ঝড়ের রাত

অলংকরণ: রিদম

এক

শন শন করে বইছে ঝোড়ো হাওয়া।

ঝম ঝম করে নামছে বৃষ্টির অঝোর ধারা।

পাহাড়ের ঢালে বেড়ে ওঠা গাছপালার মাথা ঝুঁকিয়ে দিচ্ছে এই হাওয়া আর বৃষ্টি, আছড়ে পড়ছে ক্রিমার পর্বতসারির গায়ে। উপকূলকে ঘিরে রেখেছে আকাশছোঁয়া পাহাড়ি প্রাচীর। তার পাদদেশে হামলা চালাচ্ছে উত্তাল সাগরের ঢেউ, যেন কামড় বসাচ্ছে।

শন শন! ঝম ঝম!!

বন্দর থেকে অনেকটা ভেতরে যেন ঘাপটি মেরে রয়েছে ছোট্ট শহর লাকট্রোপ, যেখানে রয়েছে সবুজ বারান্দায় ঘেরা শ খানেক বাড়ি। বারান্দাগুলো বানানো হয়েছে ঝড়বৃষ্টির হাত থেকে বাড়িগুলো রক্ষা করার জন্য, যদিও তাতে বিশেষ কাজ হয়নি। চার-পাঁচটা ঢালু, আঁকাবাঁকা রাস্তা আছে শহরে...রাস্তা না বলে ওগুলোকে গিরিখাদ বলাই ভালো। নুড়ি বিছানো রাস্তা, তার ওপর ছাইয়ের আস্তর। এই ছাইয়ের উত্স ভ্যাংলর নামের একটা আগ্নেয়গিরি, খুব কাছেই ওটা। দিনভর সালফারে ভরা ধোঁয়া বেরোয় ওটার পেট থেকে, রাতের বেলায় বেরোয় আগুনের বমি। উপকূলে দাঁড়ানো বাতিঘরটার মতো ভ্যাংলরও যেন সতর্ক করে দেয় দূর থেকে আসা নৌকা আর জাহাজকে; মানা করে লাকট্রোপের তীরে ভিড়তে।

শহরের শেষ প্রান্তে ফ্রিমেরিয়ান যুগের কিছু ধ্বংসাবশেষ রয়ে গেছে। তারপর আছে আরব্য ধাঁচের শহরতলি—রোদে জ্বলা টেরেসের ওপর দুর্গের মতো গোল গোল কিছু বাড়ি, ছাদের ওপর গম্বুজ। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে চারকোনা অসংখ্য পাথর, যেন মুঠোভরা ছক্কা ছুড়ে দেওয়া হয়েছে। কালের প্রবাহে এখন ওগুলোর কোণগুলো ক্ষয়ে গোল হয়ে গেছে।

শহরটার দর্শনীয় জিনিসগুলোর মধ্যে অদ্ভুতদর্শন এক বাড়ি আছে, একদিকে তার ছয়টা দরজা-জানালা, অন্যদিকে চারটা। এই দরজা-জানালার সংখ্যা অনুসারে লোকে বাড়িটার নাম রেখেছে ছক্কা-হালি।

আরেকটা দর্শনীয় জিনিস হচ্ছে ঘণ্টাঘর; সাধু ফিলফেলিনের ঘণ্টাঘর। খাড়া স্তম্ভের মতো আকাশছোঁয়া এক টাওয়ার, বাড়িঘরের মাথা ছাড়িয়ে অনেক দূর উঠে গেছে। ভেতরে জানালাওয়ালা অনেকগুলো খোপের মধ্যে ঝোলানো হয়েছে বেশ কিছু ঘণ্টা। জোরে বাতাস বইলেই বাজতে শুরু করে ওগুলো, যেন অশনিসংকেত দেয়। সে আওয়াজে কেঁপে ওঠে শহরবাসীর বুক।

এ-ই হলো লাকট্রোপ। ছোট ছোট, হতশ্রী কুড়েঘর দিয়ে ঘেরা এক শহর। অনেকটা ব্রিটানির মতো। তবে জায়গাটা ব্রিটানিতে নয়।

ফ্রান্সের কোথাও? জানি না।

ইউরোপে তো? সেটাও বলতে পারব না।

শুধু এটুকু বলি, অযথা খুঁজতে যাবেন না লাকট্রোপকে। একেবারে আধুনিক কোনো মানচিত্রেও পাওয়া যাবে না শহরটাকে।

দুই

ঠক ঠক!

