বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর বাবুলাল ভয়ে ভয়ে গফুর বুড়োর চায়ের দোকানে ঢুকল। বাবুলাল ছোটখাটো মানুষ। ঠান্ডায় কুঁকড়ে সে যখন দোকানে ঢুকল, তখন ঘড়ির কাঁটা ১১টা ছুঁই ছুঁই। বুড়ো অন্যান্য দিন আগেভাগে দোকান গুটিয়ে শুয়ে পড়ে। আজ নিশ্চিতভাবে শোয়নি। দূর থেকে বুড়োর চুলা জ্বলতে দেখেছে বাবুলাল। ওই আগুন আর কেটলির আবছা ধোঁয়া তার চায়ের তেষ্টা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। দুই হাত ঘষতে ঘষতে ভেতরে ঢুকে সে দেখে গফুর বুড়ো দিব্যি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
বুড়োর মাথার কাছে একটা তিন ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও বাজছে। তাতে দেশাত্মবোধক যাত্রা চলছে। মীর জাফর ও রবার্ট ক্লাইভের ষড়যন্ত্রে হতভম্ব সিরাজ উদদৌলা একবুক অভিমান নিয়ে বলছেন, ‘সিংহাসন পেলেও বাংলার মানুষের মন তোমরা কোনো দিন পাবে না।’
বুড়োকে কীভাবে জাগাবে, ভেবে পেল না বাবুলাল। কয়েকবার ডাক দিয়ে দেখল বুড়োর সাড়া নেই। মরেটরে গেল নাকি? না। বুড়োর পেট ওঠানামা করছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ওদিকে চায়ের তৃষ্ণায় বাবুলালের বুক ফেটে যাচ্ছে। চাইলে বুড়োকে ধাক্কা দিয়ে কিংবা পায়ের আঙুল টেনে ওঠানো যায়। কিন্তু বাবুলালদের স্পর্শ মানুষ পছন্দ করে না। স্বাভাবিকভাবে নেয় না। কী মনে করে সে নব ঘুরিয়ে রেডিও বন্ধ করে দিল। বুড়ো অমনি ধড়মড় করে উঠে বসল। কয়েকবার চোখ কচলে বাবুলালকে দেখে বলল, ‘কিরে তুই কখন এলি?’
বাবুলাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘অনেকক্ষণ। তুমি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলে। এদিকে কেটলির পানি ফুটে প্রায় শুকিয়ে গেল। জলদি এক কাপ চা দাও।’
লম্বা হাই তুলে বুড়ো মাত্র কেটলিতে হাত দিয়েছে, এমন সময় দেখা গেল ভ্যান চালিয়ে মফু হাওলাদার আসছে। মফুর বয়স প্রায় পঞ্চাশ। এ বয়সেও বেশ শক্তপোক্ত। সাহসী হিসেবেও তার নামডাক আছে। কারণ, তার যাত্রীরা কেউ স্বাভাবিক মানুষ নয়। শহরের যত খুন, আত্মহত্যা, দুর্ঘটনা ও রোগে ভুগে মরা মানুষ তার ভ্যানের যাত্রী। বিরামপুরের প্রতিটি মানুষ মফুকে কখনো না কখনো লাশ নিয়ে যেতে দেখেছে। ও রকম ঘটনা রাতেই বেশি ঘটে। দিনের বেলায় মফু হাওলাদার পড়ে পড়ে ঘুমায়। কখনোসখনো বাইরে এলেও কেউ তার ভ্যানে উঠতে চায় না। এমনকি ফ্রিতে নিয়ে যেতে চাইলেও না।
বুড়ো চেঁচিয়ে বলল, ‘মফু, এক কাপ চা খেয়ে যা।’
ভ্যান থামিয়ে দোকানে এসে ঢুকল মফু। তার পরনে রেইনকোট। শরীর থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরছে। মাথা ভিজে জবজব করছে। কোমর থেকে একটা গামছা বের করে সে মাথা মুছতে শুরু করল।
বাবুলাল বলল, ‘আজ কিসের ডিউটিতে গিয়েছিলে, মফু ভাই?’
