তাহলে শুরু

সেদিন সকালে জানলা দিয়ে দেখা গেল নরম শাদা বরফ পড়েছে। ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ অন্যদিনের চেয়ে বেশি সময় কাটাল খাঁচাগুলোর কাছে, কুকুরদের সঙ্গে। খে'কুরের কাছে গিয়ে আদর করে বললে:

'কেমন মেজাজ আজ? কানদুটো দেখেই বুঝছি ভালো। শীতকালটা বেশ ভালো লাগে তাহলে? কবি পুষ্কিন বলেছেন, "শীতকাল? স্লেজে চেপে সগর্বে নতুন পথ কাটে চাষী..." নতুন পথ কাটা বৈকি। আমরাও আজ শুরু করব। শুরু! শুরু!' মাথার চুল ঝাঁকিয়ে সগভীরে বললে সে, 'খে'কুরে, খোকন, গুবরে চলো যাই!'

প্রথম তুষারপাতের এই সকালটায় সেদিন খোকুরের সামনে যে দরজা খুলল, সেটা যেন নতুন, কঠিন তবু আনন্দের এক জগতের দরজা।

আর সবকটি মোটর যখন গোঁ গোঁ করছিল, তখন ওদিকে চুপি চুপি গান গাইছিল ভালিয়া আর ভাবছিল প্যাকেট যন্ত্র, টিউব আর বলের কথা। এখন খেকুরের সঙ্গে সঙ্গে কাঁপছে ওগুলো, পরে ওর সঙ্গেই যাবে রকেটে, জীবন্ত কোনো সাক্ষীর চেয়ে অনেক নিখুঁত করে জানিয়ে দেবে, কী কষ্ট সইতে হয়েছে মহাকাশযাত্রীদের।

বেশ খাপি, সবজে রঙের ইজের আর ফতুয়া পরানো হল ওদের। ভালিয়া পরালে। বোতাম এ'টে দিয়ে ভারি তৃপ্তি হল তার স্যুটগুলো সে নিজেই কেটে সেলাই করেছে কিনা। কুকুরগুলোকে দেখাল যেন বাচ্চা প্যারাশুটিস্ট; নতুন পোষাকে বিশেষ ভরসা না পেয়ে তারা কিন্তু চলা ফেরা করতে লাগল সন্তর্পণে, পাগুলোকে একটু বেশি রকম ফাঁক করে।

'এই বার তোরা হলি খাঁটি এক্সপেরিমেন্টার,' খুশি হয়ে বললে ভালিয়া। এক্সপেরিমেন্টারদের বসানো হল নতুন এক ধরনের ট্রে'র উপর, নতুন ধরনের বেল্ট দিয়ে বাঁধা হল তাদের। পোষাকের তলে ওদের লুকানো রইল ক্ষুদে ক্ষুদে সব যন্ত্র সেন্সিং ডিভাইসেস। বানানো খুব সোজা। ছোট্ট কাগজের প্যাকেটের মধ্যে সরু তারের স্পাইরেল অথবা কার্বন পাউডার ভরা রবারের টিউব। কাগজ আর স্পাইরেল, গুঁড়ো আর টিউব ওই কিন্তু এক - সূক্ষ যন্ত্র, বুক বা পেশী থেকে এতটুকু বিদ্যুৎপ্রবাহ বেরলেও তা ধরা পড়বে তাতে, আর চালান হয়ে যাবে সবুজ পর্দাটায়। এক্ষুনি যন্ত্র চালু করা হবে, কুকুর বসানো ট্রেটা কাঁপতে থাকবে আর পর্দাতেও কাঁপতে থাকবে আলোর হাল্কা তরঙ্গ আর ছোটো ছোটো বিদ্যুৎ ঝলক, ফোটোর ফিতেয় তখন একটা আলোর রেখা ছুটোছুটি করে দেখিয়ে দেবে আঁকাবাঁকা একটা লাইন। শুরু হবে সেন্সারের নিখুঁত রিপোর্ট। হার্ট, নিশ্বাস, রক্তের চাপ সব কিছুরই রিপোর্ট মিলবে তাতে।

