বিড়ালাত্মা
অ্যাপার্টমেন্টের সদর দরজা দিয়ে বেরোচ্ছিল লিটন।
সদর দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় ডানে-বাঁয়ে তাকায় ও। অভ্যাস। ডান দিকে তাকাল লিটন।
অ্যাপার্টমেন্টের সামনে চওড়া ফুটপাত। ডান দিকে কিছু ভ্রাম্যমাণ হকার থাকে। মাঝেমধ্যে। তবে এখন কোনো হকার নেই।
এবার তাকাল বাঁ দিকে। আর তাকিয়েই চমকে উঠল। সেই লোকটা!
বাঁ দিকে এক সারিতে তিনটা চায়ের দোকান। চায়ের দোকানগুলো অবশ্য ওদের অ্যাপার্টমেন্টের সীমানার বাইরে। নির্মাণাধীন আরেকটা অ্যাপার্টমেন্টের ঠিক সামনে।
এই চায়ের দোকানগুলো ভোর থেকে মাঝরাত অবধি জমজমাট থাকে। নির্মাণশ্রমিকদের ভিড়ের পাশাপাশি পথচারীদের আনাগোনাও কম নয়। দোকানগুলোর ঠিক সামনে রাস্তার ওপর রিকশা-অটোরিকশার ভিড় লেগেই থাকে। এতে সুবিধাই হয়েছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যখন–তখন রিকশা-অটোরিকশা পাওয়া যায়। তবে চায়ের দোকানে ভিড় করা মানুষদের প্রায় কাউকেই লিটন চেনে না। চায়ের দোকানিরাই বলতে গেলে ওর পরিচিত মুখ।
কিন্তু কয়েক দিন ধরে হঠাৎ একটা অপরিচিত মুখ ওর পরিচিত হয়ে উঠছে। লোকটাকে চায়ের দোকানগুলোর আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে ও। চেহারাটা অপরিচিত হলেও মনে হচ্ছে, কোথায় যেন দেখেছে। কোথায় দেখেছে, মনে করতে পারছে না। মনে করার চেষ্টা করছে। কোথায় দেখেছে?
বান্দরবানে? সুনামগঞ্জে? খাগড়াছড়িতে? দেখে থাকলে এই তিন জায়গাতেই দেখেছে। গত দুমাসে এই তিন জায়গায় গিয়েছিল ও।
লোকটার দিকে তাকাল লিটন। লোকটাও ওর দিকে তাকিয়ে আছে! কেন যেন লিটনের বুকটা ধড়াস করে উঠল। আরে! লোকটা ওকে হাতের ইশারায় থামতে বলল।
লিটনের মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। অচেনা লোকের ইশারায় থামবে? নাকি চলে যাবে? কী করবে বুঝতে পারছে না। কিন্তু লিটনকে আর কিছুই ভাবার সুযোগ দিল না লোকটি। চোখের পলকে ওর সামনে এসে দাঁড়াল।
নাহিদ আঙ্কেলও ওর হাতের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘ইশ্, আরেকটু হলেই রক্ত বেরিয়ে যেত। যাও, ঘরে গিয়ে কিছু একটা করো।’
লোকটার চোখের দিকে তাকাল লিটন। টানা টানা দুটো চোখ। চোখের মণি দুটো কুচকুচে কালো। চওড়া কপাল। চুলগুলো টান টান করে ঝুঁটি করা। ঝুঁটিটা আবার মাথার মাঝতালুতে। নাকটা বোঁচা নয়, আবার খাড়াও বলা যায় না। চওড়া মুখ।
ওর দিকে তাকিয়ে লোকটি একটা হাসি দিল। ঝকঝকে সাদা দাঁত।
কেন যেন বেশ অস্বস্তি হলো লিটনের।
লোকটি বলল, ‘আপনিই লিটন?’
‘হ্যাঁ। কেন?’
হঠাৎ লোকটার মুখ থেকে হাসি উধাও হয়ে গেল। গম্ভীর মুখে বলল, ‘তা-লে আমি টিক মানুচের কাচেই এচেছি।’
বাংলা বলার ধরন দেখে সহজেই বোঝা যায়, লোকটি বাঙালি নয়। তবে বাংলা জানে। কিন্তু লিটন বুঝতে পারছে না, লোকটি কোন অঞ্চলের?
লিটনকে চুপ থাকতে দেখে লোকটি আবার বলল, ‘টিক মানুচের কাচে এচেছি কি না, বলুন?’
বলেই খিক খিক করে হেসে উঠল।
ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে লিটন। জানতে চাইল, ‘সেটা আমি কী করে বলব? আপনি কে?’
‘আমাকে চিনবেন না। আমার নাম চিংইয়া।’
নামটা শুনেই চমকে উঠল লিটন। চোখ দুটো কপালে তুলে দিয়ে বলল, ‘চিংইয়া!’
‘নাম চুনেই চমোকে গেলেন মনে অয়?’
