সারা শহরে ইস্তাহার পড়ল:
রবিবার বেলা বারোটায়
'জনানিয়ে' সিনেমা হলে
'মহাজগতে রেনা'
বৈজ্ঞানিক কল্প-চিত্রের
উদ্বোধনী প্রদর্শনী
অতিথিবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত থাকবে
প্রধান ভূমিকা গ্রহণকারী
ব্যোমযাত্রী রেনা
সকাল থেকেই মাথা ধরে উঠল 'জনানিয়ে' সিনেমা হলের ক্যাশিয়ারের। টিকিট ঘরের গোল জানালাটার ভেতর দিয়ে কেবলি এগিয়ে আসে শক্ত করে মুঠো করা হাত, আর মুঠো খুলে ছড়িয়ে পড়ে টিকিটের পয়সা। পয়সার মালিকেরা ঘাড় উঁচিয়ে পায়ের আঙুলের ডগায় দাঁড়িয়ে উঁকি দেবার চেষ্টা করে টিকিট ঘরে। পয়সা গুনে নীল একখানা টিকিট কেটে দেওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে তারা। এক ঘণ্টা বাদেই ক্যাশিয়ার মেয়ে হাঁপ ছেড়ে নিঃশ্বাস ফেলল; সাইনবোর্ডটা টাঙিয়ে দিলে; হাউসফুল।
প্রেক্ষাঘর লোকে ভরপুর, প্রতীক্ষার গুঞ্জন উঠছে। একদল লোক ঘরে ঢুকে গেল মঞ্চের দিকে। পর্দার সামনে টেবল। টেবলের পেছনে বসেছেন অতিথিরা। প্রেক্ষাঘরের দিকে দ্রুত চোখ বুলিয়ে ক্যামেরাম্যান তার বন্ধু বিখ্যাত পরিচালকের কানে কানে বললে:
'অভিনন্দন জানাই। একটা সিটও খালি নেই।'
'কিন্তু কী রকম দর্শক সব দেখুন; কেবল পেনশনি বুড়ো আর বাচ্চা' ফিস ফিস করে বললেন পরিচালক, 'খুঁত ধরতে ওস্তাদ সব।'
দর্শকরা হাততালি দিলে সিনেমা হলের ম্যানেজারের পরনে কালো স্যুট, কোটের বুক পকেট থেকে বেরিয়ে আছে রুমালের শাদা
কোণা; ফিল্মের রচয়িতাদের পরিচয় দিতে শুরু করলেন।
উঠে দাঁড়ালেন পরিচালক; একটু চুপ করে রইলেন তিনি; চারিদিক একেবারে স্তব্ধ হয়ে উঠল।
অনুচ্চ স্বরে বললেন, 'কমরেডরা, আমার জীবনের জরুরি মুহূর্তগুলোতে আমার মনে পড়ে সেই বহুদিন আগের একটা ঘটনা: ক্লাসনায়া প্রেসনিয়ায় দাঁড়িয়ে আমি দেখছিলাম পতাকার দিকে; পতাকাটা লাল আর আমার বুকের ওপরেও একটা লাল টাই; সবে পাইওনিয়র দলে ভর্তি হয়েছি সেদিন। তারপর থেকে বহুদিন মনে হয়েছে: কী চমৎকার যে এই পতাকার নিচে আমার জীবন শুরু হলো!
'আজকের দিনটা একটা সাধারণ রবিবার। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমাদের মাথার ওপরে, আমাদের সারাদেশের ওপরে পতপত করছে একটা আনন্দের পতাকা- এটা নতুন কালের পতাকা, মানুষের মহাজগৎ জয়ের পতাকা। এ পতাকা প্রথম তোলে প্রথম সোভিয়েত স্পুৎনিক। তাকে এখন বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তৃতীয় স্পুৎনিক। বলা যায় না, ওজনে একটা 'ভলগা' মোটর গাড়ির সমান ঐ বস্তুটি হয়ত ঠিক এই মুহূর্তেই আমাদের মাথার ওপর দিয়ে, এই সিনেমা হলের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে...'
