মনের অসুখ (চতুর্থ পর্ব)

চার

পাঁচ মিনিট পর মিসেস মার্সডেন আর লিজাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল অয়ন। পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়েছে, যাতে সামনে থেকে কেউ নজর রাখলেও দেখতে না পায়।

‘তাড়াতাড়ি পা চালান,’ তাড়া দিল ও। ‘দেরি করলে হাতেনাতে ধরা যাবে না লোকটাকে।’

‘কী বলছ, বুঝতে পারছি না,’ বিভ্রান্ত গলায় বললেন মিসেস মার্সডেন। ‘কাকে ধরতে চাইছ?’

‘একটু পরই দেখতে পাবেন তাকে।’

‘জিমি কোথায়?’

‘চলে আসবে, চিন্তা করবেন না। জলদি হাঁটুন।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির সামনের কটেজটির কাছে পৌঁছে গেল তিনজন। কটেজের দরজা আগের মতোই তালা দেওয়া। লিজার দিকে তাকাল অয়ন। ‘চাবিটা?’

সকালেই কটেজের স্পেয়ার চাবিটা লিজাকে খুঁজে বের করে রাখতে বলেছিল ও। পকেট হাতড়ে সেটা বের করে দিল লিজা।

দরজার গায়ে লাগানো কি-হোলের ফুটোয় চাবিটা ঢোকাল অয়ন, মোচড় দিয়ে খুলে ফেলল তালা। তারপর সাবধানে পাল্লা ঠেলে ঢুকে পড়ল ভেতরে। ইতিমধ্যে ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে নিয়েছে।

একটু দোনোমনা করল মাইকেল, তারপর পায়ে–পায়ে উঠে এল মই বেয়ে। ওপরে উঠেই মুখোমুখি হলো মিসেস মার্সডেন আর লিজার। কামরার বাতি জ্বেলে দিল অয়ন।

দুটিমাত্র কামরা কটেজটায়। সামনের কামরা একদম ফাঁকা। পা টিপে টিপে দ্বিতীয় কামরাটাও চেক করল ও। একটা ডাবল খাট দেখা গেল সেখানে, বিছানার চাদর এলোমেলো। কেউ থাকে এখানে! কিন্তু কোথায় সেই বাসিন্দা? কামরার পাশের ছোট্ট বাথরুমেও কাউকে পাওয়া গেল না।

ঠোঁট কামড়াল অয়ন। ভুল করল না তো? কিন্তু তা তো হওয়ার কথা নয়। সামনের কামরায় ফিরে এল ও। সেখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন মিসেস মার্সডেন আর লিজা।

‘কী হলো?’ ফিসফিসিয়ে জানতে চাইল লিজা।

আরও পড়ুন

জবাব না দিয়ে ফ্ল্যাশলাইট নিভিয়ে দিল অয়ন। চোখা নজর বুলিয়ে তাকাল চারদিকে। অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসতেই দেখতে পেল সূক্ষ্ম আলোর রেখা...মেঝের এক জায়গায় ফ্লোরবোর্ড ভেদ করে বেরিয়ে আসছে। মুখে হাসি ফুটল ওর। আবার ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে গেল ওদিকে। নিচু হয়ে পরখ করল মেঝেটা।

বর্গাকার একটা হ্যাচ দেখতে পেল ও, গায়ে একটা আংটাও লাগানো আছে। মেঝের সঙ্গে মিশে আছে জিনিসটা, তাই হঠাৎ তাকালে চোখে পড়ে না। ফ্ল্যাশলাইটটা আবার নিভিয়ে দিল, নামিয়ে রাখল পাশে। এরপর সাবধানে আংটা ধরে একটু উঁচু করল হ্যাচটা, তাকাল ফাঁক দিয়ে।

ছোট্ট একটা প্রকোষ্ঠ রয়েছে নিচে, কম পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলছে সেখানে। টেবিল-চেয়ার নিয়ে সেখানে বসে আছে একজন লোক। টেবিলের ওপর শোভা পাচ্ছে নানা রকম সুইচ আর লিভারসহ একটা কন্ট্রোল প্যানেল।

