পাঁচ
রাত্রি। বড় রাস্তা থেকে সরু রাস্তাটা যেখানে বেরিয়ে গেছে, তার পাশে ক্যাম্প করেছে আশফাক খানের সঙ্গে আসা দলটা। জাফরকে দেখাশোনা করছেন দলের সঙ্গে আসা ডাক্তার।
রাস্তার পাশে ছোট্ট একচিলতে খোলা জায়গা। চারপাশটা জঙ্গলে ঘিরে আছে। এই খোলা জায়গাটুকুতেই ক্যাম্প ফেলা হয়েছে। উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে তিনটে কোলম্যান ল্যাম্প। রাইফেল কাঁধে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে সান্ত্রীরা। খোলা জায়গাটুকুর কেন্দ্রস্থলে অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হয়েছে। স্থির হয়ে আছে পাহাড়ি বাতাস। সরলরেখা সৃষ্টি করে খাড়া আকাশে উঠে যাচ্ছে ক্যাম্পফায়ারের হালকা ধোঁয়া।
আগুনের কাছে শুইয়ে রাখা হয়েছে জাফরকে। ভারী কম্বল চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। কম্বলের বাইরে শুধু মাথাটা বেরিয়ে আছে তার। বালিশের অভাবে মাথার নিচে দেওয়া হয়েছে একটা দুমড়ানো জ্যাকেট। আগুনের পাশে বসে আছে ইউসুফ। একটু দূরে রেডিও নিয়ে বসেছেন আশফাক খান। বেসক্যাম্পের অধীন কোনো কর্মচারীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন রেডিওতে। চেয়ে চেয়ে তা–ই দেখছে ইউসুফ।
‘শোনো’, কাটা কাটা শোনাল আশফাক খানের কণ্ঠস্বর, ‘তোমাদের অসুবিধা বুঝতে পারছি আমি, কিন্তু আমার অসুবিধাটাও বোঝার চেষ্টা করো। একজন মহিলা নিখোঁজ হয়েছেন এখান থেকে। একটা অতি মূল্যবান যন্ত্রও গায়েব হয়েছে তার সঙ্গে। কাজেই রাতের বেলায় অনুসন্ধানকাজ চালানোর জন্য নাইট ভিশন ইকুইপমেন্টগুলো আমার চাই এবং সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
‘ইয়েস স্যার,’ উত্তর দিল একটা হাল ছেড়ে দেওয়া কণ্ঠ। ‘বেসক্যাম্পে তো ওগুলো নেই এখন, আনার সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেব আপনার ওখানে।’
‘মনে থাকে যেন কথাটা,’ লাইন কেটে দিলেন আশফাক খান।
‘মনে হচ্ছে জিনিসগুলো পৌঁছাতে কিছুটা দেরি হবে,’ বলল ইউসুফ।
‘হুঁ!’ চিন্তিত দেখাচ্ছে আশফাক খানকে।
ঘুমের মধ্যেই নড়েচড়ে উঠল জাফর। আশফাক খান ও ইউসুফ দুজনই তাকাল একবার সেদিকে।
‘হ্যাঁ, ভালো কথা,’ ইউসুফ বলল, ‘আবার ওই পাহাড়ে চড়ব আমি। জাফরকে যেখানে পেয়েছি, সেই জায়গা আরেকবার ভালোমতো দেখতে চাই।’
‘ঠিকই বলেছ। ভুলেই গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, রেডিওতে বলেছিলে কী একটা জীবকে দেখেছ? কী ওটা?’
‘চিনতে পারিনি। দূর থেকে দেখেছি তো।’
‘ভালুক?’
‘ও রকমই। আমেরিকার বিশাল গ্রিজলি ভালুকের চেয়েও বড়।’
‘ওই প্রাণী এখানে এল কী করে?’
‘কেউ ধরে এনে ছেড়ে দিয়ে থাকতে পারে।’
‘কেন?’
‘এ প্রশ্নের জবাব জানলে তো অনেক রহস্যেরই সমাধান হয়ে যেত।’
আবু–তাহের এল। হাতে কাপড়ে জড়ানো কী যেন।
আশফাক খান জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ওটা?’
