খুনে এলিয়েন
দারুণ একটা হাসি দিয়ে রতন বলল, ‘আমরা এখানে থাকব।’
চারপাশে তাকালাম। বিশাল গুহা। সেই অনেকক্ষণ ধরে গুহার ভেতরে হাঁটছি। কিন্তু শেষ হচ্ছে না। জানতে চাইলাম, ‘আর কদ্দুর?’
‘জানি না।’
চমকে উঠলাম। বলছে কী ও! বললাম, ‘জানি না মানে?’
‘আগে কখনো এখানে আসিনি।’
‘তাহলে আমরা এখানে এলাম কেন?’
হাঁটা থামিয়ে আমার দিকে তাকাল রতন। ওর চোখ দুটো কপালে। বলল, ‘জানো না, কেন?’
বললাম, ‘আমি পৃথিবীর কোনো স্মৃতি মনে রাখতে চাই না।’
রতন এবার মুচকি হেসে বলল, ‘শুনে খুব খুশি হলাম।’
২
কতক্ষণ হেঁটেছি মনে নেই। হাঁটতে হাঁটতে আমি একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। জ্ঞান ফেরার পর দেখি, একটা ছোট্ট ঘরে শুয়ে আছি। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ঘরের এক কোনায় কী যেন করছে রতন। আমাকে উঠতে দেখেই জানতে চাইল, ‘আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকো। তোমার অক্সিজেন সিলিন্ডারটা ঠিক করে দিচ্ছি।’
এবার বুঝতে পারলাম। নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না বলেই জ্ঞান হারিয়েছিলাম। কিন্তু আমার নাকে তো অক্সিজেনের একটা নল ঢুকে আছে। ওটা দেখিয়ে জানতে চাইলাম, ‘কিন্তু এটা কার?’
‘আমার।’
অবাক হলাম। বললাম, ‘তোমার অক্সিজেন...’
কথাটা শেষ করার আগেই রতন বলল, ‘আমার দরকার নেই।’
আরও অবাক হলাম, ‘মানে!’
রতন আর কিছু বলল না। খানিক পরে আমার সিলিন্ডারটা নিয়ে এল। বলল, ‘এই নাও। এটা ঠিক হয়ে গেছে।’
৩
চার দিন ধরে গুহার ভেতর পড়ে আছি। পাথুরে গুহা। গুহা কেটে একটা ঘর বানানো হয়েছে। কিন্তু কারা বানিয়েছে? জানার ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে আমার। মনে করতে চাই না। তবু মনে পড়ছে সব। ডিসেম্বরের ৩ তারিখ পৃথিবী থেকে রওনা দিই আমরা। মানে আমি আর রতন। মঙ্গলে আসার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলাম আমি। উদ্দেশ্যটা মঙ্গলযাত্রার জন্য নয়; বরং একজনকে খুঁজতে। পৃথিবীতে আমার জীবন ঝালাপালা করে দিয়েছিল লোকটি। হঠাৎ উধাও হয়ে যায় সে। পরে খবর নিয়ে জানলাম লোকটি মঙ্গলে পাড়ি দিয়েছে। আমার কাছ থেকে অনেক দিন পালিয়ে বেড়িয়েছে। ভেবেছিল মঙ্গলে গিয়ে রেহাই পাবে। কিন্তু আমাকে তো চেনে না। আমি...
আর ভাবতে পারলাম না। মাথাটা ভীষণ ধরে আছে। বললাম, ‘চলো রতন, বাইরের আশপাশটা দেখে আসি। নতুন একটা গ্রহে এসে এভাবে গুহায় শুয়ে বসে থাকব?’
রতন বলল, ‘এখন বাইরে যাওয়া যাবে না।’
‘কেন?’
‘শৈত্যপ্রবাহ বইছে।’
‘তো কী হয়েছে? পৃথিবীতে এমন কত শৈত্যপ্রবাহ দেখেছি!’
