সারা রাত গেনা কেবল এপাশ ওপাশ করলে। মনশ্চক্ষে দেখতে পেলে মনিটর পমেরানচিক ক্ষেপে গিয়ে ওকে বলছে, "তৈরি হতে পারিসনি তো? আগেই জানতাম! মহাজগতের ব্যাপারে তাহলে নতুন কাউকে ভার দিতে হয়! তোর ওপর বরং পরিষ্কার পরিচ্ছনতা দেখার ভার দেওয়াই ভালো। এই নে তোর স্যানিটারি ব্যান্ডেজ।" "কী লজ্জা!” আতঙ্ক হল গেনার।
ভোরের আলো ফুটতেই না ফুটতেই ও খালি পায়ে ছুটল তার পড়ার টেবলে; গিয়েই একেবারে থ' হয়ে গেল: টেবলের ওপর পড়ে আছে তৈরি প্রবন্ধ! একেবারে মার্জিন রেখে টাইপ করা, কোণে পিন দিয়ে গাঁথা। প্রবন্ধের নাম 'স্পুৎনিক বলছি'।
বুঝতে দেরি হল না গেনার। হেসে ছুটে এল সোফার কাছে, যেখানে ঘুমচ্ছে তার বাবা। পায়ের ওপর নড়ে চড়ে হাসি মুখে বললে:
'ছাত্রদের কাজ তাদের বাপেদের করে দেওয়া উচিত নয়।'
আনাতোলি ইয়েভগেনিয়েভিচ একটা চোখ খুলে ঘুম ঘুম গলায় বললে:
'কেন? এতো তোদেরই সব করা। আমি শুধু তোদের ভাবনাটা লিখে দিয়েছি। তাছাড়া আমি কবিতা লিখতে পারি না, জানিস। কিন্তু বাতাস সম্বন্ধে ঐ কবিতাটা কে লিখেছে,
চমৎকার। যা পালা!'
বলেই ঘুমিয়ে পড়ল, আর গেনা ছুটল একেবারে বাতাসের মতো।
ঠিক সেই মুহূর্তে সে ক্লাসে ঢুকল যখন লালচে মুটকো পমেরানচিক বকুনি দিচ্ছিল ল্যবকা আর বরকাকে।
'ছি ছি যত বড়াই!' মনিটর বলছিল তাদের, 'একটা দায়িত্বও পূরণ করতে পারিস না। পাইওনিয়র পরিষদে আমি এ কথা তুলব কিন্তু।'
'এ্যঃ পমেরানচিক!' চেচিয়ে বললে গেনা, খুশিতে নাকের কাছে তুড়ি দিলে মনিটরের, 'এই দ্যাখ! তৈরি!'
'হুররে!' যুগপৎ চেচিয়ে উঠল বরকা আর ল্যবকা; হতভম্ব মনিটরকে ফেলে রেখে গেনার পেছু পেছু তারা ছুটে গেল বারান্দায়।
'বুঝেছিস,' হাঁপাতে হাঁপাতে বললে গেনা, 'সকালে উঠে ভাবছি, গেছি এবার, পমেরানচিক খুব একচোট নেবে, দেয়ালপত্রিকাতেও ছবি বার করে দেবে হয়ত। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি টেবলের ওপর প্রবন্ধ...'
