পান্না-রহস্য (চতুর্থ পর্ব)
কাহিনি রচনা: কাজী শাহনূর হোসেন | তিন গোয়েন্দায় রূপান্তর: শামসুদ্দীন নওয়াব
পাঁচ
সিঁড়িতে ভারী পদশব্দ তুলে অফিসে প্রবেশ করল দুজন পুলিশ অফিসার। পুরো কাহিনি সবিস্তার শুনে হিরু চাচাকে ‘আমন্ত্রণ’ জানাল থানায় গিয়ে কিছু প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য।
‘মি. পাশা, মি. জেমস আর জাঁ পিয়েরেকেও আমাদের সঙ্গে যেতে বলুন,’ এক অফিসার বলল।
‘বলব, তবে বিশ্বাস করুন, এটা বিশ্রী একটা মিসটেক ছাড়া আর কিছু না,’ বলল হিরু চাচা।
অফিসার মাথা ঝাঁকিয়ে মূর্তিটার দিকে আঙুল দেখাল।
‘এটাকেও নিয়ে যাব আমরা। ফিঙ্গারপ্রিন্টের জন্য পরীক্ষা করতে হবে।’
‘আমি আর ড. ক্রুক কি ফিরে যেতে পারি?’ প্রশ্ন করলেন সেলিনা।
‘আপনাদের ঠিকানা আমাদের কাছে আছে। কোথায় পাব জানি,’ অফিসার বলল।
‘নিশ্চয়ই,’ বললেন ড. ক্রুক। তিনি আর সেলিনা হায়েক বিদায় নিলেন।
কিশোরের কাছে হেঁটে এল হিরু চাচা।
‘ঘাবড়াস না, বেশিক্ষণ লাগবে না। আমি যতক্ষণ না ফিরি, মিশেলের সঙ্গে থাকিস।’
কিশোরকে জড়িয়ে ধরার জন্য ঝুঁকে কানে কানে বলল, ‘কিশোর, তোর কুকিটার কথা মনে রাখিস!’
জেমস ব্রাউন অফিসে তালা দিল, তারপর সবাই মিলে সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেল, দুই অফিসার মোড়ানো জাগুয়ারটা বইছে।
কাঁপা হাতে অফিসের তালা খুলল কিশোর। মাছের ট্যাংকের বাতিটা ছাড়া ঘরে আলো নেই। শব্দ বলতে শুধু ট্যাংকটার বুদ্বুদ-ছাড়া ফিল্টার।
জাঁ পিয়েরে মিশেলকে জড়িয়ে ধরে পুলিশের একটা গাড়িতে উঠলেন।
বৃষ্টির মধ্যে রওনা দিল গাড়ি।
‘রেস্টুরেন্টের ভেতরে এসো,’ বললেন মিশেল। ‘গা গরম করা দরকার। ওরা শিগগিরই ফিরে আসবে।’
বড় মগে হট চকলেট ঢাললেন ছেলেদের জন্য। জানালার কাছে বসে বৃষ্টি দেখতে লাগল ওরা।
‘চিন্তা কোরো না। ওরা ফিরে এলেই রহস্যটার সমাধান করে ফেলব আমরা,’ বললেন মিশেল।
নীল পর্দা পেরিয়ে রেস্তোরাঁর রান্নাঘরে চলে গেলেন তিনি।
‘কী বিশ্রী ব্যাপার!’ বলল কিশোর।
‘হিরু চাচা অমন কাজ করতে পারে না,’ জোর গলায় বলল মুসা।
‘কিন্তু জিনিসটা গেল কোথায়? কেউ না কেউ তো আসল পান্নাটা চুরি করেছেই!’ বলল রবিন।
ছেলেরা হট চকলেট পান করছে। বৃষ্টিভেজা জানালা ভেদ করে দৃষ্টি বাইরে প্রসারিত।
উঠে দাঁড়াল কিশোর।
‘বাথরুমে যাব,’ বলল।
‘মিশেলকে জিজ্ঞেস করো। উনি রান্নাঘরে,’ বলল রবিন।
মুসা ওর ড্রিঙ্কের তলানিটুকু চোঁ চোঁ করে টান দিল।
‘ওনার কাছে আরও হট চকলেট আছে কি না সেটাও দেখো!’ বলল ও।
রেস্তোরাঁর পেছন দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল কিশোর। নীল পর্দা ঠেলে প্রবেশ করল রান্নাঘরে।
কাউন্টারে একবাটি কাঁচা পেঁয়াজের পাশে ব্রকলির কাটা টুকরো। চারধারে নজর বুলিয়েও মিশেলকে দেখতে পেল না ও।
আরেকটা নীল পর্দা দেখে বাথরুম মনে করে উঁকি দিল। ঠিক এমন সময় একটা শব্দ কানে এল। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে, মিশেল সরু একটা দরজা দিয়ে ঢুকে গেলেন। দরজাটা ওনার পেছনে লেগে যেতেই অদৃশ্য হয়ে গেল!
