ভয়ের কিছু নেই
আধ্যাত্মিক ব্যাপারস্যাপার নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, এ রকম মানুষদের প্রতি আমার আগ্রহ বহু আগে থেকেই। বলতে পারেন, এদের সঙ্গে মিশেটিশে, সবকিছু দেখে-শুনে বেশ আমোদ অনুভব করি আমি। অন্তত, করতাম আরকি!
সেই আগ্রহই আমার কাল হয়ে দাঁড়াল একসময়। এখন অবশ্য আমার আফসোস শোনার মতো কেউ নেই। তবে আফসোস আছে।
আমার এই দশা কীভাবে হলো, তা নিয়েই আজকের এই কাহিনি। নিদারুণ অবিশ্বাস্যতা ও অসহায়তায় পরিপূর্ণ এই করুণ ঘটনা একই সঙ্গে রোমাঞ্চকর ও ভীতিকরও বটে। যার মূল কারিগর আমার প্রতিবেশী নাজিম। আধ্যাত্মিক বিষয়াদিতে তার জ্ঞান ও আগ্রহ দেখে তার প্রতি আগ্রহী হয়েছিলাম আমি। এসব ক্ষেত্রে অনেক ভণ্ড যে আমার চোখে পড়েনি, তা নয়। তবে একটা কথা আজ কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে নাজিম আর যা–ই হোক, ভণ্ড নয়!
তার প্রমাণ আমি!
শুরুতেই বলতে হয় আমার প্রতিবেশী নাজিমের কথা। বয়স বড়জোর ১৫-১৬ হবে। মানে আমার চেয়ে অন্তত বছর ছয়েক ছোট। এই লেকপাড় এলাকায় আমরা সাকল্যে মোট ৩০টি পরিবার থাকি। লেকের দক্ষিণ দিকের ছোট্ট একতলা বাড়িটায় নাজিম থাকে ওর বাবার সঙ্গে। মা নেই বেচারার। বাবাও বেশির ভাগ সময় কাটান দেশের বাইরে। তখন কেয়ারটেকার আকতার ওর দেখাশোনা করে। অবশ্য দেখাশোনা করার তো তেমন কিছু নেই। ধাড়ি ছেলে, সারাক্ষণ টইটই করে বেড়াচ্ছে। মাথায় কামিনী ঝোপের মতো চুলের কারণে চোখ দেখা দায়। সেই চোখ আবার গোল গোল চশমার ভারী কাচের আড়ালে।
দুই কামরার ফ্ল্যাটে আমি একাই থাকি। চাবি দিয়ে তালা খুলে ভেতরে ঢুকেই গ্যাসের গন্ধ পেলাম। ভুরু কুঁচকে দ্রুতপায়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি, গ্যাসের চুলার পাইপ লিক করেছে, হিসহিস করে বেরিয়ে যাচ্ছে গ্যাস।
নাজিমের সঙ্গে প্রথম পরিচয় একদিন ভোরবেলায়। মর্নিং ওয়াক শেষ করে ফিরছি। একটা তুলাগাছের নিচে দাঁড়িয়ে একটু হাওয়া খাচ্ছিলাম বোধ হয়, তক্ষুনি দূর থেকে দেখি, হ্যাংলা তালগাছের মতো একটা ছেলে এদিকে আসছে। তাকিয়ে রইলাম আমি।
আরও সামনে আসতেই চেহারাটা পরিষ্কার হলো। তক্ষুনি নিশ্চিত হলাম, হ্যাঁ, দেখেছি একে। আমার চেয়ে তিন–চার গজ সামনে থাকতেই মনে হলো, বিড়বিড় করে কী যেন বলছে ছেলেটা। একবার মনে হলো, ডান হাতের মুঠোটা চোখের সামনে খুলে কী যেন দেখে নিল!
আমাকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই কি না জানি না, হঠাৎ থেমে বলল, ‘আপনার তো ঘরবাড়ি পুড়বে কিছুক্ষণের মধ্যে। যান, বাসায় যান তাড়াতাড়ি!’
ওর হাতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা নীলচে পাখির পালকগুলো দেখছিলাম আমি। হাতের মুঠোয় বন্দী যে দুটো পাখির ছানা, তা বুঝে ওঠার আগেই ছেলেটা লম্বা লম্বা পা ফেলে হাওয়া! আর তখন আমার কানে বাজল, আপনার তো বাড়িঘর পুড়বে!