আমতা আমতা করতে লাগল লিটন, ‘ঠিক তা নয়। আসলে আমি যে চিংইয়াকে চিনি, আপনি...’
‘ওই চিংইয়ার চাতে আপনার পরিচয় হয়েচে লৈটাপাড়া আর চিকুয়া পাআড়ের মাজে। টিক?’
লিটন সায় জানাল, ‘ঠিক।’
‘তা-লে আপনি নকল চিংইয়াকে চেনেন। নিচ্চিত থাকুন, ওটা বাটপার চিংইয়া। আমিই আচল চিংইয়া।’
জানতে চাইল লিটন, ‘আমার কাছে কী চাই?’
‘বাটপার চিংইয়া আপনাকে কিচু দিয়েচিল? কিচু একটা?’
লিটন চুপ করে রইল। জবাব দিল না।
হিসহিস করে হেসে উঠল চিংইয়া। বলল, ‘এতোক্কনে নিচ্চই বুজে গেচেন আমি কী চাই। আমি জানি, ওটা আপনার বাচায় আচে। যান, নিয়ে আচুন গিয়ে। আমি অপেখা করচি।’
‘আমি এখনো বুঝতে পারছি না, আপনি কিসের কথা বলছেন?’
‘ওই যে আপনার গরে রেখেচেন। খাঁচার ভিতর। ওটাই আমি চাইচি।’
‘কিন্তু আমি তো ওটাকে কিনেছি।’
‘কত দিয়ে কিনেচেন? আমি তার দুই গুণ টাকা দেব। নিয়ে আচুন।’
‘আমি ওটা বিক্রি করব না।’
কথাটা শুনেই মুখটা গম্ভীর করে ফেলল চিংইয়া। বলল, ‘বিক্রি করবেন না খুব বালো কতা। তা-লে এমনি এমনি দিয়ে দিন। উপহার হিচেবে।’
বলে কী লোকটা! এভাবে কেউ উপহার চায়? লিটন বলল, ‘আপাতত ওটা কাউকে উপহার দেওয়ার ইচ্ছেও আমার নেই।’
‘এতাই আপনার পাইনাল কতা?’
‘জি।’
‘বেচ। তা-লে চললাম। বালো তাকবেন। তবে...’
বলেই লোকটি একটু থামল। শীতল দৃষ্টিতে তাকাল লিটনের দিকে। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘এ জন্য আপনাকে বুগতে অবে।’
হুমকিটা বুঝতে পারল লিটন। কিন্তু পাত্তা দিল না। বলল, ‘ভুগতে হলে ভুগব। তবু দেব না।’
‘দিতে আপনাকে অবেই।’
বলেই আর দাঁড়াল না। বাঁ পাশের ফুটপাত ধরে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করল চিংইয়া। হাঁটতে হাঁটতে একসময় কিছুদূর গিয়ে রাস্তা পার হয়ে ডানে ঘুরল। লোকটিকে আর দেখা গেল না।
বড্ড দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল লিটন। চিংইয়া তাকে চমকে দিয়েছে। কিন্তু কেন?
জরুরি কাজে বাইরে বেরিয়েছিল লিটন। কিন্তু এখন জরুরি কাজটা বদলে গেছে। লিটনও উল্টো দিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করল। লম্বা পা ফেলে ফিরে এল ঘরে।
লিটনকে ফিরতে দেখেই অবাক হলেন মা। ‘চলে এলি যে! কাজ শেষ?’
‘আজ যেতে ইচ্ছে করছে না।’
নিজের ঘরে ঢুকল লিটন। ওই তো খাঁচা। ঘরের কোনায় ঠিকঠাকমতোই আছে। বিড়ালটাও খাঁচার ভেতর বুকে মুখ লুকিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে।
খাঁচার কাছে গিয়ে হালকা একটা শিস বাজাল লিটন। কিন্তু কোনো সাড়া মিলল না। আবারও শিস বাজাল। পরপর দুবার। নাহ্। তবু সাড়া মিলল না।
এবার হাঁক দিল লিটন, ‘চিংইয়া!’
আর অমনি আলতো একটা মোচড় দিল বিড়ালটা। বুকের ভেতর থেকে মুখ বের করল। নীল আর হলুদ চোখ দুটো কয়েকবার পিটপিট করে তাকাল লিটনের দিকে। তারপর গরগর করে উঠল কাইমো বিড়ালটা, ‘ইঁ-য়া-ও!’
পরদিন সকাল। অ্যাপার্টমেন্টের সদর দরজা দিয়ে বেরোতে গিয়েই থমকে গেল লিটন। সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা চিংইয়া দাঁড়িয়ে আছে ঠিক ওর সামনে আধা হাত দূরত্বে।
‘আরে লিটন চাব! কোতায় যাচেন?’