চোখ পিটপিট করল কিশোর। দরজাটা চোখের সামনে হাওয়া! কোনো কাঠামো, নব কিংবা কবজা নেই। মাথা নাড়ল ও। কী দেখছে এসব আবোলতাবোল?
বাথরুম খুঁজে পেয়ে কাজ সেরে বন্ধুদের কাছে তড়িঘড়ি ফিরে এল।
সব কথা খুলে বলল ওদের।
‘অদৃশ্য দরজা!’ বলে উঠল মুসা। কণ্ঠে অবিশ্বাস।
‘ওটা হয়তো ওনার প্রাইভেট বাথরুম কিংবা অন্য কিছু,’ বলল রবিন।
হঠাৎই কিশোরের মনে পড়ল হিরু চাচা ওকে কী বলেছিল। ‘তোর কুকিটার কথা মনে রাখিস।’
‘হয়তো কুকিটার ভবিষ্যদ্বাণী মনে করতে বলেছিল,’ শুনে বলল রবিন।
‘আমি রেখে দিয়েছি ওটা,’ বলে জ্যাকেটের পকেটে হাত ভরে দিল কিশোর। ‘আরে, এটা কী?’ চাচার চাবির গোছা বেরিয়ে এল। ‘এটা এল কোত্থেকে?’
‘এটা তো মনে হচ্ছে হিরু চাচার অফিসের চাবির গোছা,’ বলল মুসা।
‘ঠিক বলেছ। খুব সম্ভব আমাকে জড়িয়ে ধরার সময় পকেটে ফেলে দিয়েছে,’ বলল গোয়েন্দাপ্রধান।
পকেটে আবার হাত ভরে ফরচুন কুকির কাগজটা বের করল।
‘তোমার চোখ তোমাকে ধোঁকা দেবে,’ পড়ল।
‘তোমার ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যাচ্ছে!’ বলল রবিন। ‘আমারটা ফলবে কি না ভাবছি। আমার গুপ্তধন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
‘দেখো!’ হঠাৎ বলে উঠল মুসা। জানালা দিয়ে আঙুল তাক করল। ‘সেই অলংকারবিশেষজ্ঞ মহিলা!’
রেস্তোরাঁর পাশ দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন সেলিনা হায়েক। ছেলেরা তাঁকে সবুজ দরজা দিয়ে সন্তর্পণে ঢুকতে দেখল। হিরু চাচার অফিসে যাওয়া যায় ওটা দিয়ে।
‘উনি ওখানে আবার যাচ্ছেন কেন?’ কিশোরের প্রশ্ন।
এ সময় মিশেল বেরিয়ে এলেন নীল পর্দা ভেদ করে। হাতে পিচার আর একপ্লেট কুকি।
‘আরও হট চকলেট আর আমার স্পেশাল ক্রানবেরি কুকিস!’
মুসা আর রবিন কুকির দিকে হাত বাড়িয়েছে, কিশোর জানালা দিয়ে সবুজ দরজাটার দিকে তাকিয়ে রইল।
হঠাৎ দরজা খুলে গেল, আর বাইরে পা রাখলেন সেলিনা হায়েক। দরজাটা পেছনে লাগিয়ে হনহন করে পা চালালেন।
কিশোর তাঁকে ছাতা মাথায় চলে যেতে দেখল।
মহিলার পিঠের দিকে তাকিয়ে রইল ও। ব্যাপারটা কী? ভাবল। হিরু চাচা নেই জেনেও অফিসে গেল কেন?
