লাশটা উঠে বসেছে।
পেছনের দিকে না তাকিয়েও ব্যাপারটা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন ডক্টর শামীম। নির্বিকার ভঙ্গিতে মুখের কাছে একটা টেস্টটিউব দোলাতে দোলাতে তিনি বললেন, ‘শুয়ে থেকে কোমর ধরে গেছে নাকি? চাইলে একটু হাঁটাহাঁটি করতে পারেন।’
লাশটার সে ইচ্ছে আছে বলে মনে হলো না। শামীম চট করে একবার ফাইলের ওপর চোখ বুলিয়ে মৃত লোকটার নাম দেখে নিলেন। অরুণ কুমার। বয়স ৫৬। মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ: বিষক্রিয়া।
চোখভরা বিস্ময় নিয়ে আশপাশ দেখছেন অরুণ। ডক্টর শামীমের ধারণা ছিল প্রথমেই লোকটা বলবেন, ‘আমি কোথায়?’ এ রকম পরিস্থিতিতে অধিকাংশ মৃত লোক তা-ই বলে। কিন্তু তাঁকে ভুল প্রমাণ করে অরুণ বললেন, ‘এক গ্লাস পানি হবে?’
‘ডান দিকে, টেবিলের ওপর দেখুন। বোতল আছে। এক বোতল পেপসিও পাবেন বোধ হয়। যা ইচ্ছে নিতে পারেন।’
‘পেপসি খাব না। আমার ডায়াবেটিসটা বেড়েছে।’
এবার ঘুরে বসতে হলো ডক্টর শামীমকে। শান্ত গলায় তিনি বললেন, ‘ভাই, আপনি বোধ হয় এখনো ব্যাপারটা ধরতে পারেননি। আপনি মারা গেছেন। আজ দুপুরেই আপনার মৃতদেহটা এখানে আনা হয়েছে। এখন আপনি আছেন মেডিকেলের ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে।’
সাধারণত, এই পর্যায়ে এসে ঘাবড়ে যায় লাশগুলো। কেউ হাসে—ভাবে এটা একধরনের রসিকতা। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে কেউ কেউ। এর কোনোটাই করলেন না অরুণ। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ‘ও’ বলে ভাবলেন কী যেন। তারপর শিশুর মতো হেসে বললেন, ‘তাহলে তো পেপসি একটু খাওয়াই যায়। মরে গেলে তো আর ডায়াবেটিসের ভয় নাই।’
বোতলে মুখ লাগিয়ে খুব আনন্দ নিয়ে পেপসি খেতে শুরু করলেন অরুণ। কেন যেন খুব মায়া হলো ডক্টর শামীমের।
‘আমাকে দেখে আপনার ভয় লাগছে না?’ অরুণ বললেন।
‘না।’
‘কেন? লাশ কি রোজ রোজ আপনার রুমে বসে পেপসি খায়?’
‘তা নয়। তবে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।’
কথা সত্য। ১২ বছর ধরে ফরেনসিক বিভাগে আছেন শামীম আহমেদ। লাশগুলো তাঁর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছে চার বছর ধরে। প্রথমবার তিনি আঁতকে উঠেছিলেন। এরপর আস্তে আস্তে ব্যাপারটা সয়ে গেছে। ঘরে কেউ না থাকলেই স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা লাশগুলো উঠে বসে, গল্পগুজব করে তাঁর সঙ্গে। আবার যাওয়ার সময় হলে শুয়ে পড়ে চুপচাপ। নিথর হয়ে যায় একেবারে। জগতে ব্যাখ্যার অতীত কত কিছুই তো হয়। এটাও হয়তো তেমনই একটা কিছু। এখন আর এই রহস্য সমাধানের চেষ্টা করেন না শামীম।
‘আচ্ছা, আমি কীভাবে মারা গেলাম?’ আধা লিটার পেপসির বোতল পুরোটা খালি করে ফেলেছেন অরুণ। একটা ঢেকুর তুলে কথাটা বললেন তিনি।
‘সম্ভবত আপনার খাবারের সঙ্গে বিষ মেশানো হয়েছিল। বিষের ধরন দেখে মনে হচ্ছে, এটা কাজ করতে পাঁচ মিনিট সময় নিয়েছে।’
‘হুম...তাই তো বলি। সকালে নাশতা খেতে খেতে একটা নাটক দেখছিলাম। নাম: সকালের মৃত্যু। নাটকের শুরুটা মনে আছে। শেষটা মনে পড়ছে না।’
‘জ্ঞান হারানোর পাঁচ মিনিট আগে আপনি কী খেয়েছিলেন, মনে আছে?’
