আরশির নতুন স্কুল
তীব্র গরমের বিকেলে স্কুল থেকে বাসায় ফিরেই আরশি অনুমান করতে পারল যে বাসায় কিছু একটা হয়েছে। পুরো বাসা কেমন অদ্ভুত রকম নীরব। নীরবতা যেন বাসার তাপমাত্রাও বেশ খানিকটা কমিয়ে দিয়েছে। ডাইনিংয়ের কোনায় চেয়ারে বসে থাকা দাদিমা অন্য দিন নিজে এসে আরশির কাঁধের ব্যাগ নিয়ে যান। অথচ আজ হালিমা দরজা খুলে দেওয়ার পর দাদিমা সেভাবেই বসে রইলেন। হালিমা নিজে দরজা খুলল, কিন্তু কিছু না বলে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। আরশির বাবা এ সময় বাসায় থাকেন না। আসেন সেই সন্ধ্যার পর। আরশির মা বাসায় থাকেন, কিন্তু অধিকাংশ দিন বিকেলের এ সময় তিনি ঘুমিয়ে কাটান। দাদিমা আর হালিমা বিকেলে আরশির রোজকার সঙ্গী। বাসায় আসলেই কিছু হয়েছে কি না, সেটা এখনই গিয়ে দাদিমাকে জিজ্ঞেস করবে নাকি পরে করবে, এই দ্বিধায় পড়ে গেল আরশি। হঠাৎ সে টের পেল, আজ বাবা বেশ আগেই বাসায় ফিরেছেন। সোজা চলে গেছেন মায়ের ঘরে। কিছু একটা হয়েছে। এবং সেটা যে ভালো কিছু নয়, এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ রইল না আরশির। উত্তেজনা আর চেপে রাখতে পারল না সে। ডাইনিং রুমে ফিরে গিয়ে দেখল, দাদিমা সেভাবেই ঝিম মেরে বসে আছেন। কাছে গিয়ে আরশি জানতে চাইল, ‘কিছু কি হয়েছে?’ দাদিমা চেয়ারে বসে থেকেই আরশিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘দাদুভাই, একটা ছোট ব্যাপার হয়েছে। তুমি কিন্তু শুনে মন খারাপ করতে পারবে না।’
আরশি ছোট করে বলল, ‘কী হয়েছে?’ দাদিমা ওকে সেভাবেই জড়িয়ে ধরে রেখে বললেন, ‘তোমার বাবার বদলির আদেশ এসেছে। আগামী রোববারই তোমার বাবার বদলি অফিস, ফেনীতে। আমাদের ফেনী শহরে চলে যেতে হবে এ সপ্তাহের মধ্যেই।’ ‘মানে!’ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল আরশি। তারপর আর কিছু বলতে পারল না। দাদিমার হাত সরিয়ে দিয়ে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে ভেতর থেকে আটকে দিল দরজা। পেছন পেছন দাদিমা উঠে দরজা পর্যন্ত গেলেন। কিন্তু দাদিমা জানেন, এখনই আরশি স্বাভাবিক হবে না। এর আগে যতবার ওর বাবার বদলির আদেশ এসেছে, প্রতিবারই এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে সবাইকে।
বদলির কথাটা শোনামাত্রই সন্ধ্যার অনেক আগেই আরশির ঘরজুড়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে আজ। মাত্র দুবছর হলো গাইবান্ধা থেকে বদলি হয়ে জামালপুরে এসেছে আরশিরা। ধীরে ধীরে শহরটা পরিচিত হতে শুরু করেছে ওর কাছে। এখানকার স্কুলে বছরের মাঝামাঝি এসে ভর্তি হওয়ার পর কী যে অসহ্য লেগেছে প্রথম প্রথম। এখন আবার সেই একই যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে আবারও যেতে হবে ওকে। নতুন শহরে যাবে ওরা। নতুন একটা স্কুল হবে আবার! একটা শিক্ষকও পরিচিত থাকবেন না, ক্লাসের সবাই অপরিচিত। সবাই এমনভাবে তাকাবে, এমনভাবে প্রশ্ন করবে যেন এলিয়েন এসে ভর্তি হয়েছে তাদের স্কুলে। সেবার কয়েকটা মাস কী যে কষ্টে কেটেছে, সেটা আর ভাবতে চায় না আরশি। এখন আবার একই কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হবে ওকে। এটা মানতেই পারছে না ও। ক্লাসে কত বন্ধু ওর—নিশু, বিন্তি, শুচি, বুশরা; ওরা সবাই থেকে যাবে একই স্কুলেই। কিন্তু পরের সপ্তাহ থেকে আরশি একাই আর থাকবে না এই স্কুলে। এটা ভাবতেই এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল ও। অভিমান কিংবা মনখারাপের রাতে আরশি চায় তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু আজ বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যার আবছা আলো কাটিয়ে বাইরে পুরো অন্ধকার নেমে এসেছে। তবু ঘুম আসেনি আরশির। ও নিশ্চিত, ফোন করে এখনই কোনো বন্ধুকে এ কথা বলতে গেলে কান্নায় কোনো কথাই বলতে পারবে না। এমন কত রাতে বাবার এই চাকরির ওপর রাগ হয়েছে আরশির। ওর মায়েরও অনেক রাগ এই চাকরির ওপর। প্রায়ই রেগে গেলে বা ঝগড়া হলে বাবাকে কথা শোনান মা। পড়াশোনা শেষ করেই বারবার চাকরি বদলি হওয়ায় কোথাও কোনো চাকরিতে থিতু হতে পারেননি আরশির মা।
