বিদেশী হরর গল্প 'অশরীরী'

সেন্ট্রাল পার্কের পুরোনো আর্সেনাল মিউজিয়ামে স্টাফ করা হামিংবার্ড, আরমিন, রুপালি শিয়াল আর উজ্জ্বলরঙা টিয়াপাখির মাঝে একটি তাকজুড়ে সার দিয়ে রাখা মানুষের মাথার বীভত্স সব নমুনা। পেরুভিয়ান, উত্তর আমেরিকান ইন্ডিয়ান, মাওরি উপজাতির সরদারের মাথাগুলো অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছি ককেশীয় নমুনাটির দিকে। এক বছরের বেশি হবে, জাদুঘরের উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ওটা। তখন থেকেই মোহ জন্মে গেছে মাথাটির ওপর।

প্রথম যখন দেখি, তব্দা খেয়ে গিয়েছিলাম। চেহারার ধ্যানমগ্ন বুদ্ধিমত্তার ছাপটা আকৃষ্ট করে আমাকে, যদিও নাকটা নেই যথাস্থানে। চোখ দুটিও অনুপস্থিত ওটার, কিন্তু বন্ধ অক্ষিকোটরেরও যেন নিজস্ব অভিব্যক্তি রয়েছে। পার্চমেন্টসদৃশ চামড়া এমনভাবে লেপটে রয়েছে যে দন্তমূল পর্যন্ত ঠাহর করা যাচ্ছে চোয়ালে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুখখানা, তবে যতটুকু অবশিষ্ট, তাতেই ফুটে উঠেছে মৃত মানুষটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। টিউটোনিক গোত্রের পরিচয়বাহী খুলিটি যেন কোনো দার্শনিকের। কোনো কালের পরিচিত কারও সঙ্গে অস্পষ্ট সাদৃশ্য খুঁজে পাই ক্ষয়া মুখটির—মনে পড়ি পড়ি করেও পড়তে চায় না, কার।

বরাবরের মতো দাঁড়ালাম গিয়ে কাচের কেসটির সামনে। আন্তরিকতা আর কৌতুক নিয়ে আচমকা যখন পিটপিট করে উঠল বন্ধ চোখের পাতা, কেন জানি বিস্মিত হলাম না অতটা!

ট্রাস্টি ডে আজ। হলে আমিই একমাত্র দর্শক। অ্যাটেনডেন্ট গেছে সহকর্মীর সঙ্গে আড্ডা দিতে।

দ্বিতীয়বারের মতো চোখ পিটপিটাল ককেশীয়, এবার আগের চেয়েও আন্তরিকভাবে। একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছি ওটার কাণ্ডকীর্তি, একজন অ্যানাটমিস্ট হিসেবে পুলক আর সমালোচনার দৃষ্টিতে। টানটান চামড়ার নিচে পেশির নড়াচড়া দেখে বুঝতে পারছি, কথা বলার জন্য কসরত করছে মাথাটা। রিজোরিয়াস আর জাইগোম্যাটি মেজর পেশির আক্ষেপ দেখে বোঝা গেল, প্রয়াস চালাচ্ছে হাসার।

বোধগম্য হলো না, কী করে হচ্ছে এসব। ব্যাপারটা অভিনব বলে সতর্কতার সঙ্গে খুলে ফেললাম গ্লাসডোর।

‘ধন্যবাদ,’ বলল মাথাটি। ‘তাজা বাতাসের আমেজই অন্য রকম!’

‘কেমন বোধ করছেন?’ জিজ্ঞেস করলাম বিনীতভাবে। ‘মানে শরীর ছাড়া?’