টিফিনের সময় বন্ধুদল গিয়ে হাজির হল রেডিও কর্নারে। দরজায় অনেকখন ধাক্কা দিতে হল: উচু ক্লাসের ছাত্ররা তালা দিয়ে বন্ধ করে রেখেছিল দরজা, ব্রডকাস্টে কেউ যেন এসে গোলমাল না করে। কিন্তু যেই শুনল মহাজগতের ব্যাপার, অমনি দরজা খুলে দিলে। বসালে টেবলের ধারে। ল্যবকার নাকের সামনে একটা ঘড়ি রেখে বললে, "নজর রাখ, তোদের সময় দেওয়া হয়েছে ১৫ মিনিট।” চুপচাপ মাথা নেড়ে লুল্যবকা তার অবাক চোখদুটো মেলে রাখল ঘড়ির ডায়েলে।
'কে শুরু করবে?' জিজ্ঞেস করল ডিউটিম্যান। গেনার দিকে দেখালে বরিস, 'ও শুরু করবে প্রথমে, তারপর আমরা, পালা করে।'
ডিউটিম্যান মাইক্রোফোন চালু করলে, শুরু হল ব্রডকাস্টিং। উত্তেজনায় বাধো বাধো গলায় পড়তে শুরু করলে গেনা:
'স্পুৎনিক বলছি! স্পুৎনিক বলছি! পৃথিবীর তৃতীয় সোভিয়েত পুৎনিক বলছি!
শুনুন, শুনুন! আপনাদের আমি শোনাব পৃথিবী, আকাশ, তারার কথা। সৌভাগ্যবানেরা শুনুন! এ গ্রহের অনেক রহস্যের কথা স্কুলছাত্রদের সমস্ত পুরুষদের মধ্যে আপনারাই প্রথম শুনছেন।
সূর্যকে জানেন তো? জানেন বৈকি, রোজই তো সে আলো দেয়!
প্রাচীন কালে সূর্যকে পূজা করত মিশরীয়রা। উত্তপ্ত 'রা' দেবতার ক্রোধের ভয়ে তারা কাঁপত তাদের ঘিরে আছে যে মরুভূমি। সূর্যের দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারত কেবল একজন- মিশরের রাজা ফেরাও, খুব দুর্লভ, বহুমূল্য, কালো কাচের এক চশমা ছিল তার। কিন্তু এ ফেরাও পর্যন্ত কখনো সন্দেহ করেনি যে 'রা' দেবতার ভয়ঙ্কর কিরণ থেকে, সূর্যের অতি বদান্যতা থেকে যে বাঁচা গেল সেটা প্রার্থনার জন্যে নয়, চশমার জোরেও নয়, নীল আকাশের জন্যে বায়ুমণ্ডলের জন্যে। তবে আপনারা নিশ্চয় এ সবই জানেন, জানেন সূর্যদেবতার কথা, প্রাচীন গ্রীকদের কথা, যারা অ্যামস্ফিয়ার এই নাম দেয় বায়ুমণ্ডলীর, জানেন যে এ বায়ুমণ্ডল আমাদের পৃথিবীর রক্ষক...
যে বছর আমি আকাশে উঠি সে বছর বায়ুমণ্ডল অশান্ত হয়ে উঠেছিল। গোল টেবলের চারপাশে বসেছিলেন বৈজ্ঞানিকেরা এ বায়ুমণ্ডলের আচরণ আলোচনা করার জন্যে।
একজন বলেছিলেন, 'বন্ধুগণ, অবস্থা শঙ্কাজনক। গোটা পৃথিবীর ওপর দুর্দান্ত ঝোড়ো আবহাওয়ার রাজত্ব। লোকেদের ওপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ নামছে। তথ্য দিই: ১৯৫৬ সালে ভূগোলোকে একশটি বড়ো বড়ো দুর্যোগ ঘটেছে বারো মাসে। ভারতবর্ষে বন্যায় হাজার হাজার গ্রাম ভেসেছে, ক্ষেত ডুবেছে, আশ্রয়হীন, খাদ্যহীন হয়ে গেছে লক্ষ লক্ষ লোক। বৃষ্টিতে, হঠাৎ ফু'সে উঠা নদীর জলে ইরান আফগানিস্তানের মতো শুকনো দেশও ডুবেছে। আর পশ্চিম ইউরোপে হঠাৎ নেমেছে ভয়ঙ্কর ঠান্ডা, হাজার হাজার লোক মরেছে তাতে।'
বিপর্যয়ের তালিকা পড়ে যেতে থাকেন দ্বিতীয় বৈজ্ঞানিক:
'১৯৫৭ সালে আরো বেড়ে ওঠে বিপর্যয়। গুজব ছড়ায় যে পৃথিবীর কী একটা যেন হয়েছে, দুর্বোধ্য পরিবর্তন ঘটছে আবহাওয়ার। ফেব্রুয়ারি মাসেই মস্কোয় শুরু হয়ে গেল বসন্ত, অথচ গরমের দেশ তাশখন্দ, আল্মা-আতায় বরফ পড়ল প্রচুর। কৃষ্ণ সাগরের ওপর ফাঁসে উঠল বিপুল তুফান, তারপর তুষার ঝঞ্চা। আর ঠিক সেই সময় গরমে মরছিল অস্ট্রেলিয়া আর উরুগুয়ে, আগুন ধরে যাচ্ছিল বনে আর শুকনো মাঠে...'
