অপারেশন বাঁশতলি
‘বাঁশতলি গ্রামের নামকরণ সার্থক।’ গ্রামে ঢুকেই বললেন মুকুল ভাই।
আমি মাথা নাড়লাম। মুকুল ভাইয়ের এই কথাটা পুরোপুরি সত্য। গ্রামের পথ বাঁশঝাড়ে ঢাকা। বিকেলবেলাতেও পথ অন্ধকার। অথচ দিগন্তে এখনো মেঘের আড়াল হয়নি সূর্য। লাল হয়ে আছে মেঘগুলো। বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়েই মাঝেমধ্যে সূর্যের লাল আলো এসে পড়ছে মুকুল ভাই, সোবহান, জামালের মুখে, চুলে।
বাঁশপাতা পড়ে পথটা নরম হয়ে আছে। দুপুরের দিকে বৃষ্টি হয়েছে বোধ হয়। পায়ের নিচের বাঁশপাতার স্তর ভেজা। পা ফেলতেই শব্দ হচ্ছে পচাৎ পচাৎ।
বাঁশঝাড়ের মধ্যে কী যেন নড়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে পিঠের স্টেনগানে চলে গেল আমার হাত। একটা ঝোলার ভেতরে স্টেনগান নিয়েছি। তাকিয়ে দেখলাম, একটা সাদা রঙের বাছুর। মনে হয় দড়ি ছিঁড়ে ফেলেছে। গলার সঙ্গে ঝুলে আছে দড়িটা। কোনো একটা বাঁশের কঞ্চিতে দড়ি গেছে পেঁচিয়ে। ‘হাম্বাআআ’ বলে ডেকে উঠল বাছুরটা।
‘আহা, বাছুরটাকে কে এখন তার মায়ের কাছে নিয়ে যাবে?’ জামাল বলল।
‘জামালের “মা মা” করা স্বভাবটা আর গেল না।’ ফোড়ন কাটল সোবহান।
জামালের বয়স ১৬। বিএএফ শাহীন কলেজে ক্লাস নাইনে পড়ে সে। তার বাবা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনির্ভাসিটির অফিসার। পলাশীর স্টাফ কোয়ার্টারে ওদের বাড়ি। বাড়ি থেকে পালিয়ে যুদ্ধে চলে এসেছে জামাল। আমাদের প্রত্যেকের যুদ্ধে আসার কাহিনি আলাদা আলাদা। আলাদা হলেও মূল কাহিনি অভিন্ন। প্রত্যেককেই মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়েছিল। কখনো বাসে উঠে, রাজাকার আর পাকিস্তানি মিলিটারির তল্লাশির চোখ ফাঁকি দিয়ে, দেড় দিন দুই দিন পথ চলেছিলাম আমরা। খালি পেটে, ফোলা পা নিয়ে বিধ্বস্ত ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় আমরা পৌঁছেছিলাম আগরতলায়। সেখান থেকে মেলাঘরের ট্রেনিং ক্যাম্প। ক্যাম্প মানে বাঁশের সারি সারি ঘর। ওপরে ছনের চালা। বিছানাও ছিল বাঁশের তৈরি খাটিয়ায় দড়ির জাল।
শক্ত চামড়ার মতো রুটি খেতে বসে আমি কাঁদতাম। রুটিতে পোকা। ডালে কাঁকর।
জামাল মানিব্যাগে এনেছে তার মায়ের ছবি। মায়ের ছবি বের করে রোজ রাতে বাতি নেভার আগে তাকিয়ে থাকে সে। আর মা মা বলে কাঁদে! কান্না সংক্রামক। আমাদেরও কান্না পায়। কিন্তু আমরা তো জামালের চেয়ে বয়সে বড়। আমার বয়স ১৯ বছর। আমি তেজগাঁও কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমি তো আর জামালের মতো সবার সামনে কাঁদতে পারি না। সোবহানের বয়সও ১৯ কিংবা ২০। মুকুল ভাইয়ের বয়স ২২ হতে পারে। তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে পড়েন। আমাদের এই দলে তিনিই কমান্ডার।
মুকুল ভাই বললেন, ‘লাভলু।’
আমি বললাম, ‘ইয়েস কমান্ডার।’
‘যাও। বাছুরটার দড়ি খুলে দিয়ে আসো।’
