান ঝাড়ু দিতেন। উঠান ছোটই। তারপর বসে থাকতেন বারান্দার পাউটিতে। কোনো দিকে না তাকিয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে পারতেন তিনি। তাঁকে তখন একটা পাথরের মূর্তি মনে হতো। আমি স্টোররুমের জানালা দিয়ে পিসিকে দেখতে পেতাম।

ছোট্ট বাসা আমাদের। তিনটা বসবাসের রুম। আর একটা স্টোররুম, যেখানে একটা চৌকি পেতে আমার শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রুমভর্তি ফেলনা জিনিসপত্রের স্তূপ—পুরোনো কাপড়চোপড়, পরিত্যক্ত থালাবাসন, সাইকেলের টায়ার, একটা দুমড়ানো ফুটবল। ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধ লেপটে থাকত ঘরটায়।

উঠানের এক কোনায় জাম্বুরাগাছের তলায় একটি খাটা পায়খানা। তাতে টিনের জং ধরা দরজা। সাদা চুনকাম দিয়ে তাতে কেউ গোটা গোটা অক্ষরে লিখে রেখেছে—SLOW। কে এটা লিখেছে, কে জানে, আর দুনিয়ায় এত কিছু থাকতে কেন ‘স্লো’ লেখা, আমি বুঝে উঠতে পারিনি।

বারান্দার এক কোনায় চৌকিতে মামা থাকতেন। আরেক কোনায় ইজিচেয়ারে প্রায় সারা দিন আধশোয়া হয়ে কাটাতেন দাদু। মামা শর্টওয়েভে রেডিও শুনতেন। তাতে অজানা দেশের, অচেনা ভাষার গান বাজত। নব ঘুরিয়ে নামহীন সেন্টার টিউন করা মামার নেশা ছিল। একবার তিনি বিদঘুটে আওয়াজের একটা শর্টওয়েভ সেন্টার পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘অ্যান্ডোরা! অ্যান্ডোরা!’ পরে জেনেছিলাম, অ্যান্ডোরা ফ্রান্স আর স্পেনের মাঝখানে গামারি ফলের মতো গোল ছোট্ট একটি দেশ।

মামা উঁচু খনখনে গলায় কথা বলতেন। সারা বাড়ি সেটা শোনা যেত। আমার ধারণা, বারান্দায় অপর কোণে দাদুর সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে তার গলার স্বর স্থায়ীভাবে উঁচু হয়ে গেছে। দাদু কানে খাটো। খুব কাছে গিয়ে কথা না বললে তিনি শুনতে পান না। মামা তার সঙ্গে যুদ্ধ আর হানাহানি নিয়ে আলাপ করেন। দুনিয়ার কোথাও না কোথাও দুটি দেশ বা একই দেশের দুটি পক্ষের মধ্যে হানাহানি-মারামারি হচ্ছে। মামা সেগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ খোঁজখবর রাখেন। দাদুর কাছে জানতে চান, কোন পক্ষ ন্যায় ও যুক্তির পক্ষে আছে। মামার ধারণা, কোনো বিষয়ে সবচেয়ে নিরপেক্ষ মতামতটাই দাদুর দিতে পারার কথা, যেহেতু তার কোনো স্মৃতি নেই। ফলে কোনো পক্ষপাতও নেই।

মামা সন্ধ্যাবেলা সেজেগুজে ডিউটিতে যান। সদর হাসপাতালে মর্গে চাকরি তার। নাইট ডিউটি।