এ রকম কিছু একটাই না বলছিল ছেলেটা? পাগল–টাগল নাকি? ভাবতে ভাবতে কী মনে করে বাড়ির দিকেই হাঁটা দিয়েছিলাম সেদিন।
দুই কামরার ফ্ল্যাটে আমি একাই থাকি। চাবি দিয়ে তালা খুলে ভেতরে ঢুকেই গ্যাসের গন্ধ পেলাম। ভুরু কুঁচকে দ্রুতপায়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি, গ্যাসের চুলার পাইপ লিক করেছে, হিসহিস করে বেরিয়ে যাচ্ছে গ্যাস।
ব্যাপার কী, ভাবতে ভাবতেই দ্রুত মিস্ত্রি ডেকে এনে লাইন ঠিক করালাম। এরপর সন্ধ্যায় বাসার সামনের বেলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে এক কাপ কফি হাতে নিয়ে লেকের হাওয়া খেতে খেতে চিন্তা করছিলাম পুরো ব্যাপারটা! ওই ছোকরার পক্ষে কোনোভাবেই জানা সম্ভব নয় যে আমার বাসার গ্যাস লিক করেছে। একই বিল্ডিংয়ের বাসিন্দা হলেও নাহয় বোঝা যেত। যদিও সেটাও অসম্ভব। আপনার বিল্ডিংয়ের কোন ফ্ল্যাটের রান্নাঘরে কী চলছে, সেটা নিশ্চয়ই আপনি জানবেন না। তাহলে আমার বাড়ি থেকে অন্তত ৫০০ গজ দূরে যার বাস, সে কী করে টের পেল? নাহ্, ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে। কফির কাপ হাতেই হাঁটা দিলাম ওর বাড়ির দিকে। এই আমার পরিচয় হলো ভুডুইস্ট (voodooist) নাজিমের সঙ্গে। আমার জীবনে খুলে গেল সম্পূর্ণ নতুন, অজানা এক জগতের দরজা। ছায়ার জগৎ।
নাজিম কীভাবে ভুডুইস্ট হলো, সেই গল্প আজ না, হয়তো আরেক দিন করতে পারব। তবে আজ পারব না। আমার হাতে এখন অনেক সময়, অফুরন্ত! সত্যি বলছি!
কিন্তু তাহলে আমি লিখতে পারব না কেন, তাই না? কারণ আমার সময়...আচ্ছা তারপর কী হলো বলি, হ্যাঁ?
অতিপ্রাকৃত ঘটনার প্রতি আমার আগ্রহ বুঝতে পেরেছিল নাজিম। প্রায়ই আমাকে ওর বিভিন্ন কার্যক্রমে ডাকত, দর্শক হিসেবে! আমি একপায়ে হাজির হতাম।
এভাবে আমি আর নাজিম মৃত মানুষের আত্মার সঙ্গে কথোপকথন থেকে শুরু করে প্রাণহীন প্রাণীর (যেমন খরগোশ, বিড়াল, পাখি) চলাফেরা ইত্যাদি অনেক অনুষ্ঠানেই (!) অতিথি হলাম।
আমি নিজে বইয়ের পোকা। নাজিমের ছোট্ট ফ্ল্যাটটা দেশ–বিদেশের শত শত বইয়ে ঠাসা। ফ্ল্যাটে ওকে ছাড়া আর কাউকে কখনো দেখিনি। নাজিমের কাছে শুনেছি, ওর বাবা নাকি কানাডায় একেবারে স্থায়ী হওয়ার জন্য বেশ তোড়জোড় করছেন। নাজিমও চলে যাবে শুনেছি শিগগিরই। তাই এখানে ইদানীং নাজিমের দিন–রাত্রির সঙ্গী কেবল আকতার।
সেদিন মর্নিং ওয়াকের ঘটনার পর ২১টা দিন কেটে গেছে। এই ২১ দিনে ২১ ঘণ্টাও মনে হয় আমি নিজের বাড়িতে কাটাইনি।
যেদিন নাজিম বলল, ‘কাল আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ চমকটা আপনাকে দেখাব কবির ভাই।’ নার্ভাস ধরনের একটা হাসি ওর মুখে, ‘কয়েকজন নিমন্ত্রিত আছে। আপনি প্রধান অতিথি। আপনাকে ছাড়া কিন্তু অসম্ভব!’ নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো সেদিন।
