তিন কিশোরের দুঃসাহসী অভিযান

অলংকরণ: তুলি

আমার নাম বাদল। আমার নিজের নাম আমার কাছে ভালো লাগে না! আমি আম্মাকে বলি, ‘আম্মা, আমার নামটা কে রেখেছে?’

আম্মা রান্নাঘর থেকে আঁচলে মুখ মুছছেন, রান্নাঘরের ধোঁয়ায় তাঁর চোখ লাল, কপালে ঘাম! আম্মার আঁচল থেকে মুরগির ঝোলের মসলাদার গন্ধ আসছে। আম্মা বলেন, ‘তোর ছোট খালা রেখেছে। সে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এমএ করছে কিনা! খুব সুন্দর না নামটা?’

আমি বলি, ‘সুন্দর না!’

আম্মা বিস্মিত হন! বলেন, ‘সুন্দর না মানে! বাদল! কী সুন্দর বাংলা নাম!’

আমি বলি, ‘আম্মা! ক্লাসের ছেলেরা আমাকে খেপায় বাঁদর বলে!’

আম্মা বলেন, ‘তোর ক্লাসের ছেলেগুলো বাঁদর। তাই তারা তোকে এই রকম কথা বলতে পারে!’

শুনে আমার চেয়ে দুই ক্লাস নিচে ক্লাস সেভেনে পড়া বোন বন্যা হি হি করে হেসে ওঠে। বলে, ‘ভাইয়া, তোমার ক্লাসের ছেলেরা যদি বাঁদর হয়, তোমার পক্ষে তার চেয়ে উত্তম কিছু হওয়া একেবারেই অসম্ভব।’

বন্যা সারাক্ষণ বই পড়ে। তাই তার চোখে চশমা। রেডিও পাকিস্তান শোনে। আর মাঝেমধ্যে শোনে আকাশবাণী। আকাশবাণীতে ভালো ভালো নাটক হয়! সেদিন হলো রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা। আমিও ওর সঙ্গে বসে বসে শুনলাম। বই পড়ে পড়ে আর রেডিও শুনে শুনে বন্যার কথা বলার ভঙ্গি দাঁড়িয়েছে বইয়ের মতো।

ক্লাস ফাইভে পড়া তমাল একটা পত্রিকার কাগজ কেটে ঘুড়ি বানাচ্ছিল। ভাতের আঠা আর ঝাঁটার কাঠি তার ঘুড়ি বানানোর উপকরণ। সে বলল, ‘আম্মা, আমার নামটা কে রেখেছে?’

আম্মা বললেন, ‘কেন, তোর কী সমস্যা?’

‘আমাকেও আমার বন্ধুরা খেপায়।’ তমাল ঘুড়ির আঠা লাগাতে লাগাতে বলল!

বন্যা বলল, ‘তমাল, তোকে কী বলে খেপায় রে?’

তমাল বলল, ‘সেটা আমি তোমাদের সামনে বলতে পারব না।’

আম্মা বললেন, ‘আজকালকার ছেলেপুলেরা এত পাজি কেন!’

আম্মা ওই ঘরে যেতেই তমাল আমার কাছে এসে কানে কানে বলল, ‘আমাকে কী বলে জানো ভাইয়া! ত-ত-ত-মাল-মাল-মাল!’

বন্যা বলল, ‘এই, তোরা কানে কানে কী বলিস রে?’

আমি বললাম, ‘বন্যা, তোর আর এসব শুনে কাজ নাই! যা, তুই রেডিও শোন। রেডিওতে কথিকা শোন মন দিয়ে!’

বন্যা বলল, ‘রেডিও তো শুনবই।’

এই সময় বাইরে মিছিলের স্লোগান শোনা যেতে লাগল। আমরা তিন ভাইবোনই দৌড়ে বারান্দায় গেলাম। আমাদের বাসা চানখাঁরপুলে। বড় রাস্তার ওপরে। রাস্তার উল্টো পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজ আর হাসপাতাল। আমাদের আব্বা মেডিকেল হাসপাতালে অ্যাডমিনস্ট্রেশনে কাজ করেন। সেই সূত্রে আমরা এই সরকারি কোয়ার্টারে থাকি।

মাঝারি আকারের একটা মিছিল। লুঙ্গিপরা লোক বেশি। অনেকেরই হাতে লাঠি। অনেকের পায়ে জুতা-স্যান্ডেল নেই। তারা স্লোগান দিচ্ছে:

ভুট্টোর পেটে লাথি মারো

বাংলাদেশ স্বাধীন করো।

বাঁশের লাঠি তৈরি করো

বাংলাদেশ স্বাধীন করো।

তোমার আমার ঠিকানা

পদ্মা মেঘনা যমুনা।

শেখ মুজিবের পথ ধরো

বাংলাদেশ স্বাধীন করো।

জয় বাংলা

জয় বাংলা।

তমাল বলল, ‘ভাইয়া, চলো, মিছিলে যাই।’

বন্যা বলল, ‘আমিও যাব। চলো।’

আমি প্রমাদ গুনলাম। আমি আর তমাল মিছিলে যেতেই পারি। কিন্তু বন্যা যদি যায়, একটু পরে আম্মা টের পেয়ে যাবেন। তাঁর তিন ছেলেমেয়ের কেউ বাসায় নেই, কোথায় গেল তারা, এই নিয়ে চিন্তা করতে করতে তিনি হঠাৎ করে ফিটও হয়ে যেতে পারেন। তাঁর ফিটের ব্যামো আছে।

ছোট খালা অবশ্য বলেন, ‘আপার মোটেও ফিটের ব্যামো নাই। যখন কোনো অসুবিধাজনক পরিস্থিতিতে তিনি পড়েন, অমনি অজ্ঞান হওয়ার ভান করেন। এতে খুবই লাভ হয়। সবাই তাঁর চোখে–মুখে পানির ছিটা দেয়। তাঁর অসুস্থতা নিয়েই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আসল ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে যায়। ঠিক যেন টিকটিকির লেজ। তুই যদি টিকটিকিকে তাড়া করিস, টিকটিকি লেজ খসিয়ে ফেলে। সেই খসে পড়া লেজটা আবার লাফাতেও থাকে। তুই টিকটিকির লেজ নিয়ে ব্যস্ত থাকবি। আর টিকটিকি পালিয়ে যাবে।’

ছোট খালা এখন বাসায় নেই। আমাদের নানাবাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুরে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস হচ্ছে না। শুধু আন্দোলন হচ্ছে। তিনি তাই ঢাকা ছেড়েছেন। তা নাহলে ছোট খালা আমাদের বাসায় থেকেই ক্লাস করেন। তাঁর ডাকনাম রিনি। তাঁরও তার নাম পছন্দ নয়। তিনি বলেন, রিনি শব্দটা ঋণীর মতো শোনায়। আমি আবার কার কাছে কী ঋণ করলাম।

আমাদের আম্মার নাম রানী। আম্মা যখন দুপুরবেলা রান্নাবান্না সেরে গোসল সেরে ভেজা চুলে গামছা পেঁচিয়ে একটা ধোয়া কমলা রঙের শাড়ি পরে বের হন, আমার তাঁকে রানীর মতোই লাগে। আমাদের নামগুলোর মধ্যে আম্মার নামটাই সবচেয়ে সুন্দর।

মিছিলটা দূরে চলে গেল। স্লোগান আস্তে আস্তে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা নিজেরাই স্লোগান দিতে লাগলাম:

বাঁশের লাঠি তৈরি করো

বাংলাদেশ স্বাধীন করো।

আমাদের বাসা দোতলায়। বারান্দা থেকে নিচের দোকানঘরটা দেখা যাচ্ছে। ওই দোকান আবদুল বারেক চাচার। বারেক চাচার ছেলে বাবু আমার সমবয়সী। সে এই দোকানেই কাজ করে। এই দোকানে মুড়িমুড়কি, বিস্কুট-চানাচুর, নানা রকমের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায়। মুদির দোকান আরকি! মুদির দোকান কথাটার মানে আমি জানি না। ছোট খালা ঢাকায় এলে তাঁকে জিজ্ঞেস করতে হবে। মুদিদোকান মানে কী?

বাবুকে দেখা যাচ্ছে একটা বিড়ালছানা কোলে করে রাস্তার ধারে ফুটপাতে বসে আছে। বাবু বিড়ালছানা পেল কোথায়?

আমি দোতলার বারান্দা থেকে চিৎকার করে উঠলাম, ‘বাবু...বাবু...!’

বাবু বলল, ‘বাদল ভাই, আইয়া পড়েন। বিলাইয়ের বাচ্চাটারে ইংলিশ শিখাইতে হইব।’

শুনে তমাল আর বন্যা হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগল।

আমি বললাম, ‘আমি নিচে যাচ্ছি। আম্মা বলেছিলেন, কেরোসিন শেষ হয়ে গেছে। যাই, আট আনার কেরোসিন তেল কিনে আনছি।’

তমাল বলল, ‘ভাইয়া, তুমি বিড়ালটাকে ইংলিশ শেখাতে যাচ্ছ। কেরোসিন আনতে হবে না। কারণ, আমি একটু আগে কেরোসিন নিয়ে এসেছি।’

‘ভেরি গুড।’ বললাম আমি। ‘তাহলে আমি ইংলিশ ক্লাস নিতেই যাচ্ছি।’

আমি দরজার কাছে যেতেই আম্মা দেখে ফেললেন। বললেন, ‘বাদল, এখন কই যাস? ভাত রান্না হয়ে গেছে। গোসল করে খেতে বস।’

আম্মা, গোসল করব। সাবান নাই। যাই, নিচ থেকে একটা লাইফবয় সাবান কিনে আনি।’

‘সাবান তো আছে একটুখানি।’

‘ক্ষয় হয়ে শেষ হয়ে গেছে। ওটা দিয়ে আর গোসল করা যাবে না। লাগবে সাবান।’

‘এখন তো আমার কাছে সাবান কেনার টাকা নাই।’

‘বাবুর কাছ থেকে এখন সাবান আনি।’ কাঁধটা ঝাঁকিয়ে বললাম আমি। ‘আব্বার কাছ থেকে টাকা নিয়ে পরে দাম দেব?’

‘বাকিতে কেনাকাটা করা ঠিক না।’

বন্যা কাছেই ছিল। বলল, ‘যদি চান ভালোবাসা, না করিবেন বাকির আশা, বাকি দেওয়া বড় কষ্ট, বাকিতে বন্ধুত্ব নষ্ট।’

বন্যাটা যে কী না। সবকিছুতে ফোড়ন কাটা ওর স্বভাব। আমি বললাম, ‘আমার সাথে বাবুর বন্ধুত্ব নষ্ট হবে না।’

কথা আর বাড়তে না দিয়ে দরজা খুলে আমি নিচে নেমে গেলাম।

মার্চের দুপুর। বেশ গরম পড়েছে। সূর্য দক্ষিণ আকাশে, পশ্চিমে হেলে পড়েছে সামান্য। ফুটপাতের ওপরে একটা শিরীষগাছের ছায়া আলপনার মতো পড়ে আছে, সেখানে বসে আছে বাবু। ওর গায়ে একটা মলিন স্যান্ডো গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি। আমার পরনে হাফপ্যান্ট। ক্লাস নাইনে যদিও পড়ি, তবু গায়ে-গতরে যথেষ্ট বড় হইনি।

আমি বললাম, ‘বিড়ালের বাচ্চা কই পেলি, বাবু?’

‘বাদল ভাই, জানি না।’ বলল বাবু। ‘সকালবেলায় দেখি দোকানের বাইরে মিউ মিউ আওয়াজ। বাইরায়া দেখি বিলাইয়ের বাচ্চা। তারে জিগাই তোর বাড়ি কই? সে কয় মিউ। কী মুশকিল। আমার মনে অয় জন্তুজানোয়ারেরা ইংরাজি ছাড়া বুঝে না। ওই যে মিয়াবাড়ির কুকুরটারে মাঝেমধ্যে বাইরে আনে, তহন দেহি, অরা অর লগে ইংরাজিতে কথা কয়। গো, গো, রান, রান। আপনে এট্টু এরে ইংলিশে জিগান তো এর বাড়ি কই?’

আমি হাসি। বলি, ‘হেই বিল্লি, তোমার বাড়ি কি দিল্লি?’

বিড়ালের বাচ্চা কান নাড়ে। তারপর আরাম করে চোখ বন্ধ করে এলিয়ে পড়ে বাবুর কোলে।

বাবু বলে, ‘জিগান না ইংরাজিতে! বাড়ি কই?’

‘হোয়ার আর ইউ ফ্রম?’ বললাম আমি। ‘হোয়ার ডু ইউ লিভ? হোয়াট ইজ ইয়োর অ্যাড্রেস!’

বিড়াল কোনো কথা বলে না।

বাবু বলে, ‘বল, জয় বাংলা।’

বিড়ালছানা তা–ও বলে না।

‘এরে এখন কী খাইতে দেই?’ জিজ্ঞেস করল বাবু। ‘আপনাগো বাড়ি কি আইজকা মাছ পাক হইছে?’

‘না তো। মুরগির মাংস রান্না হয়েছে বলে মনে হলো।’

‘মাছের কাঁটা খিলামু হেরে। বকশীবাজারের হোটেল থাইকা মাছের কাঁটা আনন লাগব।’

বাবুর আব্বা দোকান থেকে চিৎকার করেন, ‘ওই বাবু। কই গেলি?’