'সেন্সার' এই যুৎসই নামের সহজসরল যন্ত্রটি ভারি সুক্ষ। ঘাস কী ভাবে বাড়ছে সেটা অনুবীক্ষণেও ধরা পড়ে না। কিন্তু সেন্সারে সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়বে। ঘাসের সঙ্গে লাগানো হল একটা সুক্ষ তার, চোখে ধরা না পড়লেও সেটায় টান পড়বে আর চাঞ্চল্য জাগবে বিদ্যুৎপ্রবাহে। তাতে মাপ যন্ত্রের কাঁটাটা নড়বে আর একেবারে সঠিকভাবে মাপা যাবে: ঘাসের দৈর্ঘ বাড়ল এক মিলিমিটারের দশ কোটি ভাগের এক ভাগ! এই হল আমাদের হুঁশিয়ার সেল্সার।

খে'কুরেকে যে ট্রেটায় বসান হয়েছিল সেটা ঝাঁকি দিয়ে কী ভাবে কাঁপতে থাকল সেটা ভালিয়া দেখল। দাঁত দেখাল খে'কুরে, পিছনের দিকে কান চেপে টান টান হয়ে উঠল। ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ তখন তার যন্ত্র নিয়ে ব্যস্ত। ভাইব্রেশনে কী রকম ভয় পেয়েছিল খেকুরে সেটা সে দেখেনি।

'নে, বসে থাক লক্ষনী আমার, কী হয়েছে, ভয় কী,' দরদ দিয়ে ফিসফিস করে বললে ভালিয়া।

মোটরের গুঞ্জনে তার কথা শোনা না গেলেও খেকুরে কিন্তু কিছু সহজ হয়ে এল। কাঁপতে থাকা ট্রেটা ছেড়ে পালাবার জন্যে সে কিন্তু আর চঞ্চল হল না: ট্রেতে শান্তভাবে বসে থাকাটা তার আগেই অভ্যেস হয়ে গেছে।

সেন্সার থেকে যন্ত্রে কিন্তু খবর গেল যে তার নাড়ি দ্রুত চলছে, সবজেটে পর্দায় ছোটো ছোটো বিদ্যুতের চঞ্চলতা দেখল ডাক্তাররা।

আরও পড়ুন

বাড়ির দাওয়ায় শুয়ে থাকা বিশ্বস্ত চৌকিদারের মতো খেকুরে এই অস্বস্তি সবই সহ্য করে গেল। ট্রের কাঁপুনি যখন থামল, বেল্ট যখন খুলে দেওয়া হল, তখন সে কয়েকমিনিট জিভ বার করে জিরিয়ে নিলে মেঝের ওপর, তারপর ঠিক আগের মতোই খাড়া হয়ে দাঁড়াল, যেন কিছুই হয়নি।

'সাবাস!' তারিফ করে ভালিয়া তার মুখে একটা লজেন্স গুঁজে দিলে।

গুবরে কিন্তু ট্রের ওপরে করুণ সুরে ডাকতে শুরু করেছিল; তারপরেও বহুক্ষণ তার কাঁপুনি থামেনি। এক টুকরো চিনি খাওয়ার পরেই কেবল তার ধাত ফেরে।

আর পরীক্ষার পরে খোকন কেবল জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে, আর জ্বলজ্বলে বড়ো বড়ো চোখে অবাক হয়ে তাকাতে থাকে সবার দিকে।

'জানেন, ও কী ভাবছে এখন?' আশেপাশের লোকদের দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করল ইওলকিন, 'ভাবছে, কাল যে ইস্কুপটা চুরি করেছিল, সে তো সাগ্রহেই স্বীকার করতে রাজী। দোষ তো মেনেই নিয়েছে, উচিত শাস্তি নিতেও আপত্তি নেই। কিন্তু সাধারণ একটা ইস্কুপের জন্যে অমন ধারা ঝাঁকুনি, এ কখনো আশা করেনি।'

সবাই হেসে উঠল। প্রফেসর বললেন:

