আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিল

অলংকরণ: রাজীব

রন্টুদের পাড়ায় প্রায় প্রতিটি বাসার ছাদে ব্রাজিলের পতাকা উড়ছে। অর্থাৎ এই পাড়ার মোটামুটি সবাই ব্রাজিলের সাপোর্টার। কিন্তু রন্টু আবার আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। রন্টুর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আজকেই সে একটা আর্জেন্টিনার পতাকা ওড়াবে অ্যাট অ্যানি কস্ট। পতাকা কেনার টাকা তার কাছে আছে। আগেই ম্যানেজ করে রেখেছে। আজকেই টানালে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। রন্টু রওনা হলো পতাকা কিনতে।

পতাকা কিনে ফেরার পথে দেখে রাস্তার মোড়ে পাড়ার সিনিয়র-জুনিয়র কিছু ছেলেপেলে দাঁড়ানো। সবাই আড্ডা মারছে। বোঝাই যাচ্ছে, আড্ডার বিষয় তো একটাই...ফুটবল বিশ্বকাপ। এরা সবাই তার চেনা। আড্ডার প্রধান মফিজ ভাই থামালেন রন্টুকে।

‘কিরে রন্টু, খবর কী?’

‘ভালো।’

‘তোর হাতে ওটা কী?’

‘আর্জেন্টিনার পতাকা।’ গম্ভীর হয়ে বলার চেষ্টা করল রন্টু।

‘ও। তুই তো আবার আর্জেন্টিনার সাপোর্টার।’

‘হু।’

‘শোন...এই পাড়ায় কোনো বাসার ছাদে ব্রাজিলের পতাকা ছাড়া আর কোনো পতাকা উড়বে না।’

‘মানে?’

‘মানে পরিষ্কার। বাংলা কথা বুঝিস না? অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় বাংলায় কত পেয়েছিলি?’

‘ও বাংলায় সাড়ে বত্রিশ পেয়ে টিটিপি...মানে টেনেটুনে পাস।’ পাশ থেকে বলে উঠল কে যেন। সবাই হেসে উঠল। রন্টু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে দেখে কথাটা বলেছে তারই বন্ধু রউফ। রউফ এখানে কখন এল? এই মিথ্যা কথাটা কেন বলল সে! কী আশ্চর্য, এরা সব ব্রাজিলের সাপোর্টার বলে তার সঙ্গে এমন করছে!

‘ওই রন্টুর হাত থেকে পতাকাটা নিয়ে নে।’ এবার গম্ভীর গলায় বললেন মফিজ ভাই। সঙ্গে সঙ্গে রন্টুদের পেছনের বাসার সাদি টান দিয়ে রন্টুর হাত থেকে আর্জেন্টিনার পতাকাটা নিয়ে নিল।

‘মফিজ ভাই, এসব কী হচ্ছে?’ রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠল রন্টু।

‘শোন রন্টু ... তুই হয়তো জানিস না আমরা ‘‘ওয়ার্ল্ড কাপ চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল উদ্‌যাপন কমিটি’’ করেছি। আমি সভাপতি আর সাদি সাধারণ সম্পাদক। আর বাকিরা সাধারণ সদস্য। সবার মাসিক চাঁদা ২৫ টাকা। অবশ্য ব্রাজিলের সাপোর্টার হলে চাঁদা ১০ টাকা। তুই ২৫ টাকা দিয়ে যা...’

রন্টুর মুখটা হাঁ হয়ে গেল। এরা এসব কী বলছে!

৭৫ টাকার আর্জেন্টিনার পতাকা আর ২৫ টাকা চাঁদা মোট ১০০ টাকা হারিয়ে কোনোমতে কান্না চাপতে চাপতে বাসায় এল রন্টু। কথায় আছে, ছেলেদের কান্না শোভা পায় না। রাগে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা হচ্ছে রন্টুর। কিন্তু চুল ছিঁড়তে গেলে ব্যথায় ফের ওই কান্নাই পাবে। কী আর করা। শেষ পর্যন্ত সে গেল স্বপনের কাছে।