বক্তৃতা দিলেন তৃতীয় জন:
'পরের বছরের কথা বলি। সিংহলে বন্যা। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ঘোর তুষারপাত। মস্কোয় মে মাসের গরম শেষ হল ভয়ঙ্কর বজ্রপাত আর অগ্নিকাণ্ডে। জাপানে একেবারেই অনাবৃষ্টি-জলের রেশন শুরু হল।'
শেষের জন বললেন সূর্যের কথা:
'কমরেড, এ হল সূর্যে তুমুল সক্রিয়তার একটা পর্ব। তপ্ত ভাস্কর ফু'সছে। মহা মহা বিস্ফোরণে শূন্যদেশে উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে সৌর গ্যাস দশ লক্ষ সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত তা উত্তপ্ত।
এই সব তেজকণিকার নাম আপনারা জানেন কর্পাসকূলূ। এই কণিকারা পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে সেকেন্ডে হাজার কিলোমিটার বেগে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ করছে তারা। সূর্যের এই বিস্ফোরণ দেখা যায় প্রতি একাদশ বৎসরে। অল্পদিন আগেও তাই ঘটেছিল।
'প্রাকৃতিক বিপর্যয় আগেও ঘটেছে পৃথিবীতে। কিন্তু টেলিগ্রাফ, রেডিও, বিমান এ সব
যখন ছিল না, তখন লোকে জানতে পারত না কী হচ্ছে গোটা পৃথিবী জুড়ে। সমস্ত দুর্যোগের হিসাব নেবার জন্যে সমবেত হয়েছি আমরা এই প্রথম, আসামীকে ধরব আমরা। অভিযোগ সূর্যেরই বিরুদ্ধে। আমাদের মতে এ সূর্য বাতাসে বিপুল সব স্রোতের উপর প্রভাব ফেলছে, তা থেকে জাগছে ঝড় ঝাঞ্চা, তাপ আর শৈত্য। আমাদের অভিযোগ যাচাই করা যাবে স্পুৎনিকে...'
আমি যখন উড়ি, তখন এই কথা বলেছিলেন পণ্ডিত। আর আমি স্পুৎনিক যা দেখলাম তা এই:
সূর্য থেকে উঠল সৌর বায়ুর এক স্তম্ভ। ছুটল পুড়তে পুড়তে, বেগে। নির্ভয়ে গাইতে লাগল এই গানটা:
এই! সাবধান!
পথ ছাড়ো
মহাজগতের ধূলি!
সবকিছু তছনছ করে যাবো পথে
আমি - তারকার ছেলে মহাবীর!
পৃথিবী,
আমাদের তারকার সোপানে
একটা নির্বোধ গোলক তুই!
উড়ছি, উড়ছি, উড়ছি,
উড়ে চলেছি তোর কাছে!
দগ্ধ করব তোকে,
বন্যায় ডোবাব,
জাগিয়ে তুলব ঝড় ঝঞ্চা,
পরোয়া করি না তোর
কোনো পার্থিব লাঞ্ছনা!