‘না। এমনিতেও স্মৃতিশক্তি খুব একটা ভালো না আমার। অনেক প্রয়োজনীয় কথা মনে পড়ে না। আবার অনেক অপ্রয়োজনীয় কথা চাইলেও ভুলতে পারি না।’
ডক্টর শামীম একটু ভাবনায় পড়লেন। ‘পুলিশ সন্দেহ করছে আপনার বাড়ির কাজের লোক, রুবেলকে। সে-ই তো সকালে নাশতাটাশতা দেয়...’
‘আস্ত বেয়াদব! চটাং চটাং কথা বলে। সকালে নাশতাটা কোনো রকম ফেলে রেখে চলে গেছে। বলি স্যুপটা গরম করে দে, বিস্কিটের প্যাকেটটা খুলে দে। কে শোনে কার কথা! কানেই তোলে না...’ বলেই যেন দুর্ভাবনায় পড়ে গেলেন অরুণ। ‘কিন্তু রুবেল আমাকে মারবে কেন? ছেলেটা বেয়াদব, কিন্তু...’
‘পুলিশ এখনো মোটিভটা খুঁজে পায়নি।’ হাতের কাগজপত্রগুলো উল্টেপাল্টে বললেন শামীম, ‘আপনার স্ত্রী, ছেলে, মেয়েরা বিদেশে থাকে। আপনি অসুস্থ মানুষ, সারা দিন বিছানায় শুয়ে টিভি দেখেন। ঘরের ভেতর এত দামি দামি জিনিস...হয়তো রুবেলের কোনো মতলব ছিল। যদিও সে এখনো কিছু স্বীকার করেনি।’
রুবেল-বিষয়ক আলাপে অরুণ কুমারের খুব একটা আগ্রহ আছে বলে মনে হলো না। তাঁর দৃষ্টি ডক্টর শামীমের টেবিলের ওপর রাখা চকলেটের প্যাকেটটার দিকে।
‘খাবেন?’ বলে চকলেটটা এগিয়ে দিলেন শামীম।
একটু ইতস্তত করে হাতে নিলেন অরুণ। শিশুর মতো সরল হেসে বললেন, ‘একসময় খুব পছন্দ করতাম। ডায়াবেটিসের যন্ত্রণায় খেতে পারিনি অনেক দিন।’ দাঁত দিয়ে কামড়ে চকলেটের প্যাকেটটা ছিঁড়তে বেশ বেগ পেতে হলো তাঁকে। অনেকটা কৈফিয়তের সুরে বললেন, ‘আমার বাঁ হাতে জোর কম। দুই হাত দিয়ে ছিঁড়তে পারি না।’
চকলেট মুখে দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকলেন অরুণ। হঠাৎই রুবেলের কথা মনে পড়ল তাঁর, ‘কী যেন বলছিলেন? ও হ্যাঁ...রুবেল। ও কি এখন পুলিশের কাছে? আহা রে। বেচারাকে মারধর করছে না তো?’
‘করতেও পারে। ও তো কিছু স্বীকার করছে না।’
‘খুন না করলে স্বীকার করবে কেন?’