দীর্ঘশ্বাস পড়ল। ‘একটা পায়ের জন্য নিজের দুই কান দিয়ে দিতে রাজি আছি আমি!’ বলল সে নাকিস্বরে। ‘কত ভালোবাসতাম ঘুরে বেড়াতে, অথচ এই আমাকেই কিনা আটকে থাকতে হচ্ছে অভিশপ্ত এই শেলফের ওপর! অসভ্য, বর্বর ওই মাথাগুলোর সঙ্গে পার্থক্য কী থাকল আমার! ঘাড়ের ওপর বসে থেকে দেখে যেতে হচ্ছে চারপাশের স্যান্ডপাইপার আর সারসগুলোকে। ছোট্ট ওই জঘন্য লংপাইপগুলোকে দেখো! তাকিয়ে দেখো ধূসর শিরটাকে! মাথায় ঘিলু নেই ওদের, নেই কোনো অ্যামবিশন। যেটা রয়েছে সেটা হলো পা, পা আর পা!’ তাকের ওপর রাখা পাখিগুলোর দিকে ঈর্ষান্বিত দৃষ্টি বোলাল দুর্ভাগা মস্তক।

বুঝতে পারছি না, সান্ত্বনা দিই কীভাবে। নাকি বলব—পা না থাকার সুবিধা হলো, গেঁটেবাত থেকে রেহাই পাওয়া। নেব ঝুঁকিটা?

‘আর হাতের কথা যদি বলি,’ বলে চলল ছিন্নমস্তা। ‘সে তো আরেক দুর্দশা! গরমের দিনে যখন মাছি ঢোকে এখানে—ঈশ্বর জানেন, কীভাবে—অক্ষম আমি ওগুলো তাড়াতে। তারপর ওই যে চিনুক মমিটা দাঁত কেলাচ্ছে এদিকে চেয়ে, থাপড়াতেও পারি না ওটাকে। মাথা চুলকানো কিংবা নাক ঝাড়ার তো প্রশ্নই আসে না! না-ই বা বললাম খানাপিনার কথা। বিজ্ঞানের প্রতি সঁপে দিয়েছিলাম মনপ্রাণ। বিজ্ঞানই ছিল আমার ধর্ম, আমার অর্ধাঙ্গিনী। একদা যে আমি পুজো দিয়েছি বিজ্ঞানের পায়ে, ভবিষ্যদ্বাণী করেছি প্রযুক্তির উত্কর্ষের, সেই আমাকেই এখন—।’

‘এই যে দেখছেন,’ একপর্যায়ে সামনে এল ককেশীয় মাথাটির। ‘কুখ্যাত এক খুনির মাথা ওটা, স্যার। রাখা হয়েছে পনেরো মাস আগে। গত শতাব্দীতে গিলোটিনে চড়ানো হয় ওটাকে প্যারিসে।’

খেয়াল হলো, এ ধরনের আবেগপ্রবণ বক্তব্য শুনেছি আগেও। চেনা একটি মুখ ঝলসে উঠল মনের পর্দায়, মাথাটি দেখার পর থেকেই যে মুখের স্মৃতি তাড়া করে ফিরছে আমাকে অবচেতনে।

‘মাফ করবেন!’ বাধা দিয়ে বললাম। ‘আপনিই কি সেই প্রখ্যাত প্রফেসর ডুমকফ?’

‘ওটাই নাম ছিল আমার এবং রয়েছে!’ জবাব এল গম্ভীর স্বরে।

‘একসময় বোস্টনে থাকতেন আপনি। চমকপ্রদ কিছু বৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন। আপনিই প্রথম আবিষ্কার করেন ফোটোগ্রাফ থেকে গন্ধ পাওয়ার পদ্ধতি, বোতলজাত করেন সংগীত, উদ্ভাবন করেন অরোরা বোরিয়ালিসকে স্থির করে দেওয়ার উপায়,’ বলি আমি হড়বড় করে। ‘আপনিই প্রথম ভয়ংকর বিপজ্জনক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন মনের ওপর।’

‘ওসব ছোটখাটো ব্যাপার,’ বিষণ্ন কণ্ঠে বলল ছিন্ন মস্তক। ‘আমার শেষ আবিষ্কারটার সঙ্গে তুলনা করলে ছোট। শ্রেষ্ঠ ওই অর্জনটাই ডেকে এনেছে আমার ধ্বংস, হারাতে হয়েছে শরীরটা।’

‘কীভাবে ঘটল দুর্ঘটনাটা?’ শুধাই আমি। ‘কিছু কানে আসেনি তো এ ব্যাপারে!’

