আহসান হাবীবের কিশোর উপন্যাস 'সোনার সিন্দুক' (তৃতীয় পর্ব)
‘আচ্ছা আচ্ছা, বসতেছি।’ বসার ভঙ্গি করে একটু নিচু হলো বুবলী, তারপর যেন হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেল ওর শরীরে। শূন্যে লাফিয়ে উঠে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে বাঁ পা চালাল লোকটার মুখ বরাবর। লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছিটকে গিয়ে পাশের গাছটায় ঠোক্কর খেল ওর মাথাটা। লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আগেই ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয়বার আঘাত হানল বুবলী। এবার ডান পায়ের এক কিক লোকটার বাঁ চোয়ালে...। ‘ও মাগো’ বলে লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। বুবলীর এই মারদাঙ্গা রূপ দেখে আর স্থির থাকতে পারল না অপু। একটা বাচ্চা বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ল লোকটার ওপর। লোকটার অবশ্য তখন আর উঠে বসার ক্ষমতা নেই। নাক–মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। খুব দ্রুতই লোকটাকে বেঁধে ফেলল ওরা দুজন। ভাগ্যিস নব দড়ি এনেছিল, এখন দড়িটা কাজে লাগছে। লোকটার কোমরে গোঁজা ছিল একটা ছুরি। সেটা দিয়ে স্যারের হাতের বাঁধন কাটা হলো। স্যারের হতভম্ব ভাব তখনো কাটেনি। তিনি বলেই ফেললেন,
‘তোরা এসব মারপিট কোথায় শিখলি বল তো? অ্যাঁ? আমি তো অবাকের ওপর অবাক হচ্ছি।’
‘স্যার, বুবলী কারাতে জানে।’ অপু বলল।
‘স্যার, আগামী মাসে আমি ব্ল্যাক বেল্ট পাব, আজ একটু প্র্যাকটিস হয়ে গেল...। দোয়া করবেন স্যার।’
‘দোয়া কিরে, তোরা যা করেছিস আমার জন্য...শুধু দোয়া দিয়ে হবে না...আরও কিছু লাগবে...’
তখনই দেখা গেল নবকে। সে হেলেদুলে আসছে, একা। স্যারকে মুক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো। ওরাও নবকে দেখে অবাক কম হলো না!
‘কিরে নব, লোকটা কই?’
‘ও, এখন আমার মতো সেই বুবি ট্র্যাপে উল্টো হয়ে ঝুলছে। হি হি হি। ওকে মিথ্যা বলে ওই ট্র্যাপের ওপর দিয়ে নিয়ে গেলাম মন্দিরের কথা বলে...তখনই আমার মতো হঠাৎ ঝপাং করে আকাশে উঠে গেল!’
হঠাৎ নবর নজর গেল দ্বিতীয় লোকটার দিকে। ‘বাহ ওকে ফেরে ফেলেছিস? শাবাশ!’ ‘অপু!’ বলল বুবলী। ‘জলদি ট্রিপল নাইনে ফোন দে।’
‘এখানে নেটওয়ার্ক নেই তো।’
‘ওহ তাই তো। এই সময় রিরিং করে একটা ফোন বেজে উঠল। কার ফোন বাজছে? ওরা বুঝতে পারল, গাছের সঙ্গে বাঁধা লোকটার পকেটে ফোন বাজছে, লোকটার তখনো জ্ঞান ফেরেনি। অপু সেটা হাতড়ে বের করল, ‘হ্যাঁ, মনে হয় এই ফোনটায় নেটওয়ার্ক আছে।’
‘দে, আমার কাছে ফোনটা দে। স্যার ফোনটা নিলেন।’ একটা নম্বরে ফোন করে কথা বলতে শুরু করলেন
—
‘হ্যালো নসু। হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ভালো আছি। শোন, আমার তিন ছাত্রছাত্রী আমাকে উদ্ধার করেছে, সত্যি ওরা অসাধ্য সাধন করেছে। সে অনেক কাহিনি, দেখা হলে বলব। শোন, এখন আমি দক্ষিণের পাহাড়ে আছি। আমাকে যারা ধরে এনেছিল, তারাও ধরা পড়েছে। আমার তিন ছাত্রছাত্রীই ধরেছে ... হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই তাহলে তোর ফোর্স নিয়ে জলদি চলে আয়। আমরা পাহাড়েই আছি।’
‘কাকে ফোন করলেন স্যার?’