ছক্কা-হালি নামের বাড়িটার দরজায় করাঘাত করছে কে যেন। মেসাগিলয়ের স্ট্রিটের বাঁ কোণে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। লাকট্রোপের সবচেয়ে ধনী বাড়ি ওটা, আরাম আর বিলাসে ভরা...অবশ্য আরাম আর বিলাস কাকে বলে, তা যদি লাকট্রোপের কারও জানা থাকে! কয়েক হাজার ফ্রেত্জার, মানে ওখানকার মুদ্রা, থাকাকেই শহরে ধনাঢ্য হবার লক্ষণ বলে ধরে নেওয়া হয়।

যাহোক, দরজায় করাঘাতের জবাবে একটা ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল, যেন হুংকার ছাড়ল একটা নেকড়ে। তারপরই ওপরতলার একটা জানালা খুলে গেল।

‘ভিখিরিগুলো নরকে যায় না কেন?’ বলে উঠল একটা রাগী গলা। ‘এটা একটা ভিক্ষা করার সময় হলো?’

কিন্তু ভিখিরি নয়, নিচে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হু হু করে কাঁপছে একটি অল্প বয়সী মেয়ে, গায়ে একটা ছেঁড়াফাটা চাদর। ওখান থেকে জানতে চাইল, ডাক্তার ট্রিফালগাস বাড়িতে আছেন কি না।

‘কী চাও, তা-ই আগে বলো। তারপর জানবে, তিনি আছেন কি নেই।’

‘আমার বাবা...মরতে বসেছে।’

‘কোথায়?’

‘ভ্যাল কার্নিউর ঢালে। এখান থেকে চার কের্টস দূরে।’

‘নাম কী তার?’

‘ভর্ট কার্টিফ।’

আরও পড়ুন

তিন

রুক্ষ স্বভাবের মানুষ ডা. ট্রিফালগাস। শরীরে দয়ামায়ার লেশমাত্র নেই, সাড়া দেন কেবল নগদ মুদ্রার কলতান শুনলে; তা–ও তাঁর আগাম চাই। বুড়ো একটা কুকুর আছে তাঁর, নাম হারজফ। বুলডগ আর স্প্যানিয়েলের সংকর। কুকুরটাও সম্ভবত তাঁর চেয়ে দয়ালু। লোকটা টাকা নেন একেক রোগের জন্য একেক রকম। টাইফয়েড, হৃদ্‌রোগ, বাতের ব্যথা...একেকটার জন্য একেক ফি। মাঝেমধ্যে মনগড়া নানা রোগের কথা বলেও বাড়তি টাকা আদায় করেন তিনি।

ভর্ট কার্টিফ অত্যন্ত দরিদ্র। পরিবারে আর কেউ উপার্জনক্ষম নেই। এমন এক লোকের জন্য ঝড়–বাদলের রাতে বাইরে বেরোবেন ট্রিফালগাস? অসম্ভব! বকা দিয়ে মেয়েটাকে বিদায় করে দিলেন তিনি।

বিছানায় শুতে শুতে গজগজ করে উঠলেন আপনমনে। ‘যত্ত সব! এসেছে বিনা পয়সায় চিকিত্সা করাতে! আমাকে বিছানা থেকে ওঠানোর ফি-ই তো দশ ফ্রেত্জার!’

বড়জোর বিশ মিনিট পেরিয়েছে, আবার শোনা গেল দরজায় ঠকঠকানি।

গাল দিতে দিতে বিছানা ছাড়লেন ট্রিফালগাস। জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে হাঁক ছাড়লেন।

‘কে ওখানে?’

‘আমি ভর্ট কার্টিফের বউ।’

‘ভ্যাল কার্নিউর সেই গাধা?’

‘জি। আপনি না গেলে ও মারা যাবে, ডাক্তার সাহেব!’

‘ভালোই তো। তা হলে তুমি বিধবা হবে।’

‘আমি বিশ ফ্রেত্জার নিয়ে এসেছি আপনার জন্য।’

‘বিশ ফ্রেত্জার? চার কের্টস পাড়ি দিয়ে ভ্যাল কার্নিউতে যাওয়ার জন্য? হাসালে!’