'তাহলেও পয়লা নম্বর শত্রু এই ভাইব্রেশন বা কম্পন অথবা খোকন যা ভাবছে ঝাঁকুনি - সেটা সবচেয়ে দুর্বল শত্রু। জেট প্লেনের বৈমানিকদের পক্ষে এটা বরং বেশি ভয়ঙ্কর - তাকে বলে "ফ্ল্যাটার"। প্লাইউডের পাতের মতো থরথর করে কে'পে উঠতে পারে প্লেনের পাখা। কেবিনের মধ্যে বৈমানিককে একেবারে ধাক্কা দিয়ে এদিক ওদিক করতে থাকবে। টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে প্লেন... রকেটের কম্পনে ধ্বংসের ভয় নেই, দরকার শুধু অভ্যেস করে নেওয়া।'

অভ্যেস করিয়ে নেওয়ার পালা চলল প্রতিটি দিন। বাঁধাছাঁদা পরীক্ষাধীন বাচ্চাদের কাঁপাত যন্ত্রে; আর শান্ত হয়ে বসে থাকত ওরা, কেবল জিভটি বার করত, ট্রের সঙ্গে সে জিভও কাঁপত টুক টুক করে।

সবজেটে পর্দার দিকে চাইল ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ। রেখার রহস্যময় ছুট দেখে খুশিই হল সে।

আর সবকটি মোটর যখন গোঁ গোঁ করছিল, তখন ওদিকে চুপি চুপি গান গাইছিল ভালিয়া আর ভাবছিল প্যাকেট যন্ত্র, টিউব আর বলের কথা। এখন খেকুরের সঙ্গে সঙ্গে কাঁপছে ওগুলো, পরে ওর সঙ্গেই যাবে রকেটে, জীবন্ত কোনো সাক্ষীর চেয়ে অনেক নিখুঁত করে জানিয়ে দেবে, কী কষ্ট সইতে হয়েছে মহাকাশযাত্রীদের।

আরও পড়ুন

"ফুটবলের ডাক্তারের জায়গা খেলার মাঠে। জাহাজের ডাক্তার জাহাজে। সার্জেন রোগীর পাশে। আর মহাজগতের ডাক্তার তার যন্ত্রের কাছে।" ভাসিলি ভাসিলিয়ে ভিচের কথাগুলো মনে পড়ল তার, দীর্ঘশ্বাস ফেললে সে, 'আর আমি? ইজের ফতুয়া সেলাই করি, কুকুরগুলোকে পরাই আর খুলি? কোনো একটা আবিষ্কারও করি না।'

দিন কয়েক পরে কুকুরদের আনা হল একটা গোল ঘরে। ঘরের মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে আছে একটা যন্ত্র ঠিক একেবারে নাগর-দোলার মতো: মাথাওয়ালা একটা থামের মতো, চারপাশে ঠেকো, থামের উপর ফ্রেম, ফ্রেমের সঙ্গে দুটো কেবিন। নতুন বিপদের সঙ্গে কুকুরদের পরিচয় সাধনের জন্যে এই যন্ত্র। নামটা তার সেন্ট্রিফিউগ। ঘুরতে ঘুরতে প্রচণ্ড একটা গতি এসে যায় সেন্ট্রিফিউগে, কৃত্রিমভাবে উদ্ভব হয় অদৃশ্য চাপের।

ডাক্তার দ্রোনভ আর তার সহকারী জিনা খোকুরেকে তার ট্রে সমেত সেন্ট্রিফিউগের দোলনা কেবিনে বসিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

'শুয়ে থাক, লেজ নাড়াসনে,' হুকুম দিল ডাক্তার। গোঁ গোঁ করে উঠল মোটর, নড়ে উঠে চলতে শুরু করল দোলনা। দেয়ালটা যেন এগিয়ে এল খোকুরের দিকে, ছুটে গেল একেবারে কাছ ঘে'সে, সবকিছু একাকার হয়ে পরিণত হল একটা শাদা পর্দায়। বাতাসে উড়তে লাগল গায়ের লোম, ঠান্ডা হয়ে এল নাক, আর খোঁকুরের মনে হল এমন জোরে চাপ পড়তে থাকল যে মাথা নড়ানও অসম্ভব। উড়তে উড়তে দোলনাটা ক্রমশ উ'চু হয়ে কাত হয়ে রইল। যন্ত্রের নিচে টেলিভিজন আর ইনস্ট্রুমেন্টের স্ক্রীনের কাছে বসেছিল ডাক্তার আর ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট। তাদের কাছে মনে হল যেন দোলনাটা একেবারে দেয়ালের ওপর দিয়ে পিছলে চলছে।

