অনেক দিন আগে এক বনে থাকত মস্ত বড় এক কুনোব্যাঙ আর ছোট্ট এক টুনটুনি। দুজনের মধ্যে ভারি দোস্তি। টুনটুনি থাকে ঝোপে–ঝাড়ে, পাতায় তৈরি তার ছোট্ট বাসায়, আর কুনোব্যাঙ থাকে ওই ঝোপের নিচে, গর্তের ভেতর।
একদিন কুনোব্যাঙ বেড়াতে গেল কাছের নতুন শহরে। ফিরে এসে সে টুনটুনিকে বলল, ‘দোস্ত, ভারি বিপদ, আজ জবর তুফান হবে। শহরে সবাই বলাবলি করছে। আমি তো আমার গর্তের ভেতর ঢুকলেই খালাস; এখন তোমার উপায়?’
কথাটা একদম মিথ্যা। টুনটুনিকে তাক লাগানোর জন্যই শুধু বলা। পাড়াগাঁয় শহরফেরত লোক অমন উটকো খবর একটা না একটা কিছু বলেই থাকে। নইলে পয়সা খরচ করে শহর ঘুরে মজাই–বা কী?
নতুন শহরের খবর শুনে বেজায় ঘাবড়ে গেল টুনটুনি। কী ভয়ানক কথা; তুফান উঠলে তার ছোট্ট বাসটুকু কোথায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে বাতাসের তোড়ে, পাত্তাই থাকবে না। কী করে এখন প্রাণটা বাঁচে? পাগলের মতো টুনটুনিটা একছুটে বেরিয়ে পড়ল, কোথায় একটুখানি মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলবে, তারই খোঁজে।
টুনটুনিটা হন্যে হয়ে ছুটছে তো ছুটছেই। এদিকে তখন মস্ত বড় এক রংরাং (১) পাখি ইয়া উঁচু এক চিবিদগাছের মগডালে বসে তার মেঘের মতো পাখনা দুটো মেলে, মনের সুখে হাওয়া খাচ্ছিল বিরাট হাঁ করে। টুনটুনি গর্ত মনে করে তাড়াতাড়ি ওটার হাঁ করা মুখের ভেতরে ‘ফুড়ুত’ করে ঢুকে গেল, প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে।
রংরাং পাখিটা হঠাৎ ভয় পেয়ে টুনটুনিটাকে উগরে দিয়েই বুকফাটা এক বিকট ডাক ছাড়ল। ঠিক এ সময় একটা বাঁদর, কোনো এক জুমখেত থেকে একটা মিষ্টিকুমড়া চুরি করে কাছাকাছি এক গাছের ডালে নিয়ে মাত্র আরাম করে খেতে যাচ্ছে, আচমকা ওই বিকট আওয়াজটা তার কানে গেল। আর কুমড়াটা হাত ফসকে পড়ে গেল নিচে। নিচের জমিতে তখন একটা হরিণ কচি ঘাস খাচ্ছিল একমনে, কুমড়াটা সোজা পড়ল গিয়ে ওটার পিঠের ওপরে।
বেচারি পিঁপড়া আর করবে কী? মুরগির সঙ্গে তো পারার জো নেই। ঝোপের ভেতর একটা শুয়োর শুয়ে ছিল কাত হয়ে, ডিমের শোকে পিঁপড়াটা তাকেই গিয়ে কামড়ে দিল কুটুস করে।
আর যায় কোথায়। হরিণটা বিষম ভয় পেয়ে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠেই দে ছুট, দে ছুট। বনের মধ্যে বড় একটা গোসাপ খেয়েদেয়ে পেট মোটা করে শুয়ে আরাম করছিল। বেদম ছুটতে ছুটতে হরিণটা বেখেয়ালে মাড়িয়ে গেল ওটার কাঁকালে।