‘আসার কথা নয়,’ বলল অশরীরী। ‘একা ছিলাম আমি, বন্ধুহীন। আমার অনুপস্থিতি হয়তো খেয়ালই করেনি কেউ সেভাবে। বলছি ঘটনাটা।’

এ সময় আওয়াজ শোনা গেল সিঁড়িতে।

‘শ্শ্শ্!’ চাপা স্বরে বলে উঠল কাটা মুণ্ডু। ‘কে জানি আসছে এদিকে! ধরা পড়া চলবে না আমাদের! তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়ো কোথাও!’

আরও পড়ুন

ঝটিতি লাগিয়ে দিলাম গ্লাসকেসের ঢাকনা। ফিরে এসেছে প্রহরী। সন্দেহ এড়াতে পরম কৌতূহলে কাছের একটি নমুনা পরখ করার ভান করতে লাগলাম।

পরের ট্রাস্টি ডেতে ফের হাজির হলাম সংগ্রহশালায়। রক্ষীপ্রধানকে একটা ডলার দিলাম লোকটির দায়িত্বে থাকা জিনিসগুলো সম্বন্ধে তথ্য কেনার ছলে।

পুরো হল ঘুরে বেড়াল সে আমাকে নিয়ে, বকবক করে চলল পুরোটা সময়।

‘এই যে দেখছেন,’ একপর্যায়ে সামনে এল ককেশীয় মাথাটির। ‘কুখ্যাত এক খুনির মাথা ওটা, স্যার। রাখা হয়েছে পনেরো মাস আগে। গত শতাব্দীতে গিলোটিনে চড়ানো হয় ওটাকে প্যারিসে।’

মনে হলো, ঠোঁটের কোণ সামান্য কুঁচকে উঠল প্রফেসরের। হতাশার সূক্ষ্ম একটা ছাপ পড়ল যেন বাঁ চোখের পাতায়। কিন্তু ওটুকুই। আর কোনো পরিবর্তন ধরা পড়ল না চেহারায়।

চমত্কার কাজ দেখানোর জন্য অকুণ্ঠ ধন্যবাদ দিলাম গাইডটিকে। যেমনটি অনুমান করেছিলাম, সহজে উপার্জন করা টাকাটা পানীয়র পেছনে খরচ করার জন্য ত্বরিত নিষ্ক্রান্ত হলো অ্যাটেনডেন্ট ব্যাটা। আমি রয়ে গেলাম সেদিনের মতো একাকী।

‘একদম হুবহু। মোমের শিখাকে একই শিখা রূপে পাওয়া যাবে আবার, যদিও আগুন জ্বলছে ক্রমাগত। জলতরঙ্গকে পাওয়া যাবে একই জলতরঙ্গ হিসেবে, যদিও অবিরাম উঠছে-নামছে ঢেউ। ঠিক তেমনি আগের মানুষটিই গিয়ে হাজির হবে তারের অন্য প্রান্তে। বস্তুকে বিশেষত্ব দেয় যে তরঙ্গ, তারের মাধ্যমে পরিবাহিত সেটা হবে অন্যত্র, ঠিক যে রকম পৌঁছে যায় শব্দতরঙ্গ। সে জন্য একটা যন্ত্র তৈরি করি, যেটার সাহায্যে বস্তুকে—কী বলব—চূর্ণ করা যায় অ্যানোডে এবং আগের চেহারাতেই পুনর্গঠন করা সম্ভব ক্যাথোডে। এই হচ্ছে আমার টেলিপম্প!’

‘এ রকম একটা মাথামোটা গর্দভের জিম্মায় থাকতে হচ্ছে আমার মতো একজন বিজ্ঞানীকে!’ কাচের কারাগার খুলতেই খেদ ঝাড়ল ডুমকফ। ‘যদিও পূর্ণাঙ্গ নই আমি, তবু তো টেলিপম্পের আবিষ্কর্তা! প্যারিস! খুনি! গত শতাব্দী! আসলেই?’ হাসতে শুরু করল প্রফেসর। ভয় হলো, গড়িয়ে না পড়ে যায় তাক থেকে!