উড়ছি, উড়ছি, উড়ে আসছি,
বিশ্বের সবার চেয়ে দ্রুত।
আমি সৌর,
আমি আগ্নেয় সবচেয়ে করাল বায়ু আমি।
আমি স্পুৎনিক, ভয় হল আমার। বায়ুমণ্ডল যদি আত্মসমর্পণ করে বসে? রুখে দাঁড়াতে না পারে? তাহলে সূর্যের এ তপ্ত নিঃশ্বাসে পৃথিবীর জীবন্ত সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাবে ...
কিন্তু পৃথিবী, আমাদের গোলগাল শক্তসমর্থ এই যে গ্রহটি মহাব্যোমে সাড়ে চার মিলিয়ার্দ বছর ইতিমধ্যেই কাটিয়েছে, কিছু কিছু অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করেছে, সে তার জোর দেখিয়ে দিলে অহঙ্কারীকে। সৌর বায়ুর পথে সে বসিয়ে দিলে অদৃশ্য এক ফাঁদ, আর এই চৌম্বক ফাঁদে ধরা পড়ে গেল বিপজ্জনক আগন্তুক। দ্রুতগতি কর্পাস্ক্লরা এবার বন্দী!
অদৃশ্য বিপজ্জনক সব কণিকার দুটি মহাচক্র ঘেরাও করেছিল পৃথিবীকে। চক্রের ভেতর চক্র, তার মাঝখানে আমাদের পৃথিবী। বড়ো চক্রটা আমার মাথার ওপর, একেবারে মহাবিশ্বের চৌকাঠে; ছোটো চক্রটার মধ্যে বার বার উড়ছি আমি। খুব একটা আনন্দ হচ্ছিল না তা বোঝাই যায়। রেডিও অ্যাকটিভ ক্ষতিকর বিকিরণের সঙ্গে মোলাকাৎ করতে কারই বা সাধ যায়?
আমার অবশ্য লোহার হার্ট, কিন্তু আমার পরে মহাজগতে আসবে মানুষ, তাদের হার্ট জীবন্ত। তাদের পক্ষে এ কিরণ বেশি মারাত্মক। ওদের জন্যে পথ সন্ধানের দায়টা আমার। দুটি গোছা বিকিরণ পরীক্ষা করে দেখলাম আমি - আমার ছোটো ভাই স্পুৎনিকেরা আবিষ্কার করেছিল এদের। পরীক্ষা করে দেখলাম বেশ মন দিয়ে, শান্তভাবে। নিজেকে মনে হচ্ছিল ল্যাবরেটরিতে বৈজ্ঞানিক। পর্যবেক্ষণ করে টেপ রেকর্ড নিয়ে ব্রডকাস্ট করে পাঠালাম। জানতাম, শত শত কেন্দ্র থেকে আমার এ সংকেত ধরা হবে, পৃথিবীর যেখান থেকেই সে সংকেত পাঠাই না কেন। এদের কেউ বিশেষজ্ঞ, কেউ অ্যামেচার। আমার পাঠানো কাহিনী লোকে কাগজে লিখে খামে পুরে পাঠাল 'মস্কো, কসমস' এই ঠিকানায়। নয়ত টেলিগ্রাফ যন্ত্রের সামনে বসে টরে টক্কা করেছে ঐ একই ঠিকানায়- 'মস্কো, কসমস'। মস্কো-মহাজগৎ মস্কো-স্পুৎনিক
আমি সাবধান করে দিলাম, 'মহাজাগতিক রশ্মি বিপজ্জনক। অদৃশ্য এই গুলিবর্ষণ থেকে আত্মরক্ষা কোরো মহাকাশযাত্রীরা।
এর প্রতিটি কণিকায় ধ্বংস হবে দেহের ১৫ হাজার কোষ। অবশ্য সেটা খুব ভয়ানক নয় কেননা লোকের দেহের কোষের সংখ্যা হাজার হাজার কোটি। তাহলেও এ শত্রু থেকে সাবধান মহাকাশযাত্রী। আত্মরক্ষার উপায় খোঁজো! দুর্ভেদ্য কেবিন উদ্ভাবন করো! বিপজ্জনক ঐ চক্রে যেও না!..'