‘জি আব্বা। আছি তো।’

‘দোকানে কাম নাই?’

‘কী কাম? দোকানে তো কাস্টমার নাই।’

‘কাস্টমার থাকব কেমনে? সব কাস্টমার তো মিছিলে গেছে গা।’

‘আমিও মিছিলে যামু।’

‘না। তুই যাবি না। তুই দোকান পাহারা দিবি। আমি যামু।’

‘কই যাইবেন?’

‘ক্যান। মিছিলে?’

‘আপনি ক্যান যাইবেন? আমি যাই। আপনি মুরুব্বি মানুষ। আপনে দোকানদারি করেন।’

‘তুই পোলাপান। তুই ক্যান যাবি? মুরুব্বিগো দায়িত্ব বেশি। দ্যাশ স্বাধীন করন লাগব। তুই কি এই কাম পারবি?’

‘হ। পারুম। আমি যুদ্ধে যামু। ইকবাল হলের মাঠে রাইফেল কান্ধে কইরা ছাত্ররা ট্রেনিং লইতাছে। আমি তাগো লগে যামু। আপনেরে লইব না। বুড়া গো কেউ লয় না।’

‘আমি বুড়া না।’

‘আচ্ছা, তাইলে দুইজনে এক লগে যামু। অহন এই বিলাইয়ের বাচ্চাটারে লইয়া কী করি?’

‘আমাকে দাও।’ বললাম আমি। ‘বাসায় দুধ আছে। আমি দুধ খেতে দিতে পারব। যদি ভাত খায়, ভাতও দিতে পারব।’

‘ঠিক আছে, বাদল ভাই। আপনে বিলাইয়ের বাচ্চাটারে রাখেন খানিকক্ষণ। আমি আর আব্বা একটু দেশের ভাও বুইঝা আহি।’

‘ওই বাবু!’ বললেন বাবুর বাবা। ‘দুপুরে খামু কী?’

‘চানখাঁরপুলের ফুটপাতের হোটেল কি আর বন্ধ হইছে নাকি? লন। আগে খাইয়া লই। তারপর বাইরাই।’

‌বাবু বিড়ালছানাটাকে আমার কোলে তুলে দিল। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বাসায় ঢুকলাম। তমাল আর বন্যা মহাখুশি। আমরা বিড়াল পুষব।

আম্মা এলেন। বললেন, ‘বিড়াল যখন বাথরুম করবে, সেটা কে পরিষ্কার করবে শুনি।’

বন্যা বলল, ‘আমি।’

‘বিড়াল পুষতে হলে এটাকে ইনজেকশন দিয়ে আনতে হবে। তা না হলে ডিফথেরিয়া অসুখ হবে।’

আমি বললাম, ‘আম্মা, পুষব না। এখন খানিকক্ষণ রাখব। বাবু আর বাবুর আব্বা মিছিলে যাচ্ছে দোকান বন্ধ করে। ওনারা ফিরে এলে আবার আমি এটাকে বাবুর কাছে দিয়ে আসব। এখন একটু দুধ খাওয়াতে হবে। বিড়ালের বাচ্চা তো দুধ খেতে পছন্দ করে বলেই জানি।’

বন্যা এরই মধ্যে একটা বাটিতে করে দুধ নিয়ে এসেছে। আমি বিড়ালের বাচ্চাটাকে মেঝেতে নামিয়ে রাখলাম।

বন্যা বলল, ‘খাও।’

‘ড্রিংক ড্রিংক।’ বলল তমাল।

বিড়ালের বাচ্চা বলল, ‘মিউ।’

এর মধ্যে আবারও মিছিলের শব্দ। মিছিল এলেই আমাদের কাজ বারান্দায় যাওয়া। আমারও খুব মিছিলে যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু আম্মা বলে রেখেছেন, ‘খবরদার, মিছিলে যাওয়া চলবে না।’ আব্বা বলে রেখেছেন, ‘পলিটিকস অবশ্যই সবাইকেই করতে হয়। ১৮ বছর আগে হতে হবে। ভোটার লিস্টে নাম উঠতে হবে। তা না হলে পলিটিকস করা যাবে না।’

ছোট খালা থাকলে অবশ্যই তর্ক করতেন। বলতেন, ‘দুলাভাই, এটা পলিটিকস না। দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম। এখানে ছোট–বড় সবাই অংশ নেবে।’ এখন ছোট খালা এ বাসায় নেই। ছোটদের হয়ে লড়ার মতো কেউ নেই।

এবারের মিছিলটা আরও বড়। সবার হাতে লাঠি। কোনো লাঠির মাথায় কালো পতাকা। কোনো লাঠির মাথায় বাংলাদেশের লাল–সবুজ–হলুদ পতাকা।

এই পতাকা আমরাও আমাদের বাসার বারান্দায় একটা বাঁশের সঙ্গে টানিয়ে রেখেছি। জয় বাংলা। স্বাধীন বাংলা।

মিছিলে বাবু আর বাবুর আব্বা ঢুকে পড়ল। আমরা দোতলা থেকে দেখছি। মিছিলের স্লোগানের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাচ্ছি।

আপস না সংগ্রাম,

সংগ্রাম সংগ্রাম।

ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করো

বাংলাদেশ স্বাধীন করো।

বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো,

বাংলাদেশ স্বাধীন করো।

আব্বা বাসায় এলেন বিকেল পাঁচটায়। হাসপাতালের চাকরি। তাকে কাজে যেতেই হয়। আমাদের কোয়ার্টারের তিনতলায় থাকে মাহবুব। তার লেবু মামা চাকরি করেন একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে। লেবু মামা অফিসে যান না। তিনি আমাদের সঙ্গে ক্যারম খেলেন। মাহবুবদের বাইরের ঘরে ক্যারম বোর্ড পাতাই থাকে। আমি, মাহবুব, লেবু মামা খেলি। মাহবুবের ছোট বোন মণি। ক্লাস সেভেনে পড়ে। সে ক্যারম ভালো খেলে না। তাকে কেউ খেলায় নিতে চায় না। কারণ, মণি যে দলে খেলবে, সেই দল নিল–গেম খাবে। মণির একটা পা ছোট। সে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে। অন্যরা তাকে লেংড়ি বলে ডাকে। মণির জন্য আমার মন খারাপ হয়। আমার ইচ্ছা করে বলি, মণি, তুমি আমার দলে এসো। আমি তোমাকে নিয়ে রোজ পাঁচটা করে নিল-গেম খাব। কিন্তু তা বলা হয় না। এই সব কথা কেবল মনে মনে বলা যায়।

আব্বা এসে তার শার্টটা খুলে আলনায় ঝোলালেন। তার গায়ে এখন একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। এই গেঞ্জিটার নাম স্যান্ডো কেন? আমাদের ক্লাস ফোরের বাংলা বইয়ে একটা লেখা ছিল, বাঁচার মতো বাঁচা। সেখানে একজন রোগা ছেলে রাজপথে বেহালা বাজাত। সবাই তাকে উপহাস করত। শেষে সে রোজ ব্যায়াম করতে শুরু করল। সে হলো বিশাল ব্যায়ামবীর স্যান্ডো। সেই স্যান্ডোর নাম থেকে স্যান্ডো গেঞ্জির নাম দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।

আব্বা বললেন, ‘দেশের পরিস্থিতি ভালো না।’

আম্মা এগিয়ে এলেন। তার হাতে একটা তালপাতার পাখা। বাসায় ইলেকট্রিসিটি একটু আগে চলে গেছে। কারেন্ট শুধু যাওয়া-আসা করছে। মার্চের গরম। চৈত্র মাস। বাড়ির পেছনের আমগাছটায় মুকুল ধরেছে। তাতে ভ্রমর সত্যি গুঞ্জন তোলে। আমি শোবার ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে ভ্রমরের গুনগুন শুনি, আর আমের বনে ফাগুনের গন্ধে পাগলপারা হই।

আব্বা লুঙ্গি পরতে পরতে বললেন, ‘কী হবে, কিছু বলা যাচ্ছে না। বাদল, এদিকে আসো।’

আমি আব্বার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।

আব্বা বললেন, ‘মনে হচ্ছে, আলোচনা ভেঙে যাচ্ছে। যেকোনো সময় যুদ্ধ শুরু হবে। তুমি কিন্তু বাড়ির বাইরে যাবে না।’

‘জি আব্বা।’

‘জি আব্বা মানে কী?’

‘বাড়ির বাইরে যাব না।’ মাথা চুলকে বললাম আমি।

‘আমরা হাসপাতালের পাশে থাকি। পাকিস্তানি মিলিটারিরা হাসপাতালে হামলা করবে না। দেখা যাক কী হয়!’

আম্মা বললেন, ‘শেখ সাহেব কী বলছেন? অর্ডার দিক না। পাবলিক গিয়ে ক্যান্টনমেন্ট দখল করে ফেলুক।’

‘বাঁশের লাঠি নিয়ে ট্যাংক-কামানের সামনে যাবে?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন আব্বা।

‘তাহলে কী হবে?’

‘দেখা যাক। শেখ মুজিব বলে দিয়েছেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। স্বাধীনতা আসবেই...’

আমি বললাম, ‘আমি তিনতলায় যাচ্ছি।’

আম্মা বললেন, ‘কেন?’

‘লেবু মামা আছে। তার কাছে দেশ-বিদেশের খবর থাকে। দেখি কোনো খবর পাওয়া যায় কি না।’

তিনতলায় লেবু মামাকে পাওয়া গেল। মাহবুবের সঙ্গে তিনি সিঙ্গেল ক্যারম খেলছেন। পশ্চিমের জানালা দিয়ে লাল রঙের একফালি রোদ এসে ক্যারম বোর্ডের ওপরে পড়েছে।

বাইরের দরজা খোলাই ছিল। আমি ভেতরে ঢুকতেই কারেন্ট চলে এল। মাথার ওপর বাতি জ্বলে উঠল। ফ্যানও ঘুরতে শুরু করল। মনে হচ্ছে ব্রিটিশ আমলের ফ্যান। হোয়াই হোয়াট হোয়াই হোয়াট করে আওয়াজ করছে।

লেবু মামা বললেন, ‘এই তো বাদল এসে গেছে। সিঙ্গেল ম্যাচ খেলা জমছে না। ম্যাচ খেলতে হয় ডাবলস। বাদল, যা, তোর পার্টনারকে ডেকে আন।’

আমার মন বলল, যাই মণিকে ডেকে আনি।

কিন্তু মুখে সেটা বলতে পারলাম না। আমি বারান্দায় গেলাম। চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম, ‘বাবু, বাবু...’

বাবু দোকান থেকে মাথা বের করে বলল, ‘বাদল ভাইয়া, ডাকেন কেন?’

‘বাবু, লেবু মামা তোকে ডাকে। তোর দোকানের বাকি আজকেই শোধ করে দিবে। তুই ওপরে আয়।’

বাবু একগাল হাসি হেসে হাত নাড়ল।

এই বুদ্ধিটা ভালো হয়েছে।

লেবু মামা বললেন, ‘এই বাদল, আমি বাকির টাকা শোধ করব, তোকে কে বলল!’

আমি বললাম, ‘আপনার বুক পকেটে ১০ টাকার নোট বাইরে থেকে চকচক করছে। আপনি যে বেতন পেয়েছেন, তা বোঝাই যাচ্ছে।’

লেবু মামা এমন সুন্দর করে হাসলেন যে সমস্ত ঘরটাই যেন স্নিগ্ধতায় ভরে গেল। বললেন, ‘হ্যাঁ। অফিস করি না, তাতে কী। বেতন দিয়েছে। শেখ সাহেব এক ধমক দিয়েছেন, আর যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে...অমনি কাজ হয়ে গেছে...’

বাবু কড়া নাড়ল। মাহবুব বলল, ‘দরজা খোলা আছে, ভেতরে আয়।’

বাবু ভেতরে এল। লেবু মামার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মামা, বাকির টাকা আগে দিয়া লন। তারপর আসেন দুই বোর্ড খেলি...’

মামা এবার তার মানিব্যাগ বের করলেন প্যান্টের পকেট থেকে। দুটো ১০ টাকা দিয়ে বললেন, ‘এখন এটা রেখে দে। বাকি তো শোধ হলোই, কিছু অ্যাডভান্স পেমেন্টও হয়ে গেল। নে। আমি আর মাহবুব, বাদল আর বাবু। দেখি কে জেতে!’

আমরা হেরে যাচ্ছি। আমাদের পয়েন্ট ৬। মাহবুবদের ২২। আর একটা বোর্ড ওরা যদি পেয়ে যায়, তাহলেই আমরা গেম খেয়ে যাব।

এই সময় মণি এল। মণির গায়ে একটা নীল রঙের ফ্রক। হাতে একটা ট্রে। ট্রেতে চার কাপ চা। একটা পিরিচে গোল গোল নাবিস্কো ক্রিম বিস্কুট। নাবিস্কো ক্রিম বিস্কুট আমার সবচেয়ে প্রিয়।

মণি বলল, ‘কে জিতছে?’

মাহবুব বলল, ‘কে আবার। আমরা।’

লেবু মামা বললেন, ‘মামা-ভাগনে যেখানে, আপদ নাই সেখানে।’

‘বাদল ভাই, খেলায় মন দেন।’ বলল মনি। ‘ভালো করে খেলেন।’

‘হ্যাঁ।’ জবাব দিলাম। ‘ভালো করে খেলতে হবে। বাবু, ভালো করে খেল।’

‘ভালো কইরা কী খেলুম?’ বলল বাবু। ‘আইজকা শেখ সাহেবরে দেইখা আইছি। আমার রোম খাড়া হইয়া যাইতাছে।’

আমরা একসঙ্গে বলে উঠলাম, ‘শেখ সাহেবরে দেখেছিস? কোথায়?’