মুখের নিঃশব্দ হাসিটা চওড়া হলো অয়নের। বড় করে শ্বাস নিল ও। তারপর একঝটকায় তুলে ফেলল পুরো হ্যাচ। আওয়াজ শুনে চমকে উঠল লোকটা। একলাফে উঠে দাঁড়াল। ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল চেয়ারটা। পাই করে ঘুরে ওপর দিকে তাকাল সে।

‘হ্যালো, মি. বেনেট!’ হাসিমুখে বলল অয়ন। ‘আপনি মাইকেল বেনেট তো? আপনার স্ত্রী কোথায়?’

আরও পড়ুন

কয়েক মুহূর্ত মুখে কথা ফুটল না মাইকেলের। ফ্যালফ্যাল করে অপলকে তাকিয়ে রইল। তারপর তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘ক্...কে তুমি?’

‘আমার নাম অয়ন হোসেন। আমাকে আপনি চিনবেন না। তবে ওপরে আপনার পরিচিত দুজন মানুষ আছেন। দয়া করে উঠে আসবেন?’

একটু দোনোমনা করল মাইকেল, তারপর পায়ে–পায়ে উঠে এল মই বেয়ে। ওপরে উঠেই মুখোমুখি হলো মিসেস মার্সডেন আর লিজার। কামরার বাতি জ্বেলে দিল অয়ন।

‘মাইকেল!’ বিস্মিত গলায় বললেন বৃদ্ধা। ‘তুমি এখানে কী করছ? তোমার না বেড়াতে যাওয়ার কথা?’

লোকটা কোনো জবাব দিচ্ছে না দেখে অয়ন বলল, ‘যাননি উনি। এখানেই রয়ে গেছেন ভুতুড়ে কাণ্ড ঘটানোর জন্য। আপনার কামরায় নানা রকম কারসাজি করা আছে, ম্যাম। এখানে বসে সেগুলো অপারেট করা হয়।’

চোয়াল ঝুলে পড়ল মিসেস মার্সডেনের। জানতে চাইলেন, ‘কথাটা কি সত্যি?’

এবারও নিরুত্তর রইল মাইকেল।

‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না,’ হতভম্ব কণ্ঠে বললেন বৃদ্ধা। ‘তুমি আবার আমাকে পাগল বানিয়ে হাসপাতালে পাঠাতে চাইছ? কিন্তু কেন?’

চেহারা থেকে ভদ্রতার মুখোশ খসে পড়ল মাইকেলের। খ্যাপাটে গলায় বলল, ‘কারণ, ওটাই তোমার আদর্শ ঠিকানা, বুড়ি! তোমার কোনো অধিকার নেই এভাবে ফিরে এসে আমার বারোটা বাজানোর।’

‘কীভাবে কথা বলছ তুমি? আর আমি কীভাবে তোমার বারোটা বাজালাম?’

‘সেটাও বুঝিয়ে দিতে হবে?’

‘পুলিশ ডাকুন, ম্যাম,’ কড়া গলায় বলল লিজা। ‘এই বদমাশের সঙ্গে অযথা কথা বলে লাভ নেই।’

আরও পড়ুন

মুখে শয়তানি এক টুকরা হাসি ফুটল মাইকেলের। শান্ত গলায় বলল, ‘পুলিশ ডাকার সুযোগ তোমরা কোনো দিনও পাবে না, লিজা। নিজেদের খুব চালাক ভাবো, না? মিলিকে এখানে না দেখেও কিছু আন্দাজ করতে পারোনি? ওকে বাইরে রেখেছি আমি—পাহারা দেওয়ার জন্য। তোমরা হঠাৎ কটেজে হাজির হতে পারো, সেটা ভেবেই।’

‘নড়বে না কেউ!’ নারীকণ্ঠের একটা ধমক শোনা গেল পেছন থেকে। ওদিকে তাকাতেই মাইকেলের স্ত্রীকে দেখতে পেল সবাই—অতর্কিতে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। তার হাতে শোভা পাচ্ছে একটা উদ্যত পিস্তল।