‘দয়া করুন!’

‘গোল্লায় যাও।’

জানালা বন্ধ করে দিলেন ডা. ট্রিফালগাস। মেজাজ খিঁচড়ে গেছে। তাঁকে ভেবেছেটা কী? বিশ ফ্রেত্জারের জন্য ঝড়–বৃষ্টিতে ভিজে অসুখ বাধাবেন? আগামীকাল এমনিতেই কমপক্ষে পঞ্চাশ ফ্রেত্জার পেতে চলেছেন তিনি। কিলট্রেনোতে এডজিংগভ নামের এক ধনী রোগীকে দেখতে যাবেন, তার বাতের ব্যথাটা নাকি বড্ড বেড়ে গেছে।

টাকার স্বপ্ন দেখতে দেখতে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লেন তিনি।

চার

শন শন! ঝম ঝম!...তারপর আবার ঠক ঠক ঠক!

এবার আগের চেয়ে জোরে জোরে টোকা পড়ছে দরজায়। ঘুম থেকে জেগে উঠলেন ট্রিফালগাস, তবে তীব্র রাগ নিয়ে। উঠে গিয়ে জানালা খুললেন, বাইরে থেকে মেশিনগানের গুলির মতো ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল বৃষ্টির ছাঁট।

‘অ্যাই! কে তুমি?’

‘আমি সেই দুর্ভাগার কাছ থেকে আসছি।’

‘কোন দুর্ভাগা?’

‘ভর্ট কার্টিফ। আমি ওর মা।’

‘কী জ্বালা! মেয়ে, বউ আর মাকে নিয়ে গাধাটা পটল তুলছে না কেন?’

‘আপনাকে খুব দরকার, ডাক্তার সাহেব। স্ট্রোক হয়েছে ওর...’

‘তাতে আমার কী?’

‘টাকাও নিয়ে এসেছি,’ নিচ থেকে বৃদ্ধা বললেন। ‘দয়া করে চলুন আমার সঙ্গে। নইলে আমার নাতনি হারাবে বাপ, আমার বউমা হারাবে স্বামী আর আমি হারাব একমাত্র ছেলেকে!’

করুণ গলায় কথা বলছেন তিনি, কাঁপছে গলা। ঠান্ডায় নির্ঘাত বেচারির হাড়–মাংস জমে গেছে। বৃষ্টিতে ভিজে সেই ভ্যাল কার্নিউ থেকে এত দূর আসা কি যা-তা কথা!

‘স্ট্রোক হয়েছে?’ বললেন ট্রিফালগাস। ‘তাহলে ২০০ ফ্রেত্জার লাগবে।’

‘কিন্তু আমার কাছে যে মাত্র ১২০ ফ্রেত্জার আছে!’

‘তাহলে বিদায় হও।’

জানালা বন্ধ করে দিলেন ট্রিফালগাস। পরক্ষণে মনে মনে হিসাব করে দেখলেন ব্যাপারটা। যেতে-আসতে দেড় ঘণ্টা লাগবে, রোগী দেখতে লাগবে বড়জোর আধঘণ্টা। তার মানে দুই ঘণ্টায় ১২০ ফ্রেত্জার কামাই! মিনিটে এক ফ্রেত্জার। একেবারে মন্দ নয়।

বিছানায় আর গেলেন না তিনি। পোশাক পাল্টাতে শুরু করলেন। হাঁটুসমান বুট পরলেন পায়ে, গায়ে চড়ালেন গ্রেট কোট, মাথায় টুপি দিলেন, হাত দুটোয় পরে নিলেন গ্লাভস। খাটের পাশে বাতিটা জ্বলতে থাকল, নেভাতে গেলেন না। বাতির পাশে, ১৯৭ পৃষ্ঠায় খোলা পড়ে রইল তাঁর ম্যাটেরিয়া মেডিকা বইটা। নিচে নেমে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে। তাকালেন চারপাশে।

আছে...বুড়িটা আছে এখনো। একটা ছড়িতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার অশীতিপর দেহটা।

‘কোথায় তোমার ১২০ ফ্রেত্জার?’ হাত বাড়িয়ে দিলেন ট্রিফালগাস।

তাড়াতাড়ি তাঁর হাতে টাকাটা গুঁজে দিলেন বুড়ি, ‘এই নিন। ঈশ্বর যেন এর শতগুণ টাকা আপনাকে দেন।’

‘হাহ্!’ অবজ্ঞাভরে বললেন ডা. ট্রিফালগাস। ‘ঈশ্বর কবে, কাকে টাকা দিয়েছেন?’