এবার আচমকা আরেকটা চিন্তা ঘাই মারল ওর মাথায়। হয়তো চাচা নেই বলেই গেছে!
ছয়
মিশেল রান্নাঘরে না ফেরা অবধি অপেক্ষা করল কিশোর। তারপর বন্ধুদেরকে বলল, কী দেখেছে।
‘কিন্তু অফিস তো বন্ধ,’ বলল মুসা।
‘ওনার কাছে হয়তো চাবি আছে,’ বলল কিশোর।
‘চাবি পাবেন কোথায়?’ প্রশ্ন করল মুসা। ‘তোমার কাছে একটা, আরেকটা জেমস ব্রাউনের কাছে।’
‘প্রশ্ন হচ্ছে, কেউ যখন নেই, তখন উনি ওখানে গেলেন কেন?’ বলল রবিন।
উঠে দাঁড়াল কিশোর।
‘আমাদের জানা দরকার। উনি হয়তো কোনো ক্লু রেখে গেছেন। মিশেল ফেরার আগেই যাই চলো।’
বৃষ্টির মধ্যে তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়ল ছেলেরা। পাশের বাড়িতে গিয়ে সবুজ দরজাটা দিয়ে ঢুকে পড়ল।
‘দেখো,’ বলে কার্পেটের দিকে আঙুল তাক করল কিশোর। ‘ভেজা পায়ের ছাপ!’
সিঁড়ি ভেঙে তরতর করে উঠে গেল ওরা। সিঁড়ির মাথায় আরও কিছু ভেজা চিহ্ন।
কাঁপা হাতে অফিসের তালা খুলল কিশোর। মাছের ট্যাংকের বাতিটা ছাড়া ঘরে আলো নেই। শব্দ বলতে শুধু ট্যাংকটার বুদ্বুদ-ছাড়া ফিল্টার।
‘খাইছে, জায়গাটা ভুতুড়ে,’ ফিসফিস করে বলল মুসা।
মেঝে পরখ করল কিশোর।
‘এখানে ভেজা পায়ের ছাপ নেই,’ নিচু আওয়াজে বলল।
‘সেলিনা হয়তো এখানে ঢোকার আগে পা মুছেছিলেন,’ পাল্টা ফিসফিসাল রবিন।
‘হয়তো, কিন্তু আমরা ফিসফিস করছি কেন?’ বলে দেয়ালের সুইচগুলো অন করে দিল মুসা। জ্বলে উঠল বাতি, চালু হলো ফ্যান, শুরু হলো বাজনা।
চোখ পিটপিট করল কিশোর।
‘ঠিক আছে, চারপাশটা একটু দেখা যাক।’
‘কী জন্য?’ মুসা বলল।
‘জানি না, তবে সেলিনা হায়েক এখানে কোনো উদ্দেশ্যে এসেছিলেন। হয় কিছু একটা নিয়ে গেছেন, নয়তো ফেলে গেছেন,’ বলল কিশোর।
‘আমি বাক্সটা দেখছি। কিশোর, তুমি জেমসের অফিসটা পরীক্ষা করে দেখো। মুসা, তুমি ট্র্যাশ ক্যান,’ বলল রবিন।
‘খাইছে, আমাকে কেন ট্র্যাশ ক্যান হাতড়াতে হবে?’ বলল মুসা।
‘কারণ, তুমি একজন ভালো গোয়েন্দা এবং ভালো গোয়েন্দারা সব সময় ট্র্যাশ ক্যান চেক করে,’ বলল রবিন।
‘ঠিক হ্যায়,’ বলে ডেস্কের পাশে ট্র্যাশ ক্যানের দিকে এগোল মুসা।
কিশোর প্রবেশ করল মি. ব্রাউনের অফিসে।
ছোট একটা ডেস্ক। ড্রয়ারগুলো বন্ধ। ডেস্কে তিনজনের একটা ছবি।
জেমস ব্রাউন এবং নিশ্চয়ই তার স্ত্রী ও মেয়ে, ভাবল কিশোর।
এক কোনায় একটা ফাইল ক্যাবিনেট। বন্ধ। বুকশেলফে আঙুল চালাল কিশোর। কয়েকটা বইয়ের ভেতর খুঁজল, কী খুঁজছে নিজেও জানে না। এমনকি কার্পেটের তলায়ও উঁকি দিল। কিছু খোয়া গেছে কি না বলতে পারবে না ও, কোনো সূত্র খুঁজে পেল না।