‘আমার পরিচিত এক পুলিশ অফিসার, সে এখনই চলে আসবে। কিছু সময় হয়তো লাগবে। চল, আমরা ওপরের লোকটার তোরা কী অবস্থা করেছিস দেখি।’
‘চলেন স্যার...মজার দৃশ্য। ও আকাশে ঝুলছে। হি হি হি।’ নব দাঁত কেলিয়ে হাসে।
পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে বুবলী স্যারকে জিজ্ঞেস করল,
‘আচ্ছা স্যার, সোনার সিন্দুকের ব্যাপারটা কি সত্যি?’
‘আরে ধুর ধুর। পুরাই মিথ্যা একটা গল্প। আমার ঠাকুরদা, তার ছিল সোনার ব্যবসা। হঠাৎ করে তার কিছু শত্রু তৈরি হলো, একদিন তারাই রটিয়ে দিল। ঠাকুরদা নাকি সোনার সিন্দুক পেয়েছে। চারদিকে এমন রটনা হলো যে একদিন পুলিশ এসে ঠাকুরদাকে ধরে নিয়ে গেল। তার অপরাধ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ওই সিন্দুক কেন জমা দেয়নি! সিন্দুক থাকলে তো জমা দেবে।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কি, মিথ্যা মামলায় ঠাকুরদার জেল হয়ে গেল তিন বছরের জন্য। ওই জেলেই একদিন ঠাকুরদা...পরলোকগমন করলেন...আফসোস। কিন্তু ওই সোনার সিন্দুকের গল্প রয়েই গেল...। এখনো অনেকে বলে ঠাকুরদা নাকি ওই সিন্দুক লুকিয়ে রেখেছে। যকের ধনের গল্প পড়িসনি?’
‘পড়েছি স্যার, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা। মারাত্মক বই স্যার! আমাদের স্কুলের লাইব্রেরিতে আছে।’
‘অনেকটা সে রকম...এই সিন্দুক যেন সেই যখের ধনের গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠাকুরদা নেই কিন্তু তাকে নিয়ে সোনার সিন্দুকের মিথ্যা গল্প রয়েই গেছে। তোরা তো জানিস, তোদের অঙ্ক ক্লাস নিলেও আমি আসলে বোটানিতে পড়াশোনা করেছি। এই পাহাড়ি জঙ্গলে মাঝেমধ্যে আসি গাছগাছড়ার খোঁজখবর করতে। তাতেই ওই সংঘবদ্ধ দলটা ভেবেছে, আমি নিশ্চয়ই এখানে সেই সিন্দুক খুঁজে বেড়াচ্ছি। হা হা হা।’ স্যারকে এই প্রথম হাসতে দেখা গেল।
পাহাড়ে উঠে আসার পর দেখা গেল সত্যি হাস্যকরভাবে গলায় লাল রুমাল বাঁধা লোকটা বেকায়দায় ঝুলছে। ওরা তিনজনই হি হি করে হেসে ফেলল। স্যার অবশ্য হাসলেন না। বললেন,
‘ওকে নামানোর ব্যবস্থা কর। তারপর বেঁধে ফেলতে হবে। কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।’
‘জি স্যার।’ ওরা তিনজনেই হাত লাগাল। স্যারও সাহায্য করলেন। মাটিতে নামানোর পর লোকটা একটু প্রতিরোধ করার চেষ্টা করল। কিন্তু লাভ হলো না। ববুলী ওর কনুই দিয়ে কী একটা করল, ওর ভাষায় ‘সোলার পেক্সাসে আঘাত হানল’ আর লোকটা ‘মাগো’ বলে একদম ঠান্ডা মেরে গেল। তারপর সবাই মিলে লোকটাকে বেঁধে ফেলল।
ওরা যখন মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে পাহাড়ের ওপর ফাঁকা জায়গাটায় এসে দাঁড়াল সবাই মিলে, বুবলী তার আপুর আইফোন বের করেছে সবাই মিলে একটা সেলফি তোলার জন্য, ঠিক তখন দেখা গেল নিচে যে লোকটাকে ওরা বেঁধে রেখে এসেছিল, সে উঠে আসছে, তার হাতে একটা বিশাল রামদা। এ ছুটল কীভাবে? স্যারসহ তিনজনে মিলেই তো ওকে বেঁধেছিল। তাহলে? একটা শিরশিরে ঠান্ডা স্রোত তিনজনের শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেল যেন! এখন কী হবে?