দুই চক্রের মাঝখানে ধেয়ে বেড়াতে লাগল মহাজাগতিক কণিকারা, কিন্তু পালাতে পারল না। চৌম্বক ফাঁদ ওদের শক্ত করে আটকে রেখেছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতি, সবচেয়ে প্রবল কিরণগুলো কিন্তু ছি'ড়ে বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল বায়ুমণ্ডলে, তাকে তপ্ত করে তুলে ভয়ানক আলোড়ন জাগাল পৃথিবীতে। ফের কানে এল বৈজ্ঞানিকের কড়া কণ্ঠস্বর: 'বিপর্যয়ের সংখ্যা দ্বিগুণ কমেছে। কিন্তু গত বছরে, ১৯৫৯ সালে এ বিপর্যয় সবচেয়ে বিয়োগাত্মক। অনাবৃষ্টির দরুন ব্রেজিলে লক্ষ লক্ষ লোকে দুর্ভোগ সয়েছে। পাঁচ পাঁচটা গ্রীষ্মমণ্ডলীর সাইক্লোন ও বন্যায় বিধ্বস্ত হয়েছে মাদাগাস্কার দ্বীপ। জাপানে শুরু হয় টাইফুন, মেক্সিকোয় ঝড়, ইউরোপ ও আমেরিকার সমুদ্রতটে তুফান এই হল এ বছরের -সমাপ্তি।'
নিচে লোকে স্পুৎনিকের কথা শোনার জন্যে উদগ্রীব, আমি তাই কাজ করেই চললাম, কাজের পর কাজ, আমার সঙ্কেতগুলোকে বৈজ্ঞানিকেরা পরিণত করবেন অঙ্কের ভাষায়, চোখের পলকে হিসেব বার করার যন্ত্রে তা পাঠাবেন সমাধানের জন্যে, আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চেষ্টা করবেন মহাব্যোমের রহস্য ভেদ করতে।
আমি মহাজাগতিক ল্যাবরেটরি মানুষের পথ সন্ধান করেছি আমি। লোকে যখন -মহাকাশে লাফ মারার আয়োজন করছে, সেই সময়ে যে আমি বেঁচে ছিলাম তার জন্যে আমি খুশি। ব্যোমযান তৈরি করেছে মানুষ, রকেট পাঠিয়েছে মহাজগতের নিকটতম প্রতিবেশীর দিকে, চাঁদে, আর নীল সবুজ রহস্যময় সব গ্রহ সমেত দূর তারকায় যাত্রার স্বপ্ন সে দেখছে তখনি, স্বপ্ন দেখছে আলোর গতির মতো গতি অর্জন করবে, দশলক্ষ মিলিয়ার্দ কিলোমিটার পাড়ি দেবে বছরে, স্বপ্ন দেখছে মহাপরাক্রান্ত জজ্বালানি তৈরি করবে, যাতে এ গতি পাওয়া যাবে। শক্তিমান হয়ে উঠতে চেয়েছিল মানুষ, বিশ্বাস রেখেছে মহাকাশে গিয়ে সে হয়ে উঠবে মহান। তখন সে পৃথিবীর চারপাশে ওড়াবে মস্ত মস্ত স্পুৎনিক মহাকাশযাত্রার অন্তর্বর্তী স্টেশন, চাঁদে তৈরি করবে রকেটড্রোম, সেখান থেকে যাত্রা করা হবে অন্যান্য সব বিশ্বে। আর অতি দূর দূরান্ত সব লোকে, অজানা সব তারকার গ্রহ উপগ্রহে, তেজ আহরণ করবে সেখানকার সূর্য থেকে, তারপর যে মাটি তাকে পাখা দিয়েছে ফিরে আসবে সেই পৃথিবীতে।
এ হবেই - এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। গোটা মহাব্যোমের উপকূল হয়ে দাঁড়াবে পৃথিবী... সেই দিন এগিয়ে আসছে যেদিন আমাকে পুড়ে যেতে হবে: প্রতিটি প্রদক্ষিণের সঙ্গে সঙ্গে আমি একটু করে নামছি মাটির দিকে। কিন্তু বৈজ্ঞানিকেরা যে মেয়াদ ধার্য করেছিলেন সে মেয়াদ পেরিয়ে গেল, আর আমি কিন্তু এখনো উড়ছি, টের পাচ্ছি স্বাধীনতার লঘুতা।
'সে কী?' অবাক হলেন বৈজ্ঞানিকেরা। 'আমাদের ইলেকট্রোন যন্ত্রে এমন সুখকর একটা ভুল হওয়া সম্ভব কি?'