‘আপনার আবিষ্কারের কথা বলুন,’ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিতে সচেষ্ট হই আমি।

‘আহ্, টেলিপম্প!’ কাজ হলো চেষ্টায়। ‘কথা দিয়েছিলাম, কীভাবে অশরীরীতে পরিণত হলাম, বলব তোমাকে। তিন কি চার বছর আগে আবিষ্কার করি বিদ্যুতের সাহায্যে শব্দ পরিবহনের সূত্র। আমার টেলিফোন—ওই নামই দিয়েছি ওটার—সাধারণের সামনে যদি তুলে ধরতাম আবিষ্কারটা, অনেক উপযোগিতা পেত তারা এ থেকে। কিন্তু হায়—।’

‘বাধা দেওয়ার জন্য দুঃখিত,’ বলে উঠি বেরসিকের মতো। ‘আপনার জানা নেই বোধ হয়, অন্য কেউ আবিষ্কার করে ফেলেছে ওটা। সবাই-ই জানে টেলিফোনের কথা।’

‘এর বেশি কি এগিয়েছে ওরা?’ আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইল বিজ্ঞানী। ‘পরমাণু পরিবহনের মহারহস্যের হদিস কি জানা আছে ওদের? অন্য কথায়, টেলিপম্প প্রযুক্তির কৃতিত্ব কি নিতে পারবে ওরা?’

‘এমন কোনো কিছুর কথা শুনিনি আগে,’ তড়িঘড়ি করে আশ্বস্ত করি তাকে। ‘কী জিনিস এটা?’

‘তবে শোনো। টেলিফোন নিয়ে নিরীক্ষা চালানোর সময় উপলব্ধি করলাম, অনির্দিষ্ট প্রসারণের ক্ষেত্রেও কাজ করে একই সূত্র। যেকোনো বস্তু হচ্ছে অণুর সমষ্টি। অণু আবার গঠিত পরমাণু দিয়ে। এই পরমাণু হচ্ছে অস্তিত্বের একক। সংখ্যা ও পরমাণুর উপাদানের বিন্যাসের ভিত্তিতে ভিন্নতা সৃষ্টি হয় অণুতে। পরমাণু ভাঙলে যে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে, তাতে বদলে যায় অণুর গঠন। রাসায়নিক বিক্রিয়া কিংবা শক্তিশালী তড়িত্প্রবাহের প্রাচুর্যে ভেঙে যেতে পারে পরমাণু। বুঝতে পারছ তো আমার কথা?’ ‘পুরোপুরি।’

আরও পড়ুন

‘তো, ভাবতে ভাবতে দুর্দান্ত এক আইডিয়া এল মাথায়: বস্তুকে টেলিগ্রাফ করা যাক না কেন! দরকার শুধু লাইনের এক প্রান্তে অণুকে পরমাণুতে রূপান্তর করা এবং রাসায়নিক এ পরিবর্তনের তরঙ্গকে বিদ্যুতের সাহায্যে অপর প্রান্তে পৌঁছে দেওয়া। সব পরমাণুই যেহেতু একই রকম, কাজেই আগের মতোই সেগুলোকে অণুতে এবং অণুগুলোকে আগের রূপে বিন্যস্ত করলে জলজ্যান্ত বস্তুটিই ফিরে পাওয়ার কথা। অধ্যাত্মবাদীদের ভুংভাং নয় এটা, আগাগোড়া বৈজ্ঞানিক যুক্তি। বোঝা যাচ্ছে আমার কথা?’

‘খানিকটা ধোঁয়াটে লাগছে বটে,’ স্বীকার করি আমি। ‘তবে ধরতে পেরেছি আসল পয়েন্টটা। বস্তুকে টেলিগ্রাফ করা, তাই তো?’