‘এইবার সব কয়টারে কোপামু।’ লোকটা উঠে আসতে আসতে দাঁত কিরমির করে বলল। ‘আমার লগে বাইচলামি?’
আর ঠিক তখনই কোত্থেকে কী একটা হুড়মুড় করে ঝাঁপিয়ে পরে লোকটার ওপর... লোকটা কিছু বোঝার আগেই ধড়াম করে আছড়ে পড়ে মাটিতে। ওমা! ওরা অবাক হয়ে দেখে উপুড় হয়ে পড়া লোকটার পিঠে বসে আছে বিশু পাগলা। তার মুখটা হাসি হাসি। চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই, তোরা জলদি এই পাহাড় থাইকা নাইমা যা, এই পাহাড়ের গোড়া কাটা কইলাম শেষ। এইবার পরেরটা কাটুম।’ বলে সে লোকটার রামদাটা হাতে তুলে নেয়। ততক্ষণে ওরা তিনজন ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকটাকে বেঁধে ফেলল। এখন দুই ক্রিমিনাল এক জায়গায় আছে, এটা একদিক থেকে বেশ ভালোই হলো। হঠাৎ তাকিয়ে দেখে বিশু পাগলা নেই। হুট করে আবার কোথায় উধাও হয়ে গেছে। স্যার দুঃখিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন দুপাশে। ‘আহা রে, বিশুটা ভালো ছাত্র ছিল...হঠাৎ যে কী হলো...এখন এই পাহাড়ে পাহাড়ে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে...!’ স্যার দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
কিছুক্ষণ পর পাহাড়ের চূড়া থেকে ওরা দেখতে পেল নিচে একটা সাদা মাইক্রোবাস এসে থামল। চার–পাঁচজন লোক নামল মাইক্রো থেকে। স্যার বললেন, ‘ওই যে নসুরা বোধ হয় চলে এসেছে।’
ওরা বসে বসে পুলিশের লোকজনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। নব খেয়াল করল পুলিশগুলো সব সিভিল ড্রেসে এসেছে। দেখা যাচ্ছে দুজনের হাতে শটগান। ওরা ওদের সঙ্গে আনা বাকি চিপস কেক জুস ধ্বংস করতে লাগল বসে বসে। স্যার শুধু পানি আর এক পিস কেক খেলেন। আবহাওয়াটা চমত্কার, দিব্যি বাতাস দিচ্ছে। ওপরে নীল আকাশ ঝকঝক করছে। দেখা যাচ্ছে সিভিল ড্রেসের পুলিশের দলটা ধীরে ধীরে উঠে আসছে। আস্তে আস্তে তারা দৃশ্যমান হচ্ছে, পাহাড়ি গাছপালা আড়ালে।
হাত–পা বাঁধা দুজন মাঝেমধ্যে কোঁ কোঁ করছিল। অপু এবার ভালোমতো মুখও বেঁধে দিয়েছে দুজনের।
পুলিশের দল হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে এল। একজন এগিয়ে এসে সালাম দিল স্যারকে।
‘আদাব, আপনি বিনয় স্যার?’
‘হ্যাঁ, নসু কোথায়? আপনারা?’
‘নসু স্যার হঠাৎ একটা জরুরি কাজে আটকে গেছেন। আমাকে বললেন আপনাদের নিয়ে যেতে। তাই আমি এসেছি। আমি থানার সেকেন্ড অফিসার বদরুল। নসু স্যারের কলিগ। স্যার বলেছেন আপনাদের নিয়ে যেতে।’ লোকটা এবার বুবলীদের দিকে তাকাল। বলল, ‘ওহ তোমরাই তাইলে সেই সাহসী ছেলেমেয়ে...সত্যি দারুণ কাজ করেছ চল চল...নিচে চল।’
স্যারের পরিচিত নসু আসেনি দেখে স্যার মনে হলো একটু চিন্তিত হলেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘নসু তো বলল সে নিজেই আসবে!...’