গোসাপটা তো যন্ত্রণায় আর রাগে অস্থির; বেদম খেপে গিয়ে সে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল আর ভীষণভাবে তার লেজ আছড়াতে লাগল মাটিতে। কিন্তু সে সামনে উঠতে উঠতেই হরিণটা তখন চলে গেছে বহুদূরে। এখন আর কার ওপর সে গায়ের ঝাল ঝাড়ে? সামনেই ছিল এক মুরগির বাসা। মুরগিটা প্রচুর ডিম পেড়ে রেখেছে তাতে। হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে গোসাপটা তার সব কটা ডিম গিলে সাবাড় করে দিল গপাগপ।
সব দেখে হায় হায় করে উঠল মুরগিটা। তার সাধের ডিমগুলো, আর কিছুদিন গেলেই ফুটে বাচ্চা বেরোত। কিন্তু তার আর করার আছেই–বা কী? গোসাপের সঙ্গে সে পারবে কেন? রাগের ক্ষোভে থাকতে না পেরে একছুটে সে গেল পিঁপড়ার বাসায়। গিয়ে পিঁপড়ার ডিমগুলো সব খেয়ে দিল ঠুকরে ঠুকরে।
বেচারি পিঁপড়া আর করবে কী? মুরগির সঙ্গে তো পারার জো নেই। ঝোপের ভেতর একটা শুয়োর শুয়ে ছিল কাত হয়ে, ডিমের শোকে পিঁপড়াটা তাকেই গিয়ে কামড়ে দিল কুটুস করে।
শুয়োরটা তো একেবারে লাফিয়ে উঠল কামড় খেয়ে। ঘাড়ের রোম খাড়া করে ‘ঘোঁত ঘোঁত’ করতে লাগল রাগে। পিঁপড়াটা ততক্ষণে বেমালুম গা ঢাকা দিয়েছে ‘সুডু সুডু’ করে ঘাসের বনে ঢুকে। এদিক-ওদিক হম্বিতম্বি করে কাউকে না পেয়ে রেগে গেল শুয়োরটা। রাগ করে কাছের এক জুমে গিয়ে ধান খেয়ে প্রায় সাবাড় করে দিল সে।
এত সব কাণ্ড ঘটে গেল কিন্তু কয়েক পলকে। এখন হয়েছে কি, ওই জুমটা হলো গিয়ে এক রাড়ি মেয়ের। নাম তার ধনপতি। স্বামী মারা যাওয়ায় পরের দোরে দোরে হাত পেতে খুব কষ্টেই করেছে জুমটা এবার। সেই দুঃখের খেত কিনা শুয়োরে খেয়ে ফেলল। রাজ্যে কি আর বিচার আচার নেই, মনের দুঃখে বেচারি গিয়ে নালিশ জানাল রাজার কাছে।
তক্ষুনি শুয়োরের তলব হলো বিচারের জন্য। ভরপেট ধান খেয়ে একটুখানি সবে গড়াগড়ি খাচ্ছিল শুয়োরটা, জলার ধারে নরম কাদায় রাজার সেপাই এসে তলব দিতেই ভেসে গেল তার আরাম করা। ধড়মড়িয়ে উঠে এসে রাজদরবারে গিয়ে হন্তদন্ত হয়ে হাজির হলো সে। কাঁদো কাঁদো গলায় রাজাকে বলল, ‘দোহাই ধর্মাবতার। কসুর মাপ হয়। আমি মিছিমিছি ধান খাইনি। পিঁপড়েটা কেন আমাকে কামড়ে দিল আগে? তাতেই না আমার রাগ ধরে যায় আর আমিও এর ধান খেয়েছি।’
রাজা দেখলেন, তাই তো, দোষ তো তাহলে পিঁপড়েটারই, খামাখা চটিয়ে দিল কেন সে শুয়োরটাকে? কাজেই তলব গেল আবার পিঁপড়ের কাছে।