গামছা ঝাড়তে ঝাড়তে মফু বলল, ‘ষষ্ঠীপুরের হাকিম মেম্বারকে চিনিস? ট্রেনে কাটা পড়েছে। তার লাশ সদর হাসপাতালের মর্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। এই জীবনে একটুও শান্তি নাই। ভেবেছিলাম আজ বৃষ্টির দিন একটু আরাম করব। কিন্তু সুযোগ কই? থানা থেকে দারোগা সাহেব তলব করলেন। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়তে হলো।’
বাবুলাল টিপ্পনী কেটে বলল, ‘তোমার বাড়িতে আবার আরাম! আমাকে ১০ হাজার টাকা দিলেও ওই বাড়িতে এক রাত থাকতে পারব না। তুমি কীভাবে থাকো ভেবে আমার অবাক লাগে।’
মফু জবাব না দিয়ে বুড়োর কাছ থেকে চায়ের কাপ নিল। বিরামপুরে ব্রিটিশদের বানানো একটা পরিত্যক্ত জেলখানা আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বন্ধ। থানার সঙ্গে বন্দোবস্ত করে সে ওখানকার একটা ঘরে থাকে। মফুর পরিবার বলে কিছু নেই। বিয়েশাদি করেনি। ১২ বছর বয়সে দক্ষিণাঞ্চলের একটা জেলা থেকে পালিয়ে সে বিরামপুরে চলে আসে। তারপর থেকে এখানেই আছে। এত বছরে বিরামপুরের একজন হয়ে গেছে। শুধু কথা থেকে জন্মস্থানের টান একেবারে মিলিয়ে যায়নি।
বাবুলাল বলল, ‘আচ্ছা মফু ভাই, এই যে তুমি লাশ নিয়ে রাতবিরেতে চলাফেরা করো, তোমার ভয় করে না?’
চায়ের কাপে সুড়ুৎ করে একটা চুমুক দিয়ে মফু বলল, ‘না, করে না। ভ্যান চালানোর সময় দুনিয়া উল্টে গেলেও আমি পেছনে তাকাই না। চোখে না দেখলে ভয় পাব কীভাবে? ভয় পাওয়ার সুযোগই পাই না।’
বাবুলাল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। গফুর বুড়ো তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘কাপ এনেছিস? তোকে চা দিই কীভাবে বল তো?’
বাবুলাল জাতে বাঁশফোড়। তথাকথিত অচ্ছুত জাতির মানুষ। মহাত্মা গান্ধী আদর করে হরিজন নাম দিলেও মানুষের মধ্যে তারা এখনো স্বীকৃত হতে পারেনি। মানুষের সমাজে তাদের স্থান নেই। দোকানে বসে চা খাওয়ার অধিকার নেই। খেতে চাইলে বাড়ি থেকে চায়ের কাপ বয়ে আনতে হয়।
মফু হাত নেড়ে বলল, ‘আরে এত রাতে কে দেখবে? আমি লাশ টানি, আমাকে চা দিতে পারলে ওকে দিতে পারবে না কেন? দাও দাও, এই কাপে চা দাও।’
সে তাড়াতাড়ি চা–টুকু শেষ করে গফুরকে কাপ এগিয়ে দিল। বাবুলালের মুখ কৃতজ্ঞ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলল, ‘মফু ভাই, সত্যি করে বলো তো তুমি কোনো দিন ভূত দেখো নাই? এই যে এত বছর ধরে ভ্যান চালাচ্ছ, তোমার মন একবারও দুর্বল হয় নাই?’
মফু মুখ শুকনো করে বসে রইল। বাবুলাল তাড়াতাড়ি এক প্যাকেট বিড়ি বের করে মফুর দিকে এগিয়ে দিল। মফুর মুখ প্রসন্ন হলো। সে বলল, ‘ভূত কি না, জানি না। তবে ভয় একবার পেয়েছিলাম। শুনবি?’