সন্ধ্যার চা খেতে আরশিকে ডাকতে শুরু করল হালিমা। সন্ধ্যাটাকে এত দীর্ঘ মনে হলো ওর! জানালার পর্দা সরিয়ে দিলে যে চেনা সন্ধ্যার আকাশটা, একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা চেনা রেইনট্রি গাছ—এই সবই বদলে যাবে আর দুদিন পর। কান্না থামিয়ে কিছুটা শক্ত হলো আরশি। বাবার কাছে গিয়ে বলতে চাইল, একটু চেষ্টা করে দেখা যায় না? ঠেকানো যায় না বদলিটা? অন্তত আরও দু–এক বছর পেছানো যায় না? পুরো কথা শেষ করতে পারল না আরশি। অর্ধেক কথা বলেই কেঁদে ফেলল হাউমাউ করে। আরশির মা আর দাদিমাও উঠে এসে সান্ত্বনা দিচ্ছেন ওকে। ‘নতুন শহরে, নতুন স্কুলে মানিয়ে নেওয়া কোনো ব্যাপার নয়। নতুন নতুন বন্ধু হয়ে যাবে।’ মানল না আরশি। সবার সান্ত্বনাবাক্যগুলোর সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত আরশি। বছর দুয়েক আগেই তো শুনে এসেছে এসব। বারবার বলল ও, ‘বছরের মাঝখানে নতুন স্কুলে যেতে অসহ্য লাগছে আমার।’ কিছুই বললেন না আরশির বাবা। আরশি জানে, নতুন শহরে গিয়ে প্রথম দিন থেকেই বাবা এমনভাবে অফিস যাবেন-আসবেন, যেন কিছুই বদলায়নি। আরশির মা প্রথম কয়েক দিন ব্যস্ত থাকবেন হালিমার মতো নতুন কাউকে জোগাড় করার জন্য। কিংবা পাশের কোন বাজারে কোথায় কী ভালো পাওয়া যায়, সেই অনুসন্ধানে। দাদিমার কাছে সব শহরই এক। তিনি রাতদিন বাসায় থাকেন, পারতপক্ষে বাসার বাইরে কোথাও বের হন না। কিন্তু একটা নতুন শহরে, একটা নতুন স্কুলে সংগ্রামটা আরশিকেই করতে হয়, একা।
আরশির বাবা বলে দিয়েছেন, তিনি সব চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বদলি কোনোভাবেই এখন পেছানো বা স্থগিত করা যাবে না। মানে এই শুক্রবার সকালেই তাদের মালামালের ট্রাক ছুটবে ফেনী শহরের দিকে। আরশির স্কুলের বন্ধুরা তার স্কুল বদলির খবরে তাৎক্ষণিকভাবে শোকের মধ্যে পড়লেও আরশি বুঝতে পারল, তাদের এই কষ্টের মাত্রা খুব গভীর নয়। এটা খুবই স্বাভাবিক, কারণ পাঁচজন বন্ধুর দলের মাত্র এক সদস্য হারাচ্ছে ওরা। কিন্তু আরশি একলাফে হারিয়ে ফেলছে বাকি সবাইকে। হালিমাও বদলির খবরটা শোনার পর থেকেই চুপি চুপি কাঁদছে। মনমরা হয়ে আছে পুরোটা সময়। হয়তো তার নিজের চাকরি হারানোর কষ্টে। হালিমা তো আর নিজের মা–বাবা-ভাই-বোন, নিজের শহর ছেড়ে আরশিদের সঙ্গে ফেনীতে যাবে না।
শুক্রবার সকালেই ঘরের মালামাল ট্রাকে তোলা শুরু হয়ে গেল। আরশির স্কুলের সব বন্ধু পরিকল্পনা করেছে, আরশিরা চলে যাওয়ার সময় ওরা সবাই একসঙ্গে বিদায় দিতে আসবে আরশিকে। আসবে। আরশি অনেক ভেবে দেখেছে যে এইভাবে ও বিদায় নিতে পারবে না। বুক ভেঙে এমন কান্না পাচ্ছে ওর যেন নিশ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছে। এই প্রথম বন্ধুদের সঙ্গে একটা মিথ্যা কথা বলেছে আরশি। বন্ধুদের বলেছে, চলে যাওয়ার দিন বদলেছে। শুক্রবারের বদলে শনিবারে ফেনীতে যাবে আরশিরা। শনিবার সকালে আসতে বলেছে ওদের। বন্ধুদের মুখোমুখি হতে পারবে না আরশি। ওরা শনিবার সকালে এসে দেখবে, আরশি আগেই চলে গেছে ফেনীতে।
শুক্রবার দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পরই ট্রাকের পিছু পিছু আলাদা একটা গাড়িতে নতুন শহরের দিকে রওনা দিয়ে ফেলেছে আরশিরা। আরশি একদম কাঁদছে না, ও তো এখন বড় হয়ে গেছে, বড় মেয়েদের কাঁদতে হয় না।