মনের অসুখ (তৃতীয় পর্ব)

তিন

পরদিন সকালেই ফোন এল লিজার। ‘আবারও একই ঘটনা, অয়ন,’ জানাল সে।

‘ভুতুড়ে কণ্ঠ শুনতে পেয়েছেন মিসেস মার্সডেন?’ নিশ্চিত হতে চাইল অয়ন। ‘সকালে রুমটাও এলোমেলো ছিল?’

‘হ্যাঁ। ঘুম ভাঙার পরপরই ছুটে এসেছিলেন আমার কাছে। আমিও দেরি না করে ছুটে গেছি ওনার কামরায়। গিয়ে দেখলাম, সব আগের জায়গাতেই আছে।’

‘কতক্ষণ লেগেছে আপনার যেতে?’

‘কতক্ষণই-বা! বড়জোর চার-পাঁচ মিনিট খালি ছিল রুমটা। এত দ্রুত সব ফার্নিচার আবার সাজিয়ে ফেলা কারও পক্ষেই সম্ভব না।’

‘আমিও তা ভাবছি না। আপনি এখন কোথায়?’

‘ওই কামরাতেই।’

‘মিসেস মার্সডেন কি আছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘ওনাকে একটু জিজ্ঞেস করবেন, ঘুম ভাঙার পর রুমের ভেতরটা ঠিকমতো দেখেছিলেন কি না? মানে, ফার্নিচারগুলোর সিরিয়াল ঠিক ছিল কি না?’

ক্ষণিকের নীরবতা। বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলছে লিজা। একটু পর জানাল, ‘উনি বলছেন, সিরিয়াল ঠিক ছিল। কিন্তু কোনোটাই জায়গামতো ছিল না। খাটের মাথাটাও চলে গিয়েছিল বাথরুমের দরজার দিকে।’

‘হুম। এবার একটু দেয়ালের কাছে যান। গতকাল কোথায় কোথায় দাগ দিয়েছিলাম, মনে আছে তো? চেক করে দেখুন, দাগ দুটো ঠিক আছে কি না।’

আবারও নীরবতা। দুই মিনিট পর লিজা বলল, ‘দাগ ঠিকই আছে, অয়ন। তবে...’

‘তবে কী?’

আরও পড়ুন

‘আমারই চোখের ভুল বোধ হয়। দাগ দুটো পুরোপুরি এক সরলরেখায় নেই। মেঝে থেকে দেয়ালের দাগটা কয়েক সুতো ডানে সরে গেছে...দুটোই। ভালোমতো না দেখলে অবশ্য বোঝা যায় না। তুমিই মনে হয় গতকাল আঁকার সময় ওভাবে এঁকেছ। স্কেল ধরে তো আঁকোনি, আঁকাবাঁকা হতেই পারে।’

‘না, আমি ঠিকই এঁকেছি, মিস। আপনিও ভুল বলছেন না। সত্যি বলতে কি, এক্সপেরিমেন্টটা সফল হয়েছে। যা সন্দেহ করেছি, সেটাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।’

‘তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না,’ বিভ্রান্ত গলায় বলল লিজা। ‘একটু খোলাসা করবে?’

‘অবশ্যই,’ বলল অয়ন। ‘তবে এখন না। আজ রাতে আপনাদের ওখানে আসব আমি আর জিমি। তখনই সব জানতে পারবেন। আশা করছি, রহস্যটারও সমাধান হয়ে যাবে রাতের মধ্যে।’

‘ঠিক আছে।’ আর জোরাজুরি করল না লিজা। ‘কখন আসতে চাও?’

‘মিসেস মার্সডেন ঘুমান কয়টায়?’

‘১১টায়।’

‘তাহলে সাড়ে ১০টা নাগাদ আসব আমরা। এখন শুনুন, কিছু কাজ করতে হবে আপনাকে...’

রাত ১০টায় কাঁচাপাকা সাইডরোডটার মুখে অয়ন-জিমিকে নামিয়ে দিলেন ক্যাথারিন, তবে খুব যে খুশিমনে, তা বলা যাবে না।

‘রাতবিরাতে তোমাদের এভাবে নামিয়ে দিতে ভালো লাগছে না আমার,’ বললেন তিনি। ‘পৌঁছে দিয়ে এলে ক্ষতি কী?’