‘প্লাস্টার কাস্ট,’ কাপড়ের মোড়ক খুলে জিনিসটা বের করল আবু-তাহের। ‘মাটিতে বসে যাওয়া পায়ের ছাপ থেকে তৈরি করেছি।’ সাদা প্লাস্টিকে তৈরি পায়ের ছাপের ছাঁচটা মাটিতে নামিয়ে রাখল আবু-তাহের।
অবাক হয়ে ছাঁচটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন আশফাক খান।
‘এত বড় পা!’ বিড়বিড় করল ইউসুফ, ‘অবিশ্বাস্য!’ আশফাক খানের দিকে তাকাল সে। ‘আমার কী মনে হয় জানেন? রাক্ষস হোক আর গ্রিজলিই হোক, জাফর আর শারিতাকে ওই দানবই ধরে নিয়ে গেছে। জাফরকে ছেড়ে দিয়েছে। শারিতাকে আটকে রেখেছে।’
‘কেন?’
‘সেটা জানতেই যেতে হবে আবার আমাকে ওখানে।’
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে কিন্তু দ্রুত এগিয়ে আসছে পায়ের ছাঁচের মালিক। লক্ষ্য স্ট্যান্ডে বসানো দুটি উজ্জ্বল ইলেকট্রিক আলো।
বেসক্যাম্পের একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল দানবটা। একটা গাছের আড়াল থেকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, কোন দিক থেকে এগোলে সুবিধা হবে।
ক্যাম্পের পাশে পথের ধারে আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে টেলিমেট্রি ভ্যানটা, তার পাশে জেনারেটর ট্রাক। একটানা চাপা গুঞ্জন করছে জেনারেটর। ট্রাকের কয়েক গজ দূরে টেবিলটা। বিচিত্র সেন্সরগুলো নেই এখন ওটার ওপর, সরিয়ে রেখে গেছে ইউসুফ। কিন্তু ট্রানসিভারটা আছে। আর আছে কনটেইনারসহ কফি বানানোর অন্যান্য সরঞ্জাম। মৃদু আলো বেরোচ্ছে ট্রানসিভারের ডায়ালে বসানো খুদে বাল্ব থেকে। ক্যাম্প থেকে একটু দূরে জঙ্গলের কিনারায় রাখা হয়েছে পিকআপ আর আশফাক খানের জিপটা।
ক্যাম্পের সীমানায় পাহারা দিচ্ছে এখন একজন গার্ড। হাতে একটা ছোট লাঠি। কোমরে গোঁজা পয়েন্ট থ্রি এইট কোল্ট অটোমেটিক।
গাছের আড়ালে স্থির হয়ে থাকল দানবটা। দুটি বাতির আলোক সীমানার একেবারে শেষ প্রান্তে আছে সে। আর এক কদম এগোলেই ভেতরে এসে পড়বে।
আগুনের কাছ থেকে দূরে বসে বসে তাস খেলছে আরও ছয়জন গার্ড। ডিউটি নেই তাদের। চক্কর মারতে মারতে সঙ্গীদের কাছে এসে প্রতিবারেই অন্তত ১৫ সেকেন্ড ওদের খেলা দেখে যায় কর্তব্যরত গার্ড।
আস্তে করে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল দানবটা। সোজা হেঁটে এগিয়ে এল তার সবচেয়ে কাছের আলোর স্ট্যান্ডটার কাছে। বিশাল একটা লোমশ হাত বাড়িয়ে আলতো করে ঠেলা দিল স্ট্যান্ডের গায়ে। কাত হয়ে পড়ে গেল ওটা আলোসুদ্ধ।
চমকে ফিরে তাকাল গার্ডরা। আতঙ্কিত চোখে দেখল, বিশালদেহী লোমশ একটা জানোয়ার ঝড়ের গতিতে ছুটে যাচ্ছে দ্বিতীয় লাইট স্ট্যান্ডটার দিকে।