সবারই মনের মধ্যে ভেসে উঠল একটা ছবি: দেয়ালগুলো পেরিয়ে রাস্তায় ছুটে চলেছে সবুজ হলদে নীল রঙের সব 'ভলগা', আর কোথায় যেন অনেক উঁচুতে দিনের আলোয় অদৃশ্য এক মহাজাগতিক যন্ত্রযান অনায়াসে এগিয়ে যাচ্ছে সবাইকে বেদম পিছনে ফেলে।
পরিচালক তারপর বললেন সেই স্বপ্নের কথা, নির্ভয় নক্ষত্রলোকের স্বপ্নকল্পনা ও বৈজ্ঞানিকদের কথা, যারা মানুষকে এগিয়ে নিয়েছে অজ্ঞাত নভোপথে।
'আমাদের ফিল্মটাও একটা স্বপ্ন', বললেন পরিচালক। 'আজ আমার খানিকটা দুঃখই হচ্ছে কারণ এ ফিল্মের আয়ু বেশি নয়। শিগগিরই, অতি শিগগিরই মানুষ যাত্রা করবে মহাজগতে, শুরু হবে অপ্রত্যাশিত, আশ্চর্য সব অ্যাডভেঞ্চার... তবে খুবই আনন্দ হবে আমার যদি অন্তত একবারের জন্যেও কখনো আপনাদের 'মহাজগতে রেনা' ফিল্মটির কথা মনে পড়ে। বুঝব, আমাদের মেহনত বৃথা যায়নি ...' হাততালির জবাবে মাথা নুইয়ে পরিচালক তাঁর পাশের মেয়েটিকে কী যেন বললেন ফিস ফিস করে, তারপর চেয়ার থেকে একটা ছোট হাতব্যাগ এগিয়ে দিলেন। 'আর এবার সার্কাসের শিল্পী সোফিয়া লেপ আপনাদের সঙ্গে ফিল্মের প্রধান নায়িকা মহাকাশযাত্রিণী
রেনার পরিচয় করবেন।'
ঝলমলে কালো পোশাক পরা সোনালি চুল মেয়েটি দুই হাত পেছন দিকে রেখে এসে দাঁড়ালো মঞ্চের সামনে।
'আল্লে হপ্!' জোর গলায় হুকুম দিলে মেয়েটি। অমনি তার পিঠের দিক থেকে লাফ দিয়ে এসে কাঁধে
বসল ছোট একটা বাঁদরী, গায়ে তার আকাশে ওড়ার পোশাক।
দ্যাখো কাণ্ড! ইস্তাহারে যে ব্যোমযাত্রীর কথা ছিল, সবাই যার জন্যে অমন উন্মুখ হয়েছিল, সে তাহলে বেশ চুপটি করেই বসে ছিল ঐ হাতব্যাগটার মধ্যে!
উল্লাসের হিল্লোল বয়ে গেল ঘরের মধ্যে। অভিনন্দনে উৎসাহিত হয়ে রেনা তার মুখ থেকে চশমাটা খুলে ছুড়ে ফেলল মেঝের ওপর, ভেঙচাতে শুরু করল, দেখিয়ে দিল যে সে একটা বাঁদরের মতো বাঁদর- খাঁটি মারমোজেট।
দর্শকেরা চেঁচামেচি করে অনুমোদন জানালো তাদের, সিট ছেড়ে হৈহৈ করে সবাই উঠে এলো মঞ্চের কাছে ফুর্তিবাজ অভিনেত্রীটিকে আর একটু কাছ থেকে দেখবার জন্যে। আর একেবারে শেষ সারি থেকে ছুটে এলো একটি মাথায় বো বাঁধা মেয়ে, ডালিয়া ফুলের একটা তোড়া হাতে নিয়ে। মঞ্চের ওপর উঠে ফুলের তোড়াটা সে এগিয়ে দিল ট্রেনার মেয়েটির হাতে।
তাড়াতাড়ি করে বললে, আমাদের পাইওনিয়র দলের পক্ষ থেকে, তারপর সন্তর্পণে হাত বুলিয়ে দিল রেনার মাথায়।
আর মুহূর্তের মধ্যে দেখা গেল ভয়ে ৰিস্ফারিত হয়ে উঠেছে মেয়েটির চোখ; বাঁদরীটা তার বেণী ধরে দাঁত বার বরে বিজয় গর্বে তাকিয়ে যাচ্ছে চারিদিকে।
দর্শকদের মধ্যে কে একবার হিহি করে হেসে উঠেই চুপ করে গেল। মঞ্চের ওপর যারা বসেছিল তাদের মুখ কিন্তু গম্ভীর। রেনা কামড়ে বসতে পারে মেয়েটিকে। ফিল্ম তোলার সময় তা কতবার হয়েছে। বেয়াড়া বাঁদরীটা ঝাঁপিয়ে পড়ে কালো নাকে বা গালে কামড়ে দিয়েই সোজা উঠে বসেছে গাছে, মুখ ভ্যাংচাতে শুরু করেছে।