‘একদম হুবহু। মোমের শিখাকে একই শিখা রূপে পাওয়া যাবে আবার, যদিও আগুন জ্বলছে ক্রমাগত। জলতরঙ্গকে পাওয়া যাবে একই জলতরঙ্গ হিসেবে, যদিও অবিরাম উঠছে-নামছে ঢেউ। ঠিক তেমনি আগের মানুষটিই গিয়ে হাজির হবে তারের অন্য প্রান্তে। বস্তুকে বিশেষত্ব দেয় যে তরঙ্গ, তারের মাধ্যমে পরিবাহিত সেটা হবে অন্যত্র, ঠিক যে রকম পৌঁছে যায় শব্দতরঙ্গ। সে জন্য একটা যন্ত্র তৈরি করি, যেটার সাহায্যে বস্তুকে—কী বলব—চূর্ণ করা যায় অ্যানোডে এবং আগের চেহারাতেই পুনর্গঠন করা সম্ভব ক্যাথোডে। এই হচ্ছে আমার টেলিপম্প!’

‘সত্যি সত্যিই কাজ করেছে ওটা?’ জানতে চাইলাম ব্যগ্র কণ্ঠে।

‘একেবারে নিখুঁতভাবে! বোস্টনে আমার জয় স্ট্রিটের কর্মস্থলে পাঁচ মাইলমতো তার মজুত ছিল। ওই তার দিয়ে কোয়ার্টজ, স্টার্চ, পানি—এ–জাতীয় সরল পদার্থ এক কামরা থেকে আরেক কামরায় পাঠিয়ে দিতে সমস্যা হয়নি কোনো। কী যে আনন্দ পেয়েছিলাম, বলে বোঝানো যাবে না, যেদিন তিন সেন্টের একটা ডাকটিকিট তাৎক্ষণিকভাবে প্রেরণ করতে সক্ষম হই পাশের কামরার গ্রাহক যন্ত্রে।’ বিরতি নিল প্রফেসর ডুমকফ। ‘অজৈব বস্তু দিয়ে সাফল্য পাওয়ায় সাহস পেলাম এবার জ্যান্ত প্রাণীর ওপর প্রচেষ্টা চালাতে। হলদে-কালো রঙের বিড়াল জোগাড় করলাম একটা, দুই শ কাপ ব্যাটারির মারাত্মক তড়িৎ চালনা করলাম ওটার ওপর। মুহূর্তেই নেই হয়ে গেল বাঘের মাসি! একদৌড়ে ছুটে গেলাম পাশের ঘরে। হ্যাঁ, বহাল তবিয়তেই পাওয়া গেল চারপেয়েটাকে। গরগর করছে, খানিকটা হতচকিত যদিও। জাদুমন্ত্রের মতো কাজ করেছে পরীক্ষাটা!’

‘আসলেই অসাধারণ ব্যাপার!’ না বলে পারলাম না।

‘তাহলেই বোঝো! বিড়াল নিয়ে এক্সপেরিমেন্টের পর আরও বড় পরিকল্পনা খেলতে লাগল মগজে। ভাবলাম: ছোটখাটো জন্তু যদি পাঠানো যায়, মানুষ নয় কেন? পাঁচ মাইল দৈর্ঘ্যের তার যদি একলহমায় পাড়ি দিতে পারে বিড়াল বাবাজি, একইভাবে কি আটলান্টিক কেব্‌ল দিয়ে মানুষ যেতে পারবে না লন্ডনে? শক্তিশালী ব্যাটারির শক্তি আরও বাড়িয়ে চালাব পরীক্ষাটা, ঠিক করলাম। বিজ্ঞানের একজন সাধক হিসেবে নিজেই হবো গিনিপিগ।

‘আমার এই করুণ অভিজ্ঞতাটা বলতে চাইনি কাউকে।’ একফোঁটা পানি বেরিয়ে এল বেচারার চোখ থেকে, গড়িয়ে নামল গাল বেয়ে।