‘৩২ নম্বর বাড়িতে গেছিলাম। শেখ সাহেব একটা লুঙ্গি পইরা হ্যান্ডমাইক নিয়া গেটের সামনে ভাষণ দিলেন। কইলেন, স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছু বুঝি না। বিদেশি সাহেব আছিল। ক্যামেরা আছিল। তাগো ইংরাজিতে কী কী কইলেন। আমি তো বুঝি না। একজনরে জিগাইলাম, চাচা, বঙ্গবন্ধু কী কইলেন? তখন ওই লোক আমারে কইল, কইলেন বাংলা স্বাধীন করবেন। বিদেশি সাংবাদিক কইছে, কেমনে করবেন, ট্যাংক–কামান দিয়া মিলিটারি আইব। তখন বঙ্গবন্ধু কইলেন, মিলিটারি আমার কী করব, সাড়ে সাত কুটি মানুষের লগে মিলিটারি পারব, পৃথিবীর কোনো শক্তি নাই মানুষের সাথে পারব!’

লেবু মামা বললেন, ‘বুঝেছিস রে বাদল, মাহবুব, দ্য স্ট্রেংথ অ্যান্ড উইকনেস অব আ মিডল ক্লাস লিডার...উনি জানেন পিপলের শক্তি...কিন্তু উনি গেরিলা যুদ্ধে চলে যাচ্ছেন না...তার উচিত ছিল সুন্দরবনে চলে যাওয়া...ওখানে গিয়ে গেরিলা আর্মি ফর্ম করে লড়াই পরিচালনা করা...মাও সে–তুং বলেছেন...’

আমার ভীষণ রাগ হলো লেবু মামার ওপরে। অফিস করেন না। বেতন আনেন। মিছিলে যান না। খালি কতগুলো বই পড়েন। এখন উনি আবার গেছেন বইয়ের শেলফের কাছে। মনে হয় একটা লাল বই বের করবেন। মাও সে–তুং আসলে কী বলেছেন, কোটেশনটা খুঁজবেন। লেবু মামা বললেন, ‘মাও সে–তুং বলেছেন, বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস।’

মাহবুব বলল, ‘মামা, তাহলে ইয়াহিয়া খানের বন্দুক আছে। তার সাথে আমরা পারব না।’

‘পারতে হলে হাতে বন্দুক নিতে হবে। বাঁশের লাঠি দিয়ে হবেটবে না।’

আমি বললাম, ‘বাবু, ভালো করে খেল। এই লোকটারে হারাতে হবে।’

বাবু বলল, ‘জয় বাংলা।’

জয় বাংলা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ওর হাত খুলে গেল। একটার পর একটা গুটি সে ফেলে দিতে লাগল। আমরা বোর্ড পেয়ে গেলাম। একবারে পেলাম ১১।

এবার আমার হিট। আমিও বললাম, জয় বাংলা...

খেলা জমে উঠল...

পরের বোর্ড আবার পেলাম আমরা। মণি দেখছে। আমার ভীষণ ভালো লাগছে। আমরা গেম দিয়ে দিলাম। চিৎকার করতে লাগলাম, জয় বাংলা। আমাদের দুজনের সাথে মণিও চিৎকার করছে, জয় বাংলা। মাহবুব গম্ভীর। একটু পরে সে–ও আমাদের সাথে লাফাতে লাগল: জয় বাংলা...

লেবু মামা গম্ভীর হয়ে গেলেন।

আমি আর তমাল এক বিছানায় ঘুমাই। পাশে একটা ছোট্ট চকিতে বন্যার বিছানা। আমরা রাত ১০টায় ঘুমুতে গেলাম। বেশ পরিশ্রান্ত ছিলাম। সন্ধ্যার পর ছাদে গিয়ে ইলেকট্রিক বাতির আলোয় ব্যাডমিন্টন খেলেছি। রাতের বেলায় বেশ জোরে জোরে গোলাগুলির আওয়াজ আসতে লাগল। আমাদের শোবার ঘর পেছনের দিকে। রাস্তার আওয়াজ এই ঘরে তেমন আসে না। তবু ঘুম ভেঙে গেলে আমি তমালকে জড়িয়ে ধরলাম। মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছিল। একটু একটু ঠান্ডা লাগছিল। কাঁথা দিয়ে মাথা-কান ঢেকে ঘুম দিয়েছি।

ঘুম ভাঙল সকালবেলা। তখন আর কোনো শব্দ নেই। রাতের বেলা যে বেশ গোলাগুলি হয়েছে, ভয়ে সে যে তমালকে জড়িয়ে ধরে ছিল, এটাও এখন তার মনে নেই। রাতে শোবার আগে আম্মা তাকে এক টাকার নোট দিয়ে বলেছিলেন, ‘বাবা বাদল, সকালবেলা রাস্তায় গিয়ে মাঠা কিনে আনিস তো!’

চানখাঁরপুলের উত্তরের দিকে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের মাঠের কোনায় খুব ভালো মাঠা সকাল সকাল বিক্রি হয়। আমি একটা জগ নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। রাস্তায় বেরিয়ে দেখতে পেলাম, চারদিক ফাঁকা। বাবুদের দোকানে গিয়ে দেখি দোকানের ঝাঁপ খোলা। আকাশ আংশিক মেঘলা, তবু রোদ উঠেছে আর পুবের আলোয় রাস্তার পশ্চিমে বাবুদের দোকানের ভেতরটার সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যা দেখলাম, তা না দেখাই ভালো ছিল। বাবু আর বাবুর আব্বা দোকানের পাটাতনে পড়ে আছে। রক্তে সারা পাটাতন থিকথিকে কালো হয়ে আছে। বাবুর আব্বার মুখটা হা করা। চোখ খোলা। গলায় গুলির জখম। আর কোথায় কোথায় গুলি লেগেছে কে জানে। বাবুর চোখ বন্ধ। ওর খালি গায়ে রক্তের দাগ। আমার বুক কাঁপছে। শরীরও। আমি বোধ হয় এখনই পড়ে যাব। আমি দোকানের খুঁটি ধরে দাঁড়ালাম। খানিকটা ধাতস্থ হলাম। কী করা উচিত, কিছুই বুঝছি না। দোকানের পাটাতনে উঠলাম।

কালো রক্তে পা দিতেই জমাট রক্তের নিচে তরল রক্ত আমার পায়ে লাগল।

আমি বাবুর আব্বার নাকের কাছে হাত রাখলাম। কোনো নিশ্বাস-প্রশ্বাসের লক্ষণ নেই। এবার আমি বাবুর নাকের কাছে হাত রাখলাম। মনে হলো, শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে। বুকে কান রাখলাম। রক্ত আমার কানে লাগল। হ্যাঁ। বুক ঢিপঢিপ করছে। বাবু বেঁচে আছে। বাঁ হাতে গুলি লেগেছে মনে হচ্ছে। অনেকটা মাংস উড়ে গেছে। বাবু বেঁচে আছে। ওকে হাসপাতালে নিতে হবে। রাস্তায় তাকালাম। কেউ নেই।

আমি মাঠা কিনতে সঙ্গে করে আনা জগটা নিয়ে আবার নামলাম রাস্তায়। পাশে পানির কল। ট্যাপ খুলে পানি ভরলাম জগে। আবার উঠলাম দোকানের মাচায়। বাবুর চোখে-মুখে পানি ছিটাতে লাগলাম।

বাবু আস্তে আস্তে চোখ খুলল।

আমি বললাম, ‘বাবু বাবু। আমি বাদল।’

‘গুলি লাগছে।’ বলল বাবু। ‘হাতে খুব বেদনা। আমারে হসপিটালে লইতে হইব বাদল ভাই।’

‘আচ্ছা, আমি ব্যবস্থা করছি।’

‘আব্বা কই? মইরা গেছে?’

আমি কী জবাব দেব? বললাম, ‘ওই যে তোমার পাশে শুয়ে আছে। তুমি আরেকটু শুয়ে থাকো। আমি দেখি অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে পারি কি না।’

অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে। আমাদের বাসায় ফোন নেই। মাহবুবদের বাসায় আছে। আমি দৌড়ে আমাদের বিল্ডিংয়ে গেলাম। লাফিয়ে লাফিয়ে পার হলাম সিঁড়িগুলো। সোজা চলে গেলাম মাহবুবদের বাসায়। জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিতে লাগলাম। ভেতর থেকে লেবু মামার ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘কে?’

‘আমি বাদল। দরজা খুলুন। খুব দরকার।’

দরজা খুললেন লেবু মামাই। তিনি বললেন, ‘আবার গুলি হচ্ছে। শোনো। শব্দ আসছে। তাড়াতাড়ি মেঝেতে শুয়ে পড়ো।’

‘বাবুর আব্বা মারা গেছেন। বাবুর গুলি লেগেছে। ও দোকানে পড়ে আছে। অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে। ফোন করব।’

ফোনের কাছে ছুটে গেলাম। মাহবুব এসে আমার পাশে দাঁড়াল। আমি এক্সচেঞ্জে ফোন করলাম। কেউ ফোন ধরল না। তিন–চারবার রিং হলো। কেউ ফোন ধরল না।

আমি বললাম, ‘মামা চলেন। বাবুকে হসপিটালে নিতে হবে।’

লেবু মামা সোফার আড়ালে মেঝেতে শুয়ে আছেন। তিনি বললেন, ‘মাথা খারাপ। বাইরে মিলিটারি পাগলা কুত্তার মতো গুলি করছে।’

আমি বললাম, ‘মাহবুব, চল, বাবুকে ধরে ধরে হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাই।’

‘চল।’ বলল।

আমরা দুজন হাফপ্যান্ট পরা ছেলে, কারও আদেশ-নিষেধের অপেক্ষা না করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে গেলাম। বাবুদের দোকানে গেলাম। বাবুকে দুজনে ধরে তার দুই হাত আমাদের দুজনের কাঁধে দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। বাবু ভীষণ ব্যথায় কাতরাচ্ছে। সে বলল, ‘আব্বারে হসপিটালে নিবেন না বাদল ভাই?’

‘তোমাকে আগে ইমার্জেন্সি পর্যন্ত নিই। তারপর তোমার আব্বাকেও নেব।’ বাবুকে আমি বলতে পারলাম না যে তার আব্বা মারা গেছে।

বাবু আর হাঁটতে পারছে না। এই সময় স্বর্গ থেকে যেন একজন দেবদূত চলে এলেন সোনার রথ নিয়ে। একজন সুইপার। তিনি একটা সুইপার ভ্যান ঠেলছেন। দুই চাকার এই যানটায় ময়লা তুলে তিনি পেছন থেকে ঠেলেন। আমরা তাকে বললাম, ‘চাচা, আমাদের বন্ধুর গায়ে গুলি লেগেছে। ওকে এই ইমার্জেন্সিতে একটু নেব।’

‘আমার ভ্যানে তো দুইটা মানষের লাশ।’ বললেন তিনি। ‘এগুলারে কই ফেলব?’

‘ফেলতে হবে না। লাশের ওপরেই বাবুকে বসান। আমরা তিনজন ঠেলব।’

তা–ই হলো। একটা সুইপার ভ্যানে দুজন মরা মানুষ। তাদের মাথা ভ্যানের ভেতরে, পা ঝোলানো। তার ওপরেই বসানো হলো বাবুকে। বাবুর বাঁ হাতে কনুইয়ের ওপরে গুলি লেগেছে। তারা তিনজন ভ্যান ঠেলছে। দুজন ধরেছে দুই হাতল। তৃতীয়জন মাঝখানে এক হাতে ঠেলা দিচ্ছে। প্রায় দৌড়ে তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে সিঁড়ির সামনে আসতে পারল। হাসপাতালের বারান্দায় গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে আছে। ভেতরে আরও আরও গুলিবিদ্ধ আহত হাত উড়ে যাওয়া, পা উড়ে যাওয়া, কাঁধ উড়ে যাওয়া মানুষ আর্তনাদ করছে।

বাবুকে ধরে নিয়ে মাহবুব আর আমি একটা স্ট্রেচারে শুইয়ে ভেতরে গেলাম। একজন ব্রাদারকে বললাম, ‘ব্রাদার, আমার আব্বার নাম মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান। তিনি এই হাসপাতালের হেড অব অ্যাডমিন। আপনি কাইন্ডলি আমার বন্ধু বাবুকে বাঁচান।’

তিনি বললেন, ‘তুমি হাফিজ স্যারের ছেলে? হসপিটালের অবস্থা খারাপ। ডাক্তাররা নাই। নার্সরাও নাই। যারা আছে, তারা সবাই ব্যস্ত। এত গুলি খাওয়া মানুষ আসছে যে পাগল হওয়ার অবস্থা। আমি অবশ্যই এই পেশেন্টকে দেখব। তবে বাইরে কারফিউ। তোমরা কীভাবে এসেছ। পাকিস্তানি মিলিটারিরা তো গুলি করছে এলোপাতাড়ি। তোমরা নিজেরা মারা পড়বা। যাও তোমরা যাও।’