‘ইয়েস কমান্ডার।’ বলে এগোলাম আমি।
আমিও শহরের ছেলে। গ্রাম চিনি না। গ্রামের জীবন এর আগে কখনো ভালো করে দেখা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে। এখন আমি গ্রামের পথে হাঁটি। রাতের বেলা মাটিতে ঘুমাতে পারি। মশা মাছি জোঁক এসব আমাদের নিত্যসঙ্গী। মশা আমাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না। জোঁক আমাদের চলা থামাতে পারে না।
বাঁশঝাড়ের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। বাঁশের পাতা বেশ ধারালো। গায়ে খোঁচা দিচ্ছে। সত্যি বাছুরটা দড়ি পেঁচিয়ে আছে একটা কঞ্চির সঙ্গে। দড়িটাকে ছাড়ালাম। বাছুরটাকে টেনে পথের মধ্যে আনলাম। তারপর ছেড়ে দিলাম। বাছুরটা কিছুক্ষণ বিশ্বাস করে উঠতে পারল না যে সে মুক্ত। দাঁড়িয়ে রইল। তারপর চলতে শুরু করল। তারপর যখন দেখল সে সত্যিই আর বাঁধা নয়, ছুটতে শুরু করল তখন।
‘আমরাও একদিন স্বাধীন হব। পাকিস্তানি অত্যাচারী সৈনিকেরা পরাজিত হবে। দেশ শত্রুমুক্ত হবে। স্বাধীন হবে। তখন আমরাও চলতে শুরু করব। প্রথম প্রথম একটু হয়তো থেমে থাকব। তারপর এমন জোরে ছুটতে শুরু করব যে আমাদের দেশটা হবে একটা উন্নত দেশ। সেই দেশে কেউ না খেয়ে থাকবে না। সব ছেলেমেয়ে স্কুলে যাবে। ধনী–গরিবের মধ্যে তেমন তফাত থাকবে না।’ মুকুল ভাই বক্তৃতা দিতে শুরু করেছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতা ছিলেন। বক্তৃতা দেওয়া তাঁর স্বভাব। আমরা, বাকি তিনজন কিন্তু রাজনীতি করতাম না। পঁচিশে মার্চ রাতে আমাদের বাড়ির পাশের বস্তিতে আগুন দিয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। ভয়াবহ ছিল সেই রাতটা। গুলির শব্দ। গোলার শব্দ। তার মধ্যে আকাশ লাল করে অদূরে জ্বলছে বস্তি। মানুষের আর্তচিৎকার। ছোটাছুটি। এর মধ্যেই গুলি। ভয়েই মনে হচ্ছিল মরে যাব।
বাসা থেকে বের হয়েছিলাম এক দিন পর। বস্তির ঘরগুলো পুড়ে ছাই। এখানে–ওখানে লাশ পড়ে আছে। জমাদাররা সুইপারভ্যানে করে মানুষের লাশ সরাচ্ছে। তখনই ঠিক করেছি, যুদ্ধে যেতে হবে। একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম দুই বন্ধু। আমি আর আর সোবহান। সোবহান আর আমি একই কলেজে এক ক্লাসে পড়ি। বাড়িও পাশাপাশি। ফার্মগেট তেজকুনিপাড়া।
আমরা এখন বাঁশতলি গ্রামে হাঁটছি। রাতে এখানে থাকব সলিম মিয়ার বাড়ি। সলিম মিয়া একজন কৃষক। আগে থেকে খবর দেওয়া আছে। আমাদের বলা হয়েছে, সলিম মিয়া জয় বাংলার পক্ষের লোক। তবে নির্বিবাদী মানুষ। কারও সাতে-পাঁচে নেই। তাঁর বাড়িতে যেকোনো মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিতে পারেন, এটা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। কাজেই ওই বাড়িটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ হবে।