শিস দিয়ে হারজফকে ডাকলেন তিনি, কুকুরটার মুখে ধরিয়ে দিলেন লন্ঠন, তারপর সাগরপারের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলেন।

তাঁকে অনুসরণ করলেন বুড়ি।

আরও পড়ুন

পাঁচ

ক্রমাগত বইছে ঝোড়ো হাওয়া, তার সঙ্গে ভারী বৃষ্টি। বিশ্রী আবহাওয়া। ফিলফেলিনের ঘণ্টাগুলো ঢং ঢং করে বাজছে হাওয়ায় দুলে দুলে। অশুভ সংকেত দিচ্ছে যেন। তবে ওসব কুসংস্কারে বিশ্বাস নেই ডা. ট্রিফালগাসের...কোনো কিছুতেই তাঁর বিশ্বাস নেই। বিশ্বাস নেই এমনকি তাঁর নিজের চিকিত্সাশাস্ত্রেও। ওটা শুধুই তাঁর টাকা কামানোর পন্থা।

আবহাওয়ার যেমন বাজে অবস্থা, রাস্তারও তা-ই। শেওলা জমে নুড়িগুলো পিছল হয়ে আছে, পায়ের নিচে শব্দ করে ভাঙছে আগ্নেয়গিরির ছাই-পাথর। কোথাও কোনো আলো নেই, শুধু হারজফের মুখে ধরা লণ্ঠনটা থেকে বেরোচ্ছে ম্লান, কাঁপা কাঁপা আলোকরশ্মি। মাঝেমধ্যে অবশ্য দূরের আগ্নেয়গিরির মাথায় জ্বলে উঠছে আগুনের শিখা, তার মধ্যে ধূসর অস্পষ্ট ছায়ারা যেন দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে। গভীর জ্বালামুখটার নিচে কী আছে, কে জানে। হয়তো পাতালের কোনো জীব, ওপরে ওঠামাত্র যারা মিলিয়ে যায়।

সাগরের কিনার ধরে এগিয়ে চলেছেন ডা. ট্রিফালগাস, পেছনে বুড়িটা। পাশে উত্তাল সাগর সফেদ রং ধারণ করেছে। মাথায় ফসফরাস নিয়ে তীরের ওপর ভেঙে পড়ছে ঢেউ, যেন লাখো-কোটি কীটপতঙ্গ ছড়িয়ে দিচ্ছে ডাঙায়।

বালিয়াড়ির মাঝ দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে চললেন দুজন। বেয়োনেটের ফলার মতো রাস্তায় বেরিয়ে আছে চোখা নুড়িপাথর, পায়ের নিচে তারা শব্দ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

মালিকের কাছ ঘেঁষে এল কুকুরটা। যেন বলতে চাইছে, ‘ভালো, ভালো। ১২০ ফ্রেত্জার সিন্দুকে উঠতে চলেছে আপনার। ভালো কামাই। আপনার আঙুরখেতের আয়তন বাড়বে কয়েক একর। সন্ধ্যার খাবারে নতুন একটা আইটেম বাড়বে। বিশ্বস্ত হারজফের জন্যও জুটবে নতুন খাবার। এভাবেই পয়সাওয়ালা রোগীদের খেদমত করতে থাকুন...টাকা খসাতে থাকুন ওদের।’

হঠাৎ বুড়ি থমকে দাঁড়াল। কাঁপা আঙুল তুলে ছায়ার মধ্যে একটা লালচে আলো দেখিয়ে দিল। নির্ঘাত অপদার্থ ভর্ট কার্টিফের বাড়ি।