বাবুলাল খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল। গফুর বুড়ো রেডিও বন্ধ করে দিল। নিশুতি রাতের নির্জন পরিবেশে মফু বলতে শুরু করল, ‘আমার বয়স তখন পঁচিশ। ভ্যানে লাশ টানা শুরু করেছি বেশি দিন হয়নি। তখন ছিল পৌষ মাস। শীতও পড়েছিল সেবার! বিরামপুরের পৌষ মাস তো জানো, সন্ধ্যার পর বাইরে থাকা যায় না। আমিও ঘরের ভেতর কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলাম। চোখ লেগে এসেছে কি আসে নাই, এমন সময় থানা থেকে পুলিশ এসে হাজির। ওসি সাহেবের জরুরি তলব। লাশ নিয়ে এক্ষুনি সদর হাসপাতালে যেতে হবে। থানার ওসি তখন তপন বাগচী। খুব রাগী মানুষ। আমি তাড়াতাড়ি উঠে থানায় গেলাম। গিয়ে দেখি থানার বারান্দায় শাড়ি দিয়ে ঢাকা একটা লাশ পড়ে আছে। ওসি সাহেব বললেন, একটা মোবাইল পার্টি রাস্তার পাশে লাশটাকে পড়ে থাকতে দেখে তুলে এনেছে। একজন মহিলার লাশ। গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। এক্ষুনি সদর হাসপাতালে পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যেতে হবে। ওসি সাহেবের কথা শুনে আমি বাইরে তাকালাম। গাঢ় কুয়াশায় চারপাশ ঢেকে গেছে। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার রাত। এ অবস্থায় কীভাবে ৩০ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে যাব? ভাবলাম বটে, ওসি সাহেবকে বলার সাহস পেলাম না। আল্লাহর নাম নিয়ে ভ্যানে চড়ে বসলাম।
বাজার পার হতেই রাস্তার আলো ফুরিয়ে গেল। অনেকটা হাতড়ে বড় রাস্তায় উঠে এলাম। আমার কাছে একটা তিন ব্যাটারির টর্চ ছিল। সেটাই মাঝেমধ্যে জ্বালাচ্ছিলাম। প্রথম পাঁচ কিলোমিটার খুব স্বাভাবিকভাবে গেলাম। তারপর শুরু হলো তারাপুরের শালবন। এই শালবন নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে। এই রাস্তায় চলার পথে নাকি অনেকে অনেক কিছু দেখেছে। বনের মধ্যে একটা পরিত্যক্ত কালীমন্দিরে নাকি ডাকাতেরা মানুষ জবাই করত। আমি এই পথে অনেকবার গিয়েছি। কিন্তু কখনো ভয়ের কিছু দেখিনি। আজ কেমন যেন গা-টা ছমছম করতে শুরু করল।
‘আমি ভ্যান চালাতে শুরু করার পর থেকে একটা শপথ নিয়েছিলাম, যা–ই ঘটুক কখনো পেছনে তাকাব না। আল্লাহর রহমতে কখনো পেছনে দেখতে হয়নি। আজ কেন যেন বারবার পেছনে তাকাতে ইচ্ছা করছিল। কুয়াশাঢাকা রাস্তায় দ্বিতীয় কোনো জনপ্রাণী নেই। রাস্তার দুপাশের বড় বড় শালগাছের পাতায় কেমন যেন খসখস শব্দ হচ্ছে। বনের ভেতর থেকে অজানা পাখির ডাক ভেসে আসছে। আমার গায়ের লোম দাঁড়াতে শুরু করল। খেয়াল করলাম, পেছনে কিছু একটা নড়াচড়া করতে শুরু করেছে। খাটের মধ্যে কোনো জীবিত মানুষ যেমন এপাশ-ওপাশ করে সে রকম। আমি আয়াতুল কুরসি পড়তে পড়তে জোরে ভ্যান চালাতে শুরু করলাম। কুয়াশা ভেদ করে শাঁই শাঁই করে এগোতে শুরু করলাম। যত দ্রুত যাই না কেন, পথ শেষ হয় না। নেয়ামতপুর বাজারে গেলে হয়তো আলোর দেখা পাব। সে জায়গাও এখান থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে।
‘এমন সময় ভ্যানটা হঠাৎ দুলে উঠল। মনে হলো কেউ যেন লাফ দিয়ে ভ্যানে চড়ে বসেছে। অথবা ভ্যানের লাশটা শোয়া থেকে উঠে বসেছে। শীতের রাতেও আমার ঘাম ছুটে গেল। পেছনে ফিরে দেখার জন্য মনের মধ্যে ঝড় বইতে শুরু করল। মনকে বোঝালাম, এসব মনের ভুল। এটা মনে রাখলে আমার বিপদ হবে না। পেছনে দেখলেই আমি ভয় পাব। তাতে আমার বিপদ হতে পারে।
‘আমি যন্ত্রের মতো পেডেল চালাতে শুরু করলাম। বাইরের কুয়াশা যেন আমার মাথার ভেতর ঢুকেছে। চিন্তাভাবনা করতে পারছি না। বোধবুদ্ধি হারিয়ে কলুর বলদের মতো ভ্যান চালাতে লাগলাম। এমন সময় একটা ঠান্ডা বাতাস আমার ঘাড়ের ওপর পড়ল। পৌষের শীতের চাইতেও ওই বাতাস শতগুণে ঠান্ডা। আমার মেরুদণ্ড প্রায় অসাড় হয়ে গেল। ফিসফিস করে কেউ কানের কাছে বলল, “মফু, বাবা মফু, আব্বাজান?”
