আমরা আনিব রাঙা প্রভাত
আমার নাম নয়না। আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি। আমার ভাইয়ের নাম দীপ। সে পড়ে ক্লাস ফাইভে।
আজকে মা আমাকে বলেছেন, নিজ হাতে সেলাই করে একটা বাংলাদেশের পতাকা বানাতে। বাংলাদেশের পতাকা বানানো কঠিন নয়। চারদিকে সবুজ, মাঝখানে লাল বৃত্ত। কিন্তু মা বলেছেন, তোমাদের বানাতে হবে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের পতাকা।
আমরা কেন ১৯৭১ সালের পতাকা বানাব, মা? ম্যাপ আঁকা, সেটা কাপড়ে তোলা, সেই ম্যাপ ধরে কাঁচি চালানো, তারপর সেটা সেলাই করা, বেশ কঠিন হবে, মা। আমি মাকে বলি।
দীপ বলে, মা, তাহলে আমরা কি এখনকার জাতীয় পতাকাটা বানাতে পারি না?
মা বলেন, তা পারো। তবে তোমাদের দাদু চান, তোমরা ১৯৭১ সালের পতাকাটাই বানাও।
দাদু কেন তা চান? আমি জিজ্ঞেস করি।
মা বলেন, তোমরা সেটা দাদুকেই জিজ্ঞেস করে দেখো।
আমাদের দাদু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। এ বছর রিটায়ার করেছেন। তার মানে এ বছর তাঁর বয়স হয়েছে ৬৫ বছর। এখন বেলা ১১টার মতো। ডিসেম্বর মাস। ২০২৩ সাল। দাদু বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছেন। ঝকঝকে রোদ এসে পড়ছে বারান্দায়। সেখানে কতগুলো বেতের চেয়ার আছে। সামনের টেবিলে পত্রিকা রাখা। আর আছে একটা চায়ের কাপ। দাদুর মাথার পেছনে টাক। রোদ পড়েছে টাকে। টাক চিকচিক করছে।
আমি আর দীপ বারান্দায় গেলাম। আমি দাদুর কাছে গিয়ে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরলাম।
দীপ গিয়ে তাঁর চশমাটা ঠিকঠাক নাকের ওপরে বসাতে লাগল।
দাদু বললেন, ব্যাপার কী! তোমাদের মতলবটা কী! মতলব ছাড়া তো তোমরা আমার কাছে আসো না।
দীপ বলল, দাদু, মা আমাদের বাংলাদেশের পতাকা বানাতে বলেছেন। আমরা কি এখনকার পতাকাটা বানাতে পারি? ১৯৭১ সালের পতাকা বানানো কঠিন।
দাদু বললেন, বানাতে চাইলে বানাতে পারো। তবে একাত্তর সালের পতাকাটা...
দাদুর গলা ধরে এল। তাঁর চোখে পানি...
আমরা বললাম, ঠিক আছে দাদু। আমরা একাত্তর সালের পতাকাই বানানোর চেষ্টা করি।
মা কখন বারান্দায় এসে গেছেন, আমরা টের পাইনি। মায়ের গলা শোনা গেল, তোমরা চেষ্টা করো। আমি হেল্প করব। ম্যাপটা কেটে দেওয়া আর সেটা সেলাই করার কাজটা না হয় আমিই করব।
আমি দাদুর চোখ মুছে দেওয়ার জন্য বারান্দার টেবিলে রাখা টিস্যু বক্স থেকে একটা টিস্যু পেপার বের করলাম। তাঁর চশমাটা সরিয়ে দিয়ে তাঁর চোখের পানি মুছে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম, দাদু, তুমি কাঁদছ কেন!