পিঁপড়ে এসে বলল, ‘হুজুর, আমার দোষ কী? মুরগিটাই তো আগে আমার ডিমগুলো খেয়ে দিল। তাতেই না আমারও রাগ হয়েছিল, আর শুয়োরটাকে কামড়ে দিয়েছি।’
কিন্তু অনেক হাঁকাহাঁকি, ডাকাডাকিতেও আর কুনোব্যাঙ বেরোয় না ভয়ে। তখন সবাই মিলে তার পায়ে রশি বেঁধে ‘হেঁইয়ো’ ‘হেঁইয়ো’ করে টানতে টানতে গর্ত থেকে বাইরে নিয়ে এল তাকে, আর টেনেহিঁচড়ে হাজির করল রাজার দরবারে।
রাজা দেখলেন, দোষ তো তা হলে পিঁপড়েরও নয়, সুতরাং এবার তলব করা হলো মুরগিকে। সে এসে বলল, ‘মহারাজ, গোসাপটা কেন আগে খেয়ে ফেলল আমার ডিমগুলো? তাই তো আমি পিঁপড়ের ডিমগুলো খেয়ে তার শোধ নিয়েছি।’
এমনি করে একে একে রাজসভায় ডাক পড়ল সবার। গোসাপ এসে কাঁকালের দগদগে ঘা দেখিয়ে বলল রাজাকে, ‘এই দেখুন হুজুর, হরিণটা মাড়িয়ে দিয়ে কী হাল করে দিয়েছে আমার পিঠখানার। এতে কার না রাগ হয় বলুন? আমিও সামলাতে না পেরে খেয়ে ফেলেছি মুরগির ডিমগুলো।’
হরিণ বলল, ‘মহারাজ, বাঁদরটা কেন অত বড় কুমড়াটা ফেলে দিল আমার পিঠে? তাই তো আমি বেহুঁশ হয়ে ছুটছিলাম ভয়ে, আর অমনি গোসাপটাকে মাড়িয়ে গেছি হঠাৎ।’
বাঁদর বলল, ‘দোহাই ধর্মাবতার! আমি ইচ্ছা করে ফেলে দিইনি কুমড়াটা। রংরাং পাখিটা আচমকা বিশ্রীভাবে ডেকে উঠতেই ওটা হাত ফসকে নিচে পড়ে গেছে।’
রংরাং বলল, ‘মহারাজ! ডাক দিয়েছি কি সাধে? বলা নেই, কওয়া নেই, টুনটুনিটা কেন ঢুকতে গেল আমার মুখে? এতে ডাক না ছেড়ে কেই–বা থাকতে পারে হুজুর।’
টুনটুনি বলল, ‘হুজুর! কুনোব্যাঙটা কেন তুফান হবে বলে মিছিমিছি ভয় ধরিয়ে দিল? তাই তো আমি ভয়ে বেহুঁশ হয়ে গর্ত মনে করে ঢুকে পড়েছিলাম ওটার মুখে। যা করেছি হুজুর, ভয়েই করেছি। এতে আর আমার অপরাধ কী?’
কুনোব্যাঙ কিন্তু বেজায় ধড়িবাজ। তাকে পাওয়া গেল না অত সহজে। সারা দিন বনে ধরপাকড় চলছে, সেপাই এসে হামেশা একে–তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে রাজার কাছে, এসব খবর অনেক আগেই পৌঁছে গেছে কুনোব্যাঙের কাছে। তাই আগেভাগে অনেকটা বিপদের আঁচ পেয়ে সে বেলাবেলি গিয়ে ঢুকে পড়েছে নিজের গর্তে। মাথাটা একেবারে নিচের দিকে, পা দুটো খালি দেখা যায় অল্প একটুখানি।
অনেক খুঁজে খুঁজে রাজার সেপাই এসে গর্তের মুখে ডাকাডাকি শুরু করে দিল, ‘কুনোব্যাঙ! কুনোব্যাঙ!’ নিচ থেকে ভারী গলায় সাড়া দিল কুনোব্যাঙ, ‘হুজুর!’