‘ওটাই?’ নিশ্চিত হতে চাইলেন ডাক্তার।

‘হ্যাঁ,’ মাথা ঝাঁকাল বুড়ি।

ঘর্ঘরে একটা শব্দ বেরুল হারজফের গলা থেকে।

ঠিক তখনই বিকট গর্জন ভেসে এল আগ্নেয়গিরি থেকে। ভীষণভাবে কেঁপে উঠল মাটি, ভূমিকম্প হলো যেন। আগুনের লকলকে শিখা বেরিয়ে এল পাহাড়ের ভেতর থেকে, ধেয়ে গেল মাথার ওপরের অন্ধকার আকাশে। ছিন্নভিন্ন করে দিল মেঘের সারিকে। মাটির কম্পনে আর স্থির থাকতে পারলেন না ডাক্তার, পড়ে গেলেন হুড়মুড় করে।

কয়েক মুহূর্ত পর গাল দিতে দিতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। পরক্ষণে চমকে উঠলেন। বুড়িকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। অদৃশ্য হয়ে গেছে? নাকি উবে গেছে বাষ্পের মতো?

কুকুরটা অবশ্য আছে। পেছনের দুই পা একটু ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে টান টান ভঙ্গিতে। চোয়ালে ধরে রেখেছে লন্ঠনটা।

‘জাহান্নামে যাক বুড়ি,’ গজগজ করে উঠলেন ট্রিফালগাস। ভাবছেন, তাঁকে ফেলে পালিয়ে গেছে সে। হারজফকে বললেন, ‘চল, আমরা এগোই।’

হাজার হোক, গুনে গুনে ১২০ ফ্রেত্জার নিয়েছেন তিনি। টাকাটা হালাল করতে হবে তো!

আরও পড়ুন

ছয়

ঝাপসা দেখাচ্ছে আলোটা। ডা. ট্রিফালগাস যেখানে রয়েছেন, সেখান থেকে অন্তত আধ-কের্টস দূরে। নিশ্চয়ই ওখানেই রয়েছে মুমুর্ষূ লোকটা...নাকি এতক্ষণে মরেই গেছে, কে জানে। যা-ই ঘটে থাকুক, না গিয়ে উপায় নেই তাঁর। নইলে লোকে বদনাম করবে—টাকা পেয়েও রোগীর কাছে যাননি বলে। বুড়ি পালিয়ে যাওয়ায় চিন্তিত হচ্ছেন না, বাড়িটা তো দেখিয়ে দিয়ে গেছে। ওখানে পৌঁছাতে কোনো অসুবিধে হবে না।

ঝড়বাদল ভেদ করে এগিয়ে গেলেন ডাক্তার।

কাছাকাছি পৌঁছালে স্পষ্ট দেখা গেল বাড়িটা—ফাঁকা জায়গার মধ্যে নিঃসঙ্গ একটা বাড়ি। তবে দূরত্ব যত কমল, ততই খটকা লাগল ডাক্তারের, অদ্ভুত একটা সাদৃশ্য দেখতে পাচ্ছেন—বাড়িটা ঠিক তাঁর ছক্কা-হালির মতো! সামনের জানালাগুলো একরকম, ধনুকের মতো খিলানওয়ালা দরজাটাও হুবহু তাঁর বাড়ির মতো।

বৃষ্টির মাঝ দিয়ে যতটা পারেন দ্রুত এগোলেন ডাক্তার, খানিক বাদে পৌঁছে গেলেন বাড়িটার সামনে। সদর দরজা ভেজানো। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল পাল্লা। তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি। পরমুহূর্তে বাতাসের ধাক্কায় দড়াম করে দরজাটা পেছনে বন্ধ হয়ে গেল আবার।

হারজফ বাইরে রয়ে গেল, ঢুকতে পারেনি। কানে ভেসে আসছে তার চাপা ঘেউ ঘেউ ডাক। কিছুক্ষণ ডাকছে, থামছে, তারপর আবার ডাকছে। গির্জায় গান গাওয়ার সময় ছোট্ট ছেলেরা কথা আর সুর ভুলে গেলে যেমন বিরতি নেয়, অনেকটা তেমন। কিন্তু তার ডাকে কান দেওয়ার অবস্থায় নেই ডাক্তার। বাক্‌রুদ্ধ হয়ে পড়েছেন তিনি।