‘না, আন্টি,’ মাথা নেড়ে বলল অয়ন। ‘গোপনে যেতে চাইছি আমরা। গাড়িতে গেলে তো জানাজানি হয়ে যাবে।’

‘তাহলে গাড়ি রেখে আমিও তোমাদের সঙ্গে যাই।’

‘রাখবেন কোথায় গাড়ি? রাস্তার পাশে? উঁহু, ওটাও রিস্কি। মানুষের চোখে পড়বে। খালি গাড়ি দেখে লোকে কৌতূহলী হয়ে উঠবে। বলা যায় না, ভিড়টিড়ও জমে যেতে পারে। তার চেয়ে আপনি চলে যান।’

‘তোমাদের একা ফেলে?’

‘অযথা দুশ্চিন্তা করছ, মা,’ বলল জিমি। ‘আমরা একা কোথায়? ওখানে মিসেস মার্সডেন আর লিজা আছে না?’

‘যদি বিপদ হয়?’ ক্যাথারিন স্বস্তি পাচ্ছেন না।

‘বিপদ-আপদ সামলাতে পারি আমরা, জানোই তো। তা ছাড়া অয়নের প্ল্যানে পুরোপুরি আস্থা আছে আমার।’

একসঙ্গে পা বাড়াল দুই বন্ধু। হাঁটতে শুরু করল কাঁচাপাকা রাস্তাটা ধরে। বড় বড় গাছের ছায়ায় ঢাকা পড়ে আছে রাস্তাটা। আকাশে চাঁদ থাকলেও পাতা আর ডালের আচ্ছাদন পেরিয়ে পৌঁছাতে পারছে না নিচে। আঁধার যেন জমাট বেঁধে রয়েছে। গা ছমছমে পরিবেশ।

লিজার ফোন পাওয়ার পরেই জিমির কাছে ছুটে গিয়েছিল অয়ন। পুরো রহস্যটা ভেঙে না বললেও রাতে কী করতে চায়, তা জানিয়েছে। আপত্তির কিছু দেখেনি জিমি। ঝুঁকি অবশ্য কিছুটা আছে, তবে গোয়েন্দাগিরিতে ওটুকু ঝুঁকি নিতেই হয়। কিন্তু সে কথা বলে মাকে ঘাবড়ে দেওয়া চলে না।

‘ঠিক তো?’ জিজ্ঞেস করলেন ক্যাথারিন।

‘নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়ো,’ তাঁকে বলল জিমি। ‘ফোনটা মাথার পাশে রেখো। আমাদের কাজ শেষ হলেই কল দেব তোমাকে।’

কয়েক মুহূর্ত দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগলেন ক্যাথারিন, শেষে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, সাবধানে থেকো তোমরা। কোনো ঝুঁকি নিয়ো না।’

বিদায় নিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেলেন তিনি।

অয়নের দিকে ফিরল জিমি। ‘এবার তো বল, আসলে কী ঘটছে ওই বাড়িতে? কিসের মধ্যে তুই নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে?’

আরও পড়ুন

‘একটু পরে নিজ চোখেই সব দেখবি,’ ওকে বলল অয়ন। ‘এখুনি বলে দিয়ে মজাটা মাটি করতে চাইছি না। চল, দেরি না করে রওনা হওয়া যাক।’

অস্ফুট শব্দে হতাশা প্রকাশ করল জিমি। অয়নের এই চাপা স্বভাবটা ওকে ভোগায় খুব। শেষ মুহূর্তের আগে কিছুই জানাতে চায় না। কিন্তু কিছু করারও নেই।

একসঙ্গে পা বাড়াল দুই বন্ধু। হাঁটতে শুরু করল কাঁচাপাকা রাস্তাটা ধরে। বড় বড় গাছের ছায়ায় ঢাকা পড়ে আছে রাস্তাটা। আকাশে চাঁদ থাকলেও পাতা আর ডালের আচ্ছাদন পেরিয়ে পৌঁছাতে পারছে না নিচে। আঁধার যেন জমাট বেঁধে রয়েছে। গা ছমছমে পরিবেশ।

কোনো কথা বলল না অয়ন বা জিমি। আবছাভাবে যতটুকু দেখা যায়, তাতেই এগিয়ে চলল নিঃশব্দে। সঙ্গে ফ্ল্যাশলাইট থাকলেও জ্বালানোর সাহস করছে না। অন্ধকারে অনেক দূর থেকে দেখা যাবে আলো। নষ্ট হবে গোপনীয়তা। ওদের উপস্থিতির কথা কাউকেই জানতে দিতে চায় না। পরেছেও তাই গাঢ় রঙের পোশাক, যাতে দূর থেকে দেখা না যায় ওদের।