‘আরেহ, এভাবে বলা লাগবে না।’ ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলাম আমি, ‘আমি তো এমনিতেই থাকব, তুমি জানো’
আমার সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। আসল কথায় আসি।
সেদিন সন্ধ্যায় আমি গিয়ে দেখি, নাজিমের বসার ঘরের আলমারিটা সরানো হয়েছে। তার পেছনে আরেকটা দরজা। আমি ওর পিছু পিছু ওই ঘরে চলে গেলাম। বেশ বড়সড় নরম গদিমোড়া তিন–চারটে চেয়ার সেখানে! খালি দুটোয় আমি আর নাজিম বসলাম, বাকি দুটোর একটা আগে থেকেই একজন দখল করে রেখেছেন। ভদ্রলোকের বয়স আনুমানিক চল্লিশ কি বিয়াল্লিশ। বাজপাখির মতো বাঁকানো নাক, ব্যাক ব্রাশ করা কুচকুচে কালো চুল। এ রকম নিখুঁত ব্যাকব্রাশ আমি কেবল ইংরেজি সিনেমায় দেখেছি এর আগে। চোখ দুটো কেমন জানেন? সাদা অংশ একদম সেদ্ধ ডিমের সাদার মতো সাদা। আর মণি অপেক্ষাকৃত একটু ছোট। ভালো করে লক্ষ না করলে বোঝার উপায় নেই কারও। আর সেই চোখ ঢেকে আছে বেশি পাওয়ারের এক জোড়া সোনালি রিমের চশমা। এর চোখেও গোল চশমা! পাতলা ঠোঁটে হালকা লালচে ছোপ। বোধ হয় পান খেয়েছেন ভদ্রলোক। আয়েশ করে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছিলেন। সাদা পাঞ্জাবি–পায়জামা পরা ছিপছিপে লম্বা দেহটা যিশুখ্রিষ্টের মূর্তির মতো সোফায় দুপ্রান্তে দুহাত ছড়িয়ে দিয়েছে।
অরেঞ্জ স্কোয়াশের একটা গ্লাস আমার সামনে রাখল নাজিম, ‘ইনি খসরু ভাই। আমার গুরু বলতে পারেন। অনেক কিছুই আমি ওনার কাছে শিখেছি।’
‘তাই নাকি, বাহ্!’ টাইপের একটা চাহনি দিলাম ভদ্রলোকের দিকে। এই ফাঁকে হাতে তুলে নিচ্ছিলাম স্কোয়াশের গ্লাস।
ভদ্রলোকও দেখলাম কথা বলায় আগ্রহী নন। আমার দিকে তাকিয়ে ‘এই আরকি’ গোছের একটা হাসি দিয়ে মাথা কাত করলেন কেবল।
নাজিম উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে এসে পাশে বসতে বসতে বলল, ‘কবির ভাই, আজকের কার্যক্রম...’ একটু বিরতি নিল ও। ‘বশীকরণ’ বলে আমার দিকে তাকাল। চশমার ভেতর ওর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। আমার পাশে বসা খসরু ভাই খিলখিল করে কেন যে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন, সেটা ভাবতে ভাবতেই আমার চোখ অন্ধকার হয়ে গেল।
পরিশিষ্ট
৬ ইঞ্চি বাই ৩ ইঞ্চি পুতুলটা মেঝে থেকে তুলে নিল নাজিম। পাশে পড়ে থাকা একটা বলপয়েন্ট, যদিও সাধারণ কলমের অর্ধেক আকারের, দেখতে পেয়ে তুলে নিল সেটাও। এটা ওর নিজের তৈরি প্রথম খেলনা পুতুল। এই পুতুলের বিশেষত্ব হলো, এর পেছনের চাবি ঘোরালে এটা ছোট এই কলম দিয়ে লিখতে শুরু করে।
নাজিম এবার পুতুলটা বাক্সে ভরে স্যুটকেসে ঢোকাল। আজ রাতেই ওর কানাডার ফ্লাইট!