সূর্য ডুবে গেল। আকাশে এখনো লাল আভা খানিকটা রয়ে গেছে। তাই এখনো পথ চলা যাচ্ছে। একটু পর অন্ধকার ঘন হয়ে আসবে। টর্চলাইট জ্বালিয়ে চলতে হবে। টর্চলাইট জ্বালানোও বিপজ্জনক ব্যাপার। এই গ্রামে দুইটা দালালের বাড়ি আছে। তারা পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।
সলিম মিয়ার বাড়িটা ঠিক কোনটা? একটা বাড়ির সামনে কতকগুলো হাঁস তাড়া করে ফিরছে এক কিশোরী। মনে হয়, হাঁসগুলো পথ হারিয়ে ফেলেছিল। পুকুর থেকে উঠছিল না। কিশোরীটি তই তই করে হাঁসগুলোকে ডেকে নিয়ে পেছনে পেছনে তাড়া করে বাড়ি ফিরছে। কিশোরীর হাতেও একটা কঞ্চি।
মুকুল ভাই বললেন, ‘এই মেয়ে, শোনো, এখানে সলিম মিয়ার বাড়ি কোথায় জানো?’
কিশোরীটা বলল, ‘এই হাঁসের বাচ্চাগুলানের পিছে পিছে যান। পায়া যাইবেন।’
‘মানে? মুকুল ভাই শুধালেন।’
‘এই হাঁসের বাচ্চাগুলান ওই বাড়িতেই যাইব। আপনেরা তাগো পিছে পিছে চলেন।’
খিক খিক করে হেসে উঠল জামাল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার নাম কী?’
কিশোরী বলল, ‘নাম দিয়া কাম কী?’
আমি হতোদ্যম হলাম না। ‘বললাম, তা অবশ্য ঠিক। নাম দিয়ে কোনো কাজ নেই। তবে আমার নাম লাভলু।’
ঠাস করে আমার গালে একটা চড় মারলেন মুকুল ভাই। আমি হতভম্ব। একটু পরে টের পেলাম। আমাদের নাম বলে বেড়ানোর নিয়ম নেই। আমাদের নাম গোপন রাখতে হয়। ছদ্মনাম নিতে হয়। আমার কোড নাম মাইকেল। আধো অন্ধকারে গ্রামের মধ্যে পথ চলতে চলতে এক কিশোরীকে দেখে সব ভুলে বসেছিলাম।
আমাকে চড় খেতে দেখে মেয়েটি বলে ফেলল, ‘আমার নাম শেফালি।’
আমরা শেফালির পেছনে পেছনে গেলাম। বাঁশঝাড় পাতলা হয়ে এসেছে। পথের ধারে সম্ভবত চষা খেত। এই খালের পাশে কতকগুলো ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। গাছগাছড়ায় ছাওয়া।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামছে। কতকগুলো কুকুর ঘেউ ঘেউ করে আমাদের দিকে তেড়ে এল। শেফালি কঞ্চি উঁচিয়ে কুকুরগুলোকে ‘দূর দূর ছেই ছেই’ করে সরিয়ে দিল।
আমরা একটা উঁচু ভিটায় উঠলাম। দুটি পগারের মধ্য দিয়ে সরু রাস্তা। সুপারিগাছ, কলাগাছ বাড়ির এক পাশে বেড়ার কাজ করছে। একটা গোয়ালঘর পেরোলে উঠান। এর মধ্যে আকাশে চাঁদ উঠে গেছে। উঠানে জ্যোৎস্না লুটাচ্ছে। ডালিমগাছের পাতার ছায়া পড়েছে উঠানে। আকাশে মেঘও আছে। এখন চাঁদটা আকাশের পরিষ্কার একটা জায়গায় নিজেকে নিয়ে যেতে পেরেছে।
শেফালি হাঁক জুড়ল, ‘আব্বা আব্বা। দেখেন, কারা আইছে।’
একটা টিনে ছাওয়া বড় ঘর। সেখান থেকে বের হয়ে এলেন একজন বছর পঁয়ত্রিশ বয়সের মানুষ। তাঁর মাথায় টুপি। কৃষকের পরিশ্রমী চেহারা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি হাতের লণ্ঠনের আলোয় দেখা যাচ্ছে।
শেফালি হাঁসগুলোকে খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে ফেলল। উঠানের এক কোনায় মাটি দিয়ে তৈরি হাঁস–মুরগির ঘর।
মুকুল ভাই বললেন, ‘আপনার নাম কি সলিম?’