আরও পড়ুন

সার্কাসে গোলকের মধ্যে মোটরসাইক্লিস্ট যে ভাবে খেলা দেখায়, তেমনি।

কেবিন যত জোরে ঘুরতে লাগল ততই যেন একটা অদৃশ্য দানব দোলনার সঙ্গে চেপে ধরল কুকুরটাকে। ওজন বেড়ে চলল তার। পাঁচ কিলোগ্রামের খেকুরে যেন প্রথমে হয়ে উঠল একটা বড়োগোছের দো আঁশলা, তারপর রীতিমতো একটা শিকারী কুকুর, শেষ পর্যন্ত একেবারে একটা ভেড়া- খেদানো কুকুর। অবিশ্যি চেহারা ওর তাই বলে বাড়েনি, বরং আরো যেন ছোটোই হয়ে উঠল: অতি ওজনের ভার তাকে চেপে ধরেছিল।

ইনস্ট্রুমেন্টে দ্রোনভ দেখল: খোকুরের ওজন

এবার তার সাতগুণে দাঁড়িয়েছে। টেলিভিজনে দেখা গেল মুখটা তার খানিকটা রোগা হয়ে গেছে। তার মানে রক্ত ওর এখন লোহার মতো ভারী। হার্টের পক্ষে কাজ চালানো এখন যে কী মুশকিল তা বোঝাই যায়; হার্টটাও যেন ঠিক ওই লোহাতেই তৈরি...

স্টপ! মোটর থেমে গেল, ফ্রেমটা কিন্তু তখনো ঘুরছে। নিজেকে অসম্ভব হালকা লাগতে লাগল খে'কুরের, মনে হল যেন হঠাৎ সে শূন্যে নিশ্চল হয়ে ঝুলছে। কেবিনটা কখন থেমে গেছে সে খেয়াল তার ছিল না।

'প্রাণটা যায়নি এখনো?' দোলনার দিকে তাকিয়ে রহস্য করে জিজ্ঞেস করলে দ্রোনভ।

প্রাণ যায়নি বটে! কিন্তু কী হাল হয়েছে বেচারার... ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে, বোকার মতো চোখ মিটমিট করছে, লালা ঝরেছে প্রায় এক বাটি।

আরও পড়ুন

'সাবাস!' খে'কুরের গায়ে হাত বুলিয়ে বললে ডাক্তার, 'এই তো রাস্তার কুকুর, কী না সইতে পারে জীবনে! এমন কষ্ট সৌখীন কুকুরে কিন্তু সইতে পারত না।' খে'কুরের দিকে ভালো করে নজর করে বলে চলল দ্রোনভ, 'আমি একটা পুল্ কুকুর জানি, ভারি বুদ্ধিমান কুকুর প্রতিভাধর। কিন্তু সব প্রতিভা ওর যত বাজে ব্যাপার নিয়ে: মনিবের জন্যে চটি এনে দেয় ঠিক। সেন্ট্রিফিউগ সইতে পারত না।'

'কালও সইতে পারবে?' জিজ্ঞেস করল জিনা।

'পারবে।'

পরের দিন যন্ত্রের রাগ যেন আরো বেশি, খে'কুরের পক্ষে আরো কষ্ট। মাথাটা সামনের দিকে করে সে শুয়ে ছিল দোলনায় আর ভার চাপে সবচেয়ে আগে মাথায়। রক্ত ছুটে যায় পায়ের দিকে। চোখ অন্ধকার হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে খোঁকুরে।

পরের দিন তাকে শোয়ানো হল উল্টো দিকে। চোখে আঁধার নামার বদলে এবার লালচে পর্দা কেননা রক্ত সব ছুটে আসছে মাথায়। দেহের প্রতিটি কোষ চাপ দিচ্ছে পরের কোষের ওপর, আর রক্তটা দেহের মধ্যে সবচেয়ে সচল জিনিস বলে অতিভারের প্রচণ্ড চাপের অধীনস্থ হয় সেই আগে।