‘এটা পৃথিবী নয়। কথাটা মাথায় রেখো। তাপমাত্রা কত এখন জানো? মাইনাস ২০০। বাইরে বেরোলেই একেবারে স্ট্যাচু হয়ে যাবে। তোমার এই পোশাকেও কাজ হবে না।’
নিজের পোশাকের দিকে তাকালাম। মঙ্গলের জন্য বিশেষভাবে তৈরি। একটা পোশাকই নিয়ে আসতে পেরেছি। আসলে খুব তাড়াহুড়ো করে এসেছি। সেই বিকেলের কথা মনে পড়ছে আবার। হুট করেই খবর পাঠিয়েছিল রতন, ‘মঙ্গলে যাবে?’ আমিও উত্তরে জানিয়েছিলাম, ‘যাব।’
‘এখনই।’
‘ঠিক আছে।’
হাতের কাছে যা ছিল, তা-ই নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। দেখা হতেই রতন আমায় নিয়ে গেল ওর বাড়ির মাটির তলার ঘরে। ঘরে ঢুকেই চমকে উঠেছিলাম। আমার চোখ দুটো কপালে উঠে গিয়েছিল। কেবল বলতে পেরেছিলাম, ‘স্পেসশিপ!’
রতন বলেছিল, ‘মঙ্গলে যাওয়ার জন্য আমি নিজেই বানিয়েছি। কেমন হয়েছে দেখতে?’
বললাম, ‘সুন্দর না। ছবিতে যেমন দেখি তেমন নয়।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রতন বলেছিল, ‘তা তো হবেই না। হাতে বানানো স্পেসশিপের ফিনিশিং ভালো হয় না। তবে এটা টেকসই। কখনো ফিরতে চাইলে এটাতে করেই আবার পৃথিবীতে ফিরতে পারবে।’
ভেতরে তাকালাম। দুটো আসন। পাশাপাশি নয়, সামনে–পেছনে। রতন সামনের আসনে বসল। আমি পেছনে। তারপর হঠাৎ আমরা মঙ্গলের উদ্দেশে উড়াল দিলাম। মহাশূন্যে আসার পর রতন একটা ক্যাপসুল খেতে দিয়েছিল। গিলে খেয়ে ফেললাম। তারপর আর কিছু মনে নেই। এ কদিন ঘুমিয়েই ছিলাম। ২২ দিন পর আমার ঘুম ভাঙিয়েছিল রতন। বলেছিল, ‘আমরা এখন মঙ্গলে।’
৪
তক্কে তক্কে রইলাম আমি। কখন রতন ঘুমাবে। রতনের দিকে তাকালাম। ওর চোখ দুটো বন্ধ। মনে হয় ঘুমাচ্ছে। কিন্তু চোখ দুটো পিটপিট করছে কেন? অনেক সময় এমন হয়। ঘুমালেও অনেকের চোখ পিটপিট করে। স্লিপটো মিটার বের করলাম। রতনের চোখের সামনে নিয়ে ধরলাম। হুঁ। ঠিক তাই। গভীর ঘুমে রয়েছে রতন। ঘুমের ডেপথ ১২ ডেটাবেজ। ১৫ ডেটাবেজ হচ্ছে আজীবনের ঘুম। মানে মৃত্যু। রতন প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ে চলে গেছে। আমার ঘুম এত গভীর হয় না। বড়জোর সাত ডেটাবেজ।
তবু চুপি চুপি উঠে দাঁড়ালাম। আলো জ্বালালাম না। আমাদের আলো দরকার নেই। মঙ্গলস্যুটের সঙ্গেই বিশেষ চশমা আছে। ওটা দিয়ে আলো–অন্ধকার সব জায়গায় দেখা যায়। কতখানি পথ পেরিয়ে এই গুহা থেকে বেরোতে হবে, জানি না। আমি হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ আমার অ্যালারপিংটা বেজে উঠল। বড্ড অবাক হলাম আমি। কেন!
আমি যাকে খুঁজছি, তার সবকিছু আমার অ্যালারপিংয়ে দেওয়া আছে। আমার দুই কিলোমিটারের মধ্যে থাকলেই ওটা বেজে উঠবে। তার মানে লোকটি আমার আশপাশেই আছে! আমি যে মঙ্গলে লোকটি কি জানে? কেমন করে জানে?
তবে লোকটিকে নাগালের মধ্যে পেয়ে বেশ খুশি হয়ে উঠলাম আমি। আর জোরে জোরে পা চালাতে লাগলাম। আর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম অ্যালারপিং যন্ত্রটার দিকে। আরও কাছাকাছি আসছে লোকটি। তবে কি লোকটি এটাও জেনে গেছে যে আমি এই গুহাতেই আছি! কিন্তু জানল কীভাবে?