না, ইলেকট্রোন যন্ত্রে ভুল হয়নি! যে অঙ্ক তাদের দেওয়া হয়েছিল সেটা তারা সঠিকভাবেই কষে দিয়েছে। তবে আর একটা অবাক কাণ্ড ভাগ্যে ছিল বৈজ্ঞানিকদের। এটা ঘটালে আমার জ্যোষ্ঠ ভাই 'লুন্নিকেরা'।
আমি যে উচুতে উঠতে পারিনি সেই উচু থেকে এই রকেটগুলো তাকিয়ে দেখেছে পৃথিবীর দিকে; দেখেছে যে পৃথিবী নিঃশ্বাস নেয়, হ্যাঁ হ্যাঁ, নিঃশ্বাস নেয়! আমি যখন স্টার্ট নিই তখন সূর্যের কিরণে বায়ুমণ্ডল জ্বলে যায় আর ফে'পে ওঠে তা। যেন নিঃশ্বাস নিয়ে বুক ফুলে উঠল পৃথিবীর। আর আমি যখন কাজ করে চলেছি, ততক্ষণ বায়ুর মেঘ ঠাণ্ডা হয়ে নিচে নেমে এসেছে - নিঃশ্বাস ফেলায় যে রকম ছোটো হয়ে আসে মানুষের বুক। আমার ওড়ার পথটা ছিল তার পেছু পেছু তাই বেচে যাই আমি! আরো পুরো একবছরের কাজ
জুটল আমার।
সর্বকালের স্কুলছাত্রদের মধ্যে সৌভাগ্যবানেরা, জেনে রাখুন যে পৃথিবীর মাথায় একটা মুকুট পরানো আছে! বিশ্বের সমস্ত মুকুটের চেয়ে সুন্দর আর মহার্ঘ এই মুকুট জীবনের বায়বীয় মুকুট। এ মুকুটের আয়তন এতদিন ছিল রহস্য আজ আমি তা উদ্ঘাটন করেছি: ২০ হাজার কিলোমিটার উচু। এটা নেহাৎ চাট্টিখানি কথা নয়। মুকুটের বনিয়াদটা আপনাদের অবশ্য জানা বাতাস। আমি যতটা উচুতে উঠেছিলাম সেখান থেকে পাকা জহুরীর মতো তার একটা মণি খসিয়ে দেখেছি, সেখানে কেবল হাইড্রোজেন। মুকুটের মধ্যে সবচেয়ে হালকা গ্যাসের রাজত্ব। এ গ্যাস এল কোথা থেকে? সূর্যের কিরণে তা সৃষ্টি হয় জল থেকে। পরমাণুর পর পরমাণু হাইড্রোজেন শেষহীন হাওয়াই বেলুনের মতো উড়তে উড়তে উঠে যায় হাজার হাজার কিলোমিটার উচুতে, হালকা স্বচ্ছ একটা মুকুট গড়ে তোলে পৃথিবীর ওপরে। আর এ গ্যাস যেখানে নেই, সে জায়গা থেকেই শুরু হয়েছে মহাকাশ, আন্তর্নাক্ষত্রিক ব্যোমদেশ। সৌভাগ্যবান আপনারা, এবার বুঝতে পারছেন তো কী অদৃশ্য টুপির নিচে আপনাদের বাস? অনুভব করতে পারছেন কি মহাব্যোমের মধ্যে আপনার অবস্থানটা কোথায়?