‘স্যার, চলুন আমরা নামতে থাকি। ক্রিমিনালদের ওরা নিয়ে আসবে। চলেন আমরা গাড়িতে গিয়ে বসি।’
পাহাড় থেকে নামতে দেড় ঘণ্টার মতো লাগল ওদের। নামতে নামতে মাঝেমধ্যে পেছনের দিকে তাকাচ্ছিল ওরা, পুলিশ ক্রিমিনাল দুটোকে সত্যিই নিয়ে আসছে কি না। কিন্তু দেখা যাচ্ছিল না কাউকে। গাড়িতে ওঠার পরপরই গাড়ি স্টার্ট নিয়ে ছেড়ে দিল।
সামনে বসেছে ড্রাইভার আর একটা লোক, হাতে শটগান। পেছনের সিটে স্যার আর ও সেকেন্ড অফিসার, যিনি নসুর বদলি হিসেবে এসেছেন। একদম পেছনের সিটে বসেছে ওরা তিনজন। নবর একটু খটকা লাগল। সে বলেই ফেলল,
‘ওই শয়তান লোক দুটোকে আনবেন না? মানে গ্রেপ্তার করবেন না?’
‘আনবে, আনবে। বাকি দুজন ওদের নিয়ে আসবে। আরেকটা গাড়ি আসবে। ওতে করে ওরা আসবে।’
অপু ফিসফিস করল, ‘দুজন পুলিশ দুজন ক্রিমিনালকে আনতে পারবে?’
ঠিক তখন দেখল স্যার একটা হাত সিটের পেছনে রেখেছেন, সেখানে ছোট্ট একটা কাগজ ধরা দুই আঙুলে। টুপ করে কাগজটা নিচে পড়ে গেল, মানে স্যারই ফেলে দিলেন। বুবলী কাগজটা উঠিয়ে দেখে স্যার লিখেছেন ‘ মনে হচ্ছে একটা বিপদ থেকে বের হয়ে আমরা আরেকটা বিপদে পড়তে যাচ্ছি...এরা পুলিশ না, সম্ভবত এরা নসুর লোকও না।’
তিনজনই পেছনে বসে শিউরে উঠল। এখন কী হবে? স্যার এই চিরকুটটা কখন লিখলেন! স্যারকে অবশ্য ওরা তার কলম ও হলুদ রুমাল বুঝিয়ে দিয়েছিল এক ফাঁকে। স্যারও স্বীকার করেছিলেন, চিহ্ন রাখতেই তিনি এই কাজ করেছিলেন।
স্যারের কথাই ঠিক। গাড়িটা একটা বাড়ির সামনে থামল। এটা মোটেই থানা না।
‘এ আমাদের কোথায় আনলেন? নসু কোথায়?’ স্যার বললেন।
‘আরে, নসুর আলাপ রাখেন। আপনি এই ঘরটায় ঢোকেন।’ লোকটার কথাবার্তায় এখন আর সেই মোলায়েম ভাবটা নেই। আর তোমরা ত্রিরত্ন পাশের ঘরে ঢোকো, বেশি ফরফর করবা না; তাহলে বিপদ হবে। যা বলব শুনবা।’ এই বলে মোটামুটি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ওদের তিনজনকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে দিল। নব চট করে দেয়ালে কান পাতল। ওদের ইশারা করে চুপ করতে বলল। ওরাও নবর দেখাদেখি কান পাতল দেয়ালে।
পরিষ্কার কথাবার্তা শুনতে পারল ওরা। লোকটা কর্কশ ভাষায় বেশ জোরে জোরে বলছে,
‘এবার বলেন তো, আপনার ঠাকুরদার সোনার সিন্দুকটা আসলে ঠিক কোথায়?’
স্যার কী বললেন, ঠিক বোঝা গেল না। লোকটা আবার বলল,
‘স্যার, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে কিন্তু আঙুল বাঁকা করব। পাশের ঘরে আপনার প্রিয় তিন ছাত্রছাত্রী আছে, একটা একটা করে... (বাকি কথা বোঝা গেল না)।’
স্যার কী বললেন, এবারও বোঝা গেল না। ধাম করে একটা শব্দ হলো। চিত্কার করে উঠলেন স্যার। ‘মনে হয় লাঠি দিয়ে স্যারকে মারল!’ ফিসফিস করল বুবলী। তারপর হুড়োহুড়ির শব্দ। এ সময় হেঁড়ে গলায় কে একজন চিত্কার করে বলল, ‘এই পাশের রুম থেকে ওই পিচ্চি মেয়েটাকে বের করে আন তো, মেয়েটার মাথায় একটা বুলেট ঢোকালে স্যারের মুখে কথা ফুটবে... যা!’ ওরা তিনজনই সরে এল দেয়াল থেকে।
চলবে...