সেই দিনই সন্ধ্যায় সিনেমা হলের পাশের দশতলা বাড়িটার বাসিন্দেরা এক অপ্রত্যাশিত বিস্ফোরণে চঞ্চল হয়ে উঠল।
বাড়িটা শহরের একটা একটেরে জায়গায়; একেবারে শেষে। তার একদিকে সুন্দর রাস্তা, খুব অল্পদিন হলো রাস্তাটা বসেছে, কিন্তু এর মধ্যেই সরু সরু গাছপালায় তা সেজে উঠেছে, ঝলমল করছে দোকানপাতির সাইনবোর্ড। কিন্তু বাড়িটার চওড়া ছাই রঙের পেছন দিকটায় কেবল অবারিত মাঠ, ঘাসের মেঠো গন্ধের ঢেউ নিয়ে বাতাস আসত সেখান থেকে। মাঠের একেবারে এধারে গড়ে উঠেছিল গ্যারেজের একটা এলাকা আর অপর প্রান্তে শুরু হয়েছে বন। সেখানে ছোট্টো একটা গাঁ। চারিদিক থেকে গাঁয়ের দিকে এগিয়ে আসছে বাড়ি বানাবার উঁচু উঁচু ক্রেন।
পোড়ো জমিটা শিগগিরই অদৃশ্য হবে, তবে ইতোমধ্যে সেখানে বাচ্চাদের রাজত্ব।
তাই এই রবিবার সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যায় গ্যারেজগুলোর পেছনে কী যেন করছে তারা। সংখ্যায় অবিশ্যি দুজন। ওদের দৃঢ় ধারণা ছিল জানালায় জানালায় আলো আর বাজনা ভরা বাড়িখানা নিজের মনেই আছে, যেমন ওরা আছে তাদের নিজেদের মনে।
কিন্তু ভুল হয়েছিল ওদের। বাড়িটায় থাকত একটি মেয়ে ল্যবকা কাজাকোভা, সবকিছুতেই ওর নাক গলান চাই। তার বড় বড় ধূসর চোখদুটো সব সময়েই হাট করে খোলা, যেন কী একটা ঘটনায় সে আগে থেকেই অবাক হয়ে আছে। যাই ঘটুক সবার আগে সেখানে গিয়ে সাধারণত হাজির হবেই ল্যুবকা; আজকেও সবজান্তা ল্যুবকা শেষের গ্যারেজটির পেছন থেকে উঁকি দিয়ে দেখছিল, অন্ধকারে চোখ মেলে রেখেছিল। ক্ষণে ক্ষণে বুক ঢিপ ঢিপ করছিল তার, টের পাচ্ছিল কী একটা ঘটবে।
ওদিকে অন্ধকারের মধ্যে ওখানে ছেলেদুটো- কে যে ওরা তা ল্যুবকা ঠাহর করতে পারলে না- ছেলেদুটো নলের মতো চেহারার একটা অদ্ভুত জিনিস নিয়ে ব্যস্ত। নলটা লোহার, কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, ও জায়গাটায় আগে কখনো কোনো নল তো ছিল না। ল্যবকার সতর্ক কানে আরও একটা জিনিস ধরা পড়ল কেমন একটা কুকুরের ডাক। খুবই চাপা, কিন্তু শোনা যাচ্ছে। কোথেকে আসছে শব্দটা, নলটা থেকেই নয়ত?