এক ধাক্কায় লাইট স্ট্যান্ডটা ফেলে দিল দানবটা। ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেল ক্যাম্প এলাকা। একমুহূর্ত দ্বিধা করল কর্তব্যরত গার্ড। তারপর সাহসে বুক বাঁধল। লাঠিটা কোমরের বেল্টে গুঁজে রেখে টান মেরে খাপ থেকে রিভলবার বের করে আনল। পা টিপে টিপে এগিয়ে চলল দ্বিতীয় লাইট স্ট্যান্ডটার দিকে। তাস ফেলে উঠে দাঁড়াল তার সঙ্গীরাও। সার বেঁধে এগোল তার পিছু পিছু।
ওদিকে জেনারেটর ট্রাকের কাছে এগিয়ে গেছে দানবটা। অন্ধকারেও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে। এগিয়ে আসা গার্ডদের দিকে একবার তাকাল। তারপর ঝুঁকে ট্রাকের পেছনে তলার দিকের কিনারা চেপে ধরল। পরক্ষণেই ভয়ংকর এক গর্জন ছেড়ে হ্যাঁচকা টান মারল ওপর দিকে। ঝাঁকুনি খেয়ে শূন্যে উঠে গেল ভারী ট্রাকের পেছনটা। প্রচণ্ড আরেক ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়ল দড়াম করে। জেনারেটরের সঙ্গে যুক্ত তারগুলো ছিঁড়ে যেতেই ছেঁড়া মাথা থেকে তীব্র নীল স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে গেল। ট্যাংক থেকে গলগল করে মাটিতে পড়তে লাগল পেট্রল। তাতে বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গের ছোঁয়া লাগতেই দপ করে জ্বলে উঠল আগুন।
দেখতে দেখতে জেনারেটর ট্রাকটাকে গ্রাস করল আগুন। আলোকিত হয়ে গেল ক্যাম্প এলাকা। দাউ দাউ জ্বলছে লাল আগুন।
পালাচ্ছে গার্ডের দল। পড়িমরি করে গিয়ে ঢুকছে জঙ্গলের ভেতর। সবার পেছনে পিস্তল হাতে ডিউটিরত গার্ড। পিছু নিল দানবটা। ছোঁ মেরে অবলীলায় তুলে নিল পিস্তলধারীকে। মাথার ওপর তুলে ছুড়ে দিল জঙ্গলের দিকে, যেন একটা হালকা ছোট্ট পুতুল ছুড়ল।
ফিরে দাঁড়াল দানবটা। দ্রুত এগিয়ে এল। তাঁবু দুটি লক্ষ্য। টেনে খুঁটিসুদ্ধ উপড়ে আনল একটা তাঁবু। কাগজ ছেঁড়ার মতো ফড়ফড় করে টেনে ছিঁড়ল অতি সহজে। দ্বিতীয় তাঁবুটারও একই গতি করে এগিয়ে গেল টেলিমেট্রি ভ্যানের দিকে।
বনের ভেতর থেকে জ্বলন্ত জেনারেটর ভ্যানের আলোয় আতঙ্কিত চোখে এই ধ্বংসলীলা দেখছে ছয়জন গার্ড। একটা ঝোপের ভেতরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে হতভাগ্য গার্ডটা। তার হাতের পিস্তল ছিটকে গিয়ে পড়েছে আরও ১০ হাত দূরে মাটিতে।
টেলিমেট্রি ট্রাকটা ধ্বংস করে দিয়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল দানবটা। এক ধার খামচে ধরে শূন্যে তুলে ফেলল ভারী টেবিলটা। ঝনঝন শব্দে মাটিতে পড়ে ভাঙল কফি কনটেইনার আর যন্ত্রপাতি। টেবিলটা মাটিতে আছড়ে ফেলল দানবটা। তারপর চারপাশে একবার চোখ বোলাল। জিপ আর পিকআপটা দেখতে পেয়েই এগিয়ে গেল ওদিকে। এক এক করে উল্টে দেখল দুটিই। আর কিছু ভাঙার নেই। নিজের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে যেদিক থেকে বেরিয়েছিল, আবার সেদিক দিয়েই বনের ভেতরে ঢুকে গেল সে।