স্বপন তাদের ক্লাসের ফার্স্টবয়। তাদের পাড়াতেই থাকে। সে এক অদ্ভুত চরিত্র। ক্রিকেট, ফুটবল কিছুই তার প্রিয় নয়, তার ভালো লাগে দাবা আর বই। বই বই আর বই। সারা দিন একটা না একটা বই পড়ছেই। ক্লাসের পাঠ্যবইও তাকে কেউ কখনো পড়তে দেখে না। কিন্তু ক্লাসে আবার সে ঠিকই ফার্স্ট হয়। নানান আইডিয়া ঘুরপাক খায় ওর মাথায়। একবার তাদের ক্লাসে এক বদের হাড্ডি ছেলে ভর্তি হলো। শরীর–স্বাস্থ্যেও বেশ দশাসই সে। সবাইকে কমবেশি বুলি করতে শুরু করল ছেলেটা। তখন স্বপন তাকে এমন এক ট্রিটমেন্ট দিল যে সেই ছেলে একদম টিভির বিজ্ঞাপনের পিভিসি পাইপের মতো সোজা হয়ে গেল। সে আরেক কাহিনি। যাহোক, শেষ পর্যন্ত স্বপনের কাছে সব খুলে বলল রন্টু। ঠান্ডা মাথায় সব শুনল স্বপন। তারপর বলল,

‘তুই এখন কী করতে চাস?’

‘আমি ওই মফিজ ভাইকে একটা ট্রিটমেন্ট দিতে চাই।’

‘হুম।’ গম্ভীর হয়ে হাতের বইটা নামিয়ে রাখল স্বপন। ‘একটা ট্রিটমেন্ট দেওয়া যায়।’

‘কী কী?’

‘হ্যাঁ, আমি ওকে ট্রিটমেন্ট দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। তুই যদি আমাকে একটা বই জোগাড় করে দিস।’

‘কী বই?’

স্বপন একটা কাগজ এগিয়ে দিল, সেখানে একটা বইয়ের নাম লেখা।

‘এ বই আমি কোথায় পাব?’

‘সেটা আমি জানি না। তুই যদি বইটা জোগাড় করে আনতে পারিস, তাহলে আমি তোর কাজটা করে দেব...ওই মফিজউদ্দীনকে এমন ট্রিটমেন্ট দেব যে সে আসলেই বেকুব হয়ে যাবে।’

ওই দিনই রন্টু বইয়ের সন্ধানে বের হলো। দু-তিনটা লাইব্রেরি ঘুরে বই না পেয়ে গেল নীলক্ষেতে। নীলক্ষেতের লোকজন বলল, ‘এ বই পাইবা না। তবে আমি তোমারে প্রিন্ট বাইর কইরা বই বানায়া দিতে পারি...আমার কাছে এই বইয়ের পিডিএফ আছে। আর কারও কাছে পাইবা না।’

‘বেশ, তা–ই দেন।’

বই হাতে পেয়ে স্বপনের খুশি দেখার মতো। বইটা অনেক দিন ধরেই নাকি খুঁজছিল সে। খুশির চোটে রন্টুকে জড়িয়ে ধরে স্বপন বলল, ‘মফিজ ভাইকে এমন ট্রিটমেন্ট দিব দেখিস তুই। ও তো আমাদের বাসার দুটো বাসা পরেই থাকে।’

ঘটনা ঘটল ঠিক বিশ্বকাপ শুরুর আগের দিন। সকালেই স্বপন এসে হাজির।

‘চল।’

‘কোথায়?’

‘ওই যে, অপারেশন মিস্টার মফিজ।’

‘ওহ সত্যি? আজ?’

‘হ্যাঁ আজ এবং এখনই...’

দুরু দুরু বুকে বের হলো রন্টু। স্বপন যে কী করে কে জানে। তিন গলির মোড়ে এসে দাঁড়াল ওরা দুজন। ‘ওয়ার্ল্ডকাপ চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল উদ্‌যাপন কমিটি’র সদস্যরা আজকাল এখানেই আড্ডা মারে। ওদের দেখে হই হই করে উঠলেন মফিজ ভাই।

‘ওই যে আমাদের হারজেন্টিনার সাপোর্টার চলে আসছে। ওরা ধরেই নিয়েছে এবার আর্জেন্টিনা হারবে। তাই আর্জেন্টিনাকে সব সময় হারজেন্টিনা বলে।’ রন্টু কিছু বলল না। মফিজ ভাই স্বপনকে জিজ্ঞাসা করলেন,

‘কিরে স্বপন, তুই কোন দল?’

‘যে দল জিতবে, আমি সেই দল।’

‘তাহলে তো তুই আমাদের দলে।’

‘এখানে আপনারা সবাই ব্রাজিল?’

‘অবশ্যই।’ সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল।

‘কিন্তু...’ স্বপন কেমন যেন একটু ইতস্তত করে।

‘এর মধ্যে আবার কিন্তু কিরে?’ মফিজ ভাই বলে।

‘আমি কার কাছে যেন শুনলাম কাল নাকি আপনি দলবদল করেছেন?’