দ্রোনভ জানত কেবিনের মধ্যে কেমন লাগছে খোঁকুরের। চোখে আঁধার দেখা, লালচে পর্দা দেখা, এ সব সে জানত। জানত নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এবং অ্যাক্সেলেরোগ্রাফ যন্ত্রের রেকর্ড দেখে। এ যন্ত্রে কাগজের ওপর অসমান বেড়ার মতো যে খোঁচা খোঁচা দাগ পড়েছে, তা থেকে বিজ্ঞানী টের পায় কুকুরটা কতখানি অতিভার সইল, অর্থাৎ ওজন তার বেড়ে উঠেছিল কতখানি, আর কত মিনিট বা সেকেন্ড চলেছিল তার ক্রিয়া।

দ্রোনভ আরো জানত যে সবচেয়ে ভালো হয় যখন অদৃশ্য চাপটা চড়াও হয় বুক থেকে পিঠের দিকে, অথবা উল্টোভাবে পিঠ থেকে বুকের দিকে; আর সবচেয়ে খারাপ মাথাটা বা পাটা সামনের দিক করে ওড়া জ্ঞান হারিয়ে যায় তখন।

তাহলেও কুকুরগুলোকে সব রকম অবস্থাতেই রেখে দেখল ডাক্তার। যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে তার অবস্থা লক্ষ্য করে গুন গুন করে গান গাইছিল দ্রোনভ:

এটা এবং ওটা ওটা এবং সেটা জেনে নেওয়াই চাই। অজানাটার ভাবী আঘাত যত, সবই করব রে যাচাই।

দ্রোনভের পাশে বসে জিনা ট্রেনিংরতদের ডায়েরি লিখে যাচ্ছিল। আর সবচেয়ে নিখুঁত রেকর্ডিং'এর কাজটা চলছিল যন্ত্রে কুকুরের বুকে পিঠে, পাশ থেকে পেছন থেকে কত অতিভার চেপেছিল সব লেখা হয়ে যাচ্ছিল ফিতেয়।

শত শত মিটারের ফোটো ফিতের ওপর খোঁচা খোঁচা রেখার ওই রেকর্ডগুলো কেন নেওয়া হচ্ছে সে কথা জিনা দ্রোনভকে জিজ্ঞেস করেনি। নিজেই সে আন্দাজ করলে, "রেকর্ডগুলো তুলনা করে দেখতে চায় বোধ হয়। রকেট যখন ছাড়া হবে, তখন তার মধ্যেকার কুকুরের অবস্থার কথাও রেকর্ড হবে যন্ত্রে। সেই রেকর্ডের সঙ্গে এই রেকর্ড' মিলিয়ে দ্রোনভ ধরতে পারবে কী ধরনের অদৃশ্য শক্তির কবলে পড়বে মহাকাশযাত্রী।”

এটা এবং ওটা

ওটা এবং সেটা...

আরও পড়ুন

গেয়ে চলেছে আমুদে ডাক্তার। জিনা কিন্তু ইতিমধ্যেই গর্বে ভরে উঠেছে। এ'র মতো ডাক্তার আর বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে চলেছেন হাজার হাজার। সেন্ট্রিফিউগে শুধু কুকুর নয়, উঠল মানুষ, বৈমানিক। পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যে দশ থেকে বারো গুণ ত্বরান্বয়ন সইল তারা অক্লেশে। সুবিধাজনক পোজ নিত তারা- অতিভারের চাপটা আসত হয় পিঠে নয় বুকে। আর একজন পরীক্ষাধীন জিনা এটা শুনেছিল প্রফেসরের রিপোর্ট থেকে ডুবুরির পোষাক পরিয়ে সেন্ট্রিফিউগের উপর বাঁধা জলভর্তি টবের মধ্যে মাথা পর্যন্ত ডুবিয়ে শোয়ান হয়েছিল তাকে আর কয়েক সেকেন্ডের জন্যে তার ত্রিশ গুণ ওজন সহ্য করছিল সে।