ধীরে ধীরে নিভে আসছে জ্বলন্ত ট্রাকের আগুন। পায়ে–পায়ে এগিয়ে এল গার্ডরা। গাছপালার আড়াল থেকে বাইরে বেরোতে যাবে, হঠাৎ এক বিস্ফোরণে চমকে উঠে আবার দ্রুত গিয়ে ঢুকল বনের ভেতরে। পেট্রল ট্যাংক ফেটেছে। আবার বেড়ে গেল আগুন। প্রচণ্ড হয়ে উঠছে উত্তাপ। বিস্ফোরণের ফলে ধাতু আর কাঠের ছোট–বড় অসংখ্য টুকরা ছিটকে পড়েছে এদিক–ওদিক। কয়েকটা জ্বলন্ত টুকরা গিয়ে পড়ল মাটিতে পড়ে থাকা ছেঁড়াখোঁড়া তাঁবুর কাপড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে গেল ওগুলোতেও। সাংঘাতিক উত্তাপ সইতে না পেরে বনের আরও গভীরে ঢুকে গেল গার্ডের দল।
ওদিকে দ্রুত হিমপাহাড়ের দিকে ছুটছে দানবটা। নিজের কাজ ভালোমতোই সমাধা করেছে সে।
সবে ভোর হয়েছে। সূর্য উঠতে দেরি এখনো। ধূসর ছায়াটুকু সরি সরি করেও সরছে না বনভূমির ওপর থেকে। বেসক্যাম্পের দিকে এগিয়ে চলেছে ইউসুফ, সঙ্গে আশফাক খান আর আবু-তাহের। রাতের ধ্বংসলীলার খবর পেয়েছে তারা ঘণ্টা দেড়েক আগে। রাতেই একজন গার্ড খবর দিয়েছে ফরেস্ট রেঞ্জার অফিসে। অফিসের ফায়ার ডিভিশনের লোকেরা এসে বেসক্যাম্পের আগুন নিভিয়েছে। আশপাশে শুকনা গাছপালা নেই, তাই রক্ষা, নইলে দাবানল ছড়িয়ে পড়ত।
যে গার্ডকে ছুড়ে ফেলেছিল দানবটা, অজ্ঞান অবস্থায় তুলে এনেছে তাকে তার সঙ্গীরা। কপাল ভালো লোকটার, একটা ঘন ঝোপের ওপর গিয়ে পড়েছিল। শরীরে বেশ কিছু কাটাছেঁড়া আর মেরুদণ্ডে সামান্য চোট লাগা ছাড়া তেমন কোনো মারাত্মক আঘাত পায়নি সে। দিন সাতেকের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবে।
পুরো ধ্বংস হয়ে গেছে জেনারেটর ট্রাকটা। ওয়ার্ক টেবিলে রাখা যন্ত্রপাতিগুলোও আর কোনো কাজে আসবে না, বেঁকেচুরে ভেঙে শেষ। এখনো অল্প অল্প ধোঁয়া উড়ছে পোড়া ট্রাকটার শরীর থেকে।
ধ্বংস হয়ে যাওয়া বেসক্যাম্পের আঙিনায় এসে দাঁড়ালেন আশফাক খান। তার একটু তফাতে ইউসুফ আর আবু-তাহের।
‘আশ্চর্য!’ ভ্রু কুঁচকে পোড়া ট্রাকটার দিকে তাকিয়ে আছেন আশফাক খান।
জেনারেটর ট্রাকটার ওপাশে সামান্য একটু জায়গায় জমাট কাদা। হাঁড়িপাতিল আর বাসন–পেয়ালা ধুয়েছে ওখানে বাবুর্চি। গত কয়েক দিনে অনেকখানি পানি ঢেলেছে, তাই কাদা হয়ে গেছে। তবে আগুনের প্রচণ্ড উত্তাপে কিছুটা শুকিয়েছে।
কী ভেবে ওই কাদাটুকুর কাছেই এগিয়ে গেল ইউসুফ। যা ভেবেছিল, ঠিক তা–ই। কাদায় বসে আছে দৈত্যের পায়ের ছাপ।
‘এদিকে আসুন,’ হাত তুলে ডাকল ইউসুফ।
এগিয়ে এলেন আশফাক খান।
‘কী?’
‘দেখুন,’ হাত তুলে দানবীয় পায়ের ছাপটা দেখাল ইউসুফ। ‘রাক্ষসটা এখানকার লোকের কল্পনা নয়, বাস্তবেই আছে ওটা।’
ঝুঁকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পায়ের ছাপগুলো দেখলেন আশফাক খান। বিড়বিড় করলেন, ‘খোদাই জানে, কিসের পায়ের ছাপ ওগুলো!’