বেরিয়ে যাবে, হঠাৎই চোখে পড়ল একটা দেয়াল অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা। কেন বিসদৃশ লাগছে বোঝার জন্য তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে।
এবার উপলব্ধি করল কী ওটা: এই দেয়ালে কোনো বুকশেলফ, ফাইল ক্যাবিনেট, ছবি কিংবা কিছুই নেই! সম্পূর্ণ ফাঁকা।
কাছে গিয়ে ছেঁড়া ওয়ালপেপারে আঙুল বোলাল ও। মাথার ঠিক ওপরে সূক্ষ্ম একটা ফাটল অনুভব করল। ফাটলটাকে অনুসরণ করে আরেকটা ফাটল আবিষ্কার করল ও, এটা নেমে গেছে মেঝের দিকে। উল্টো দিকে দুই ফুট দূরে তৃতীয় আরেকটা ফাটল নেমে গেছে মেঝেতে। ফাটলগুলো ওয়ালপেপারে ঢাকা পড়েছে প্রায়।
হাতে আগুনের ছেঁকা খেয়ে যেন পিছিয়ে এল কিশোর।
‘শুনে যাও!’ চেঁচাল।
জেমসের অফিসে দৌড়ে এল রবিন আর মুসা।
আবিষ্কারটা বন্ধুদের দেখাল কিশোর।
‘মনে হচ্ছে, এটা গোপন দরজা,’ বলল।
ফাটলে জোর করে আঙুল ঢোকানোর চেষ্টা করল ও, কিন্তু দরজা একচুল নড়ল না।
‘এই দেয়ালের পেছনে যদি সিঁড়ি থাকে, তাহলে সেটা সোজা মিশেলের রান্নাঘরের গোপন দরজার সঙ্গে মিশবে!’ বলল রবিন।
মুসার চোখ বিস্ফারিত।
‘খাইছে, তার মানে উনি এখানে চাবি ছাড়াই আসতে পারেন!’
‘আমি যখন ওনাকে নিচে দেখি, তখন কি উনি এখানেই আসছিলেন?’ কিশোরের প্রশ্ন।
‘হয়তো সেলিনা হায়েকের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁর। তাঁকে ভেতরে ঢুকতে দিয়েছেন।’
‘হতে পারে,’ বলে চাচার অফিসে ফিরে এল কিশোর। ‘কিন্তু কেন?’ আমাদের নজর রাখতে হবে। ট্র্যাশে কিছু পেলে, মুসা?’
‘না,’ বলল মুসা।
মেঝেতে রবিন যেখানে বসে ছিল, সেখানে প্যাকিং পিনাটের স্তূপ। প্রতিটা আর্টিফ্যাক্ট খুলে এক পাশে সরিয়ে রেখেছে।
‘কাল যা দেখেছি তা–ই। কিছু খোয়া গেছে বলে মনে হচ্ছে না,’ বলল ও।
ছেলেরা তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে। পর্দার পেছনে, ইরানি গালিচার নিচে। ডেস্ক–ড্রয়ার থেকে সবকিছু টেনে টেনে বের করেছে। এমনকি জানালার পাশে রাখা ফুলের টবগুলোর কাদাও ঘেঁটেছে।
‘খোলে না এমন একটা গোপন দরজা ছাড়া কিছুই পেলাম না,’ আওড়াল মুসা।
‘আর মিশেল যেহেতু রান্নাঘরে আছেন, নিচের দরজাটাও আমরা পরীক্ষা করতে পারছি না,’ বলল রবিন।
‘তো এখন কী করা?’ মুসার প্রশ্ন।
‘জানি না।’ বন্ধুদের দিকে তাকাল কিশোর। ‘কিন্তু হিরু চাচা আমাদের ওপর ভরসা করছে। তার আশা, আমরা এখানে এমন কিছু খুঁজে পাব যাতে প্রমাণিত হবে যে সে দোষী নয়।’