এবার বন্ধুগণ, শেষ করতে হবে আমার ভাষণ, দশ হাজারবার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে যা দেখেছি তার স্মৃতি। পথটা আমার দীর্ঘই বটে, এখান থেকে মঙ্গলগ্রহ যতটা তার আট গুণ, অথবা শুক্র গ্রহ যতটা তার এগার গুণ। রেডিওয় আমার কথা পৌঁছছে আপনাদের কাছে। আর কয়েকদিন বাদেই আমি বায়ুমণ্ডলীর ঘনস্তরে নেমে আসব, এ'কে যাব আমার শেষ বাঁক। এতে আমার মোটেই দুঃখ নেই। আমি জানি, শিগগিরই রূপোলী ব্যোমযান মহাকাশ ঘুরে পৃথিবীতে ফিরে আসবে। মহাকাশযাত্রীরা তখন আমার কথা মনে করবেন, আর যেসব সাহসী, বুদ্ধিমান মানুষ আমায় গড়েছেন তাদের জানাবেন অজস্র ধন্যবাদ। বিদায়! স্পুৎনিকের কথা ফুরুল, স্পুৎনিকের কথা শুনলেন...'
ল্যবকার পড়া যখন শেষ হল (ওকে দেওয়া হয়েছিল শেষ পাতাগুলো) তখন তার মনে
হল মুখের মধ্যে জিভটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ইঙ্গিত করে জানালে, জল খেতে চায় সে। ডিউটিম্যান তাকে এক গ্লাস জল দিয়ে বললে: 'বক্তৃতা চলেছে কিন্তু ৪৫ মিনিট ধরে।'
'তাই নাকি! আর আমাদের ক্লাস? বন্ধ মাইক্রোফোনের সামনে এতক্ষণ বলছিলাম নাকি?'
সশঙ্কে ছুটে গিয়ে দরজা খুললে গেনা। হাঁপ ছেড়ে দেখলে, ক্লাসের সব ছেলে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়, যেন টিফিনই চলছে। তার মানে শুনছিল সবাই! অষ্টম শ্রেণীর একটা টেরি-কাটা ছাত্র ছুটে এল বরকার কাছে। বললে: 'এতক্ষণ ধরে এসব তোরা বকছিল নাকি? বাহাদুরি বটে! আমাদের জ্যামিতির পরীক্ষা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল। মোট কথা মহাজগত আর কী? উড়তে পারলে তবে না।' ঠিক সেই মুহূর্তে এসে দাঁড়ালেন জ্যামিতির শিক্ষিকা।
'জ্যামিতি নইলে কিন্তু সুখভ, কোনো মহাজগতেই তুই পৌঁছবি না।' কড়া গলায় বলে চলে গেলেন রাগ করে। আর ওদিকে গেনাকে ততক্ষণে চেপে ধরেছে পমেরানচিক:
'বাতাস সম্পর্কে' খাসা বলেছিস বটে! আমিও কিন্তু বাতাস নিয়ে খানিকটা লিখেছিলাম। তার শুরুটা, দাঁড়া,' কয়েকটা টোকা সে মারল নিজের কপালে। 'হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে:
বাতাস তুই কতো শক্তিধর, মেঘের সাথে খেলিস, বাজের আগে চলিস শনশনিয়ে ঘরবাড়ির উপর।'
'হাঁদারাম!' গেনা একেবারে বসিয়ে দিল ওকে। 'আমাদের এ বাতাস একেবারে অন্য জিনিস - মহাজাগতিক বাতাস। কিছুই মাথায় ঢোকেনি তোর। কী আমার কবি! এক লাইন কবি পুশকিনের, এক লাইন নিজের। জুড়ে দিয়ে একেবারে পুশকিন-পমেরানচিক।'