মা বললেন, দাদুকে কষ্ট দিয়ো না। এই গল্প বলতে তোমার দাদু কষ্ট পান।
দাদু বললেন, না না, বউমা, কষ্ট না। আর ওদের তো আমাকে বলতেই হবে।
দাদু বলতে লাগলেন, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের গল্পটা আগে বলি। আমি তখন পড়ি ক্লাস ফাইভে। আমাদের একজন বড় ভাই ছিলেন। বাদল ভাই। তিনি পড়তেন ক্লাস সেভেনে। আর আমাদের একটা বোন ছিল। লাভলি। সে পড়ত ক্লাস থ্রিতে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পুরো দেশ স্বাধীনতা স্বাধীনতা বলে পাগল হয়ে গিয়েছিল। বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো স্লোগান দিতাম আমরা। একদিন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা আমাদের ছোট্ট থানা শহর রতনপুরে চলে এল। কী সুন্দর পতাকা। সবুজের মধ্যে লাল। তার মধ্যে হলুদ বাংলাদেশের ম্যাপ। আমরা আমাদের আম্মার কাছ থেকে সবুজ শাড়ি চেয়ে নিলাম। হলুদ কাপড় আনতে গেলাম পাশের বাসায়। ওখানে মজিদ স্যারের বোনের কাছে হলুদ কাপড় ছিল। আর লাল কাপড় আমরা পেয়ে গেলাম লেপের দোকানে। ওখান থেকে দরজি চাচার কাছ থেকে আমরা চেয়ে আনলাম লাল কাপড়।
তোমাদের লাভলি দাদি ভালো সেলাই করতে পারত। আম্মাও হেল্প করলেন। আমরা একটা স্বাধীন বাংলার পতাকা বানিয়ে ফেললাম। তারপর একটা বাঁশের ডগায় বেঁধে আমাদের বাড়ির সামনে সেই পতাকা ওড়াতে লাগলাম আমরা। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
পাকিস্তানি সৈন্য এল আমাদের রতনপুরে।
আমাদের বাড়ির বাংলাদেশের পতাকাটা আমরা নামিয়ে ফেললাম। মা সেটা লুকিয়ে রাখলেন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা ভীষণ অত্যাচার শুরু করল। আমাদের বাড়ি থেকে কিছু দূরে ছিল নদী। সেই নদী দিয়ে মানুষের লাশ ভেসে যেতে দেখতাম। মাঝেমধ্যে খবর আসত, আজ মিলিটারি আসবে আমাদের পাড়ায়। রাতের বেলাতেই আমরা বাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করতাম। ১০ মাইল দূরে দুটো নদীর ওই পারে চরে গিয়ে বসে থাকতাম। গোলাগুলির শব্দ আসত। ভীষণ ভয় লাগত।
ডিসেম্বরের ১০ তারিখে মুক্তিযোদ্ধারা চলে এলেন আমাদের রতনপুরে। বাদল ভাই তাঁদের কাছে চলে গেলেন। ক্লাস সেভেনে পড়া বাদল ভাইও নাকি যুদ্ধ করবেন। আমাদের সাজু মামা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের দলে। তিনি বললেন, ঠিক আছে। বাদলকে একটা কঠিন কাজ দেওয়া হবে। সে পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে যাবে একটা চিঠি নিয়ে। তাদের সারেন্ডার করতে বলবে।
খুবই ভয়াবহ ব্যাপার। রেলস্টেশনের কাছে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। তারা কংক্রিট দিয়ে বাংকার বানিয়ে রেখেছে। তাদের পজিশন খুব স্ট্রং। মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে তাদের ঘিরে রেখেছেন।
কিন্তু তাদের তোলা তো আর চাট্টিখানা কথা না। খুবই কঠিন কাজ।
সেই দুপুরটার কথা আজও মনে আছে আমার। আমাদের রান্নাঘরের চালে একটা লাল মোরগ উঠে পড়েছিল। কুক্কুরুকুক বলে ডাকছিল। বাদল ভাই আব্বা-আম্মার পায়ে সালাম করলেন। তারপর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গেলেন রতনপুর হাইস্কুলে। আমিও পেছন পেছন গেলাম।
কমান্ডার চিঠি লিখেছেন। একটা সাইকেল দেওয়া হলো বাদল ভাইকে। সাইকেলের সামনে একটা বড় লাঠি বাঁধা হলো। সেই লাঠির ডগায় বাঁধা হলো একটা সাদা পতাকা। সেই সাইকেল চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের দেওয়া ইংরেজি চিঠি পকেটে নিয়ে বাদল ভাই চললেন ভয়ংকর পাকিস্তানি পোস্টে। রেলস্টেশনের দিকে।