‘বেরিয়ে আয় ব্যাটা! তোর নামে ওয়ারেন্ট আছে।’
তেমনি ভারী গলায় জবাব দিল কুনোব্যাঙ, ‘হুজুর! আমার ভারি অসুখ করেছে। উহ্, একদম মাথাটা তুলতে পারছি না।’
রাজার সেপাই অধৈর্য হয়ে বলল, ‘সেসব চলবে না। রাজার হুকুম, এক্ষুনি যেতে হবে। বেরিয়ে আয় জলদি।’
কিন্তু অনেক হাঁকাহাঁকি, ডাকাডাকিতেও আর কুনোব্যাঙ বেরোয় না ভয়ে। তখন সবাই মিলে তার পায়ে রশি বেঁধে ‘হেঁইয়ো’ ‘হেঁইয়ো’ করে টানতে টানতে গর্ত থেকে বাইরে নিয়ে এল তাকে, আর টেনেহিঁচড়ে হাজির করল রাজার দরবারে।
কুনোব্যাঙের অবস্থা কাহিল। সাফাই গাওয়ার মতো তার তো আর কিছু নেই। প্রাণের ভয়ে সে একেবারে রাজার পায়ে আছড়ে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে বলল, ‘দোহাই মহারাজ! ঘাট হয়েছে, প্রাণে মারবেন না। আমি আর কোনো দিন কাউকে অমন উড়ো খবর বলব না। এবারের মতো মাপ করুন হুজুর।’
সদয় হয়ে রাজা বললেন, ‘যা ব্যাটা, এবারের মতো প্রাণে বেঁচে গেলি। কিন্তু তোর একটা উড়ো কথায় রাজ্যের এতগুলো লোকের হয়রানি হয়েছে, কিছুটা সাজা পাওয়া তোর নেহাত দরকার, যাতে চিরকাল মনে থাকে। এই! নিয়ে যা। একে গুনে গুনে পঁচিশ ঘা বেত লাগাবি, তারপর যেতে দিবি যেখানে খুশি।’
তারপর আর কী, টানতে টানতে জল্লাদ কুনোব্যাঙকে নিয়ে গেল আর সবাই মজা করে ছুটল পিছু পিছু, কুনোব্যাঙের সাজা দেখতে। রাজবাড়ির উঠানে ছিল আদিকালের মস্ত বড় এক কাঁঠালগাছ। কুনোব্যাঙকে তার সঙ্গে পেঁচিয়ে বেঁধে জল্লাদ তার পিঠে বেত মারতে লাগল গুনে গুনে, দুই, তিন, এক...’
জল্লাদ এক বেত লাগায় আর কুনোব্যাঙটা তত ফুলতে থাকে, আর সঙ্গে সঙ্গে ফিনকি দিয়ে তার গা বেয়ে আঠার মতো সাদা সাদা একরকমের ক্ষীর বেরোতে লাগল। এমনি করে পঁচিশ ঘা বেত লাগাতে কুনোব্যাঙের সারা গা ক্ষীরে জবজবে হয়ে গেল, আর তাই লেগে লেগে, যে কাঁঠালগাছটার সঙ্গে কুনোব্যাঙকে বাঁধা হয়েছিল, তার গুঁড়িটাও সাদা হয়ে উঠল।
সেই থেকে কুনোব্যাঙের সারা গা উঁচু–নিচু ঢিবি ভরা খসখসে হয়ে গেল আর তখন থেকে কাঁঠালগাছের গায়েও আঘাত দিলে তারও গা বেয়ে সাদা সাদা ক্ষীর বেরোতে থাকে।
(১) একরকমের অতিকায় পাখি। চেহারায় ধনেশ পাখির মতো, কিন্তু আকারে অনেক বড়। (King hornfil)
বঙ্কিম কৃষ্ণ দেওয়ানের চাকমা রূপকাহিনি বই থেকে সংগৃহীত