‘মিলি!’ চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস মার্সডেন।

‘চুপ, বুড়ি!’ ধমকে উঠল মহিলা। ‘যেখানে আছ, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।’

জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করল মাইকেল। ‘কপাল মন্দ তোমার, ফুফু। ভেবেছিলাম শুধু পাগলাগারদে ফেরত পাঠাব। কিন্তু চালাকি করতে গিয়ে নিজের, সেই সঙ্গে এই দুজনেরও মরণ ডেকে আনলে। একদিক থেকে অবশ্য উপকারই করেছ আমার। কেয়ারটেকার হয়ে আর থাকতে হবে না, তোমার মৃত্যুর পর একমাত্র নিকটাত্মীয় হিসেবে পুরো সম্পত্তির মালিক হয়ে যাব আমি।’

আরও পড়ুন

চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল অয়নের। বলল, ‘তিন-তিনটা খুন করে পার পাবেন ভাবছেন?’

‘কেন নয়?’ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল মাইকেল। ‘পাগল এক বুড়ি...যদি দুজন মানুষকে খুন করে নিজেও আত্মহত্যা করেছে বলে প্রচার করি, কেউ সেটা অবিশ্বাস করবে কেন?’

‘তুমি যে এত বড় শয়তান, তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি,’ চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন মিসেস মার্সডেন।

‘কল্পনা করতে হবে না। এখন নিজের চোখে, বাস্তবে দেখবেন।’

আরও পড়ুন

‘দুঃখিত, সে সৌভাগ্য ওনার হবে না,’ বেরসিকের মতো বলল অয়ন। ‘কারণ, আমরা আসলে তিনজন নই, চারজন।’

‘মানে?’ মাইকেল ভুরু কোঁচকাল।

‘মানে আপনি যেমন সতর্কতা অবলম্বন করেছেন, আমরাও তেমন করেছি। আমরাও কটেজের বাইরে রেখেছি একজনকে।’ এবার গলা চড়াল অয়ন। ‘জিমি!’

পরমুহূর্তে ঝড়ের বেগে কটেজে ঢুকল জিমি, হাতে লম্বা একটা লাঠি। আওয়াজ শুনে উল্টো ঘোরার চেষ্টা করল মিলি, কিন্তু তাকে সফল হতে দিল না ও। লাঠি দিয়ে প্রচণ্ড এক ঘা বসিয়ে দিল মাথায়। আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল মহিলা।

অয়নও সচল হয়ে উঠেছে। মাইকেলের হতচকিত অবস্থার সুযোগ নিয়ে ছুটে গেল ও, মাথা আর কাঁধ দিয়ে একটা ধাক্কা দিল তার বুকে। খোলা হ্যাচের একেবারে কিনারে দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা, ধাক্কা খেয়ে তাল সামলাতে পারল না। সরাসরি পড়ে গেল মেঝের ফুটো দিয়ে নিচে। বেমক্কা আছাড় খেয়ে চিত্কার করে উঠল।

সোজা হলো অয়ন। লাঠি হাতে বিজয়ীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ওর বন্ধুটি। প্রশংসার সুরে বলল, ‘ওয়েল ডান, জিমি। মোক্ষম ঘা দিয়েছিস। বাই দ্য ওয়ে, মেরেটেরে ফেলিসনি তো?’

ঝুঁকে মিলিকে পরীক্ষা করল লিজা। জানাল, ‘না, মরেনি। মাথা ফেটে গেছে। বেহুঁশও হয়ে গেছে।’

‘এরও অবস্থা খারাপ,’ হ্যাচের ফুটো দিয়ে নিচটা দেখল অয়ন। তারস্বরে ককাচ্ছে মাইকেল। ‘হাত-ঠ্যাং ভেঙেছে মনে হয়। শুধু পুলিশ না, অ্যাম্বুলেন্সও ডাকতে হবে।’

‘আমি এখনই ডাকছি,’ বলে পকেট থেকে সেলফোন বের করল লিজা।

আরও পড়ুন