আশ্চর্য ব্যাপার! ঘরের ভেতরে চোখ বুলিয়ে যে কেউই বলতে বাধ্য হবে, ডা. ট্রিফালগাস বুঝি নিজের বাড়িতেই ফিরে এসেছেন। কিন্তু তা কী করে হয়? পথ হারাননি তিনি। সোজা সামনে হেঁটেছেন, কোথাও বাঁক নেননি। কাজেই পথ হারিয়ে লাকট্রোপে ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই। অথচ সামনের দৃশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলছে। সেই একই রকম নিচু ছাদওয়ালা করিডর, সেই একই কাঠের সিঁড়ি, রেলিংগুলো বহু হাতের স্পর্শে ক্ষয়ে গেছে।

সিঁড়ি ধরে উঠতে শুরু করলেন ট্রিফালগাস, থামলেন ল্যান্ডিংয়ে পৌঁছে। সামনে একটা দরজা, বাইরে বাতি জ্বলছে...ঠিক তাঁর বাড়ির মতো।

স্বপ্ন দেখছেন? নাকি মতিভ্রম হয়েছে? দরজার ওপাশের কামরায় ঢুকে স্থবির হয়ে গেলেন। ক্ষীণ আলোয় হলদে সোফাওয়ালা নিজের ঘরটা চিনতে অসুবিধে হচ্ছে না। ডানদিকে আদ্যিকালের সেই পিয়ারউডের সিন্দুক, বাঁ দিকে তাঁর লোহা দিয়ে গড়া স্ট্রংবক্স, যেটায় সদ্য কামাই করা ১২০ ফ্রেত্জার তুলে রাখার কথা তাঁর। ওই তো তাঁর আরামকেদারা, চামড়ার কুশনে ঢাকা। তার পাশে বাঁকা পায়ার টেবিলটা। টেবিলের ওপর পড়ে আছে তাঁর ম্যাটেরিয়া মেডিকা বইটা...এখনো ১৯৭ পৃষ্ঠায় খোলা!

চোখ রগড়ালেন ট্রিফালগাস। ‘এসবের মানে কী!’ বিড়বিড় করলেন আপনমনে।

ভীষণ ভয় পেয়ে গেছেন তিনি, বিশ্বাস করতে পারছেন না কোনো কিছু। কেমন যেন কুঁকড়ে যেতে চাইছে শরীর। কনকনে শীতের মধ্যেও ঘামতে শুরু করেছেন কুলকুল করে। খাড়া হয়ে গেছে শরীরের সব লোম।

তাড়াতাড়ি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলেন ডাক্তার, অস্থির হওয়ার সময় এখন নয়। কাজ করতে হবে মাথা ঠান্ডা রেখে। প্রদীপের তেল ফুরিয়ে এসেছে, আলো নিভে যেতে দেরি নেই, বিছানায় শোয়া মানুষটির জীবনও একই সঙ্গে ফুরাতে বসেছে।

বাকি সবকিছুর মতো খাটটাও তাঁর খাটেরই মতো। ঠিক একই রকম নকশাকাটা বেডপোস্ট, ওপরে চাঁদোয়া, বড় বড় ফুল আঁকা পর্দা দিয়ে ঘেরা। ভর্ট কার্টিফের মতো একটা অকর্মার কি এমন বিছানা হতে পারে?

আরও পড়ুন

কম্পিত হাতে পর্দা ধরলেন ডাক্তার, আস্তে আস্তে সরিয়ে উঁকি দিলেন ভেতরে। অসুস্থ মানুষটার মাথা চাদরের মাঝ থেকে অদ্ভুতভাবে বেরিয়ে আছে, পড়ে আছে সে, যেন একটা লাশ, এক্ষুনি শেষনিশ্বাস ফেলবে।

সামনে ঝুঁকলেন ট্রিফালগাস, তাকালেন মুখটার দিকে।

পরক্ষণে গলা চিরে একটা চিত্কার বেরিয়ে এল তাঁর। আর্তচিত্কার। সেই চিত্কারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাইরে থেকে চেঁচিয়ে উঠল কুকুরটাও।