বাবু বলল, ‘বাদল ভাই, মাহবুব ভাই, আপনেরা যান। আব্বারে লইয়া আহেন।’

ডেটলের গন্ধমাখা মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে থাকা হাসপাতালের গুমোট ওয়ার্ডের ভেতরে দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমরা বাইরে এলাম। গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ কানে এল।

সুইপার আঙ্কেলের ভ্যানটা নিয়ে আবার এলাম বাবুদের দোকানের সামনে। বাবুর আব্বার লাশটা ধরাধরি করে ভ্যানে তুলে দিয়ে আমরা বাসায় এসে ঢুকলাম। আমার ভীষণ বমি পাচ্ছে। বাথরুমে ঢুকে বমি করলাম। গোসল করলাম।

আব্বা-আম্মাকে বললাম সব। আব্বা বললেন, ‘খবরদার আর বাইরে বের হবে না।’ আব্বা নিজে অফিসের পোশাক পরে নিয়ে বের হলেন। হাসপাতালে অনেক রোগী আসছে। তাদের চিকিৎসা যাতে ঠিকঠাকভাবে হয়, সেই দায়িত্ব তার ওপরই।

আম্মা বললেন, ‘যেয়ো না। বাইরে কারফিউ।’

‘আমার আইডেন্টি কার্ড আছে। আমি হাসপাতালের লোক। আমার আবার কিসের কারফিউ।’

তিনি বেরিয়ে গেলেন। আম্মা তসবিহ হাতে নিয়ে আল্লাহকে ডাকতে লাগলেন।

কার্জন হল এলাকা থেকে মিলিটারিরা সার বেঁধে গুলি করতে করতে এদিকেই এগোচ্ছে। বারান্দায় একবার উঁকি দিয়ে দেখতে পেলাম। দেখতে ভয়ংকর পশুর দলের মতো। দৌড়ে ঘরের ভেতর এলাম।

চাল–ডালের বস্তার পাশে আমরা সবাই শুয়ে পড়লাম। আমি, তমাল, বন্যা, আর আম্মা। আম্মা কাঁদছেন। তোদের আব্বা এর মধ্যে কেন বাইরে গেল?

আমি বললাম, আব্বা হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে গেছেন এতক্ষণে। নিশ্চয়ই ওইখানে সেফ থাকবেন।

প্রচণ্ড গুলি হচ্ছে। পুরো ভবন কেঁপে কেঁপে উঠছে। সকাল ১১টার পর আর গুলির শব্দ শোনা গেল না।

দুপুরের পর সব নিস্তব্ধ। কী করা যায়?

আমি আস্তে আস্তে গেলাম তিনতলায়। মাহবুব, মাহবুব...

মাহবুব বেরিয়ে এল।

বললাম, ‘চল তো, দেখে আসি, বাবুর কী অবস্থা?’

মাহবুব বলল, ‘চল।’

আমরা পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে রাস্তায় এলাম। কেউ নেই কোথাও। রাস্তা দখল করে নিয়েছে কুকুর আর কাক। রেললাইন পার হয়ে চলে গেলাম হাসপাতালে। রোদের ভেতর থেকে হাসপাতাল ভবনের ভেতরে গিয়ে ঠান্ডা আর অন্ধকারের মধ্যে গিয়ে পড়লাম।

অলংকরণ: তুলি

বাবুকে খুঁজে পেতে কষ্ট হলো। তবে একটা ওয়ার্ডের মেঝেতে তাকে পাওয়া গেল। সে বসে আছে। বাঁ হাতে ব্যান্ডেজ। আমাদের দেখে বলল, ‘ভাই, বাঁইচা গেছি। গুলি এই দিক দিয়া ঢুইকা ওই দিক দিয়া বাইর হয়া গেছে। কাইলকা রাইতে আজরাইল আইছিল। কোনো কথা নাই। সোজা গুলি। আব্বারে কি ভর্তি করাইতে পারছেন?’

‘না, তাকে আর পাইনি। দোকানে গিয়ে দেখি উনি নাই। মনে হয়, অন্য কেউ তাকে নিয়ে গেছে।’

‘হসপিটালে ভর্তি হইলে আব্বাও বাঁইচা যাইব।’

‘বাবু, তুমি থাকো। আমরা আবার আসব।’

মাহবুব আর আমি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বাগানের ভেতর দিয়ে গেলাম শহীদ মিনারের সামনে। শহীদ মিনার অর্ধেকটা আছে, বাকিটা কামান দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তানিরা।

মাহবুব বলল, ‘চল, জগন্নাথ হলের দিকে যাই।’

‘চল।’

সেই ফাঁকা রাস্তায় গনগনে সূর্যের নিচ দিয়ে কুকুর আর কাকদের দখল করা পথ ধরে হেঁটে জগন্নাথ হলের মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে যা দেখলাম, তা দেখার জন্য তৈরি ছিলাম না। ভেতরে পড়ে আছে ছাত্রদের লাশ। ছাত্রটা আমার অনুমান। তাদের অনেকেই খালি গা। অনেকেই লুঙ্গি পরা। ধুতি পরা। লাইন ধরে লাশগুলো পড়ে আছে। আমরা লাশের সংখ্যা গুনতে থাকি। এক দুই তিন চার.. বিশ একুশ... ১০৪, ১০৫... ১৫৬, ১৫৭... গোনা আর শেষ হয় না। আমার আকাশ ঘুরতে থাকে, পায়ের নিচের মাটি দুলে ওঠে...আমি মাহবুবকে ধরি...তারপর দৌড়াতে শুরু করি। রেললাইন ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা চলে আসি আমাদের বাড়ির বিল্ডিংয়ে।

রাতের বেলা রেডিওতে বিবিসি শোনার চেষ্টা করা হলো। বিবিসির ইংরেজি খবরে বলে:

২৬ মার্চ ১৯৭১। ২২.০০ পাকিস্তান ওয়ান।

ইয়াহিয়া খান তার সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেওয়ার পর এবং ভারত থেকে পাওয়া খবর অনুসারে শেখ মুজিবুর রহমান প্রদেশকে স্বাধীন বলে ঘোষণা দেওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক যুদ্ধের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকায় আমেরিকান কনসাল জেনারেল বলেন, বিদ্রোহ দমনের জন্য ট্যাংক ব্যবহার করা হয়েছে। ভারত থেকে পাওয়া আগের খবরে বলা হলো, একটা গুপ্ত বেতার থেকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে।

এরপর আবার গুলির শব্দ। আমি একটু জানালার দিকে যাই। বাইরে বস্তিতে আগুন দিচ্ছে মিলিটারিরা। আর গুলি করছে। কী একটা যন্ত্র দিয়ে গুলি করার মতো করে আগুন বর্ষণ করছে। বস্তিগুলো দাউ দাউ করে পুড়ে যাচ্ছে। নারী, শিশু, যুবক, বৃদ্ধ সব দৌড়াচ্ছে। তারা গুলি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। তাদের গায়ে বারুদ দিয়ে আগুন দেওয়া হচ্ছে।

আম্মা চিৎকার করে ডাকলেন, ‘বাদল, ভেতরে আয়। ফ্লোরে শুয়ে পড়।’

আমি কাঁপতে কাঁপতে এসে ফ্লোরে শুয়ে পড়ি। জড়িয়ে ধরি আম্মাকে।

‘আম্মা...’

‘কী হয়েছে, বাবা।’

‘মিলিটারিরা আমার চোখের সামনে একটা বাচ্চার গায়ে আগুন ছিটিয়ে দিল। বাচ্চাটা অন্ধকারে আগুনের বাচ্চা হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে পড়ে গেল। আম্মা গো...’

আম্মা আমাকে বুকের মধ্যে ঠেসে ধরেন।

আব্বা পাশে শুয়ে আছেন। তিনি বললেন, ‘তুমি কেন দেখতে গেছ এই দৃশ্য? কী সর্বনাশ।’

বন্যা আর তমাল কাঁদতে লাগল।

বাইরে গুলির শব্দ। মানুষের পালানোর শব্দ। আর চিৎকার। কী ভয়াবহ রাত! আজই কি কেয়ামত হয়ে যাবে?

লেবু মামা বললেন, ‘এবার রেডটা মারতেই হবে। বাদল, রেড টাচ করা ছাড়া তোমার কোনো উপায় নাই।’

‘ওকে।’ বললাম আমি। ‘রেডই টাচ করব। কিন্তু আমার কভার যে জায়গায়, রেড ফেললেও কোনো লাভ নাই। রেডটা আপনার হাতের বাইরে রাখি।’

আমরা ক্যারম খেলছি। জুন মাসের প্রচণ্ড গরম। গরমে ঘামছি। মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে। আমি, মাহবুব, লেবু মামা আর বাবু।

বাবুকে হাসপাতালে রেখে এসেছিলাম যখন, ২৬ মার্চ সকালে, তখনো ছিল কারফিউ। পরে আস্তে আস্তে কারফিউ দিনের বেলা থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। এখন কারফিউ থাকে শুধু রাতের বেলা। হাসপাতালে আমি আর মাহবুব মাঝেমধ্যে বাবুকে দেখতে যেতাম। বাবুর গুলি লেগেছিল বাহুর মাংসে। ডাক্তাররা ব্যান্ডেজ করে ইনজেকশন দিয়ে বাবুকে সারিয়ে তুললেন। ততদিন মার্চ গড়িয়ে এপ্রিল পেরিয়ে গেছে। আমরা রাতের বেলা বিবিসি আর দিনের বেলা আকাশবাণী শুনে জানতে পারলাম, স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠিত হয়েছে মুজিবনগরে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী।

বাবুকে যেদিন হাসপাতাল থেকে রিলিজ করল, সে সন্ধ্যাটা আমার মনে আছে। কারণ, সে সন্ধ্যায় আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনেছিলাম। বাবুও আমাদের বাইরের ঘরে বসে রেডিও শুনেছিল। হঠাৎ করে সে বলে বসেছিল, ‘আমার আব্বায় কই? বাদল ভাই, আমার আব্বায় কই?’

আমাকে সেদিন সত্য কথাটা বলতে হয়েছিল, ‘তোর আব্বা নাই বাবু। ২৫ মার্চ রাতেই তোর আব্বা শহীদ হয়েছেন।’ বাবু বলেছিল, ‘আমি মা আর বোনের লগে দেখা করতে যামু।’ ওর মা ছিল তেজগাঁ বস্তিতে। মায়ের সঙ্গে ছিল ছোট বোন ফুলি। বছর আটেক বয়স।

তেজগাঁ বস্তিতে মাকে আর বোনকে খুঁজতে গিয়েছিল বাবু। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে এসেছে।

আমি বলেছিলাম, ‘কী রে বাবু, মায়ের দেখা পেলি?’

‘না, বাদল ভাই। গিয়া দেখি বস্তির কোনো নিশানা নাই। খালি ছাই আর পোড়া খুঁটি।’

‘তোর মা আর বোন কোথায় গেছে, কেউ বলতে পারল না?’

‘কইব কেডা? কাউরে তো রাখে নাই।’

‘আল্লাহকে ডাক। হয় তো কোনো বাড়িতে তোর মা আর বোন গিয়ে লুকিয়ে আছে।’

‘থাকলে তো ভালোই। আব্বারে হারাইছি। অহন মা আর বোনও যদি মইরা যায়, আমার আর থাকেটা কী!’ বাবু কাঁদতে আরম্ভ করেছিল। তাকে সান্ত্বনা দেবার কোনো ভাষা আমার ছিল না। আমি আমার মায়ের দিকে তাকাই। আমি আমার বোনের দিকে তাকাই। আমি আমার আব্বার দিকে তাকাই। আব্বা শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছেন। হাসপাতালের ডিউটি তিনি করেই চলেছেন। রোজ মানুষের লাশ আসে। আহত মানুষ আসে। আর আসেন নারীরা।

আব্বা আর আম্মা ফিসফিস করে কথা বলেন। আব্বা বলেন, ‘পাকিস্তানিদের ওপরে আল্লাহর গজব পড়বে। পড়তে বাধ্য। মেয়েদের ওপর অত্যাচার করছে। এমন অত্যাচার করছে, আল্লাহ এটা সইতে পারবেন না। তিনি পাকিস্তানিদের শাস্তি দেবেনই। কঠিন শাস্তি দেবেন।’

বাবু এখন আমাদের সঙ্গে ক্যারম খেলছে। বাবু আমাদের বাসাতেই থাকে। আমাদের বাইরের ঘরে সোফার ওপরে রাতে ঘুমায়। কাজে–কর্মে আমাদের সাহায্য–সহযোগিতা করে। খেলতে খেলতেই বাবু বলে, ‘বাদল ভাই, কোনো খোঁজখবর করতে পারলেন? ক্যামনে যুদ্ধে যাইতে হয়! আমি আমার আব্বারে খুন করার প্রতিশোধ লমু।’

মাহবুব বলে, ‘খোঁজ একটা পেয়েছি। মেজর খালেদ মোশাররফের লোক এসেছে। বলেছে, ঢাকা কলেজের ছেলেদের নিয়ে চলে এসো আগরতলা।’

‘লেবু মামা, চলো, আমরা একসাথে যুদ্ধে যাই।’

লেবু মামা বলেন, ‘খালেদ মোশাররফ চেয়েছেন ছাত্রদের। আমি তো ছাত্র না। আমি যুদ্ধে গিয়ে কী করব?’