বাবা বড় বাজারে একটা কাঁসার বাসনের দোকানে বসেন। কর্মচারী। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত সেখানে থাকেন তিনি। লোকজন এলে কাঁসার থালা, জামবাটি, ধূপদানি, পিকদানি নামিয়ে দেখান। একটার সঙ্গে আরেকটা বাসন ঠোকাঠুকি লাগিয়ে ‘ঠং’ আওয়াজ তুলে কাস্টোমারকে বোঝানোর চেষ্টা করেন কোনটা পাকা কাঁসা। বাবা দুপুরে বাসায় ফেরেন না। বাসা থেকে তার কাছে খাবার যায়। টিফিন ক্যারিয়ারে করে সেটা বয়ে নিয়ে যায় শান্তনু, আমার মেজ ভাই। রাতে বাবা বাসায় ফিরলে বাসাটা আগের চেয়ে চুপচাপ হয়ে যায়। সবাই অকারণে বাবাকে সমীহ করে, পা টিপে চলাফেরা করে, গলা নামিয়ে কথা বলে। অথচ এমন না যে উনি রাশভারী।

শান্তনু আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। তার একটা সমস্যা আছে। তার মধ্যে পুরুষালি ব্যাপারস্যাপার একটু কম। ওর হাঁটার ভঙ্গিটাও কেমন যেন। অনেক বয়স পর্যন্ত ও শেফালির সঙ্গে পুতুল খেলত। এ নিয়ে স্কুলে একটা মুখ–টেপাটেপি ছিল। এ কারণে শান্তনু বন্ধুবান্ধব এড়িয়ে চলে। এখনো। আমার সঙ্গে তার বরাবর খাতির বেশি।

শেফালির একটু ছেলেঘেঁষা স্বভাব আছে। একবার ও ছেলেবন্ধুদের নিয়ে দল বেঁধে গ্যারিসন হলে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। এ নিয়ে মা ওকে ধমকটমক দিচ্ছে চাপা স্বরে, আমি শুয়ে থেকে শুনেছি।

বড় হয়ে আমার কোমরের অসুখ সেরে গেছে। একটু কুঁজো হয়ে থাকলেও আমি এখন মোটামুটি সাবলীলভাবে চলাফেরা করতে পারি। তবে ছোটবেলা থেকে একটানা অসুখবিসুখে ভোগার কারণে কিনা কে জানে, আমার মন খুব নরম। বাড়ির সবার প্রতি আমার খুব মায়া, খুব দরদ। এ জন্য যেদিন জানতে পারলাম, এ বাড়ির সবাই দানব, সেদিন আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল।

লোকটা কথা বলছিল খাটের কোনায় বসে, মেঝের দিকে ঝুঁকে যেন একটা বাঁধানো পুকুরপাড়ে বসে নিচে জলের মধ্যে নিজের ছায়া দেখছে। এতক্ষণ ধরে সে একটানা কথা বলে গেল স্বগতোক্তির মতো।

আমি তার উল্টো দিকে আরেকটা খাটে চিত হয়ে শুয়ে শুনছিলাম। বেশির ভাগ সময় তাকিয়ে ছিলাম ছাদের দিকে।

এটুকু শোনার পর আমি মুখ খুললাম। বললাম, দানব মানে?

দানব বলতে সবাই যেটা বোঝে, সেটাই—দানব।

সেটা তো একটা কথার কথা। মিথ।

আমিও তো মিথই জানতাম। কিন্তু আমার ভুল ভেঙেছে। এগুলো আছে।

তারা যে…ওই যেটা বললেন…, দানব, কীভাবে বুঝলেন?

আমি দেখেছি।

কী দেখেছেন?

খেতে।

কী খেতে?

মাংস।

‘মাংস’ কথাটা লোকটা এমনভাবে বলল, আমার আর জিজ্ঞাসা করার দরকার পড়ল না, কিসের মাংস।

কীভাবে দেখলেন?