‘আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। এ যে আমার মায়ের গলা। মা আমাকে ডাকছে। কিন্তু তা কী করে হয়? মা তো মারা গেছে আজ ১৭ বছর আগে। আমার চোখের সামনে চুলার আগুনে পুড়ে মা মারা গেছে।
‘আমার চোখ ফেটে কান্না এল। ঝরঝর করে গাল বেয়ে পড়তে শুরু করল। আজ একি বিপদে পড়লাম। পেছনে তাকানোর জন্য আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু পেছনে তাকাতে পারছি না। মন বলছে, যা হওয়ার হোক, পেছনে তাকাই। বুদ্ধি-বিবেচনা বলছে, তাকিয়েছিস কি মরেছিস। ওটা তোর মা নয়। মা সেই কবে মারা গেছে। মায়ের মৃত্যুর পর তোর জীবন পাল্টে গেছে। সৎমায়ের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য তোকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। মা বেঁচে থাকলে তোকে বাড়ি ছাড়তে হতো না।
‘কণ্ঠটা আবার বলে উঠল, “আব্বা, আমার লগে রাগ করছত? তোরে ছাইড়া গেছি বইলা রাগ করছত? এই দিকে ফির, আমার দিকে চা। দেখ তোরে হারাইয়া আমার কত কষ্ট হইছে। মায়ের মন বাবা, পুতের লাইগা হারা দিন কান্দে। কিরে মায়েরে দেখবি না?”
‘কান্নায় আমার দাঁতে দাঁতে বাড়ি দিতে শুরু করছে। আমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললাম, “তুমি আমার মা না। আমার মা মইরা গেছে আইজ ১৭ বৎসর। তুমি আমার মায়ের ভেক ধইরা আইছ আমারে ভয় দেখাইতে। আল্লাহর কসম লাগে চইলা যাও। চইলা যাও।”
‘কণ্ঠটা বলল, “পাগল পোলার কাণ্ড দেখ! আরে আমি ফিরত আইছি। আমি তোর মা মতিজান। আয় বাবা আমার দিকে ফির। আয় মার কোলে আয়। আয় কইতাছি, আয়।”
‘এমন সময় আমার কাঁধে একটা হাত পড়ল। শিউরে উঠে বললাম, “আমারে ছুঁইবা না খবরদার! দূরে যাও। শুইয়া যাও। তুমি মইরা গেছ। আল্লাহর মেহমান হইছ। আল্লাহর ওয়াস্তে চইলা যাও।”
‘মহিলা কণ্ঠটি হা হা করে হাসতে শুরু করল। কী ভীষণ সেই হাসি। আমার কলিজায় গিয়ে ধাক্কা দিল। চমকে উঠে আমি পেছনে তাকালাম। দেখি ভ্যানের সামনে দুই পা ঝুলিয়ে বসে আছে আমার মা মতিজান। ১৭ বছরে আগে যে পুড়ে মারা গেছে। শরীরে দগ দগ করছে পোড়া দাগ। বীভৎস সেই দৃশ্য। আমি চিৎকার করে জ্ঞান হারালাম।
‘পরের দিন ভোরে একদল কাঠুরে আমাকে রাস্তার পাশে খুঁজে পায়। ভ্যানটা রাস্তার পাশে পড়ে ছিল। একটা পুরোনো শালগাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে বসে ছিল লাশটা। আমি তার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিলাম। লাশটার হাত ছিল আমার কপালে। যেন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।’
মফু হাওলাদার চুপ করল। গফুর বুড়ো বলল, ‘বাপ রে বাপ, এই গল্প শোনার পর এখন কীভাবে একা বাড়ি যাই বল তো?’
মফু হেসে বলল, ‘একা যাইতে কে বলেছে? আমার ভ্যান আছে না! তোমাকে আর বাবুলালকে আমি রেখে আসছি চলো।’
দোকান বন্ধ করে ফেরার পথে ওরা অনেক গল্প করল। মফুর মায়ের কথা, ওর দেশের কথা, চুলায় পুড়ে মরার কথা বারবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনল বাবুলাল। কী সব যেন ভাবল।
সে বছর শীতকালে খুব শীত পড়ল। পৌষের এক রাতে সেই কারাগারের ঘরে মফু ঘুমিয়েছিল। গভীর রাতে বাবুলাল এসে দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করল, ‘মফু ভাই, ও মফু ভাই, ওঠো। শিগগির ওঠো।’
মফু দরজা খুলে বলল, ‘কিরে বাবুলাল, তোর কী হয়েছে?’
বাবুলাল বলল, ‘সর্বনাশ হয়েছে। আমার বোন দুর্গার ডেলিভারি হবে, ব্যথা উঠেছে। এখনই হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু কোনো অ্যাম্বুলেন্স পাচ্ছি না। তুমি একটু সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারবে?’