ক্যামেরাম্যান ও পরিচালকের আর নড়ন চড়ন নেই। কে জানে যদি ক্ষেপে ওঠে বাঁদরীটা।
'রেনা, ছেড়ে দে বলছি', সোফিয়া লেপের শান্ত মৃদু গলা শোনা গেল, ছেড়ে দে রেনা, নাও, ছেড়ে দাও, 'সোনা আমার...' নিরীহের মতো চোখ মিটমিট করে রেনা তাকালো ট্রেনারের দিকে। তারপর হাই তুলল, ধীরে ধীরে মুঠো খুলে নিজের গা চুলকালো। মেয়েটা ছাড়া পেয়ে ছুটে পালিয়ে এলো মঞ্চ থেকে।
অস্বস্তি লাগছিল অতিথিদের।
সিনেমা হলের ম্যানেজার সবাইকে চাঙ্গা করে বললেন: 'বন্ধুগণ, আজ আমাদের উদ্বোধন দিন। এই যে ফিল্মটি নিয়ে আমাদের মাননীয় অতিথিরা সারা বছর ধরে খেটেছেন তার প্রথম দর্শক আপনারা। এখুনি আলো নিভে যাবে, রকেটের সাহসী যাত্রীটির মধ্যে আপনারা চিনতে পারবেন এই বাঁদরীটিকেই। আশা করি দুষ্ট রেনাকে আপনারা উদারতা দেখিয়ে মাফ করে দেবেন।'
রেনার নাম উচ্চারণ করতেই তালিম- পাওয়া বাঁদরীটা ম্যানেজারের পকেট থেকে রুমালটা তুলে নিলে। তারপর রুমাল নেড়ে একটা হাওয়াই চুমু পাঠালো দর্শকদের উদ্দেশে।
হেসে উঠল সবাই, অতিথিরা সরে গেলেন মঞ্চ থেকে।
আলো নিভল। লহরে লহরে ঝরে পড়ল সঙ্গীতের একটা অনভ্যস্ত ঝঙ্কার। অন্ধকারের মধ্যে ফুটে উঠল তারা। নিশ্চল হয়ে রয়েছে তারাগুলো। কেবল একটা ধাবমান ছোট্ট আলোর বিন্দুতে শান্তি ভঙ্গ হচ্ছে মহাকাশের। তাড়াতাড়ি মাটিতে ফিরে আসছে রকেট। কিন্তু তার চেয়েও দ্রুত বেজে উঠল বিপদ সঙ্কেত। ব্যোমযানের ক্রু জানালো যে ব্যোমপোতটা গিয়ে পড়েছে বিপজ্জনক কিরণ সম্পাতের মধ্যে।
এই শঙ্কার মধ্যে ফিল্মটার শুরু। মনে হলো যেন ঐ মহাকাশের নিস্তব্ধতাই বুঝি নেমে এসেছে হলের মধ্যে। স্টার্ট নেবার ময়দানে উৎকণ্ঠ হয়ে আছে ছুঁচলো নাক রকেট। আন্তগ্রহ যাত্রার স্টেশনে কেউ নেই। বৈজ্ঞানিকেরা কবে যে এই কিরণ সম্পাতের রহস্য ভেদ করে তা থেকে বাঁচাবার উপায় পাবে তারই প্রতীক্ষায় বিষণ্ণ হয়ে আছে তারকা-যাত্রীরা, যেন বাধ্য হয়ে নেমে পড়তে হয়েছে বিমানকে।
কিন্তু সারা পর্দা জুড়ে হেসে উঠল একটা পরিচিত মুখ রেনা! মহাজগৎ সন্ধানে যাবে সে। পৃথিবী থেকে সঙ্কেত পাওয়া মাত্র ট্রেনিং পাওয়া বাঁদরী যন্ত্রের হাতল চালিয়ে দেবে, বৈজ্ঞানিকেরা জানতে পারবেন কেমন বোধ করছে সে।
তাহলেও ভয়ের কথা। বাঁদরী হলেও মায়া হয় বৈকি।
সংরক্ষণী পোশাক পরানো হয়েছে রেনাকে, কেবিনের মধ্যে বসানো হলো, বেল্ট দিয়ে চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা। মাথা ঘোরাচ্ছে রেনা, হেলমেটের কাচের মধ্য থেকে দাঁত দেখাচ্ছে, মুখ হাঁ করছে। বিদায় উপলক্ষে কিছু একটা বলতে চাইছে বুঝি?