লোকটা এতক্ষণ নিজের খাটে বসে ছিল। এবার উঠে একটা চেয়ার টেনে আমার সামনে এসে বসল।

একটা অপরিসর কক্ষে কাছাকাছি দুটি খাট। একটায় আমি আছি আজ মাস তিনেক ধরে। বলা যায়, একটা বস্তার মতো পড়ে আছি। অপর খাটে গত পরশু এসে উঠেছে এই কুঁজো লোকটা। হাড়–জিরজিরে শরীর। দেখে মনে হবে একটা কঙ্কাল।

লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ১৪ বছরের আগপর্যন্ত আমার কোনো দিন সন্দেহ হয়নি। হবে কেন, হওয়ার কোনো কারণ ঘটেনি। কিন্তু এখন ভাবলে বুঝি, আরও আগেই আমি টের পেতে পারতাম, ইশারা ছড়িয়ে ছিল চারপাশে, চোখ-কান খোলা রাখলেই বুঝতে পারতাম। প্রথম সন্দেহটা হতে পারত দাদুকে নিয়ে। কেন দাদুর কোনো স্মৃতি নেই? সেটা কি শুধু ডিমেনশিয়া? ডিমেনশিয়ার রোগীরা এভাবে শৈশব-কৈশোর সব ভুলে যায় না। দাদুর সম্ভবত কোনো শৈশব-কৈশোরই নেই, যে অর্থে আমাদের থাকে। দ্বিতীয় সন্দেহটা হতে পারত মামাকে নিয়ে। মামা মর্গে চাকরি করেন। সারা রাত লাশের মধ্যে কাটান তিনি। নানা রকম লাশ। কোনোটা দুর্ঘটনায় মৃত, কোনোটা খুন হয়ে। আমি শুনেছি, লোকে বলাবলি করত, মামা পুরো রাত নাকি মর্গের ভেতরেই কাটাতেন, মর্চুয়ারিতে, যদিও বাইরে অন্য ঘরে তার বসার জায়গা ছিল। তিনি বসতেন না। লাশের সান্নিধ্য পছন্দ তার—লোকে বলাবলি করত।

আমি বললাম, তাতে কী?

লোকটা একটু দম নিল। তারপর বলল, প্রতি মাসে অমাবস্যার রাতে আমাদের বাসাটা বদলে যেত। বাসার সবার চলাফেরায় একটা কেমন পরিবর্তন আসত। সেটা আলাদা করে শনাক্ত করা মুশকিল। কিন্তু আমি অনুভব করতে পারতাম। সবাই কেমন যেন একটা চাপা উত্তেজনা নিয়ে চলাফেরা করছে। সেদিন সন্ধ্যায় মামা একটু বেশি যত্ন নিয়ে রেডি হতেন। বাড়ির লোকজন সেদিন তাকে বাড়তি খাতির করত। সবাই তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিত, যেন তিনি ট্রেনে চেপে অন্য শহরে যাচ্ছেন। আর রাতের তৃতীয় প্রহরে, অন্য দিনের চেয়ে আগেভাগে তিনি যখন ফিরতেন, তখন খুব আলতো করে গেটে ছিটকিনি ঝাঁকিয়ে কড়া নাড়তেন। মা সন্তর্পণে গিয়ে দরজা খুলে দিতেন। আর মামা একটা প্যাকেট হাতে বাড়িতে ঢুকতেন। একটা ব্যাগ। ভারী ব্যাগ। মায়ের হাতে সেটা তুলে দিয়ে তিনি বলতেন, ‘আজ ভালো চালান পেয়েছি।’ তারপর বাথরুমে চলে যেতেন। আর মা ব্যাগ নিয়ে রান্নাঘরে চলে যেতেন।

অমাবস্যার রাতগুলোয় বাসার সবাই জেগে থাকত এবং পা টিপে টিপে চলাফেরা করত আর বারান্দায় ছোট্ট ডাইনিং টেবিলের চারপাশে গোল হয়ে খেতে বসত শেষ রাতে। এ সময় বারান্দার বাতি নেভানো থাকত। অন্ধকারে তাদের খাওয়ার শব্দ শুনতে পেতাম আমি। কাঁচা কিছু চিবিয়ে খাওয়ার শব্দ। তার আগে তারা নিশ্চিত হয়ে নিত, আমি ঘুমাচ্ছি কি না।

আপনাকে নিত না কেন? অসুস্থ বলে?