আমি বললাম, ‘যুদ্ধ করবেন।’

‘না না, এইটা ক্লাস স্ট্রাগল না। মিডল ক্লাসের নিজেদের লড়াই। এক দল শোষকের কাছ থেকে ক্ষমতা আরেক দল শোষক নিতে চায়। আমার লড়াই এই দুই শোষকের বিরুদ্ধে। আমি তোদের মতো এদের সাথে গিয়ে জয়েন করতে পারি না। মাও সে–তুং বলেছেন...’

মাহবুব বলে, ‘লেবু মামা! তোমার এই মাও সে–তুং বলেছেন বলা কি তুমি বন্ধ করবে?’

গত রাতে ঘুম আসছিল না আমার। খুবই উত্তেজনায় ভুগছিলাম। চোখ মুদে আসতে একটু সময়ই লেগেছিল। রাত চারটায় ঘড়ির অ্যালার্ম বেজে উঠতেই তড়াক করে উঠে ঘড়ি বন্ধ করে দিলাম।

ঘুমভাঙা চোখে অন্ধকারের মধ্যে বোঝার চেষ্টা করলাম, তমাল ঘুমাচ্ছে কি না!

তমালের নাক ডাকার শব্দ আসছে। পারফেক্টলি অলরাইট। এখন বন্যাও যেন ঘুমিয়ে থাকে। আমার চলাচলের শব্দে এদের ঘুম যেন ভেঙে না যায়!

রাতেই সবকিছু গুছিয়ে রেখেছি। ছোট্ট একটা ব্যাগ। তাতে এক সেট কাপড়। একটা চিঠি লিখে রেখেছি:

আব্বা এবং আম্মা,

আমি যুদ্ধে চলে যাচ্ছি। তোমাদের বললে তোমরা কিছুতেই রাজি হতে না। তাই না বলেই গেলাম। ২৫ মার্চ রাতে আমি নিজের চোখে মারা যেতে দেখেছি বাবুর আব্বাকে। দেখেছি, জগন্নাথ হলের মাঠে কীভাবে ছাত্রদের লাশ পড়ে ছিল। কীভাবে বস্তিতে আগুন দিয়ে বাচ্চা ছেলেমেয়েদেরও পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এরপর আর ঘরে থাকার কোনো মানে হয় না। তোমরা শান্ত থাকবে। এই চিঠি পুড়িয়ে ফেলবে। আমার জন্য দোয়া করবে।

তমাল ও বন্যাকে আদর জানাবে। তোমাদের জন্য আমি দোয়া করব। যদি বাঁচি ইনশা আল্লাহ দেশ স্বাধীন করেই ফিরব। তখন যদি বেঁচে থাকি, তাহলে দেখা হবে।

ইতি, তোমাদের বাদল

চিঠিটা বাইরের ঘরে টেবিলের ওপরে একটা গেলাস চাপা দিয়ে রাখলাম। বাইরের ঘরে সোফার ওপরে ঘুমাচ্ছে বাবু। তার কাছে এসে কানে টোকা দিতেই সে জেগে উঠল। সে–ও প্রস্তুত। তাড়াতাড়ি দুজনে বাথরুম সেরে নিয়ে নীরবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে গেলাম বাড়ির বিল্ডিংয়ের নিচে। সিঁড়ির কাছে। মাহবুবের যাওয়ার কথা। সে কি এরই মধ্যে নিচে এসে গেছে? সিঁড়ির সামনে একটা ইলেকট্রিক বাতি জ্বলছে। তার নিচে অনেক পোকা মরে পড়ে আছে। এখানেই মাহবুবের থাকার কথা ঠিক সোয়া চারটায়। আমার হাতঘড়িতে ঠিক সোয়া চারটাই বাজে। মাহবুব আসেনি। আমরা সিঁড়ির নিচের জায়গাটায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

বাবু ফিসফিস করে বলল, ‘মাহবুব আইব না নাহি? ডরাইছে মনে করেন?’

‘না। তা হওয়ার কথা না। মাহবুবের সাহস আমার চেয়ে বেশি। ও সিঁড়িঘরের দেড়তলার জানালা দিয়ে নিচে লাফ দিতে পারে। আমি পারি না। ও গাছের মগডালে উঠতে পারে। আমি পারি না। আমার ভয় লাগে।’

মিনিট পাঁচেক পার হয়ে গেল। এখনো মাহবুব নামছে না। একটা কোড ঠিক করা আছে। আমরা নিচ থেকে কুকুরের ডাক নকল করে ডাকব। আমি আর বাবু সিঁড়িঘরের তলা থেকে বের হয়ে বিল্ডিংয়ের পেছনে মাহবুবের শোবার ঘরের নিচ বরাবর গিয়ে দাঁড়ালাম। বাবু কুকুরের ডাক ডাকতে লাগল। সেই ডাক ভোররাতের নির্জনতা ভেঙে বেশ পিলে চমকানো একটা হায়েনার ডাকের মতোই শোনা গেল। রাস্তার কুকুরগুলো সেই ডাক শুনে নিশ্চয়ই এর নকলত্ব ধরে ফেলতে পেরেছে। তারা ঘেউ ঘেউ করে উঠল একযোগে। এই সময় তিনতলায় মাহবুবের রুমের জানালা থেকে টর্চের আলো এসে আমাদের ওপরে পড়ল। তারপর নিভে গেল। একটু পর মাহবুব চলে এল নিচে। আমরা চানখাঁরপুলের রেললাইন ধরে চলে গেলাম ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই আকাশ ফরসা হতে শুরু করল। কাকেরা ডাকাডাকি শুরু করে দিল।

আমাদের কোথায় যেতে হবে, আমরা জানি। আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন পল্টনের মুক্তিযোদ্ধা মানিক ভাই। তিনি যুদ্ধ করছেন দিনাজপুর এলাকায়। কিন্তু খবর এনেছেন আগরতলা থেকে। ২ নম্বর সেক্টরে মেজর খালেদ মোশাররফ ঢাকার বুদ্ধিমান তরুণদের চান। মানিক ভাই আগরতলা যাওয়ার রাস্তা মুখস্থ করিয়েছেন আমাদের। তার আগে অবশ্য নানাভাবে তিনি চেষ্টা করেছেন আমরা যেন যুদ্ধে না যাই।

তিনি বলেছেন, ‘তোমরা কি মনে করেছ যুদ্ধ একটা ছেলেখেলা ব্যাপার?’

মাহবুব বলে, ‘না না। এটা জীবন–মৃত্যুর ব্যাপার।’

‘জীবন–মৃত্যু তো একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। মানুষ নিজের বিছানা থেকে পড়ে মারা যেতে পারে। নিজের বিছানাতে শুয়েও বহু মানুষ মারা যায়। যুদ্ধ শুধু জীবন–মৃত্যুর ব্যাপার না। গুলিতে হাত উড়ে গেল, বোমায় একটা পা কাটা পড়ল, যুদ্ধ মানে শুধু তা-ই নয়। যুদ্ধ শুধু ভয়ের ব্যাপার নয়। যুদ্ধ খুব কষ্টেরও ব্যাপার। প্র্যাকটিক্যাল কষ্ট। ধরো, তুমি কয়েক দিন ধরে ভাত পাবে না। খেতের কলাগাছ কেটে ভেতরে থোড় চিবিয়ে খেতে হবে। তুমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা গলাপানিতে দাঁড়িয়ে আছ। হাতে রাইফেল। একটা শত্রুনৌকা ওই পথ দিয়ে যাবে। তখন গুলি করতে হবে। কয়েক ঘণ্টা পানিতে দাঁড়িয়েই থাকতে হবে। মাইলের পর মাইল হাঁটতে হবে। খালি হাতে হাঁটা না। পিঠে অনেক ওজনের বোঝা। কাঁধে অস্ত্র। ট্রেনিংও কঠিন। ভাত পাবে না। পোকাওয়ালা মোটা শক্ত রুটি। খোসাসহ ডাল। ক্রলিং করতে করতে কনুই কেটে যাবে, হাঁটু থেঁতলা হয়ে যাবে। আবার যদি শত্রুর হাতে ধরা পড়ো, কোনো কথা স্বীকার করা যাবে না। পেটাতে পেটাতে তক্তা বানিয়ে ফেলবে। ইলেকট্রিক শক দেবে। চামড়া কেটে লবণ লাগিয়ে দেবে। তবু একটা কথা স্বীকার করা যাবে না। এটা তোমরা পারবে না। তোমরা বাচ্চা। একেবারে বাচ্চা। তোমাদের যুদ্ধে যাবার দরকার নাই।’

মাহবুব, বাবু আর আমি একযোগে বলেছি, ‘না না। আমরা যুদ্ধে যাবই।’

বাবু বলেছে, ‘ভাইজান, আমার আব্বারে মাইরা ফেলছে। আমার হাতে গুলি লাগছিল। আমি তো মইরাই গেছিলাম। বাঁইচা আছি আল্লাহ হায়াত রাখছে বইলা। আর এই দুই ভাই আমারে হসপিটালে লইছিল বইলা। আমার মায়ে নাই। আমার বোইনে নাই। বস্তিঘরে আছিল। বস্তি পুইড়া ছাই। পাকিস্তানিরা মানুষ না। তারা জানোয়ার। তাগো লগে যুদ্ধ করা সোয়াবের কাম। আমরা যুদ্ধে যামুই। পাকিস্তানি মিলিটারিগো আমি গুলি কইরা কইরা মারুম। না হইলে আমার বাপে আমারে বদদোয়া দিব। আমার মায়ে আমারে বদদোয়া দিব।’

‘ওকে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মানিক ভাই। ‘তোমরা যুদ্ধে যাবে।’

ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম নরসিংদীর বাসস্ট্যান্ডে। আজান দেবার খানিকক্ষণ পরে একটা বাসে ড্রাইভার–কন্ডাক্টর উঠল। বাসটা স্টার্ট দিয়ে এনে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড় করাল তারা। দরজায় দাঁড়িয়ে হেলপার চিৎকার করতে লাগল, নরসিংদী...নরসিংদী। বাসে উঠে তিনজনের একটা সিটে তিনজনে পাশাপাশি বসলাম।

মানিক ভাই আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন আগরতলা যাওয়ার রাস্তা। আমরা তিনজনই মুখস্থ করেছি। দেখা যাচ্ছে, আমার চেয়ে বাবুর স্মরণশক্তি ভালো। ‘বাবু বল তো, কীভাবে যেতে হবে?’

রাইতের আন্ধারে সাবধানে পার হইব সিঅ্যান্ডবি রোড, এইখানে রাজাকাররা পাহারা দেয়, পাকিস্তানি মিলিটারি গুলি করে, হাঁইটা রেললাইন, তারপর বর্ডার। কোনাবন শরণার্থী ক্যাম্পে থাকন লাগব রাইতে। হেরপর বাসে আগরতলা...’

‘শাবাশ!’ বললাম আমি।

মাহবুব বলল, ‘এই আমরা তিনজন এক সিটে বসলে সার্চ করলে ধরা পড়ব। তিনজন তিন সিটে বসি।’

‘তাই তো।’ গুরুত্বসহকারে নিলাম ব্যাপারটা। তিনজন তিন সিটে বসে পড়লাম।

আমাদের রুটের বর্ণনা একনিশ্বাসে দিয়েছিল বাবু। কিন্তু বাস্তবে আগরতলা এসে পৌঁছাতে আমাদের লাগল তিন দিন। এই তিন দিনে আমরা একনাগাড়ে হেঁটেছি ১৬ ঘণ্টা। আমরা ঢাকার ছেলে। আমি আর মাহবুব পড়ি শাহীন স্কুলে। বলা যায়, আমরা আলালের ঘরের দুলাল। ১৬ ঘণ্টা হাঁটার কথা আমি এর আগে কল্পনাও করিনি। তবে একটা মধুর স্মৃতিও আছে। কড়ইবাড়িতে আমরা যখন পৌঁছুলাম, তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। রাতটা কোথায় কাটাব, ভাবছি। সামনে বাঁশঝাড়ে ঢাকা, কলাগাছে ঘেরা একটা বাড়ি দেখে সেখানেই হাজির হলাম। একজন কৃষকবধূ আমাদের দেখে ঘোমটাটা বড় করলেন। একজন দাড়িওয়ালা খালি গা কৃষক ঘাড়ের গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে এলেন। আমরা সালাম দিলে তিনি বললেন, ‘কার পোলা গো তোমরা? রোদে পুইড়া মুখটা তামা কইরা আইছ। যুদ্ধ করবার লাইগা ইন্ডিয়া যাইতাছ? আহো। পুকুরে গোসল কইরা লও। আমগো বাড়িতে রাইতটা কোনোমতে কাটাও।’

সেই কৃষকের বাড়ির ছোট ছেলে, তার নামও বাবু, একটা লাল রঙের মোরগ ধরে আনল। বলল, ‘এইটা আমার পুষা মোরগ। এইটা অহন জবাই হইব।’

বাবু মোরগের পায়ের দিকটা ধরল। কৃষক চাচা ঘাড়ে গামছা বিছিয়ে নিয়ে মোরগের মাথাটা ধরে গলা বরাবর ছুরি চালালেন। কৃষকবধূ হারিকেনের আলোয় মোরগটার চামড়া ছাড়াতে লাগলেন উঠানে চুলার ধারে বসে। বাইরের মাটির চুলাতেই রান্না চলতে লাগল। আমরা টিনে ছাওয়া ঘরের বারান্দায় একটা লম্বা বেঞ্চে বসে চাচার সঙ্গে গল্প করলাম। ছোট বাবুও নানান গল্প করতে লাগল। বলল, ‘এই গেরামেও মিলিটারি আইছিল। আমরা সবাই পলাইছিলাম।’

ভাত রান্না হলো। একটু আগে আমরা পুকুরের পানিতে গোসল সেরে নিয়েছি। গরম ভাত, মুরগির মাংসের ঝোল দিয়ে খাওয়াটা খুব ভালো হলো। তারপর তাদের খানকাঘরের বিশাল কাঠের চকিতে কাঁথার ওপরে ঘুমটা কী যে দারুণ হয়েছিল আমাদের!

