বড় ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন
চৈত্রের দুপুর। গ্রামের স্কুলের মাঠে ধুলা উড়িয়ে ক্রিকেট খেলছে একদল কিশোর। মাঠের ঠিক মাঝখানে রহিম দাঁড়িয়ে আছে। তার গলায় স্পষ্ট নির্দেশ, ‘ফিল্ডিং টাইট করো! শেষ বল!’ শোভন বল হাতে প্রস্তুত। কামাল উইকেটের পেছনে চিৎকার করছে, ‘ধর ধর, আউট কর!’
বল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলা শেষ। মাঠে ধুলা আর শোরগোল। আজ শুধু অনুশীলন, কিন্তু তাদের জন্য প্রতিদিনই যেন একটা যুদ্ধ।
রহিমের জীবন শুধু মাঠেই নয়, বাড়িতেও যুদ্ধ। তার বাবা চান সে পড়াশোনায় মনোযোগ দিক। ‘এই খেলার পেছনে সময় নষ্ট না করে পড়ালেখায় মন দাও,’ প্রায়ই বকা দেন। কিন্তু রহিমের জন্য ক্রিকেট শুধু খেলা নয়, তার স্বপ্ন।
তানিম, দলের সেরা অলরাউন্ডার, প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখে বড় ক্রিকেটার হওয়ার। কিন্তু তার মা বলে, ‘তুই তোর বাপের মতন শ্রমিক হবি নাকি? পড়াশোনা ছাড়া কিছু হবে না!’
অন্যদিকে শোভন পুরো দলে সবচেয়ে চুপচাপ। বাবার অসুস্থতার জন্য অনেক দিন খেলা থেকে দূরে ছিল। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে নামলে সব কষ্ট যেন ভুলে যায় সে।
কয়েক দিন পর স্কুলে ঘোষণা এল আন্তস্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্টের। খবরটা শুনে সবাই উচ্ছ্বসিত। কিন্তু রহিমের দল বুঝতে পারল, তাদের পথ সহজ নয়। তাদের কাছে ভালো ব্যাট, বল কিংবা জার্সি নেই। প্রতিপক্ষ রাশেদের দল, যাদের কাছে সব আধুনিক গিয়ার।
‘আমাদের কীভাবে হবে?’ শোভন বলল।
রহিম হেসে বলল, ‘গিয়ার দিয়ে খেলা হয় না। মনের জোর আর বন্ধুত্ব থাকলেই সব হয়। শুরু করি!’
প্র্যাকটিসের মাঝখানেই মাঠে এল নতুন একটি মুখ—আবির। শহর থেকে নতুন এসেছে। ক্রিকেটে সে–ও দারুণ পারদর্শী। কিন্তু প্রথম দিনই শোভন তাকে ভুল বুঝল। আবির কিছু টেকনিক্যাল পরামর্শ দিল আর শোভন ভেবে বসল, সে নিজেকে বড় কিছু মনে করছে।
রহিম বলল, ‘শোন, ও আমাদের দলে যোগ দিলে উপকারই হবে। নতুনদের কাছ থেকেও শেখা যায়।’
ক্রমেই দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠল আবির। তার কাছে একটি পুরোনো ব্যাট ছিল। অনুশীলনে ব্যবহার করতে দিয়েছিল সেটা। ধীরে ধীরে, শোভন-আবিরের বন্ধুত্বও জমে উঠল।
একদিন প্র্যাকটিসের সময় কামাল মজার ছলে শোভনের বল নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে যায়। মাঠজুড়ে হাসি। কিন্তু এই হাসির মধ্যেই শোভন নিজের হাতের ব্যথা আড়াল করে। সে ভেবেছিল, দলের প্র্যাকটিস বন্ধ হয়ে যাবে, যদি তারা জানে।
তানিমেরও একটা সমস্যা তৈরি হয়। মা তার খেলা নিয়ে আবার আপত্তি জানান। ‘যদি টুর্নামেন্টে নামো, তবে ঘরে ফেরার দরকার নেই!’ মা বলেছিলেন।
‘তুমি কী করবে?’ রহিম জিজ্ঞেস করল।
তানিম একমুহূর্ত চুপ থেকে বলল, ‘আমি খেলব। কারণ, আমার স্বপ্ন বড়। একদিন তোমরা সবাই দেখবে।’
কামাল তার হাস্যরসের আড়ালে দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে চলেছে। সে তার কমিক বই বিক্রি করে নতুন বল কিনে দিল।
টুর্নামেন্ট শুরু হলো। রহিমের দল প্রথম ম্যাচে দুর্দান্ত খেলল। তাদের ফিল্ডিংয়ে সবাই মুগ্ধ। কিন্তু রাশেদের দল ফাইনালে ওঠার পর তাদের ওপর কটাক্ষ করা শুরু করল।
‘তোমাদের দিয়ে হবে না,’ রাশেদ বলল। ‘শেষ ওভারে ১০ রান চেজ করা তো দূরের কথা, ঠিকঠাক মাঠে দাঁড়াতেই পারবে না।’
রহিম মাথা ঠান্ডা রেখে বলল, ‘শেষ পর্যন্ত খেলব। মাঠেই দেখা হবে।’
ফাইনালের দিন। মাঠভর্তি দর্শক। রাশেদের দল প্রথমে ব্যাটিং করে ৯৬ রান তোলে। জেতার জন্য ৯৭ রান দরকার। কিন্তু উইকেট পড়তে শুরু করে দ্রুত।
শেষ ৩ ওভারে দরকার ৩৫ রান। আবির আর তানিম ক্রিজে। আবির ৪টি চারে রানটা কমিয়ে আনে। শেষ ওভারে দরকার ১২ রান। আবির আউট হয়ে গেলে ক্রিজে আসে শোভন।
হাতের চোট নিয়ে ব্যাট করতে পারল না শোভন। কিন্তু সে ঠিক করল, রান নেওয়ার ঝুঁকি নেবে। তার ওপর ভরসা রাখল তানিম। শোভন এক দৌড়ে রান নিল, আর তানিম শেষ বলে ছক্কা মেরে ম্যাচ জিতল।
ফাইনালের পর পুরো দল আনন্দে মাতল। মাঠের চারপাশে কোলাহল। রহিমের বাবা মাঠে এসে তার মাথায় হাত রাখলেন। ‘তোমার এই বন্ধুত্বই তোমার জীবনের বড় শক্তি। তোমাদের দেখে বুঝলাম, শুধু জিতলেই নয়, কীভাবে একসঙ্গে লড়াই করতে হয়, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।’
কামালের প্রিয় কমিক বইয়ের গল্পটা শেষ হয়ে গেলেও তার বন্ধুত্বের গল্প শুরু হলো নতুন অধ্যায়ে। আর শোভন, যার আত্মবিশ্বাস কম ছিল, সে বুঝল, বন্ধুদের জন্য সে অনেক কিছু করতে পারে।
দ্বাদশ শ্রেণি, নটর ডেম কলেজ, ঢাকা