পকেট থেকে রুমাল বের করে আলগোছে মুছে দিলাম অশ্রু।

আরও পড়ুন

‘পরিকল্পনা অনুযায়ী তিন গুণ বাড়িয়ে নিলাম ব্যাটারির শক্তি,’ বলে চলল বৈজ্ঞানিক। ‘তার টানালাম কাজের জায়গার ছাদ থেকে ফিলিপস স্ট্রিটের বাসায়। নিজের থিওরি নিয়ে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে প্রশান্ত গাম্ভীর্যের সঙ্গে দাঁড়ালাম গিয়ে জয় স্ট্রিটের অফিসে রাখা টেলিপম্প মেশিনের গ্রাহক যন্ত্রে। নিজের অস্তিত্বের মতোই নিশ্চিত ছিলাম, যখন সংযোগ দেব ব্যাটারিতে, ফিলিপস স্ট্রিটের কামরায় আবিষ্কার করব নিজেকে। একবুক দম নিয়ে চাপ দিলাম বিদ্যুতের সুইচে। কিন্তু...!’ ভাষা হারাল সায়েন্টিস্ট। কিছুক্ষণ হাঁসফাঁস করার পর বলতে লাগল বাকি কাহিনি। ‘পা থেকে চূর্ণ হওয়া শুরু হলো আমার, অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে। পায়ের পর ধড়, এরপর উধাও হয়ে গেল হাতজোড়া। কিছু একটা ঠিক নেই—প্রক্রিয়াটার মাত্রাধিক মন্থরতা থেকে আঁচ করছিলাম, কিন্তু তখন নিরুপায় আমি। মাথা গায়েব হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংজ্ঞা হারালাম পুরোপুরি। সূত্র অনুযায়ী, সব শেষে মুড়ো অদৃশ্য হয়ে সবার আগে আবির্ভূত হওয়ার কথা তারের আরেক মাথায়। বাস্তবে ঘটছিলও সেভাবে সবকিছু। জ্ঞান ফিরে পেয়ে চোখ মেললাম ফিলিপস স্ট্রিটের অ্যাপার্টমেন্টে। চিবুক তৈরি হচ্ছে তখন। দারুণ সন্তুষ্টির সঙ্গে লক্ষ করলাম, আস্তে আস্তে আকার পাচ্ছে ঘাড়। হঠাৎই, তৃতীয় কার্ভিক্যাল ভার্টেব্রাতে এসে থেমে গেল গঠনপ্রক্রিয়া। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম কারণটা। ফ্রেশ সালফিউরিক অ্যাসিডে কাপ ভরতে ভুলে গেছি ব্যাটারির। শরীরের বাদবাকি অংশের পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না যন্ত্র। অতএব, রয়ে গেলাম এভাবে মাথাসর্বস্ব হয়ে। বাকি শরীরটা—ওপরওয়ালা জানেন, কোথায়!’

সমবেদনা জানানো বৃথা। বিজ্ঞানসাধকের দুরবস্থার কাছে সেটা হবে উপহাসেরই নামান্তর।

‘মেডিকেল স্টুডেন্টে গিজগিজ করত ফিলিপস স্ট্রিটের বাড়িটা,’ বিষাদ ঝরে পড়ছে প্রফেসর ডুমকফের কণ্ঠ থেকে। ‘ধারণা করছি, ওদেরই কেউ হয়তো খুঁজে পায় মাথাটা; আমার বা আমার আবিষ্কার সম্বন্ধে কোনোই ধারণা নেই যাদের। নিশ্চয়ই ব্যবহারিক পড়াশোনার উপযুক্ত মনে করে আমাকে। এ-ও অনুমান করি, কোনো ধরনের আর্সেনিক্যাল দ্রবণে সংরক্ষণের চেষ্টা নেওয়া হয় মাথাটা। ঠিকমতো যে করতে পারেনি, তার প্রমাণ তো দেখতেই পাচ্ছ—নাকটা। মেডিকেল ছাত্রদের হাতে হাতে ঘুরতে থাকি আমি, অ্যানাটমিক্যাল ক্যাবিনেট থেকে ক্যাবিনেট ভ্রমণের এক পর্যায়ে রসিক কেউ হয়তো ফ্রেঞ্চ খুনি হিসেবে জাদুঘরে দান করে দেয় আমাকে। মাসের পর মাস চেতনা ছিল না আমার। জ্ঞান যখন ফিরে পেলাম, নিজেকে আবিষ্কার করি হতচ্ছাড়া এ মিউজিয়ামে।’ শুষ্ক, কর্কশ হাসিতে ভেঙে পড়ল প্রফেসর। ‘নিয়তির নির্মম খেলা, তাই না?’