সিঅ্যান্ডবি রোড ক্রস করাটা সত্যি ঝুঁকিপূর্ণ। রাতের অন্ধকারে নৌকা নিয়ে ব্রিজের নিচ দিয়ে আমরা এসেছি। ওপরে রাজাকাররা পাহারা দিচ্ছিল। আমরা তিনজনে ১০০ টাকা দিয়েছিলাম এক লোককে। তিনি বলেছিলেন, রাত নয়টায় ব্রিজের নিচ দিয়ে পার হতে। রাজাকারদের টাকা দিয়ে রাখা থাকবে। তারা ওই সময় মানুষকে পার হতে বাধা দেবে না। তবে আমরা শুনেছি, দুই দিন আগেও এই ব্রিজের নিচে গুলিতে অনেক কজন বাঙালি শহীদ হয়েছেন।

আগরতলা এসে পৌঁছুলাম দুই রাত, তিন দিন পর। বিকেলে। মানিক ভাই বলে দিয়েছিলেন, সিপিএম অফিসে যেতে। আমরা রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করছিলাম সিপিএম অফিসে নিয়ে যেতে পারবে কি না। সেই সময় চোখে পড়ল রাস্তার ধারে পাকা কাঁঠাল বিক্রি হচ্ছে। কাঁঠাল কিনে ভেঙে রাস্তার ধারে কচুপাতায় কোয়া রেখে খেতে শুরু করলাম। এই শহরে পাকিস্তানি টাকা বেশ চলে দেখা গেল।

আহা। কাঁঠাল খেয়ে ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এল। আমি তাকালাম বাবু আর মাহবুবের মুখের দিকে। ধূলিধূসরিত চেহারাগুলো দেখাচ্ছে চুনাপাথরের মূর্তির মতো। নিজের চেহারা আয়নায় দেখলে চিনতে পারব তো!

এই সময় আগরতলার পুলিশের একটা গাড়ি এসে থামল আমাদের সামনে। আমাদের দিকে নেমে এল ভারতীয় পুলিশ। বলল, ‘তোমরা কারা?’

মাহবুব বলল, ‘আমরা জয় বাংলার লোক।’

‘কোথায় যাবে?’

‘সিপিএম অফিসে।’

‘চলো আমাদের সঙ্গে।’ বলে আমাদের ধরে নিয়ে গেল থানায়। কথা নেই, বার্তা নেই পুরে দিল গরাদের ভেতর।

মাহবুব বলল, ‘কী হলো?’

‘আমাদের অ্যারেস্ট করেছে।’ আমি বললাম। ‘আমরা বন্দী।’

মাহবুব ইংরেজিতে কথা বলে উঠল, ‘ইউ জেন্টলম্যান, হোয়াট আর ইউ ডুয়িং? উই আর স্টুডেন্টস ফ্রম ঢাকা। উই ট্রাভেলড লং সিক্সটি আওয়ারস টু জয়েন আওয়ার ওয়ার অব ইনডিপেনডেন্স। লুক। হেয়ার ইজ দ্য বয়। বাবু। হিজ মাদার অ্যান্ড ফাদার হ্যাভ বিন কিলড বাই ব্রুটাল পাকিস্তানিস। জয় বাংলা। আমাদের ছেড়ে দিন।’

বাবুও চিৎকার শুরু করে দিয়েছে, ‘জয় বাংলা। হেই মিয়ারা আমগো আটকায়া থুইছেন ক্যান? আমরা চোর না ডাকাত?’

তখন দেখা গেল একজন লম্বা চওড়া ভদ্রলোক এদিকে এগিয়ে আসছেন। বললেন, ‘বাবারা, বাচ্চা ছেলেরা, তোমরা কারা? আমার নাম হাজি হাশেম। আমি এই এলাকার নির্বাচিত এমএনএ।’

আমি বললাম, ‘আঙ্কেল। আমরা ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে এসেছি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেব বলে। আমি শাহীন স্কুলে পড়ি। আর ওরা আমাদের এই থানায় বন্দী করে রেখেছে।’

হাজি হাশেম আঙ্কেলের জন্য আমি আজীবন দোয়া করব। তিনি বললেন, ‘আর কইও না মিয়ারা। তোমগো হেরা নকশাল ভাবছে। তোমরা সিপিএমের কথা নাহি কইছ। তা কইবা ক্যান। তোমরা কইবা তোমরা জয় বাংলার লোক। জয় বাংলার নেতাগো কাছে যাইবা।’

তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘এই আমার ছেলেদের তোমরা আটকে রেখেছ কেন? এই তিনটাই আমার ছেলে। ছাড়ো ছাড়ো।’

পুলিশ স্যালুট দিয়ে গরাদের তালা খুলে আমাদের মুক্ত করে দিল।

হাজি হাশেম নিজেই একটা জিপ চালাচ্ছেন। বললেন, ‘ওঠো জিপে।’

তিনি প্রথমে নিয়ে গেলেন একটা ভাতের হোটেলে। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। বাতি জ্বলছে। হাজি হাশেম বললেন, ‘ভাত খাও।’ তারপর বললেন, ‘আমার সঙ্গে রাতে থাকো রেস্টহাউসে। কার্পেটের ওপরে শুইয়া ঘুমাইতে পারবা?’

‘জি আঙ্কেল, পারব।’ বললাম আমি।

‘রাতে আর তোমাদের মেলাঘরে গিয়া কাম নাই। কাইলকা সকালে চান্দের গাড়িতে তুইলা দিমু। আরামসে পাহাড়–পর্বত দেখতে দেখতে মেলাঘর পৌঁছাইবা।’

চান্দের গাড়ির স্ট্যান্ডে আমাদের নামিয়ে দিল হাজি হাশেম সাহেবের গাড়ি। জিপগাড়ি, মনে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলের। ভেতরে অনেকগুলো সিট। ছাদের ওপরে বাক্সপেটরা। ঠাসাঠাসি গাদাগাদি করে গাড়িতে উঠলাম। দুই ধারে পাহাড়। ঘন বন। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে গাড়ি ছুটছে। আমরা তিনজন বসে আছি। মেলাঘর মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পে যাব।

মেলাঘর রাস্তার ওপরে আমাদের নামিয়ে দিয়ে গাড়ি চলে গেল। ট্রেনিং ক্যাম্পটা কোথায়? লোকদের জিজ্ঞেস করি। একটা কাঁচা রাস্তা দেখিয়ে দিল লোকেরা। সেই রাস্তায় এখানে-ওখানে কাদা। ঘণ্টাখানেক হাঁটতে হলো। তারপর দেখলাম, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা। একটা গেট আছে। বাঁশ দিয়ে সেই গেট বন্ধ করে রাখা। পাহাড়, জঙ্গল, উপত্যকা, সমতল—তার ভেতরে সারি সারি বাঁশের ঘর। এই হলো মেলাঘর ট্রেনিং ক্যাম্প। গেটে সশস্ত্র প্রহরী। তাঁদের কাছে নাম–ঠিকানা লিখে জমা দিলাম।

একটু পরে এলেন একজন বাংলাদেশি মিলিটারির সৈন্য। আমাদের বললেন, ‘আপনেরা চলেন আমার সঙ্গে। মেজর হায়দার সাহেবের লগে দেখা করবেন।’

হেঁটে বাঁশের তৈরি একটা ঘরে গিয়ে ঢুকলাম আমরা। সামনে বসে আছেন মেজর হায়দার। তাঁকে আমরা সালাম জানালাম। আমাদের সঙ্গের সৈনিকটি অবশ্য পা ঠুকে স্যালুট করল।

মেজর হায়দার বললেন, ‘তোমরা কেন এসেছ?’

‘যুদ্ধ করতে।’ আমি বললাম।

‘তোমরা তো বাচ্চা ছেলে। তোমাদের নেওয়া যাবে না।’

‘আমরা বাচ্চা নই। আমাদের বয়স ১৮ হয়েছে।’ মিথ্যা কথা বললাম আমি। মেজর বললেন, ‘তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?’

‘এবার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেব।’ (এটাও বানিয়ে বললাম)

‘আচ্ছা। বয়স ১৮ হয়েছে বলছ?’

‘জি।’

‘ঠিক আছে। ট্রেনিং কিন্তু খুব কঠিন হবে, জানো তো?’

‘জি জানি।’ বলল মাহবুব।

‘এই তোমরা দুপুরে খেয়েছ?’

‘জি না। আগরতলা থেকে আসতে অনেক সময় লেগে গেল।’

‘এই এদের খেতে দাও।’ কাকে যেন নির্দেশ দিলেন মেজর।

আমাদের নিয়ে গেল একটা পাহাড়ের ঢালে। পাশেই লঙ্গরখানা। সেখান থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে টিনের থালায় আমরা আনলাম রুটি। সেই রুটি কীভাবে ছিঁড়তে পারা যাবে, আমি জানি না। খেসারির ডাল।

পাহাড়ের ঢালে বসে সেই রুটি দাঁতে ছিঁড়ে মুখে পুরে চিবুতে গিয়ে চোয়ালে ব্যথা হয়ে গেল। আমার আম্মার কথা মনে পড়তে লাগল। আম্মা আমাকে গরম ভাত পাতে তুলে দিয়ে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতেন। কখনো কখনো ভাত মেখে মুখে তুলে খাওয়াতেন। আর আমি এ কোথায় এলাম? এই খাবার আমি খাব কী করে?

মাহবুব বলল, ‘বাদল, তুই খাচ্ছিস না কেন?’

‘খাচ্ছি তো।’

‘কী ভাবছিস?’

‘কিছু না।’

‘তোর চোখে পানি কেন?’

‘কই না তো?’ আমি চোখ মুছে মুখে হাসি আনার চেষ্টা করলাম। ‘ঝাল লেগেছে।’

অমনি মাহবুব ডুকরে কেঁদে উঠল। বাবু আমাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল, ‘ভাইজানেরা, কাইন্দেন না। আপনাগো বাপে আছে, মায়ে আছে। আমার দিকে দেখেন। আমার কেউ নাই।’

রাতে থাকতে হয় বাঁশের তৈরি টংয়ে। চারদিকে বাঁশের খুঁটি, বাঁশের ফ্রেম, ভেতরে দড়ির জাল। এটা হলো বিছানা। পাহাড়ের ঢালে, গর্ত খুঁড়ে নালা বানানো হয়েছে, তার ওপরে বাঁশের মাচা। সেটাই টয়লেট। ভোর থেকে শুরু হয় ট্রেনিং। দৌড়, লেফট–রাইট। তারপর ক্রলিং। অস্ত্র চালানো শেখানো শুরু হলো। আমরা তিনজনই এক প্লাটুনে। ৩৮ জনের প্লাটুন। আমরা তিনজন একটা করে রাইফেল পেলাম। চানমারিতে গিয়ে গুলি চালানো শিখি। অস্ত্রের নামধাম শিখি। ব্যবহার শিখি। নানা রকমের অস্ত্র। এমনকি শিখি বোমা বানানো। বিস্ফোরণ ঘটানো। গ্রেনেড ছুড়তে শিখলাম। দাঁতে ধরে গ্রেনেডের চাবি খুলে এক থেকে দশ গোনার মধ্যে ছুড়ে মারতে হয়। ট্রেনার বলেন, ‘এক থেকে দশ অনেক সময়। ভয় পেয়ো না। দূরে ছুড়ে মেরো। না হলে নিজের হাতেই বিস্ফোরিত হবে গ্রেনেড।’ ট্রেনারদের মধ্যে বাঙালি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সুবেদার আছেন। আমরা ডাকি ‘ওস্তাদ’ বলে। আর আছেন ভারতীয়রা। তাঁরা হিন্দিতে কথা বলেন।

তিন সপ্তাহের ট্রেনিং। সারা দিন পরিশ্রম। সন্ধ্যার পরে বিনোদনের ব্যবস্থা। আমাদের সঙ্গে একজন আছেন, গায়ক। তাঁর নাম আজম খান। তিনি গিটার বাজিয়ে গান করেন। একজন আছেন আর্টিস্ট। তাঁর নাম শাহাবুদ্দীন। তিনি বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকেন। রোববারে ছুটি। রুমি ভাইয়ের বাড়ি থেকে টাকা এসেছে। রুমি ভাই ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছেন। আর আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি ভর্তি হয়ে আছেন। তিনি দেখতে নায়ক দেবানন্দের মতো। তিনি বললেন, ‘বাদল, চলো, তোমাদের আগরতলা শহরে নিয়ে যাই। হোটেলে ভালো খাবার খাওয়াই। সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখি।’

রুমি ভাইয়ের সঙ্গে একটা চাঁদের গাড়ি ভাড়া করে আমরা উঠে পড়লাম গাড়িতে।

গাড়িতে পরিচয় হলো জুয়েল ভাইয়ের সঙ্গে। স্টেডিয়ামে আমি জুয়েল ভাইকে ক্রিকেট খেলতে দেখেছি। আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে খেলতেন। সাংঘাতিক ব্যাটসম্যান। খালি চার আর ছয় মারেন। জুয়েল ভাইও মুক্তিযুদ্ধ করতে চলে এসেছেন। আমাদের সঙ্গেই ট্রেনিং নিচ্ছেন। আগরতলায় গিয়ে আমরা উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখলাম। হোটেলে বসে পেট ভরে ভাত খেলাম। বাবু এখন আর আমাদের আপনি বলে না। সে আমাদের তুমি করে বলে। আমরা একসঙ্গে থাকতে থাকতে বন্ধুর অধিক বন্ধু হয়ে গেছি। সে–ও আমাদের সঙ্গে বসে খাচ্ছে, সিনেমা দেখছে, তারপর রুমি ভাইয়ের সঙ্গে পাতার বিড়ি ভাগ করে খেতে লাগল। একটা রোববার বড় আনন্দে কাটল।

সারা দিন ব্যস্ততায় কাটে। রাতে শোবার পরে হয় মন খারাপ। তমালের কথা মনে পড়ে। বন্যার কথা মনে পড়ে।

আর মনে পড়ে মনির কথা। মনি কি মাহবুবের জন্য অনেক কাঁদে?