‘জে। আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’
‘আপনাগো আসার কথা আছিল। আমি জানি। আসেন। ঘরের মাঝে আসেন। আমরা গরিব মানুষ। আপনাগো কষ্ট হইব।’
‘না, আমাদের কষ্ট হবে না।’
আমরা বড় ঘরটাতে ঢুকলাম। ইয়া বড় একটা কাঠের চকি। ওপরে বালিশ তোশক চাদর বিছানো। আমাদের চারজনের জন্য এ রীতিমতো স্বর্গীয় একটা আয়োজন।
শেফালি সলিম মিয়ার মেয়ে। শেফালির মা বড় ঘোমটা দিয়ে আমাদের সামনে এলেন। বললেন, ‘আপনারা কুয়ার পাড় থাইকা হাত-পা ধুয়া আসেন। গোসল করলে কইরা নেন। রাইতে আর পুকুরে নামার কাম নাই। শব্দ হইব। শেফালি আপনাগো কুয়া থাইকা পানি তুলা দিব।’
শেফালি সত্যি সত্যি পানি তুলে বড় বালতি ভরতে আরম্ভ করে দিয়েছে। কুয়ার দড়ি একটা বাঁশের লগির সঙ্গে বাঁধা। আমি বললাম, ‘শেফালি, তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। আমরা পানি তুলে নিতে পারব।’
বিছানাতেই পাত পেতে খেতে বসলাম আমরা। কাঁসার থালা দেওয়া হয়েছে। লণ্ঠনের আলোয় চকচক করছে থালা। শেফালির মা ভাত বেড়ে বেড়ে দিচ্ছেন। মুরগির মাংস রান্না হয়েছে। গন্ধেই আমাদের পেট ভরে উঠছে, মন ম–ম করছে। জামাল বলল, ‘আমার মায়ের রান্নার মতো রান্না হয়েছে।’
শেফালির মা বললেন, ‘খান বাবারা। খান। আপনেরা তো আমার পোলারই লাহান।’
‘আপনার কি একটাই মেয়ে?’ সোবহান জিজ্ঞেস করল।
‘না। আমার আরেকটা পোলা আছে। ১৬ বছর বয়স। শরিফ অর নাম।’
‘সে কোথায়?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘তারে মামাবাড়ি পাঠায়া দিসি। এই জায়গাটা ভালো না। প্রায়ই পাকিস্তানি মিলিটারি আসে। দালাল আছে দুই ঘর। এই বয়সের ছেলে পাইলে ধইরা নিয়া যায়। হয় রাজাকারে নাম লেখায়, নাইলে মাইরা ফেলে। তাই সরায়ে রাখছি।’
সারা দিন প্রায় কুড়ি মাইল হেঁটেছি আমরা। তাড়াতাড়ি করে শুয়ে পড়লাম। পাশে আরেকটা ঘর। মনে হয় শেফালির ভাই শরিফের ঘর। সেই ঘরে সলিম মিয়া, শেফালির মা আর শেফালি শুয়েছে। বাইরে শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডাকছে কুকুর।
আমরা ভীষণ ক্লান্ত। সমস্ত শরীর ভেঙে আসছে। ঘুমিয়ে পড়লাম চারজনই। অস্ত্রগুলো সব মাথার কাছে রইল।
দরজায় শব্দ হচ্ছে। ‘ওঠেন। ওঠেন। লাভলু ভাই। ওঠেন।’
ঘুম ভাঙল চারজনেরই। ধাতস্থ হতে সময় লাগল আমার। আমি কোথায়? এটা কোন জায়গা? একটু পরে বুঝলাম এটা বাঁশতলি গ্রাম। সলিম মিয়ার বাড়ি। বাইরে শেফালি দরজা ধাক্কাচ্ছে।
উঠে দরজা খুললাম।
শেফালি হাঁপাচ্ছে। ‘আমি ভোরবেলা খালের পাড় ধইরা হাঁটতে গেছিলাম। দেখলাম, নৌকায় কইরা মিলিটারি আসতাছে।’
ততক্ষণে শেফালির মা-ও এসে গেছেন। উঠে গেছেন সলিম মিয়াও।
আমাদের মাথা কাজ করছে না।
মুকুল ভাই বললেন, ‘কত দূর?’