‘আমি দল বদল করেছি মানে?’ মফিজ ভাইয়ের ভ্রু কুঁচকে যায়।

‘না, মানে আপনার বাসার ছাদে আর্জেন্টিনার পতাকা উড়ছে দেখে কনফার্ম হতে এলাম এখানে।’

‘মানে?’ মফিজ ভাই এগিয়ে এসে স্বপনের বুকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘এসব ফালতু কথা তোকে কে বলেছে?’

‘এই যে, আমি ছবি তুলে এনেছি।’ বলে তার ফোনের স্ক্রিনটা এগিয়ে দেয় সবার দিকে। সবাই তাকিয়ে দেখে ঘটনা ঠিকই। মফিজ ভাইয়ের দোতলা বাড়ির ছাদে একটা বিশাল আর্জেন্টিনার পতাকা পতপত করে উড়ছে। সবাই ঘুরে তাকাল মফিজ ভাইয়ের দিকে। মফিজ ভাই ঢোক গিলে ফ্যাকাশে গলায় বলে, ‘এটা কে করেছে?’

‘আপনার বাসায় আপনি ছাড়া আর কে করবে?’ রাগী গলায় বলে ‘ওয়ার্ল্ডকাপ চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল উদ্‌যাপন কমিটি’র সাধারণ সম্পাদক সাদি।

‘চল তো দেখি।’ বলে মফিজ ভাই এগিয়ে যায়। তার পেছন পেছন গেল সবাই। মফিজের বাসার সামনে এসে দেখে সত্যিই উড়ছে আর্জেন্টিনার পতাকা। এই সময় পাড়ার একজন পরিচিত বয়স্ক মানুষ হেঁটে যাচ্ছিলেন। ওদের দেখে থামলেন।

‘মফিজ, তুমি তাহলে আর্জেন্টিনার সাপোর্টার? গুড, গুড। আমিও। পতাকা লাগানোর জন্য ধন্যবাদ। আমি তো ভেবেছিলাম এ পাড়ায় সবাই বুঝি ব্রাজিলের সাপোর্টার।’

‘কাজটা ঠিক করলেন না, মফিজ ভাই।’ কে যেন কঠিন গলায় বলে উঠল।

‘স্রেফ গাদ্দারি।’ বলল আরেকজন। মফিজ ভাই ফ্যাস ফ্যাসে গলায় বলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র...!’

‘কিসের ষড়যন্ত্র? আপনি রাজনৈতিক নেতা নাকি? ফালতু...’ বলে একে একে সরে পড়ল সবাই। স্বপন আর রন্টু হাঁটা দিল বাড়ির দিকে। রন্টু ফিসফিস করে বলল, ‘এটা কী করে হলো রে?’ হি হি করে হাসল স্বপন। বলল,

‘ম্যাজিক।’

‘বল না, প্লিজ।’

‘আরে সেদিন বললাম না আমার দুটো বাসা পরেই মফিজ ভাইদের বাসা। আমি রাতের বেলা ছাদ টপকে টপকে ওদের বাসায় গিয়ে কাজটা করেছি। সিম্পল কাজ, একটা পতাকা নামিয়ে আরেকটা পতাকা টাঙানো। আসলে কী জানিস, ম্যাজিক যত জটিল, তার ট্রিকস তত সোজা। আমাদেরটাও তা–ই হয়েছে।’

‘উফ্‌! সত্যি তুই একটা ব্রিলিয়ান্ট। তোর যদি কখনো আরও কোনো বইয়ের দরকার হয়, আমাকে বলিস।’

শেষ কথা হচ্ছে, মফিজ ভাইয়ের ছাদে কিন্তু আর্জেন্টিনার পতাকা উড়তেই থাকল। নামল না। কারণ, মফিজ ভাইয়ের বাবা নাকি কঠিন আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। তিনি পতাকা নামাতে দেননি। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ‘ওয়ার্ল্ডকাপ চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল উদ্‌যাপন কমিটি’ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। আর পাড়ায় অনেক বাসাতেই এখন ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ছাড়াও জার্মান, ফ্রান্স, পর্তুগাল...সব দেশের পতাকা উড়ছে। কোনো বাধা নেই। শুধু তা-ই না, অন্য দেশের পতাকা লাগালেও সবার ওপরে কিন্তু নিজের দেশের লাল-সবুজ পতাকাটা আছেই। নিজের দেশটা তো আগে, নাকি!