অবসর সময়ে দ্রোনভ তার সহকারিণীকে গল্প করে শোনাত সেন্ট্রিফিউগের কেবিনে চাপানো হয়েছে কত প্রাণীকে বাঁদর, ব্যাঙ, একোয়ারিয়মের মাছ, এমন কি অনুজীবসত্তা পর্যন্ত। বাঁদরের প্রতিক্রিয়াটা হয় মানুষের মতো। একোয়ারিয়ম চাপানো হয়েছিল সেন্ট্রিফিউগে, স্পীড বাড়ার পর ক্ষুদে ক্ষুদে মাছগুলোর ওজন দাঁড়ায় বড়ো বড়ো রুইকাতলার মতো। ভাসমান ব্যাঙ সমেত ওঠানো হয় জলের টব, যন্ত্র ছোটানো হয় আরো জোরে আর এক একটা ব্যাঙের ওজন দাঁড়ায় দেড়শ কিলোগ্রাম করে। আর অণুজীবসত্তা নিয়ে দোলনা কেবিন ঘুরতে থাকে একেবারে পাগলার মতো। ওজন তার বেড়ে ওঠে দুশ হাজার গুণ। তাহলেও অণুজীবসত্তার কিছু হয় না, কারণ জলের মধ্যে ছিল।

দ্রোনভ বলে, 'শুনতে যতই আশ্চর্য লাগুক, যে কোনো বর্মের চেয়ে কিন্তু জলেই অদৃশ্য শক্তির হাত থেকে ভালো বাঁচা যায়। তার মানে এমন একটা কেবিন বা পোষাক উদ্ভাবন করা যায়, যাতে আঘাত বা বর্ধিত ওজন থেকে বাঁচা সম্ভব। আগেই সে সম্বন্ধে লিখে গেছেন ৎসিওলকভস্কি। কিন্তু যতদিন তা উদ্ভাবন করা না হচ্ছে, ততদিন আমাদের চারপেয়ে সন্ধানীদের তালিম দিয়ে যেতে হবে যাতে মহাজগতের নানা চমকের জন্যে তৈরি থাকতে পারে তারা।

প্রতিদিন খেকুরে পরিণত হতে লাগল একটা ভারী কুকুরে তারপর ফের যে কে সেই। কেন যে এটা করা হচ্ছে তা সে বুঝত না, কিন্তু বাধ্যের মত শুনত। দোলনা কেবিন যেই স্টার্ট নিত, অমনি খেকুরে নিরীহের মতো থাবার ওপর মাথাটি রেখে অদৃশ্য শক্তির চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করত। ওর ভাব দেখে মনে হত যেন বলছে শেষ পর্যন্ত যে কোন অদ্ভুত ব্যাপারও তো অভ্যেস হয়ে যায়।

এর পর খোকুরের পরীক্ষা শুরু হল নিরেট করে বন্ধ একটা ছোট কেবিনে, তৈরি হতে লাগল তিন নম্বরের শত্রুর মোলাকাত করতে এ শত্রু হল মহাজাগতিক শূন্য। দিন কয়েক ধরে সে কাউকে দেখতে পেত না, নির্জনতায় অভ্যস্ত হল সে। খাবার দেওয়া হত বিশেষ একটা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে।

খাঁচায় ফিরে আসার পরও এই সব নতুন অনুভূতি পীড়িত করত খোকুরেকে। ঘুমের মধ্যে সে তার পা নাড়াত, কান খাড়া করত, চাপা স্বরে ডাকত। রাত্রে ডিউটির সময় ভালিয়া খাঁচার কাছে আসতেই প্রথমে তার একটা কান, পরে দ্বিতীয় কানটা কে'পে কে'পে, টান টান হয়ে খাড়া হত, ঘুরে যেত যে দিকে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সেই দিকে। সজীব হয়ে উঠে মেঝের ওপর আস্তে আস্তে ঢোকা মারত লেজটা। চোখের পাতা মেলে পরিচিত দৃষ্টিতে দেখত খে'কুরে।

খাঁচার ফাঁক দিয়ে খেকুরের গায়ে হাত বুলিয়ে চলে গেল ভালিয়া। তারপর ভোর পর্যন্ত শান্ত হয়ে ঘুমল খে'কুরে।

আরও পড়ুন