ট্রেনিং শেষ হলো। একসঙ্গে অনেকগুলো ব্যাটালিয়নের শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ হবে।

সবাই মিলে পাহাড়ের ঢাল কেটে পরিষ্কার করা মাঠে আমরা সমবেত হয়েছি। শাহাবুদ্দীনের আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবিটা বাঁশে করে টাঙানো হয়েছে। মেজর খালেদ মোশাররফ এলেন। জাতীয় পতাকা তুললেন। আমরা সশস্ত্র সালাম জানালাম। তারপর সবাই মিলে গাইতে লাগলাম, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।

‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে গাইতে আমরা সবাই লাইনে দাঁড়িয়েই কাঁদতে লাগলাম।

২১ দিনের ট্রেনিং শেষেই আমরা একেকজন মুক্তিযোদ্ধা। আমরা যে তিনজন একসঙ্গে এসেছি—আমি, বাবু আর মাহবুব—আমাদের বয়স বড়জোর ১৬। আমাদের রাইফেল দেওয়া হয়েছে। রাইফেল বইতে বইতে কাঁধে দাগ পড়ে গেছে। কনুইতে আর হাঁটুতে হামাগুড়ি দেবার দাগ তো আছেই। আবার প্রত্যেককে ১০টি করে গুলিও দেওয়া হয়েছে। এখন আমাদের পাঠানো হচ্ছে ফ্রন্টে। সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে। বিএসএফের লরিতে উঠলাম আমরা। আমাদের ব্যাটালিয়নের ৩৮ জন। মন্দাবাগ রেলস্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে থামল আমাদের ট্রাক। তারপর আমরা ঢুকে পড়লাম বাংলাদেশের ভেতরে। খেতের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুলাম আমরা বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর অপারেশন হেডকোয়ার্টার্সে। জায়গাটার নাম কোনাবন। কাছেই মন্দাবাগ রেলস্টেশন। কমান্ডার এইচ এম এ গাফফার। একটা স্কুলঘরকে হেডকোয়ার্টার বানানো হয়েছে। চারদিকে ইটের বাংকার। সেখানে পজিশন নিয়ে আছে সেন্ট্রি। আমাদের প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার ওহাব। ইনি হালকা-পাতলা। ছোটখাটো একজন মানুষ। ইপিআরের সুবেদার। এরই মধ্যে এই এলাকায় সুবেদার ওহাব খুবই নাম করেছেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁর নাম শুনলেই ভয়ে কাপড় নষ্ট করে ফেলে। আমাদের নতুন প্লাটুনটাকে সুবেদার ওহাবের হাতে তুলে দেওয়া হলো।

আমাদের দলের অধিকাংশের পরনে লুঙ্গি। দু–একজনের পরনে হাফপ্যান্ট। কারও পরনে প্যান্ট। আমরা তিনজন, আমি আর মাহবুব হাফপ্যান্ট পরে আছি। বাবু দেখি লুঙ্গিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে বেশি।

আমরা তিন রাত এই বাড়িতে চুপচাপ বসে রইলাম। তারপর কমান্ডার ওহাব আমাদের ডেকে বললেন, ‘পাক সেনারা কসবা থানার সালদা নদী, মন্দভাগ বাজার, কামালপুর এলাকায় ডিফেন্স গইড়া তুলছে। এই সব এলাকায় পাক বাহিনী রসদ পাঠায়, আসা-যাওয়া করে নদী দিয়া। কুমিল্লা থাইকা সিঅ্যান্ডবি সড়ক দিয়া আসে কালামুড়িয়া ব্রিজ পর্যন্ত। তারপর গাড়ি ছাইড়া ওঠে নৌকায়। সালদা নদী দিয়া শত্রুর এই চলাচল বন্ধ করতে চাই। সালদা নদীতে অ্যাম্বুশ করতে চাই। অনুমতি পাওয়া গেছে। এবার অপারেশন। আমগো কোম্পানি কমান্ডার গাফফার সাহেব আমগো অনুমতি দিছেন। কাইলকা সকাল সকাল আমরা অভিযানে বাইরামু। শুনতে পাইলাম, হারামজাদা ক্যাপ্টেন বুখারি আইব কাইল। বুখারি মানুষ না। জানোয়ারের অধম। গ্রামের পর গ্রাম খালি কইরা বাঙালি মাইয়াদের ধইরা নিয়া গেছে সে। তারে পাইলে আর ছাড়ন নাই।’

আমরা তিনজন রাতের বেলা খড়ের ওপরে কাঁথা বিছিয়ে শুয়ে আছি পাশাপাশি।

বাবু বলল, ‘কাইলকা অপারেশন। কাইলকা পাকিস্তানি হারামিগুলানরে গুলি কইরা মারতে যামু। আমার খুশি খুশি লাগতাছে।’

আমি বলি, ‘আমারও খুব এক্সাইটমেন্ট হচ্ছে। রাতে ঘুমাতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।’

মাহবুব বলে, ‘না। মনটাকে শান্ত কর বাদল। ভালো করে ঘুমাতে হবে। কাল আসল যুদ্ধ।’

খুব ভোরে কোনাবন ক্যাম্প ছাড়লাম আমরা। সামনে কমান্ডার ওহাব, পেছনে আমাদের দলের ২২ জন। আমরা তিনজন—আমি, বাবু, মাহবুব—একসঙ্গে থাকব। আমাদের এই অনুরোধ কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছে। হয়তো আমাদের বয়স কম দেখে।

ওহাব মিয়ার সহ–অধিনায়ক নায়েক সুবেদার মঙ্গল মিয়া। ভারী অস্ত্রের মধ্যে একটা মেশিনগান ও সাত–আটটা এলএমজি। এগুলো চালাবে যারা, তারা হয় ইপিআর থেকে এসেছে, না হলে এসেছে মিলিটারি থেকে। আমরা হাঁটছি। সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র। আমাদের তিনজনের হাতে তিনটা রাইফেল। প্রত্যেকের সঙ্গে কুড়িটা করে বুলেট।

ঝিলমিল ধানখেত পেরিয়ে কলতাদিঘির পাড় ও নেপতারহাট হয়ে এসে পৌঁছালাম মইনপুর গ্রামে। দূরে সালদা নদী দেখা যাচ্ছে। এই নদীই পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগের পথ। কমান্ডার ওহাব বললেন, ‘সবাই শুয়ে পড়ো।’ আমরা সবাই ধানখেতে শুয়ে পড়লাম, সবুজ আউশ ধানের আড়ালে।

দুরবিন চোখে লাগিয়ে কমান্ডার ওহাব বললেন, ‘নদী দিয়া পাকিস্তানি মিলিটারি যাইতাছে। তাগো সামনে একটা স্পিডবোট। পিছনে কয়েকটা নৌকা। স্পিডবোটটা খানিকক্ষণ পরপর থামতাছে, যাতে নৌকাগুলান কাছে আসে।’

নৌকায় সৈন্য, নৌকার দুই পাশে নদীতীর ঘেঁষেও সৈন্য। ওহাব বললেন, ‘আফসোস! আরেকটু আগে আইসা পৌঁছালেই তো হ্যাগো ওপরে আক্রমণ করা যাইত। যাউক গা, অসুবিধা নাই। দিনে দিনেই হ্যারা এই পথ দিয়াই ফিরব। তখন অ্যাটাক করুম।’

পাকিস্তানি নৌকার বহরটা আস্তে আস্তে দূরে চলে গেল। কমান্ডার ওহাব আমাদের যুদ্ধটা বুঝিয়ে বললেন। কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে। আমরা বুঝলাম, এ এলাকার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান। সুতরাং, যেকোনো অভিযান পরিচালনার আগে নিজেদের প্রতিরক্ষা ও প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারটি নিশ্চিত করা দরকার। মইনপুর গ্রামের উত্তরে কামালপুর গ্রামের পূর্ব দিকে বিনী নদীর পশ্চিম পাড়ে ব্রিজের কাছে রাখলেন হাবিলদার মুসলিমকে, মেশিনগানসমেত। মইনপুর গ্রামের দক্ষিণ-পূর্বে কায়েমপুর গ্রামে একটি এলএমজি বসানো হলো, মন্দভাগ বাজারের দিকে তাক করে। মইনপুরের উত্তর-পশ্চিমে রইল আরেকটি এলএমজি গোবিন্দপুরের দিকে মুখ করে।

এরপরের কাজ হলো অ্যাম্বুশের জন্য উপযুক্ত জায়গা বাছাই। একটা দলকে মইনপুরে রেখে আমাদের তিনজনসহ গোটা ১২ জনকে নিয়ে ওহাব চললেন নদীর ধারে, ঝিকুরা গ্রামের পাশে। বটগাছের কাছের জায়গাটা পছন্দ হলো তাঁর।

দুপুর ১২টার দিকে আমরা নদীর ২৫ গজের মধ্যে পজিশন নিলাম। ওহাব নিজে রইলেন বটগাছের পাশে, এলএমজিসহ। তাঁর সঙ্গে রইল পাঁচ–ছয়জন। এর মধ্যে একজন হলো বাবু। নায়েক সুবেদার মঙ্গল মিয়া তিন–চারটা এলএমজিসহ নদীর পশ্চিম পাড়ে পজিশন নিলেন কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে। তাঁর দলে রইলাম আমি। বটগাছের ঠিক উত্তর দিকে ২৫–৩০ গজের মধ্যেই রইল আরও একটা দল এলএমজিসহ। বটগাছের দক্ষিণে আগাম সংকেত দেওয়া ও দরকার হলে গুলি করার জন্য মোতায়েন করা হলো সিপাহি শামসু ও বাবুকে। বর্ষাকাল। নদী উপচে দুপাশের ধানখেত প্লাবিত করে রেখেছে। আমরা সবাই মিলেমিশে আছি পানি, ধানখেত, শণগাছের আড়ালে। রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করছি শত্রুর জন্য। ১২টা থেকে ২টা। দুই ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। দেখা গেল, একটা স্পিডবোট আসছে দ্রুতগতিতে। একেকটা মুহূর্ত যাচ্ছে, আর নিকটতর হচ্ছে শত্রুর স্পিডবোট। সেটি ঢুকে পড়ল ফাঁদ-দলের আওতার মধ্যে। সুবেদার ওহাব তাঁর এলএমজির নল তাক করলেন স্পিডবোটের দিকে। শুরু হলো গুলি। তাঁর গুলির সঙ্গে আমরাও একযোগে গুলি শুরু করলাম। ওহাব সাহেব প্রথমে আনুভূমিকভাবে, তারপর রিফু করার মতো খাড়া করে বুনলেন বুলেটের সেলাই। আমি সেদিকে তাকাই। রাইফেলে একটা করে গুলি ভরি। আর গুলি ছুড়ি। প্রায় ১২টা গুলি আমি ছুড়লাম। আর আছে মাত্র আটটা বুলেট।

স্পিডবোটে কতগুলো ছাতার আড়ালে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অফিসাররা। মুহূর্তের মধ্যে সব কটি ছাতা উল্টে ছিটকে পড়ল পানিতে। স্পিডবোট শতছিদ্র হয়ে অচল হয়ে রইল। শত্রুসেনাদের দেহ লুটিয়ে পড়ে রইল বোটে। একজন শত্রু পড়ল পানিতে। দুই হাত, দুই পা দিয়ে পানি ঠেলে সে চেষ্টা করল নিজের দেহ খাড়া করতে। ওহাবকে খরচ করতে হলো আরও দুটো বুলেট। তারপর সব নীরব।

ওহাব বললেন, সবাই চলো স্পিডবোটের কাছে। আমরা দৌড় ধরলাম অস্ত্র উঁচিয়ে। উপুড় হয়ে পড়ে আছে এক অফিসার। তার শরীর উল্টিয়ে মুখ দেখে তাকে চিনলেন ওহাব। ক্যাপ্টেন বুখারি। তার দেহে বিদ্ধ হয়েছে ৭০–৭২টি বুলেট।