না। নিত না আমি দানব না বলে।

পরিবারের সবাই দানব, শুধু আপনি নন?

না।

কেন?

এটা আমার কাছে একটা রহস্য। আমার অনুমান আমি ওই পরিবারের সদস্য নই। এটা আমাকে কেউ বলেনি। আমার অনুমান আমাকে অ্যাডপ্ট করা হয়েছে। দত্তক। আর সেটা আমার কাছে লুকানো হয়েছে। কেন আমাকে দত্তক নেওয়া হলো, আর কেন সেটা গোপন করা হলো, আমি জানি না। হয়তো একদিন জানব। তবে এ নিয়ে আমি কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করব না। কাউকে আমি এখনো জানতে দিইনি যে আমি জেনে গেছি।

যে, তারা দানব?

হ্যাঁ।

দানব নাকি পিশাচ?

পিশাচই হবে বোধ হয় শব্দটা। তবে আমি দানবই বলব।

নরমালি পিশাচেরা আর কী কী করে?

আমি জানি না।

‘খাওয়ার’ ব্যাপারটা ছাড়া আপনার পরিবারের লোকেরা আর কী করে?

আর কিছুই করে না। এটুকু ছাড়া তাদের মধ্যে আর কোনো দানবত্ব নেই। অন্য যেকোনো মানুষের চেয়ে নিরীহ, শান্ত তারা।

আমরা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।

মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। কমে এসেছে বাইরে রাস্তার কোলাহল। একটা ঘোড়ার গাড়ি গেল খটাখট আওয়াজ তুলে। এ অঞ্চলে এখনো কিছু ঘোড়ার গাড়ি দেখা যায়, তাতে জায়গাটা পশ্চিম দেশীয় বলে ভুল হয়।

সরাইখানার ছেলেটা আমার ভাত ঢেকে রেখে গেছে টেবিলে। অধিকাংশ দিন ওভাবে ঢাকাই পড়ে থাকে। বেশ কিছুদিন হলো আমার খাবার রুচি চলে গেছে। চিরতরে। লোকটা বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে।

পাটকাঠির মতো দেখতে এই লোক পরশু উঠেছে এ হোটেলে। আমার সঙ্গে রুম শেয়ার করা ছাড়া তার উপায় ছিল না। পুরো হোটেলে ওই একখানা বেডই খালি। কয়েক দিন ধরেই শহরের সব হোটেল-মোটেল ভরে গেছে, কোথাও জায়গা খালি নেই। মাঝপুকুর কয়লাখনির ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দুই সপ্তাহ ধরে বর্ণাঢ্য উৎসব চলছে এই মফস্বল শহরে। দূরদূরান্ত থেকে লোক আসছে।

উল্টো দিকের বেডটা খালি পড়ে থাকার কারণ, এখানে প্রচার হয়ে গেছে, কোনো এক অজ্ঞাত ছোঁয়াচে রোগে আমি অসুস্থ। এ কক্ষে কেউ আসে না, ভাত এনে দেওয়া ওই ছেলেটি ছাড়া।

আমি লোকটাকে বললাম, আপনার পরিবারের এমন ভয়ানক একটা তথ্য আমাকে দেওয়ার কারণ কী?

লোকটা জবাব না দিয়ে জানালাপথে বাইরে তাকিয়ে থাকল। বাইরে অন্ধকার আকাশে আতশবাজি পুড়ছে। দূরে, উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা কয়লাখনির ভেতরে কার্নিভ্যাল শুরু হয়েছে। অন্ধকার আকাশে উঠে যাওয়া তিন বিশাল কালচে চিমনিরও অনেক ওপরে ‘পটপট’ শব্দে ফেটে পড়ছে বিচিত্র আলোর ফুলকি, আর তার আভায় লোকটার হাড্ডিসার মুখমণ্ডল মাঝেমাঝেই আলোকিত হয়ে উঠছে।

আমি বললাম, আপনি কি জেনে গেছেন, আমি আর বেশি দিন বাঁচব না?