পেছনের গভীর জঙ্গলের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল ইউসুফ।
তার এই দৃষ্টি চেনেন আশফাক খান। কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ভয়ংকর বিপদে ঝাঁপ দেওয়ার আগে অমন হয় এই রোবটমানবের। খপ করে ইউসুফের হাত চেপে ধরলেন আশফাক খান।
আশফাক খানের চোখে চোখে তাকাল একবার ইউসুফ। তারপর আবার ঘাড় ফেরাল বনের দিকে। আনমনে বলল, ‘চলার পথে নিজের চিহ্ন রেখে যেতে বাধ্য অত বড় দানব!’ চকিতেই মুখ ফেরাল আবার আশফাক খানের দিকে, ‘আমি নিশ্চিত, দানবটাকে অনুসরণ করলেই শারিতার খোঁজ পাব। সমাধান করতে পারব এই রহস্যের।’
ইউসুফের কবজিতে আশফাক খানের হাতের চাপ বাড়ল। আস্তে করে হাতটা ছাড়িয়ে নিল ইউসুফ। ঘুরে দাঁড়াল। পরক্ষণে রওনা হয়ে গেল বনের দিকে।
‘ইউসুফ!’ চেঁচিয়ে ডাকলেন আশফাক খান। কিন্তু বৃথা। বায়োনিক গতিতে ছুটেছে ইউসুফ। নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল বনের ভেতর।
পরিষ্কার চিহ্ন রেখে গেছে দানবটা। জায়গায় জায়গায় গাছের ছোট ছোট ডাল ভেঙে আছে, পায়ের তলায় ঘাস–মাটি মাড়ানো। বায়োনিক চোখটা ব্যবহার করছে ইউসুফ। এতে আশপাশের অতি সামান্য অস্বাভাবিকতাও নজর এড়াচ্ছে না তার। দ্রুতগতিতে দৈত্যের গতিপথ অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছে সে।
ভিডিও সেন্সর ব্যবহার করছে ওরা। ইউসুফের গতিবিধির ওপর পরিষ্কার নজর রাখছে। বিশেষ টেলিভিশনের পর্দায় দেখছে দৈত্যের ফেলে আসা চিহ্ন অনুসরণ করে এগিয়ে আসছে বায়োনিকম্যান। এখনো জানে না ওরা, ইউসুফ স্বাভাবিক মানুষ নয়।
‘ওরেব্বাবা! লোকটার টেলিফটো ভিশন পর্যন্ত আছে!’ বলল হিগ।
‘হ্যাঁ,’ টোরা বলল। ‘দেখছ না, ২০০ গজ দূরে থেকেও অতি হালকা পায়ের ছাপ চোখ এড়াচ্ছে না ওর! এমনকি ডালপাতায় লেগে থাকা সূক্ষ্মতম আঁচড়টুকু পর্যন্ত ঠিক দেখছে পাচ্ছে!’
‘ওর দেহের ভেতরে কোনো ধরনের থার্মাল সেন্সর আছে মনে হচ্ছে! স্পিড দেখেছ? তা ছাড়া খালি চোখে এভাবে চিহ্ন দেখতে পাওয়ার কথা নয়। তা সে যত উন্নত মানের টেলিফটোভিশনই থাকুক না কেন।’
‘ইনফ্রারেড?’ টোরার প্রশ্ন।
‘মনে হচ্ছে।’
‘অতি উন্নত মানের বহুযন্ত্রের সংমিশ্রণ নাকি ও?’ নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল রাটিন।
তার কথার জবাব দিল না কেউ।
টোরার দিকে তাকাল হিগ। ‘কোন ধরনের সৃষ্টি হতে পারে, বলো তো? নায়োসিনথেটিক?’
‘জানি না’, মাথা নাড়ল টোরা। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে টেলিভিশনের পর্দার দিকে।
‘তার মানে ওকে পরীক্ষা করে দেখাটা এখন আমাদের একান্ত কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘হ্যাঁ,’ টোরা জবাব দিল। ‘পরীক্ষা করতেই হবে।’
‘তাহলে আর দেরি কেন? ভিটুকে পাঠাই, ধরে নিয়ে আসুক।’
একমুহূর্ত ভাবল টোরা। ‘পারবে তো?’