আম্মা–আব্বাও চলে এসেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। তাঁরা কাঁদছেন। মামা রেগে গেলেন, বুবু, তোমার এখানে আসার দরকার কী। যুদ্ধের সময়। কখন কী হয় বলা যায় না।
বাদল ভাইয়ের কাছে পরে শুনেছি, পাকিস্তানি সৈন্যরা সাদা পতাকা দেখে বাদল ভাইকে গুলি করেনি। তবে তার নিয়ে যাওয়া চিঠিটা পড়ে বাদল ভাইকে চড় মেরেছিল।
চিঠিতে ইংরেজিতে লেখা ছিল:
মুক্তিযোদ্ধারা তোমাদের ঘিরে ফেলেছে। সারেন্ডার করো। তা না হলে আমরা আক্রমণ করব। তোমরা সবাই মারা পড়বে। সারেন্ডার করলে তোমাদের জেনেভা কনভেনশন অনুসারে রক্ষা করা হবে। সম্মান দেওয়া হবে।
চড় খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাদল ভাই ফিরে এসেছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ শুরু করলেন।
আমাদের বাড়িতে আমরা ট্রেঞ্চ খুঁড়ে রেখেছিলাম। সবাই সেই গর্তে গিয়ে লুকালাম। কী যে গোলাগুলির শব্দ। ভয়ে আমি ট্রেঞ্চের ভেতরেই পেশাব করে ফেললাম।
বাদল ভাই কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সঙ্গেই রইলেন। তিনি গ্রেনেড ছোড়াও শিখে নিয়েছিলেন।
পাকিস্তানিরা হার মানল। মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে আক্রমণ করে একদিক খুলে রেখেছিলেন। পাকিস্তানিরা সেই দিক দিয়ে পিছিয়ে যেতে শুরু করল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের পজিশন থেকে আক্রমণ বন্ধ হয়ে গেল।
মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা বলতে বলতে তাদের বাংকার, ক্যাম্প, পজিশনগুলোয় চলে গেলেন। স্টেশনের দখল নিয়ে চিৎকার করে স্লোগান দিতে লাগলেন ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’ বলে। আমাদের ছোট্ট শহরের সব মানুষ রাস্তায় নেমে জয় বাংলা স্লোগান দিচ্ছে।
আমি আম্মাকে বললাম, আমাদের পতাকাটা কই লুকিয়ে রেখেছ? দাও।
আম্মা ট্রাংকের নিচ থেকে পতাকাটা দিলেন। সেটা নিয়ে আমি দৌড়ে যেতে লাগলাম স্টেশনের দিকে।
গিয়ে দেখি, বাদল ভাই। তিনি সাজু মামাদের সঙ্গে স্লোগান দিচ্ছেন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে।
আমাদের চোখ গেল স্টেশনের আকাশে। একটা পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে সেখানে।
বাদল ভাই আমার হাতের পতাকাটা নিয়ে সেই পতাকা স্ট্যান্ডের দিকে দৌড় ধরলেন। তারপর বাঁদরের মতো পাইপ বেয়ে পতাকা হাতে উঠে গেলেন ওই খাম্বাটার চূড়ায়। পাকিস্তানি পতাকা খুলে ফেলে দিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে দিলেন সেখানে।
অমনি একটা গুলি এসে লাগল বাদল ভাইয়ের বুকে।
একটা পাকা ফলের মতো বাদল ভাই টুপ করে পড়ে গেলেন ওই স্ট্যান্ড থেকে।
দাদু কাঁদতে লাগলেন।
তারপর বললেন, সেই থেকে বিজয় দিবসে সবাই যখন বাংলাদেশের লাল–সবুজ পতাকা ওড়ায়, আমরা ওড়াই লাল–সবুজ আর হলুদ পতাকাটা।
আমরা বাদল ভাইকে স্মরণ করি।
আমাদের মা যত দিন বেঁচেছিলেন, সারাক্ষণ বাদল ভাইয়ের কথা মনে করতেন। কোনো দিনও তিনি বাদল ভাইকে ভোলেননি।
দাদু কাঁদছেন। ভেজা চোখে ভাঙা গলায় তিনি গেয়ে উঠলেন, ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত, আমরা আনিব রাঙা প্রভাত, আমরা টুটাব তিমির রাত, বাধার বিন্ধ্যাচল...।
দাদু আমাদের জড়িয়ে ধরলেন। আমি তাঁর চোখ মুছে দিচ্ছি। এবার পতাকাটা অনেক বড় বানাব আমরা। অনেক যত্ন করে বানাব। এই পতাকায় আমাদের দাদুর ভাইয়ের মতো অনেকের রক্ত লেগে আছে। এই পতাকা বুকে নিয়েই বড় হয়ে আমরাও একদিন আনব রাঙা প্রভাত।