এমন তুলনা সহ্য হল না পমেরানচিকের। সে যে ক্লাসের মনিটর, শৃঙ্খলা রক্ষার দায় তার ওপর, এসব ভুলে ঘুসি বাগিয়ে ছুটে এল। বহুক্ষণ ধরে মারামারি চালাল ওরা, পরস্পরকে ঠেসে ঠেসে ধরল দেয়ালে, অবিশ্যি মুখের ভাবটা এমন করলে যেন মোটেই মারামারি নয়, একটা রগড় হচ্ছে।
গেনার জামার বোতাম ছি'ড়ল প্রথমে, তারপর পমেরানচিকের। যখন তৃতীয় বোতাম ছোঁড়ার পালা তখন ওদের নিয়ে যাওয়া হল শিক্ষকদের ঘরে।
'বসে একটু মাথা ঠান্ডা করে নাও তো দেখি,' সোফার দিকে আঙুল দেখিয়ে শান্তভাবে বললেন অঙ্কের শিক্ষক।
দুজনেই বাধ্য হয়ে বসে রইল।
কিছুক্ষণ পরে দুজনে যখন বেরিয়ে আসছিল, তখন চাপা গলায় জানিয়ে দিলে গেনা:
'সৌর বায়ু সম্পর্কে' কবিতা - সে লিখেছে ল্যবকা। লিখতে হলে ঐ রকম!' পমেরানচিকের এবার খেয়াল ছিল যে সে মনিটর, তাই কিছু না করে কেবল কিল দেখাল।
ক্লাসের পর ল্যবকা, গেনা আর বরকার পেছু পেছু ছুটে গেল রেডিও টেকনিকের ডিউটিম্যান:
'এক্ষুনি এসো তোমরা, প্রতিনিধিদল এসেছে তোমাদের কাছে।'
'প্রতিনিধিদল? আমার বোতাম যে ছে'ড়া,' নিজের জামার কলার দেখাল গেনা।
'ওতে কিছু হবে না। কারো নজরে পড়বে না,' সান্ত্বনা দিলে ডিউটিম্যান।
রেডিওর ঘরে দেখা গেল আট জোড়া উল্লসিত গোল গোল চোখ। আটজন প্রতিনিধি সমস্বরে জানাল যে তারা প্রথম শ্রেণীর 'ক' 'খ' 'গ' ও 'ঘ' শাখা থেকে আসছে। লাইন টানা কাগজে লেখা একটা তালিকা বাড়িয়ে দিলে তারা।
'কী এটা?' জিজ্ঞেস করলে হেড ডিউটিম্যান।
সমস্বরে প্রতিনিধিরা জানাল, 'এটা তালিকা।'
'কীসের তালিকা?'
"স্পুৎনিক” রেডিও-গেজেটের জন্যে।'
'দেখি তো কী ব্যাপার!'
তারপর জোরে জোরে পড়ে শোনালে ডিউটিম্যান:
'১। নাতাশা বিলোভা।
২। আলিক পেত্রোভ।
৩। নিনা হিত্রোভা।
৪। কস্তিয়া স্মিরনভ।
৫। ইওজিক কভাস্কি।
এই ছাত্রছাত্রীদের জন্ম দিন ৪ঠা অক্টোবর। প্রথম স্পুৎনিকের জন্মদিনও ৪ঠা অক্টোবর। অনুরোধ করি, এই তালিকাটা যেন "স্পুৎনিকে" পড়ে শোনানো হয়।'
'বাঃ,' গুরুত্ব দিয়েই বললে ডিউটিম্যান, 'পরের বার আমাদের রেডিও-স্পুৎনিকে নিশ্চয় ব্রডকাস্ট করা হবে এটা।'
বিজয় গর্বে চলে গেল প্রথম শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা।
ল্যবকা কনুই দিয়ে গতো মারলে বরকার পাঁজরায়, বরকা মারলে গেনাকে, আর তিনজনেই হো হো করে হেসে উঠল। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ব্রডকাস্ট সাকসেসফুল!