সাড়ে ১০টা বাজার কয়েক মিনিট আগেই মিসেস মার্সডেনের বাড়ির কাছে পৌঁছে গেল ওরা। সরাসরি গেল না বাড়ির দিকে, খোলা জমিনেও বেরোল না; তার পরিবর্তে গাছের ছায়ায় ছায়ায় অনেকটা পথ ঘুরে চলে গেল বাড়ির পেছনে। এরপর একছুট লাগিয়ে পৌঁছে গেল কিচেনের জানালার পাশে। পাল্লা খোলা, ভেতর থেকে লাগানো হয়নি, জানালা গলে দুজন ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতর।

শব্দ শুনে কিচেনে হাজির হলো লিজা। চাপা গলায় ডাকল, ‘অয়ন? জিমি? তোমরা?’

‘হ্যাঁ,’ একইভাবে নিচু গলায় জবাব দিল অয়ন। ‘বাতি জ্বালাবেন না। ভেতরে চলুন।’

পথ দেখিয়ে নিজের কামরায় ওদের নিয়ে গেল লিজা। ওখানে আলো জ্বলছে। তবে জানালার পর্দা টেনে রেখেছে আগে থেকেই, বাইরে থেকে এখন আর দেখা যাবে না কামরার ভেতরটা। এতক্ষণে সতর্কতায় একটু ঢিল দেওয়া গেল।

অন্ধকার থেকে আলোয় এসে চোখ ধাঁধিয়ে গেছে দুই বন্ধুর। চোখ পিটপিট করে ধাতস্থ হয়ে নিল।

‘আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’ জানতে চাইল লিজা।

‘তা হয়নি,’ জিমি বলল। ‘তবে বুক ধড়ফড় করছে এখনো। বাপ রে, রীতিমতো ভুতুড়ে রাস্তা। সারাক্ষণ মনে হচ্ছিল, এই বুঝি দুপাশ থেকে কিছু একটা ঝাঁপিয়ে পড়ে!’

আরও পড়ুন

ওর বলার ভঙ্গি শুনে হেসে ফেলল লিজা।

‘ভিতুর ডিমটার কথায় কান দেবেন না তো,’ বিরক্ত গলায় বলল অয়ন।

‘কী! আমি ভিতুর ডিম?’ রেগে গেল জিমি। ‘তুই নিজে কী এমন সাহস দেখিয়েছিস? ভয়ের চোটে তোর গলা দিয়েও তো কোনো শব্দ বেরোয়নি।’

‘ভয় পেয়ে চুপ থাকিনি, থেকেছি সাবধানতার জন্য। নইলে গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে আসতাম।’

‘তোর গলায় গান শোনার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। গলা তো নয়, যেন ফাটা বাঁশ...’

‘কী বললি?’

‘থাক, থাক, ঝগড়া করতে হবে না,’ তাড়াতাড়ি দুই বন্ধুকে থামাল লিজা। ‘এখন কী করবে, তা-ই বলো।’

‘যা যা চেয়েছিলাম, সব জোগাড় হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল অয়ন।

‘হ্যাঁ। বাড়তি বালিশ আর পরচুলা...মিসেস মার্সডেনের বিছানায় রাখা আছে।’

‘চাবি?’

‘ওটাও। কিন্তু এসব কী কাজে লাগবে, তা বুঝতে পারছি না।’

‘বলছি...’

আরও পড়ুন

লিজাকে পুরো প্ল্যান বুঝিয়ে দিল অয়ন। মাথা ঝাঁকিয়ে মিসেস মার্সডেনের কামরায় চলে গেল সে—তাঁকে তাঁর করণীয় জানিয়ে দেওয়ার জন্য। অপেক্ষা করতে থাকল অয়ন আর জিমি। ১১টা বাজার কয়েক মিনিট আগে লিজার রুম থেকে বেরিয়ে এল ওরা, মিসেস মার্সডেনের রুমের সামনে গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল মেঝেতে। আস্তে করে টোকা দিল দরজায়।