হঠাৎ পেছন থেকে একটা তুমুল ধাক্কা খেলাম। ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে একটা আলোর ঝলকানি দেখতে পেলাম। আমার মাথার সামান্য ওপর দিয়ে কিছু একটা উড়ে গেল। ঘুরে তাকালাম জিনিসটির দিকে।
সেই লোকটি। আমার একেবারে সামনে। আর আমার পেছনে...!
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘রতন!’
রতনের মুখে ক্রূর হাসি। বলল, ‘নিজেকে খুব চালাক মনে করো, তাই না? কিন্তু তোমার গতিবিধি আমি ঠিকই খেয়াল করছিলাম। তুমি জানো না, এখানে কোনো রকম খুনোখুনি করা যায় না? এটা তোমাদের পৃথিবী নয়। এটা মঙ্গল। আসলে শুরুতেই ভুল হয়ে গেছে। তোমাদের পৃথিবীর মানুষ যখন এখানে বসতি গড়ার শুরু করেছিল, তখনই বাধা দেওয়ার দরকার ছিল। তাহলেই আমরা মঙ্গলবাসী শান্তিতে থাকতে পারতাম।’
আমি আরও অবাক হয়ে বললাম, ‘তুমি, তুমি এলিয়েন!’
রতন এবার চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘এলিয়েন নয়, মঙ্গলবাসী। পৃথিবী থেকে মঙ্গলে এসে মঙ্গলবাসীকে বলছ এলিয়েন? এলিয়েন তো তোমরা দুজন। আজ তোমাদের কারোরই রেহাই নেই।’
বলেই আমাদের দিকে এগিয়ে এল রতন। ওর চোখে–মুখে ঘৃণা। পৃথিবীবাসীর প্রতি ঘৃণা। এলিয়েনদের প্রতি ঘৃণা। এত দিন আমি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি যে রতন মঙ্গলবাসী। কেন বুঝতে পারিনি? ভাবতে লাগলাম।
কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবার সুযোগ পেলাম না। হঠাৎ আমার ডান হাতে একটা হ্যাঁচকা টান অনুভব করলাম। আমাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছুটতে শুরু করল লোকটি। আমিও পড়িমরি করে ছুটলাম লোকটির পেছন পেছন। তারপর বেরিয়ে এলাম গুহার বাইরে।
বাইরে বেরিয়েই অচেনা একটা স্পেসশিপ চোখে পড়ল। এক লাফ দিয়ে স্পেসশিপে উঠে পড়ল লোকটি। পেছনে তাকালাম। তেড়েমেরে ছুটে আসছে রতন। ওর দুচোখে আগুন। যেন হাতের নাগালে পেলেই...
আর ভাবতে পারলাম না। লোকটির পেছন পেছন আমিও স্পেসশিপটায় উঠে পড়লাম।
স্পেসশিপে উঠেও হাঁপাতে লাগলাম আমি। স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লাগল আমার। ধাতস্থ হওয়ার পর বললাম, ‘আমাকে ওখান থেকে বাঁচিয়ে আনার জন্য ধন্যবাদ। কী, তুমি কেমন করে জানলে আমি ওখানে?’
লোকটি বলল, ‘তুমি যেমন আমাকে অনুসরণ করছিলে, আমিও তোমাকে অনুসরণ করছিলাম। এবং আমি জানতাম তুমি আমাকে খুন করার জন্যই মঙ্গলে এসেছ। আর তারপর আরও জানতে পারলাম, তুমি ভয়ংকর এক খুনে মঙ্গলবাসীর কবলে পড়েছ। তাই তোমাকে বাঁচানোর জন্য...’
লোকটির কথা শেষ করতে দিলাম না। বললাম, ‘ভয়ংকর খুনিটার হাত থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্য আবারও ধন্যবাদ। কিন্তু আমরা এখন যাচ্ছি কোথায়?’
উত্তরটা শোনার আগেই মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল। চোখ দুটো বুজে আসতে চাইছে। আর চোখ বোজার আগে লোকটির হাতে একটা সিরিঞ্জ দেখতে পেলাম। লোকটি কখন যে আমার শরীরে সুই ঢুকিয়ে দিয়েছে, টের পাইনি।
তবে এটা টের পেয়েছি, আমরা এখন পৃথিবীর পথে।
পৃথিবী।
আহ...!