শেফালি বলল, ‘দুই–তিন মিনিটের মধ্যে এই বাড়ি আইসা পড়ব।’
সলিম মিয়াও মাথায় টুপি পরে এসেছেন। ফজরের নামাজ পড়ছিলেন তিনি।
শেফালির মা বলল, ‘আপনারা সব চকির নিচে ঢোকেন। শেফালির বাপ, ওই বারান্দার জলচৌকির ওপরে নামাজ পড়তে থাকো।’
সলিম মিয়া বললেন, ‘আমি তো নামাজ পইড়া ফেলছি।’
শেফালির মা বললেন, ‘আরও দুই রাকাত পড়ো। যাও। দেরি কইরো না। নামাজ ধরো। শেফালি! তুই ওই ঘরে যা। আপনারা চকির নিচে ঢোকেন। আমি দরজার চৌকাঠে বইসা কোরআন শরিফ পড়ুম।’
তিনি দৌড়ে কোরআন শরিফ আর রেহেল নিয়ে এলেন।
আমরা সবাই চকির নিচে। এখনো বাইরে আঁধার কাটেনি। কেবল ফজরের ওয়াক্ত পার হচ্ছে।
শেফালির মা আমাদের ঘরের দুয়ারে বসে রেহেলে কোরআন শরিফ রাখলেন। মাথার ঘোমটা বড় করে দিয়ে কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করছেন। ‘আলিফ-লাম-মিম; জালিকাল কিতাবু ...’
আমরা নিজেদের নিশ্বাসের শব্দ শুনছি। বিছানার নিচে পাট রাখা হয়েছে। পাটের গন্ধে পেট ফুলে উঠছে। একটা মুরগি পাটের স্তূপে ডিম পেড়ে তাতে তা দিচ্ছে। সেটিও চুপ করে আছে। আমরাও চুপ করে আছি।
বাইরে বুটের শব্দ শোনা গেল।
‘এই বাড়িতে কোনো বাইরের মানুষ উঠছে নি?’ বাঙালির গলা।
‘হারামজাদা রাজাকার।’ ফিসফিস করল জামাল।
জবাব কে দেবে?
আমাদের ঘরের দরজায় শেফালির মা বসে কোরআন শরিফ পড়ছেন। ‘লা-রাইবা ফিহি হুদাল-লিল মুত্তাকিন...’
রাজাকারটা বলল, ‘না, এইহানে মুনে হয় কেউ আসে নাই...’
‘মুক্তি ইধার নেহি হ্যায়। লেটস মুভ। কুইক মার্চ।’
বুটের আওয়াজ ধীরে ধীরে মিইয়ে এল।
একটু পর শেফালি এসে ঢুকল ঘরে। ‘লাভলু ভাই। বাইর হন। মিলিটারি গেছে গা।’
আমরা ঘেমেনেয়ে বের হলাম চকির তলা থেকে।
শেফালিকে বললাম, ‘তোমাদের কালো মুরিগটা কি হারিয়ে গেছে?’