'ঘেউ।' সারা প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে শব্দ উঠল, 'ঘেউ, ঘেউ!'
সাউন্ড অপারেটর কিছু বুঝতে পারল না। সে কী, এ ডাক এলো কোথা থেকে? 'সাউন্ড রেকর্ডিং'এর সময় তো কোনো কুকুর ছিল না কোথাও।
কিন্তু ডাকটা যেন আর থামতেই চায় না। এতক্ষণে সবাই বুঝতে পেরেছে ডাকটা পর্দা থেকে শিস দিতে লাগল দর্শকেরা, এদিক ওদিক চাইতে লাগল। সেই সঙ্গে একটা ছোট্ট শব্দও যাতে বাদ না যায় সেদিকেও কান খাড়া।
অন্ধকারে কে যেন ছুটে যাচ্ছিল প্যাসেজ দিয়ে, মৃদু স্বরে ধমকালে;
'যত সব নচ্ছারের দল। লুকিয়ে লুকিয়ে কুকুর নিয়ে এসেছে হলের মধ্যে।' আলো জ্বলে উঠল; শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের এবার দেখা গেল।
সিটের সারির মধ্যে ডাকতে ডাকতে ছুটছে এক শাদা কুকুর, কুকুরের পেছনে গুড়ি মেরে ধাওয়া করেছে গেট-কীপার, গেট-কিপারের পেছন পেছন ছুটছে হতভম্ব একটা ছেলে আর ছেলেটার পিছনে দ্রুত পা চালিয়ে আসছেন ম্যানেজার।
সিটের গোলকধাঁধার মধ্যে পথ হারিয়ে কুকুরটা মুহূর্তের জন্যে থামল। সঙ্গে সঙ্গে চারটে হাতে জাপটে ধরা হলো তাকে। গেট-কীপার তাকে টানতে চায় নিজের দিকে, ছেলেটা উল্টো দিকে।
'কী হচ্ছে এ সব।' কাছে এসে গর্জন করলেন ম্যানেজার।
'এ... এ হলো তিয়াপা', কুকুরটাকে না ছেড়েই বললে ছেলেটা, আমি ভেবেছিলাম...
'কী ভেবেছিলে সে সব জানতে চাই না। এক্ষুনি হল ছেড়ে বেরিয়ে যাও।' বেরিয়ে যাবার দরজাটা দেখিয়ে দিলেন ম্যানেজার।
কর্তার লাল মুখ দেখে গেট-কীপার কুকুরটাকে ছেড়ে দিলে। ছেলেটা খপ করে কুকুরটাকে নিয়ে ওভারকোটের তলে বুকের কাছে ধরে এগিয়ে গেল গেটের দিকে। কুকুরটা ততক্ষণে শান্ত হয়ে উঠেছে একটা সাদা কুণ্ডলীর মতো।
পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল:
'আ মর, গবেট কোথাকার!'
ম্যানেজার ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন কেদারায়, রুমাল দিয়ে কপালটা মুছলেন।
উদ্বোধনী প্রদর্শন চলতে থাকল।