‘আচ্ছা ধরলাম রুবেল খুন করেনি। তাহলে আপনার খাবারে বিষ মেশাল কে?’
‘খাবারে যে বিষ মেশানো ছিল, সেটা নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে?’
এই প্রশ্নটায় যুক্তি আছে। পুলিশের রিপোর্ট বলছে, সেদিন অরুণ বাবুর সকালের নাশতায় বেশ কিছু আইটেম ছিল। এক কাপ রং চা, ছোট ছোট টুকরো করে কাটা আপেল, বিস্কিট, টোস্ট, ডিম পোচ আর ভেজিটেবল স্যুপ। প্রতিটা খাবারের অবশিষ্ট অংশ পরীক্ষা করে দেখেছেন শামীম। কোথাও বিষাক্ত কিছুর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। খুনি যদি রুবেলই হয়ে থাকে, খুনটা সে করল কীভাবে?
হঠাৎ কী যেন মনে পড়তেই চট করে অরুণ কুমারের মুখোমুখি বসলেন শামীম। ‘আচ্ছা। আপনার খাবার টেবিলে সব আছে। পানি নেই কেন? আপনি নাশতার পর পানি খান না?’
একটু ভাবলেন অরুণ। ‘উমম...পানির বোতল তো একটা সব সময় আমার বালিশের পাশে থাকে। আমার আবার একটু পরপর পানির পিপাসা পায়। সেদিন বোতলটা খালি হয়ে গিয়েছিল। তাই ফেলে দিয়েছিলাম। রুবেলকে বলেছিলাম আরেক বোতল পানি এনে রাখতে। আমি আবার মিনারেল ওয়াটার ছাড়া খাই না।’
‘আচ্ছা, আপনার পানির সঙ্গে কি বিষ মেশানো হতে পারে?’
‘তা তো জানি না। মনে হয় না। কারণ, রুবেল আমাকে পানির বোতলটা দিয়েছিল আগের রাতে। রাতে আমি বেশ কয়েকবার পানি খেয়েছি। তখন তো কোনো সমস্যা হয়নি।’
‘পানির বোতলটা কোথায় ফেলেছেন?’
‘আমার বিছানার পাশেই একটা ময়লার ঝুড়ি থাকে। সেখানে।’
ঝটপট ইন্সপেক্টর রজতকে ফোন করলেন শামীম। ‘হ্যালো। আচ্ছা, দুপুরে যে ডেডবডিটা নিয়ে এলেন। তাঁর ঘরে কি একটা ময়লার ঝুড়ি ছিল?...হ্যাঁ হ্যাঁ...আচ্ছা...ময়লার ঝুড়িতে কী কী পাওয়া গেছে বলুন তো?’
ডক্টর শামীম একটা কাগজ-কলম টেনে নিয়ে লিখতে শুরু করলেন, ‘হুম বলুন। কয়েকটা প্যারাসিটামলের খালি প্যাকেট, একটা পানির বোতল, একটা বিস্কিটের প্যাকেট, কতগুলো ব্যবহূত টিস্যু আর পুরোনো পেপার। এই? আচ্ছা...আচ্ছা শুনুন, জিনিসগুলো আমার দরকার। হ্যাঁ, সবগুলোই। ওকে। ধন্যবাদ।’
ফোন রাখলেন শামীম। বললেন, ‘অরুণ বাবু, আপনার মৃত্যুটা কীভাবে হলো, সেটা বোধ হয় আমি বুঝতে পারছি। রুবেল ছেলেটা তো জিনিয়াস।’
কীভাবে খুন করা হলো অরুণ কুমারকে?
উত্তর
খাবারে নয়, বিষ মাখানো ছিল বিস্কুটের প্যাকেটে। অরুণের একটা হাত দুর্বল। প্যাকেট ছেঁড়ার জন্য তাকে দাঁতের সাহায্য নিতে হয়, এটা রুবেল জানত।