‘না দেখলে বুঝব কীভাবে?’
সোজা হিমপাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেছে দানবটা। জীবটাকে অনুসরণ করে যতই এগোচ্ছে, অস্বস্তি জোরদার হচ্ছে ইউসুফের মনে। ওখানে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে একবার গিয়েছে সে, দানবটাকে দেখেছে, এখন আবার যাচ্ছে জীবটার নিজের এলাকায়। লড়াই বেধে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। চলার গতি ধীর করে আনল ইউসুফ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশপাশের জঙ্গলের দিকে নজর রাখতে রাখতে এগোল। ক্রমেই আরও বেশি আদিম হয়ে আসছে জঙ্গল। আরও কয়েক সেকেন্ড পর থমকে দাঁড়াল সে।
ইনফ্রারেডে কোনো কিছুর অস্তিত্ব টের পায়নি এখনো। কিন্তু সেন্সরের সাহায্যে একটা বিরাট জন্তুর উপস্থিতি টের পাচ্ছে। আশপাশে গভীর জঙ্গল। ঝোপঝাড়গুলো ঘন লতায় আচ্ছন্ন। তলার দিকটা বড় বড় শেওলার আস্তরণে ঢাকা। এই অঞ্চলে তেমন একটা কাজ করবে না ইনফ্রারেড। কাজেই এটাকে আর এখন চালু রাখার কোনো মানে হয় না। সুইচ অফ করে দিল সে।
অতি তীক্ষ্ণ বায়োনিক শ্রবণযন্ত্রে মৃদুভাবে একটা শব্দ ধরা পড়ছে এখন। ডাল ভাঙছে কেউ। পাতায় গা ঘষছে। এগিয়ে আসছে কোনো বড় জানোয়ার।
কান পেতে শুনছে ইউসুফ। ক্রমেই আওয়াজ স্পষ্ট হচ্ছে। শব্দের উৎস বরাবর তাকাল সে। কিন্তু চোখের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অতি ঘন জঙ্গল। টেলিফটোভিশন পর্যন্ত সুবিধা করতে পারছে না।
হঠাৎ থেমে গেল শব্দ।
আওয়াজ থেমে যাওয়ায় কৌতূহলী হয়ে পড়ল ইউসুফ। অতি ধীরে এগিয়ে গেল কয়েক পা। উঁকিঝুঁকি মারল। কিন্তু কিছুই নজরে পড়ল না। এগিয়ে গেল আরও খানিকটা। বিশাল ঝোপটার ওপর চোখ পড়তেই দাঁড়িয়ে গেল। সন্দেহ হচ্ছে। এক সেকেন্ড কী ভাবল, তারপর এগিয়ে গেল ঝোপটার দিকে। কয়েক পা এগিয়ে আবার থামল। কী ভেবে পিছিয়ে আসতে লাগল আবার। তারপর ঘুরে রওনা দিল ঝোপটার দিকে। গজ দশেক গিয়ে থামল। অপেক্ষা করে দেখতে চায় কী ঘটে।
মিনিট দশেক পর ডালপাতা ভাঙার আওয়াজ শোনা গেল। ঝোপটার ডান পাশে ছোট্ট একচিলতে জায়গায় গাছপালা আশপাশের চেয়ে হালকা হয়ে জন্মেছে। একছুটে এই জায়গাটুকুতে এসে দাঁড়াল ইউসুফ। দৈত্যটার সঙ্গে লড়াই করতে হলে এখানে করাই ভালো।
শব্দ শুনেই বোঝা যাচ্ছে, তার দিকে এগিয়ে আসছে ওটা। দুই কি তিন সেকেন্ড পরই ঝোপঝাড় ঠেলে বেরিয়ে এল সে। পাহাড়-জঙ্গল কাঁপিয়ে গর্জন করে উঠল।
স্থির দৃষ্টিতে দৈত্যটার দিকে তাকিয়ে আছে ইউসুফ। ৮ ফুট লম্বা দানবটার সাদা চোখ দুটি জ্বলছে দপদপ করে, ইলেকট্রিক বাল্বের মতো।
ভারী দম নিল ইউসুফ।
আরেকবার প্রচণ্ড গর্জন করে উঠল দানবটা।