দরজা খুলল লিজা। ওদের দিকে ফিরেও তাকাল না, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বের হলো রুম থেকে। তবে সময় নিল একটু বেশি, সেই ফাঁকে হামাগুড়ি দিয়ে রুমে ঢুকে পড়ল ওরা। লিজা আবার দরজা টেনে দিয়ে চলে গেল। মিসেস মার্সডেন বিছানায় বসে বই পড়ছেন, আড়চোখে একবার তাকালেন ওদের দিকে, ফের ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বই নিয়ে। হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় ঢুকে গেল দুই বন্ধু। জানালা দিয়ে বাইরে থেকে যেন ওদের দেখা না যায়, তাই এত সতর্কতা।

১১টা বাজার সংকেত দিল ঘড়ি। বই বন্ধ করে বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলে রেখে দিলেন মিসেস মার্সডেন। নিভিয়ে দিলেন বেডসাইড ল্যাম্প। অন্ধকারে ঢেকে গেল কামরার অভ্যন্তর। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি।

কয়েক মিনিট কাটল, এরপর শোনা গেল বৃদ্ধার চাপা গলা। ‘অয়ন, জিমি, আমি কি যাব এখন?’

খাটের তলা থেকে বকের মতো মাথা বের করল অয়ন। বলল, ‘হ্যাঁ, যান। সাবধান, আওয়াজ করবেন না।’

নিচু লয়ের শব্দ, প্রায় ফিসফিসানির মতোই বলা যায়, ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল জিমির। কোনোমতে বলল, ‘মাই গড! এ তো সত্যিই...’

ঝটপট বিছানা থেকে নেমে গেলেন বৃদ্ধা। পা টিপে টিপে চলে গেলেন দরজার কাছে, পাল্লা সামান্য খুলে সেখান দিয়ে বেরিয়ে গেলেন দ্রুত। বাকি রাত লিজার ঘরে কাটাবেন—এমনটাই ঠিক করা হয়েছে। তিনি চলে গেলে দুই বন্ধুও বেরিয়ে এল খাটের তলা থেকে। ঝড়ের বেগে হাত চালাল ওরা, বাড়তি বালিশগুলো সাজিয়ে একটা মানবদেহের আকৃতি দিল, সেটা ঢেকে দিল কম্বল দিয়ে। মেয়েদের একটা পরচুলা এনে রেখেছে লিজা, সেটা পরিয়ে দিল আকৃতিটার মাথার জায়গাটায়। দূর থেকে তাকালে এখন মনে হবে, সত্যি সত্যি একজন মানুষ শুয়ে আছে বিছানায়।

কাজ শেষ করে আবার খাটের তলায় ঢুকে গেল ওরা।

জিমি জানতে চাইল, ‘এখন কী?’

‘অপেক্ষা,’ সংক্ষেপে বলল অয়ন।

মন্থর গতিতে গড়িয়ে চলল সময়। খাটের তলায় উপুড় হয়ে শুয়ে অপেক্ষায় রইল দুই বন্ধু। কিছুই ঘটছে না। শক্ত মেঝেতে শুয়ে থাকতে থাকতে গা ব্যথা হয়ে গেল, কিন্তু হাল ছাড়ল না ওরা। অপেক্ষা করতে থাকল অসীম ধৈর্য নিয়ে।

নানা রকম চিন্তায় আনমনা হয়ে পড়েছিল অয়ন। হঠাৎ জিমির কনুইয়ের খোঁচা খেয়ে সচেতন হয়ে উঠল।

‘অয়ন, দেখ!’

খাটের তলা থেকে জানালার দিকে তাকাল অয়ন। গাঢ় একটা ছায়া দেখতে পেল ওখানে। পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত পরেই সরে গেল ছায়াটা। ঘড়ি দেখল ও—রাত দেড়টা।

‘হুম,’ বলল ও। ‘এবার শুরু হবে আসল মজা।’

আরও পড়ুন

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। মিনিট পাঁচেক পরেই শোনা গেল অপার্থিব আওয়াজ। প্রথমে ভেসে এল ঘড়ঘড়ানি...যেন মৃত্যুপথযাত্রী কোনো মানুষ খুব কষ্ট করে শ্বাস নিচ্ছে। এরপর গমগম করে উঠল একটা কণ্ঠ।

‘মার্গারেট! মার্গারেট!! তুমি কোথায়?...কাছে এসো। ...আমি অপেক্ষা করছি। ...আর দেরি কোরো না।’

নিচু লয়ের শব্দ, প্রায় ফিসফিসানির মতোই বলা যায়, ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল জিমির। কোনোমতে বলল, ‘মাই গড! এ তো সত্যিই...’