চিত্কার না দিয়ে উপায় কী? বিছানায় পড়ে থাকা মুমূর্ষু মানুষটা তো ভর্ট কার্টিফ নয়, ডা. ট্রিফালগাস নিজে! তাঁরই স্ট্রোক হয়েছে...ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলে সেরিব্রাল অ্যাপোপেস্নক্সি। মাথার খুলির ভেতরে জমতে শুরু করেছে তরল পদার্থ, পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছে পুরো শরীর।

কোনো সন্দেহ নেই, যাঁর জন্য ডাক্তার ডাকা হয়েছে, সেই রোগী তিনি স্বয়ং! তাঁর নিজের চিকিত্সার জন্যই দেওয়া হয়েছে ১২০ ফ্রেত্জার। ঝড়বাদলের দোহাই দিয়ে নিজেকেই সুস্থ করতে চাননি তিনি, গালাগাল করেছেন, যাঁরা তাঁকে ডাকতে এসেছিলেন তাঁদেরকে। তিনি নিজেই এখন মৃত্যুর মুখে।

কীভাবে এসব সম্ভব, জানা নেই ডাক্তারের। পাগল পাগল মনে হচ্ছে নিজেকে। কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে ক্রমে। স্পষ্ট বুঝতে পারছেন, আস্তে আস্তে শরীরের সব শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে। থেমে যাচ্ছে হৃত্স্পন্দন, বন্ধ হয়ে আসছে শ্বাসপ্রশ্বাস, কিন্তু নিজের পরিচয় ভোলেননি তিনি।

দ্রুত ভাবতে শুরু করলেন ডাক্তার, কী করা যায়? পরিমিত রক্তপাতের মাধ্যমে রক্তচাপ কমিয়ে আনবেন? কাজ হলেও হতে পারে তাতে, কিন্তু নষ্ট করার মতো একটি মুহূর্তও নেই। দেরি করলেই চিরঘুমে ঢলে পড়বেন অসুস্থ ট্রিফালগাস।

তাড়াতাড়ি ডাক্তারি ব্যাগটা টেনে নিলেন ট্রিফালগাস, ভেতর থেকে বের করে আনলেন একটা ছুরি। নিজের প্রতিমূর্তির হাতের ধমনিতে ফুটো করলেন একটা, কিন্তু কোনো রক্ত বেরোল না। তাঁর নিজের দেহেই রক্ত চলাচল করছে না আর। তাড়াতাড়ি প্রতিমূর্তির বুক ডলতে শুরু করলেন, ততক্ষণে তাঁর নিজের বুকের স্পন্দনই থেমে এসেছে। এবার পায়ের তালু ডলতে চাইলেন ডাক্তার, তবে তাঁর নিজের পা অসাড় হয়ে পড়েছে।

কিছুতেই কিছু হলো না। হঠাৎ উঠে বসল প্রতিমূর্তি, গগনবিদারী চিত্কার দিয়ে ফের লুটিয়ে পড়ল বিছানায়।

চিকিত্সাশাস্ত্রের সব জ্ঞান ব্যর্থ হলো। নিজের হাতেই মরলেন ডা. ট্রিফালগাস।

বাইরে তখনো মাতম করছে প্রকৃতি।

শন শন। ঝম ঝম।

আরও পড়ুন

সাত

ছক্কা-হালিতে পরদিন সকালে একটাই লাশ পাওয়া গেল, তা ডা. ট্রিফালগাসের। স্থানীয় নিয়ম অনুসারে, লাশটা শবযানে তুলে মহা আড়ম্বরে নিয়ে যাওয়া হলো লাকট্রোপের গোরস্তানে।

হারজফের কথা যদি জানতে চান...লোকে বলে, মুখে লন্ঠন ঝুলিয়ে কুকুরটা নাকি আজও ঘুরে বেড়ায় পথে-প্রান্তরে, ডাকে করুণ সুরে।

এসবের কতখানি সত্যি, আমার জানা নেই। তবে এটুকু জানি, ভোলসিনের দেশে...বিশেষ করে লাকট্রোপে নানা ধরনের ব্যাখ্যাহীন, অদ্ভুত ঘটনা ঘটে।

তবে আবার বলছি, মানচিত্রে লাকট্রোপকে খোঁজার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। দুনিয়ার সেরা ভূগোলবিদেরাও জানেন না ওটার অক্ষাংশ বা দ্রাঘিমাংশ।