ল্যুবকা ঠিক করলে ঐ গোপন সরঞ্জামটার কাছে আরও এগিয়ে যাবে। কোণটি ছেড়ে চুপি চুপি এগুতে গিয়েই থমকেজিনিস হট নামে পিছিয়ে গেল। একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বলতে দেখা গেল অন্ধকারে, তারপরেই ছেলেদুটো পড়িমরি ছুটে আসতে লাগল তারই দিকে।
পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। ক্ষুদে গোয়েন্দাটি বুঝল, এখন উধাও হওয়াই সবচেয়ে ভালো। গ্যারেজগুলোর মাঝখানের প্যাসেজ দিয়ে গলে সে ছুটল রাস্তার দিকে আর অল্পের জন্যে একটা 'ভলগা' মোটরগাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেলে না। গাড়িটা আসছিল সামনের দিক থেকে। ড্রাইভার হুঁশিয়ারি দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে হেড লাইট জ্বালিয়ে দিল। আলো এসে পড়ল একেবারে ল্যুবকার চোখে, চোখ ধাঁধিয়ে গিয়ে সে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো ঠাণ্ডা দেয়ালটায়।
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই শোনা গেল কান ফাটানো এক বিস্ফোরণ- গ্যারেজের পেছন থেকে ভয়ঙ্কর শিস দিয়ে আকাশের দিকে উঠে গেল কী একটা গোলা। তার আগুনঝরা লেজের আলোয় আলো হয়ে উঠল পোড়ো জমিটা, আলো পড়ল মাথা তুলে চেয়ে থাকা উল্লসিত ছেলে দুটোর ওপর, ভয় পাওয়া মেয়েটি আর 'ভলগা' থেকে বার হয়ে আসা চওড়া-কাঁধ, টুপি মাথায় লোকটার ওপর। আলো কিন্তু ঝলসে উঠেই নিভে গেল। শিস বন্ধ হয়ে মাটিতে এসে পড়ল গোলাটা।
লোকটা ছেলেদুটোকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে বলে উঠল, 'কেরে, গেনা নাকি?'
ছেলেদুটো কিন্তু ততক্ষণে নলটার দিকে ছুটতে লেগেছে। তার মধ্যে থেকে তখন একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা যাচ্ছে কুকুরের।
'দাঁড়া তিয়াপা, এখুনি', সান্ত্বনা দিল কুকুরের মালিক, অন্ধকারে তাকে দেখা যাচ্ছিল না, 'একটু দাঁড়া, বার করে আনছি তোকে।'
গরম নলটা থেকে কুকুরটাকে বার করার বহু চেষ্টাই করা হলো, কিন্তু কিছু ফল হলো না। ছ্যাঁকা খাওয়া বন্দিনীর কান্না আরও করুণ হয়ে উঠল।
ইতোমধ্যে এই করুণ পরিণতির জায়গাটায় এসে হাজির হয়েছে 'ভলগাটা'। গেনার বাপ নলটার কাছ থেকে ভাগিয়ে দিল ছেলেদুটোকে, ভয় দেখালো এর প্রতিফল শিগগির পাবে। গরম রকেটটা গাড়িতে তুলে নিয়ে রাখল সে, তারপর ধমকাতে ধমকাতে ঘ্যাঁচ করে ঘুরে স্পীড নিয়ে চলে গেল বনের দিকে। রাস্তা থেকে হুইসিল শোনা গেল- দারোয়ান ঘুম ভেঙে মিলিশিয়াকে খবর দিয়েছে। ছেলেদুটো মুহূর্তের মধ্যে চুপসে গিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে চম্পট দিল অন্ধকারের মধ্যে দশতলা বাড়িটার প্রায় প্রত্যেকেই পোড়ো জমিতে আওয়াজ শুনেছিল, বিস্ফোরণের আগুন দেখেছিল।
আন্দাজ করল একটা চল্লিশ ও একচল্লিশ নম্বর ফ্ল্যাটের উদ্ভাবকদের কীর্তি, নিজেদের বানানো রকেট দিয়ে এরা বাসিন্দাদের কম ভয় খাওয়ায়নি। কেউ কেউ পাজিদুটোর পক্ষও নিলে, বললে ওদের টেকনিকে মাথা আছে। কিন্তু অধিকাংশ বাসিন্দেই এমন অপ্রত্যাশিত তামাসার বিরুদ্ধে মত দিলে; গৃহম্যানেজার শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের জরিমানা করার হুমকি দিচ্ছিল, তারই সমর্থন করলে।
গৃহম্যানেজার অবশ্য নিজের মনে আফসোস করলে সে তার হাতে কোনো প্রমাণ নেই। দারোয়ান মিলিশিয়া ও গৃহম্যানেজার তল্লাশ করে অপরাধের জায়গায় সামান্য পোড়া ঘাস আর ঝোপ ছাড়া কিছুই পেলে না।
'দস্যিগুলো কি সত্যি সত্যিই রকেট ছেড়েছিল?' গৃহম্যানেজার হতভম্ব হয়ে ভাবলে, 'রকেট যদি কারও মাথায় এসে পড়ত তাহলে? না, বড়ই অনাচার... কিন্তু সাক্ষীও নেই ... আর সাক্ষী ল্যুবকা কিন্তু কারও কাছেই কিছু ফাঁস করল না।