‘কিছু কি করতে পারি আপনার জন্য?’ মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে জানতে চাইলাম।

আরও পড়ুন

‘শুকরিয়া বলার জন্য,’ জবাব দিল প্রফেসর। ‘হাল ছেড়ে দিয়েছি আমি। চেষ্টা করছি মানিয়ে নেওয়ার। বিজ্ঞান সম্বন্ধে সব আগ্রহ উবে গেছে আমার। দিনের পর দিন একখানে বসে থেকে চেয়ে চেয়ে দেখছি জাতিতাত্ত্বিক আর প্রাণী-মত্স্য-শঙ্খবিদ্যার নিদর্শনগুলো। মনে হয় না, কিছু করার আছে আমার জন্য।...না, না, আছে, আছে!’ আরও একবার বিজ্ঞানীর দৃষ্টি গিয়ে পড়ল উল্টো দিকের লংপাইপগুলোর ওপর। ‘একান্তই যদি কোনো কিছুর প্রয়োজন বোধ করি, সেটা হচ্ছে বাইরের খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়া। কোনো উপায় করতে পারো তুমি?’

কথা দিলাম, রাখার চেষ্টা করব অনুরোধটা।

খানিক ভাবনাচিন্তার পর প্ল্যান দাঁড় করালাম একটা।

সেই বিকেলেই, মিউজিয়াম বন্ধ হওয়ার আগে আগে ফিরে এলাম ওখানে। ঘাপটি মারলাম ম্যানাটাস আমেরিকানাস নামে প্রকাল সি-কাউটির পেছনে। গোটা হলঘরে চকিতে নজর বুলিয়ে বিল্ডিং তালাবদ্ধ করে যখন বিদায় নিল জাদুঘররক্ষক, বেরিয়ে এলাম সিনা টান করে, তাক থেকে তুলে নিলাম বন্ধুটিকে।

লম্বা সুতোর সাহায্যে মোয়াপাখির একটি মাথাবিহীন কঙ্কালের ঘাড়ের ওপর এঁটে বাঁধলাম মানবমাথার নিচের অংশ। নিউজিল্যান্ডের বিরাটকায় বিলুপ্ত পাখিটি ভারি পা, চওড়া বুকওয়ালা; লম্বায় পূর্ণবয়স্ক মানুষের সমান। বিশাল, ছড়ানো এর পায়ের পাতা।

পা আর ডানা পেয়ে বন্ধুটির আনন্দ দেখে কে! থপ থপ কদম ফেলে হেঁটে বেড়াচ্ছে, ঝাপটাচ্ছে ডানা। কী একটা অবস্থা, ভাবুন একবার! মনে করিয়ে দিলাম, ঐতিহাসিক পাখিটির ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখা উচিত তার।

আফ্রিকান সিংহ থেকে কাচের চোখজোড়া তুলে নিয়ে বসিয়ে দিলাম প্রফেসরের অক্ষিকোটরে। সিউ ইন্ডিয়ানদের ব্যবহার্য কম্বলে ঢেকে দিলাম কঙ্কালটা।

আদ্যিকালের দালানটি থেকে বেরিয়ে পড়ি আমরা সন্ধ্যার সজীব বাতাসে। নগরীর গোলকধাঁধা ভেদ করে পৌঁছে যাই শান্ত লেকের ধারে। দিঘির পাড় ধরে হেঁটে চলি রুপালি জ্যোত্স্নায় ভিজতে ভিজতে।

এডওয়ার্ড পেজ মিশেলের জন্ম ১৮৫২ সালে। ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘দ্য ম্যান উইদাউট আ বডি’ গল্পটিতেই প্রথম টেলিপোর্টেশন ধারণার উল্লেখ পাওয়া যায়। মার্কিন এই লেখক মৃত্যুবরণ করেন ১৯২৭ সালে।

আরও পড়ুন