শেফালি বলল, ‘হ্।’
‘ওটা চকির নিচে পাটের পালায় আছে। ডিমে তা দিচ্ছে।’
আমরা শেফালির মাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি বাইরে গেলাম। অস্ত্র হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। শেফালিকে সঙ্গে নেওয়া হলো। আমরা যাব জয়েন মাস্টারের বাড়ি। সেখানে আমাদের আরেকটা দল আছে।
শেফালি আগে আগে যাচ্ছে। আমরা পাটখেতের আল ধরে এগোচ্ছি। ছুটছি আর ছুটছি।
জয়েন মাস্টারের বাড়িতে ছিল পাঁচজন। এখন আমাদের দলে নয়জন। আমরা বাঁশঝাড়ের ঘন একটা বনের দিকে চললাম।
শেফালি দেখিয়ে দিল। মিলিটারির নৌকাটা উজান থেকে ভাটিতে এসেছে। আবার ভাটি থেকে উজানে এই পথ দিয়েই যাবে।
শেফালিকে বললাম, ‘শেফালি বাড়ি যাও। আমরা আমাদের কাজ করব।’
শেফালি বলল, ‘লাভলু ভাই। ভালা থাইকেন। আমরা আপনাগো লাইগা দোয়া করমু।’
আমরা ওত পেতে বসে আছি। এখানে খালটা গভীর। মিলিটারির নৌকা এই পথ দিয়েই ফিরবে। আমরা খালের পাড়ে ঘন বাঁশ-বেত–গুল্মলতার জঙ্গলে পজিশন নিয়ে বসে আছি। আমার হাতে স্টেনগান। আমাদের কাছে আরও ছয়টি রাইফেল আর একটি এলএমজি আছে। গ্রেনেড আছে ১৮টি।
সময় কাটতে চাচ্ছে না। বাইনোকুলারে চোখ রেখে মুকুল ভাই বললেন, ‘আসছে। রেডি।’ সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে রেখেছে। প্রথম গুলিটা চালাবেন সুবেদার ওয়াহাব। তিনি ইপিআরের সুবেদার। তিনি গুলি চালানোর আগে কেউ গুলি চালাতে পারবে না।
ভ্যাপসা গরম। সকাল ১০টার মতো বাজে। এখনো এই জঙ্গলে ঝিঁঝির ডাক শোনা যাচ্ছে। গায়ের ওপর দিয়ে পিঁপড়া হাঁটছে। দুটি বেজি ওখানে মাথা উঁচু করে আমাদের দেখছে।
‘ফায়ার!’
সুবেদার ওহাবের এলএমজি গর্জে উঠল।
আমাদের অস্ত্রগুলোও।
নৌকা ফুটো হয়ে ডুবে যাচ্ছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আমরা টার্গেট করে গুলি করছি।
একজনও বাঁচবে না। রাজাকারটা চিৎকার করে উঠল, ‘আমি বাঙালি। আমারে মাইরেন না।’ সেই চিৎকার শেষ হতে পারল না।
সফল অপারেশন চালিয়ে আমরা দ্রুত আবার বর্ডারের দিকে হাঁটা ধরলাম। সীমান্ত পেরিয়ে নিরাপদ জায়গায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে এল।
দুই দিন পর শুনলাম, পাকিস্তানি সৈন্যরা আরও শক্তি ও সৈন্য নিয়ে বাঁশতলি গ্রামে ঢুকেছিল।
গ্রামের প্রতিটা ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে ওরা। নির্বিচার মানুষ মেরেছে।
কাঁদতে লাগলাম আমি। মুকুল ভাই বললেন, ‘কী হয়েছে?’
আমি বললাম, ‘শেফালি কেমন আছে, মুকুল ভাই? শেফালির মা কেমন আছেন? সলিম মিয়া কেমন আছে?’
মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলেন মুকুল ভাই। কোনো জবাব দিতে পারলেন না।