মফু চিন্তিত গলায় বলল, ‘তোর বোনের বাচ্চা হবে? বলিসনি তো।’
বাবুলাল ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘সেসব পরে হবে। তুমি তাড়াতাড়ি ভ্যান বের করো।’
মফু তাড়াতাড়ি ভ্যান বের করল। ভ্যানে উঠে বসল বাবুলাল। দুর্গাকে নেওয়া হলো একটা তোশকের ওপর। সে ব্যথায় কাতরাচ্ছে।
মফু জোরে জোরে পেডেল মারতে শুরু করল। পেছন থেকে বাবুলাল তাড়া দিতে শুরু করল, ‘আরও জোরে চালাও, মফু ভাই, আরও জোরে।’
মফুর বয়স হয়েছে। আগের মতো জোরে ভ্যান চালাতে পারে না। তা ছাড়া তার মড়া বয়ে অভ্যাস। মড়া কখনো তাড়া দেয় না। যত ব্যস্ততা জীবিত মানুষের।
ভ্যান চলতে চলতে তারাপুরের শালবনের ভেতরে গিয়ে ঢুকল। আজও বেশ কুয়াশা পড়েছে। ২৫ বছর পরেও রাস্তাটা ভীষণ ফাঁকা। কালেভদ্রে এক-দুটো ট্রাক হেলেদুলে যাচ্ছে। তারপর অখণ্ড নীরবতা নেমে আসছে। মফু সর্বশক্তি দিয়ে ভ্যান চালাচ্ছে আর দুর্গা প্রসববেদনায় ছটফট করছে।
কিছু দূর যাওয়ার পর মফু লক্ষ করল, দুর্গা কোনো শব্দ করছে না। তার ভয় ভয় করতে লাগল। মেয়েটার অসুখ বাড়ল কি? সে ডাক দিল, ‘বাবুলাল, দুর্গা ঠিক আছে তো?’
কেউ জবাব দিল না।
মফুর ভয় ভয় করতে লাগল। সে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘বাবুলাল, দুর্গা সুস্থ আছে?’
কোনো জবাব নেই।
৩০ বছরের প্রতিজ্ঞা ভেঙে সে পেছন ফিরে তাকাল। বলতে গেল, ‘বাবুলাল!’ কিন্তু বাবুলাল কোথায়? ভ্যানের সামনের দিকে পা ঝুলিয়ে বসে আছে মতিজান বিবি, তার মা। সারা শরীরে দগদগে পোড়া ক্ষত। খোলা চুল উড়ছে এলোমেলো। মফুর দিকে তাকিয়ে হাসছে। মায়ের স্নেহ যেন তাতে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে।
মফু একটা গোঙানি দিয়ে সিট থেকে পড়ে গেল। তার মাথা বাড়ি খেল রাস্তার পিচে। ফট করে একটা শব্দ হলো।
মিনিট পনেরো পর বাবুলাল হাসতে হাসতে এসে হাজির হলো। উল্লসিত হয়ে বলল, ‘দুর্গা, আরে ও দুর্গা। দারুণ অ্যাক্টিং করেছিস তুই। মফু ভাই যা ভয় পেয়েছে। হা হা হা।’
দুর্গা মফুকে কোলে নিয়ে বসে ছিল। মাথায় হাত বোলাচ্ছিল। বাবুলাল ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘আর অ্যাক্টিং করতে হবে না। এবার থাম। ওকে জাগিয়ে তোল। বিরামপুরে ফিরতে হবে।’
দুর্গা প্রথমে জবাব দিল না। খানিক বাদে হিস হিস করে বলল, ‘দুর্গা কেডা? আমি মতিজান। আমার ছাওয়ালরে তুই মাইরা ফালাইছস। আহা রে আমার আদরের ছাওয়াল রে! হায় আল্লাহ, আমার মফু!’
বাবুলাল ভীত গলায় বলল, ‘এসব কী বলছিস! দুর্গা, ওকে রেখে দে এখানে। চল আমরা বাড়ি ফিরি।’
দুর্গারূপী মতিজান আলগোছে মফুর মাথাটা ঘাসের ওপর রেখে উঠে দাঁড়াল। তার দুই চোখ জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো জ্বলছে। প্রায় ১০ ফুট দূর থেকে সে বাবুলালের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। যেন দূর থেকে গলা চেপে ধরবে। আতঙ্কে অবশ হয়ে রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল বাবুলাল।
মফু হাওলাদারের মতো তার মাথাও ফাটল ফট করে।