লোকটা আতশবাজির দিক থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকাল। বলল, হ্যাঁ।

কত দিন বলে আপনার ধারণা?

জানি না।

আমি বলছি। আর তিন দিন। আমার আয়ু আর তিন দিন, বড়জোর।

লোকটার মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো না।

আমি বললাম, একটা কথা জানতে চাই, যদি আপনি আহত বোধ না করেন।

বলুন।

আমি যখন মারা যাব, হতে পারে সেটা মাঝরাতে বা দুপুরবেলা, তখন এ ঘরে আপনি থাকবেন, বোঝাই যাচ্ছে। আমার লাশটাকে আপনি কী করবেন?

কী করব মানে?

আমার লাশটাকে কি আপনি খেয়ে ফেলবেন?

লোকটার চোখে একটা বিষাদের ছায়া পড়ে। বলেন, কেন বললেন এ কথা?

আমি চাই না, মৃত্যুর পর আমার দেহ কেউ চিবিয়ে খেয়ে ফেলুক।

লোকটা বলল, আমি দানব না।

তাহলে এখানে এসেছেন কেন?

লোকটা এবার উঠে দাঁড়ায়। দরজার কাছে গিয়ে তাতে কান পাতে। দরজা খুলে বাইরে করিডরে কেউ আছে কি না পরীক্ষা করে। তারপর এসে আবার বসে চেয়ারে। আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে প্রায় না শুনতে পাওয়ার মতো করে বলে, আমি এসেছি একটা লোককে খুঁজতে।

কাকে?

এক দানব-শিকারি।

কে সে?

লোকটা এ শহরে আসবে তার শিকারের খোঁজে। আমি নিশ্চিত জেনেছি।

তাকে কী দরকার আপনার?

আপনাকে বলেছি, আমার পরিবারকে আমি ভালোবাসি। জীবন দিয়ে আমি তাদের রক্ষা করতে চাই। আমি জানি, তাদের যদি কোনো দিন বিপদ আসে, এই লোকটার দিক থেকে আসবে, এই দানব-শিকারির দিক থেকে। লোকটা একটা মিশন নিয়ে পথে নেমেছে আজ থেকে ছয় বছর আগে। খুঁজে খুঁজে বের করছে লুকিয়ে থাকা দানবদের। কোনো না কোনো দিন সে আমার পরিবারের খোঁজ পেয়ে যাবে। ওরা লুকিয়ে থাকতে পারবে না। লোকটা আমার পরিবারকে খুঁজে বের করার আগেই আমি তাকে খুঁজে বের করতে চাই। তার মুখোমুখি হতে চাই। আমার পরিবারকে আমার বাঁচাতেই হবে।

ঘরটা নীরব হয়ে গেছে।

আমি শুয়ে থেকে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছি। লোকটা বসে আছে চেয়ারে। ঝিমাচ্ছে। আতশবাজি অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে। উৎসবকারীরা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

তারপর অনেক রাতে, যখন আমারও একটু তন্দ্রা মতন এসেছে, বাইরে করিডরে আওয়াজ শুনলাম। পায়ের আওয়াজ। ভারী শরীরের কেউ একজন চামড়ার চপ্পল পরে হেঁটে আসছে, আলতো পায়ে, সন্তর্পণে। প্রতিটা কক্ষের দরজার সামনে একটু করে থামছে যেন। তারপর আবার এগিয়ে আসছ।

আমি চেয়ারে বসা লোকটার দিকে তাকালাম।

লোকটার তন্দ্রা টুটে গেছে। চোখ চকচক করছে।

লোকটা উঠে দাঁড়াল।

তার প্রতীক্ষা শেষ হয়েছে।