‘কুইক!’ তাড়া দিল অয়ন। ‘শব্দটা কোত্থেকে আসছে, বোঝার চেষ্টা কর।’

খাটের দুপাশ দিয়ে শরীর বের করল দুই বন্ধু। উঠে দাঁড়াল না, কিন্তু কান খাড়া করে শুনতে থাকল আওয়াজটা। একই কথা বারবার বলে চলেছে কণ্ঠটা। কয়েক দফা পুনরাবৃত্তির পর থেমে গেল, আবার নেমে এল নীরবতা। আবার খাটের তলায় ফিরে এল ওরা।

‘বাঁ দিক থেকে এসেছে শব্দটা,’ বলল জিমি। ‘পরিষ্কার শুনতে পেয়েছি।’

আরও পড়ুন

‘ডান দিক থেকেও শুনতে পেয়েছি আমি,’ জানাল অয়ন। ‘তার মানে রুমের দুই পাশেই লুকানো স্পিকার আছে। সম্ভবত দেয়ালের ভেতরে...ওয়ালপেপারের তলায়।’

‘আর কোনো সন্দেহ নেই, কেউ শয়তানি করছে,’ বলল জিমি। ‘মাথা খারাপ হয়ে যায়নি মিসেস মার্সডেনের। আমরা কি বেরোব এখন?’

‘না। এখনো আরেকটা রহস্যের সমাধান বাকি।’

ধীরে ধীরে কেটে গেল আরও প্রায় দেড় ঘণ্টা। অন্ধকারে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল জিমি। ভারী হয়ে এল চোখের পাতা। আচমকা গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। ভুল দেখছে না তো? তাড়াতাড়ি চোখ কচলাল, তাতে বদলাল না সামনের দৃশ্য।

যেন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে রুমটা। নড়াচড়া করছে সবকিছু। একপাশে সরে যাচ্ছে জানালা আর দরজা, জায়গা বদলাচ্ছে আসবাবগুলো! সবই ঘটছে নিঃশব্দে।

‘অয়ন!’ ফিসফিসিয়ে ডাকল জিমি।

‘দেখতে পাচ্ছি,’ পাশ থেকে জানাল ওর বন্ধুটি।

‘এ তো...এ তো রীতিমতো ভুতুড়ে কাণ্ড!’

‘মোটেই ভুতুড়ে না। কী ঘটছে বুঝতে পারছিস না?’

‘বোঝাবুঝির কী আছে? দেখতেই তো পাচ্ছি, ঘরের দরজা, জানালা, ফার্নিচার, টব...সবকিছু নড়ছে।’

‘ভুল। ওসবের কোনোটাই নড়ছে না। নড়ছে শুধু একটা জিনিস। ঠিক নড়ছেও না। ঘুরছে। আমাদের নিচের মেঝেটা।’

‘কী!’ চমকে উঠল জিমি।

‘হ্যাঁ,’ শান্ত গলায় বলল অয়ন। ‘দরজা-জানালাকে স্থির ভেবে নে, তাহলে বুঝবি—মেঝেটা ঘুরছে। তার সঙ্গে ঘুরছে সমস্ত আসবাবপত্র, এমনকি আমরাও। মেঝেটা আসলে মেঝে না, একটা টার্নটেবল...মানে, বৃত্তাকার একটা প্ল্যাটফর্ম, যেটা ঘুরতে পারে। নিচে নিশ্চয়ই মোটরসহ কোনো মেকানিজম আছে, সেটাই ঘোরাচ্ছে মেঝেটাকে।’

তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল জিমি। বুঝল, অয়ন ঠিকই বলছে। সত্যিই ঘুরছে মেঝেটা। পুরো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে থেমে গেল। জানালার দিকে মুখ করে খাটের তলায় ঢুকেছিল ওরা, এখন পুরোপুরি উল্টো দিকে চলে এসেছে। সব পরিষ্কার হয়ে গেল ওর কাছে—কেনই–বা সকালে ঘুম থেকে জেগে পুরো রুমটা এলোমেলো লাগে মিসেস মার্সডেনের কাছে; কেনই–বা লিজাকে নিয়ে ফিরে আসার আগে রুম আবার আগের মতো হয়ে যায়। মোটরের সাহায্যে ঘোরানো হয় মেঝেটাকে, তাই অমন দ্রুত কাজ সারা যায়।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল ও। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘এখন?’

‘এখন?’ মুচকি হাসল অয়ন। ‘এখন নাটের গুরুকে ধরার পালা।’

চলবে...

আরও পড়ুন