বিরক্ত হলো লিটন। জবাব দিল না। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইল। কিন্তু যেতে পারল না। খপ করে লোকটার বাঁ হাতের আঙুলের নখগুলো ওর ডান হাতটা খামচে ধরেছে। লোকটার হাতের নখগুলো বেশ ধারালো। ব্যথা পাচ্ছে লিটন।
আর্তনাদ করে উঠল লিটন, ‘উফ্! হাত ছাড়ুন!’
বলেই লোকটার চোখের দিকে তাকাল লিটন। আর তাকিয়ে চমকে উঠল। একটা চোখ নীল, আরেকটা হলুদ।
এ কী করে সম্ভব! গতকালও তো লোকটার চোখ দুটো অমন ছিল না। তাহলে! নীল আর হলুদ চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে। লোকটার ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল, ‘আমার বিড়াল ফেরত চাই! একুনি!’
ঘাবড়ে গেল লিটন। ঢোঁক গিলল কয়েকবার। সাহায্যের আশায় আশপাশে তাকাল।
আবারও আর্তনাদ করে উঠল লিটন, ‘ছাড়ুন! নইলে লোকজন ডাকব।’
তবু লিটনের হাত ছাড়ল না লোকটা। উল্টো আরও জোরে চেপে ধরল। বলল, ‘আমার আত্মা ওই বিড়াল। আমার আত্মা আমাকে ফেরত দাও। নইলে...’
লোকটা পুরো কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই অ্যাপার্টমেন্টের কেয়ারটেকার নাহিদ আঙ্কেলের ভারী কণ্ঠ ভেসে এল, ‘কী হয়েছে লিটন?’
জবাব দিল লোকটা, ‘এই ছেলে আমার বিড়াল ফেরত দিতে চাইচে না।’
লিটন আপত্তি জানাল, ‘ওটা আমার বিড়াল। আমি বান্দরবান থেকে কিনে এনেছি।’
নাহিদ আঙ্কেল লোকটির দিকে তাকালেন। জানতে চাইলেন, ‘কে আপনি?’
গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল লোকটা, ‘বিড়ালাত্মা।’
লোকটার কথা বুঝতে পারেননি নাহিদ আঙ্কেল। বললেন, ‘আপনি যে-ই হোন না কেন, ওর হাত ছাড়ুন।’
‘আমার বিড়াল ফেরত না পেলে চাড়ব না।’
লিটনের হাতে নখের চাপ আরও বাড়িয়ে দিল লোকটা।
নাহিদ আঙ্কেল লোকটার বাঁ হতের কবজি চেপে ধরলেন। রাগী গলায় বললেন, ‘বলেছি ওর হাত ছেড়ে দিন। আর এখান থেকে চলে যান।’
‘কিন্তু আমার বিড়াল?’
‘আগামীকাল আসেন।’
‘আগামীকাল কেন?’
‘আগামীকাল ছুটির দিন। ওর বাবা বাসায় থাকবেন। আমি জানিয়ে রাখব। এখন কোনো ঝামেলা করবেন না।’
সত্যিই আর কোনো ঝামেলা করল না লোকটি। চট করে লিটনের হাত ছেড়ে দিল। ঝটকা মেরে নিজের হাতটাও ছাড়িয়ে নিল। তারপর ঘুরে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করল। একটা কথাও বলল না।
লিটন চেঁচিয়ে বলল, ‘লাভ হবে না। আমার বিড়াল আমি কাউকে দেব না।’
নিজের হাতের দিকে তাকাল লিটন। পাঁচটা নখের দাগ ওর হাতে। দাগগুলোয় রক্ত জমাট বেঁধে আছে।
নাহিদ আঙ্কেলও ওর হাতের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘ইশ্, আরেকটু হলেই রক্ত বেরিয়ে যেত। যাও, ঘরে গিয়ে কিছু একটা করো।’
আজও ওকে চটজলদি ফিরতে দেখে অবাক হলেন মা। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। ততক্ষণে ওর হাতের দিকে মায়ের চোখ পড়েছে। আর চোখ পড়তেই বললেন, ‘কীভাবে হলো? বিড়ালের খামচি খেয়েছিস? কেন যে ওই বুনো বিড়াল ঘরে এনেছিস, বুঝি না। চুপ করে বসে থাক। আমি গরম পানি আর সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে দিচ্ছি।’
হাত ধোয়া শেষে নিজের ঘরে এল লিটন। খাঁচার দিকে তাকাল। সব সময়কার মতোই বুকের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে কাত হয়ে শুয়ে আছে বিড়ালটা। কয়েকবার শিস বাজাল লিটন। বিড়ালটা সাড়া দিল না।
তারপর কোমল স্বরে ডাকল লিটন, ‘চিংইয়া!’
ডাক শুনেই মুখ তুলল চিংইয়া। চোখ দুটো পিটপিট করে তাকাল। চিংইয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে গেল লিটন। নীল আর হলুদ নয়, কুচকুচে কালো চোখ মেলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে বিড়ালটা।
তারপর কয়েকবার পিটপিট করে গরগর করে উঠল, ‘ইঁ-য়া-ও!’