মোট ১২ জন পাকিস্তানি অফিসার মারা পড়ল এ অভিযানে। এদের মধ্যে ২ জন মেজর, ৪ জন ক্যাপ্টেন, ১ জন সুবেদার মেজর। একজন বাঙালি মেডিকেল অফিসার। দুজন লে. কর্নেল। তাদের হাতের অস্ত্র হাতেই ধরা ছিল। একটি গুলিও করার সময় পায়নি তারা।

একটা খুব দরকারি ম্যাপ পাওয়া গেল। এতে এই এলাকার পাকিস্তানি বাহিনীর গোলন্দাজ অবস্থান চিহ্নিত ছিল। পাওয়া যায় অস্ত্রশস্ত্র, ওয়্যারলেস। ডুবন্ত স্পিডবোটের ইঞ্জিন খুলে এনে পাটখেতে রাখা হলো।

স্পিডবোটের পেছনে নৌকাসমেত যে শ খানেক পাকিস্তানি সৈন্য ধীরে ধীরে আসছিল, গোলাগুলির শব্দ পেয়ে তারা আর আসেনি। মইনপুরের একজন দরবেশ ফকিরের কাছে জানা গেল, ওরা ক্রলিং করে কসবা চলে গেছে।

সফল অভিযান শেষে আমরা ফিরছি। তখন ৯ প্লাটুনের কমান্ডার নায়েব সুবেদার শহীদ ছুটে এলেন আমাদের কাছে। ক্যাপ্টেন বুখারি মারা গেছে শুনে তিনি খুব খুশি। পাকিস্তানিদের হাত থেকে পাওয়া মেশিনগানটি তুলে নিলেন। ২৫০টি গুলির শিকল গলায় জড়ালেন সাপের মতো। ছুটে গেলেন আগে আগে, কোম্পানি কমান্ডার গাফফার সাহেবের কাছে। তাঁর কাছে খবর পেল গ্রামবাসী আর ক্যাম্পের লোকজন। ওই আসছে ওহাব, স্পিডবোট আর অনেক অফিসার আর ক্যাপ্টেন বুখারিকে মেরে।

লোকজন ছুটে এল তাঁদের স্বাগত জানাতে। চারদিকে হর্ষধ্বনি। জয় বাংলা। জয় বাংলা বলতে বলতে আমরা ফিরে এলাম ক্যাম্পে। তখন মনে পড়ল, আজ সারা দিন কিছুই খাওয়া হয়নি।

ক্যাম্পে ফেরার পর লঙ্গরখানা থেকে খাবার এল। আজ আর রুটি নয়। আজ ভাত। আমরা তিনজন ভাত খাচ্ছি।

মাহবুব বলল, ‘বাদল, আমরা তো মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছি। আজকে আমরা যুদ্ধ করে জিতে ফিরেছি।’

আমারও মনে হলো, কী সাংঘাতিক কথা। আমরা—আমি আর মাহবুব—ক্লাস নাইনের ছাত্র, পাকিস্তানি পেশাদার সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করে ফিরলাম। আমরা একটু আগে মানুষ মেরেছি! আমি ভাত চিবুতে চিবুতে বললাম, ‘এই আমরা কি মানুষ মেরেছি?’

মাহবুব বলল, ‘না। আমরা মানুষ মারিনি। পশু মেরেছি। শুনেছিস না, কমান্ডার ওহাব সাহেব বলেছেন ক্যাপ্টেন বুখারি ছিল জানোয়ারের চেয়েও বড় জানোয়ার।’

সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে আমরা মেলাঘর ক্যাম্পে এসেছি। মেজর হায়দার আমাদের তিনজনকে ঢাকা পাঠাবেন। ঢাকায় ক্র্যাক প্লাটুন একটার পর একটা অভিযান পরিচালনা করছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের জন্য ঢাকাকে দোজখ বানিয়ে ছেড়েছে। রুমী ভাই, জুয়েল ভাইরা ঢাকায়। আমাদেরকেও ঢাকা পাঠানো হবে। আমরা তিনজনই সেই খবরে উত্তেজিত।

এরই মধ্যে পাওয়া গেল ভয়ংকর দুঃসংবাদ। রুমী ভাই, জুয়েল ভাইসহ আমাদের অনেক মুক্তিযোদ্ধা ঢাকায় ধরা পড়েছেন। মেজর হায়দার আমাদের সামনেই কাঁদতে লাগলেন। বললেন, ‘আমার এতগুলো ব্রাইট ছেলে এইভাবে ধরা পড়ল!’

আমাদের তিনজনকে জড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, ‘দেখো, আমি জানি তোমাদের বয়স আঠারো নয়। বাবু এসেছে তার বাবা-মায়ের হত্যার বদলা নিতে। তোমরা তার বন্ধু। সে জন্য তোমরা এসেছ। তোমাদের মতো বাচ্চা ছেলেকে আমি ঢাকা পাঠাব না। তোমরা বরং আমার সঙ্গে থাকো। আমার এখানে ট্রেনিং সেন্টারেও অনেক কাজ। তোমরা দুজন, মাহবুব আর বাদল আমার অফিসের কাজগুলো করবে। আর বাবু ওস্তাদদের সঙ্গে থাকো। নতুনদের অস্ত্র চালানো শেখাও।’

আমি বললাম, ‘স্যার। আপনার অর্ডার আমরা মানতে বাধ্য। কিন্তু আমরা যুদ্ধ করতে এসেছি। ছোট বলে সুবিধা নিতে পারব না। যুদ্ধ তো কোনো আরামের ব্যাপার না, স্যার। জীবন যেতে পারে জেনেই আমরা যুদ্ধ করতে এসেছি। ট্রেনিং শেষে সেই শপথ নিয়েছি।’

মেজর হায়দার আমাদের জড়িয়ে ধরলেন। ‘তোমাদের দেখেই আমরা বুঝি, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। আমরা বিজয়ী হবই।’ আমরা আবার ফ্রন্টে গেলাম। আমাদের রাখা হলো ডিফেন্স লাইনে। আমরা কংক্রিটের শক্ত বাংকার বানিয়ে ডিফেন্স নিয়ে রইলাম। আমাদের সামনে দিয়ে মুজিব ব্যাটারি যুদ্ধ করতে বাংলাদেশের আরও ভেতরে ঢুকে পড়ে। মুজিব ব্যাটারি হলো গোলন্দাজ বাহিনী। তাদের কাছে মর্টার আছে।

একদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এলেন যুদ্ধের ময়দানে আমাদের উৎসাহ দিতে। আমাদের ডিফেন্স পার হয়ে তাঁরা পাহাড়ে উঠবেন। আমরা দাঁড়িয়ে স্যালুট করলাম। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আমাদের তিনজনের দিকে এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘তোমাদের কার কী নাম?’ আমরা তিনজন নাম বললাম। ‘তোমরা কে কী পড়ো?’

আমি বললাম, ‘স্যার, আমি শাহীন স্কুলে পড়তাম। ক্লাস নাইনে।’ ‘তোমরা এত অল্প বয়সে যুদ্ধ করতে কেন এসেছ?’ ‘স্যার, আপনি কেন আমাদের এখানে এসেছেন বিপদের মধ্যে?’

মাহবুব বলল, ‘স্যার, আমরা দেশকে শত্রুমুক্ত করতে জীবন দেব বলে এসেছি।’ তাজউদ্দীন আমাদের তিনজনকেই জড়িয়ে ধরলেন। অনেক দোয়া করলেন। তারপর এগিয়ে গেলেন পাহাড়ের দিকে।

কমান্ডার সুবেদার আকবর আলী বললেন, ‘কুসুমবাগ রেলস্টেশনটা কিছুতেই আমরা দখল করতে পারতেছি না। ওইখানে পাকিস্তানিরা কংক্রিটের বাংকার বানাইছে। হেভি অস্ত্রশস্ত্র নিয়া পজিশন নিয়া আছে। আমরা অনেকবার অ্যাটাক করছি। কিন্তু পাকিস্তানি পোস্ট উঠাইতে পারি নাই। একটাই উপায় আছে। সেইটা হইল গেরিলা অপারেশন। বাদামওয়ালা সাইজা ওই স্টেশনে যাইতে হইব। তারপর পাকিস্তানি তিনটা বাংকারের ভিতরে টাইমবোমা রাইখা আসতে হইব। কামটা কারা করতে পারবা?’

আমরা তিনজন নিজেদের মুখের দিকে তাকালাম। আমি তাকাচ্ছি বাবু আর মাহবুবের দিকে। মাহবুব তাকাচ্ছে আমার আর বাবুর দিকে।

বাবু তাকাচ্ছে আমাদের দুজনের দিকে।

শেষে বাবু বলল, ‘আমরা তিনজন ছোট আছি। মিলিটারিরা আমাগো সন্দেহ করব না। আমরা যামু।’

বাবুকে দেখতে বাদামওয়ালার মতোই লাগে। আর যুদ্ধের ময়দানে থাকতে থাকতে, না খেয়েদেয়ে, পেটের পীড়ায় আমি আর মাহবুবও বাদামওয়ালাই হয়ে গেছি। সমস্যা হলো, তিনজন নতুন বাদামওয়ালা তো একসাথে স্টেশনে থাকতে পারে না। বাবু সাজল বাদামওয়ালা।

আমি সাজলাম মুচি। জুতা কালি করি।

মাহবুব সাজল কুলি। রাতের অন্ধকারে আমরা চললাম স্টেশনের দিকে। আমাদের দেওয়া হয়েছে একটা করে গ্রেনেড। তিনজনের প্রত্যেকের সঙ্গে একটা করে রিভলবার। লুকিয়ে শরীরের ভেতরে রাখবার জন্য। ডিসেম্বর মাসে ভয়াবহ শীত। আমরা চাদরের নিচে সবকিছু লুকিয়ে দেহের সঙ্গে বেঁধে রেখেছি। রাতের অন্ধকারে কুয়াশার আড়ালে আমরা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে উঠলাম। প্রথমে রেকি করতে হবে। তারপর অভিযান।

নিজেদের মধ্যে কথা বলছি না। তিনটা বাংকার স্টেশনের তিন দিকে। আমরা তিনজন তিনটা বাংকার বেছে নিলাম। স্টেশনটা চালু। রোজ তিনটা করে ট্রেন আসে। যাত্রীরা নামে। কিছু যাত্রী ওঠে। সেদিক থেকে স্টেশনে আমাদের আগমন নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলল না। আমরা সারা রাত স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে রইলাম। ভোরের দিকে একটা ট্রেন এল। চলে গেল।

আমি যেখানে বসে আছি জুতা রং করার জিনিসপত্র নিয়ে, সেখান থেকে আমার টার্গেট বাংকারটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমার সামনে একটা ঝাঁকড়া গাছ আছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আমি দেখতে পাই, কিন্তু আমাকে মিলিটারিরা দেখতে পায় না। সকাল আটটার দিকে বাংকারে খাবার এল। খাবার এসেছে রিকশাভ্যানে। ছয়টা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে দুটো অল্প বয়সী কিশোর রিকশাভ্যান দাঁড় করাল স্টেশনের সামনে। তারপর দুজন চারটা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে দুইটা বাংকারে গেল। আবার এসে দুইটা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে গেল আরেকটা বাংকারে। তারা নতুন খাবার ভরা টিফিন ক্যারিয়ার দিয়ে পুরাতন ও খালি ছয়টা টিফিন ক্যারিয়ার ফিরিয়ে নিয়ে চলল।

আমরা ঠিক করে ফেললাম আমাদের কর্তব্য। স্টেশন ছেড়ে চলে গেলাম পুব দিকের গ্রামের পথে। একটু পরেই জঙ্গল। আমরা তিনজন জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম।

ঠিক করলাম, আমাদের কী করতে হবে। আমরা জঙ্গলের পথ বেয়ে ফিরে গেলাম আমাদের ক্যাম্পে।

আমাদের কমান্ডার বললেন, ‘কী ব্যাপার, তোমরা ফিরা আইছ যে! ঘটনা কী!’ আমরা বললাম, ‘আগামীকাল ভোরবেলা আমাদের অপারেশন হবে। আপনারা একটা প্লাটুন চারদিক থেকে ঘিরে অ্যাম্বুশ করে রাখবেন। আমরা স্টেশনে ঢুকব। ওদের বাংকারের ভেতরে আমরা বোমা রেখে দেব। প্রথম বোমাটা ফাটার সঙ্গে সঙ্গে আপনারা একযোগে আক্রমণ করবেন। ততক্ষণে আমরাও আপনাদের গুলির রেঞ্জের বাইরে চলে যাব।’

কমান্ডার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীভাবে রাখবে?’

আমরা বললাম, ‘ওদের খাবার দিতে যায় দুইটা কিশোর ছেলে। ওদের পরনে থাকে লুঙ্গি আর খাকি সোয়েটার। মনে হয়, ওরা রাজাকার। আমরা রাজাকার সেজে কাল ভোরে ওদের বাংকারে টিফিন ক্যারিয়ার দিয়ে আসব। ওপরের বাটিতে থাকবে রুটি আর ডাল। নিচের দিকের বাটিতে থাকবে টাইমবোমা। ওরা যেই টিফিন ক্যারিয়ারের বাটির মুখ খুলবে, বোমার ডেটোনেটর আপনা–আপনিই খুলে যাবে। অমনি বাটি বোমা হয়ে ফেটে যাবে।’

কমান্ডার বললেন, ‘এত সফিস্টিকেটেড বোমা আমাদের নাই। তোমাদেরকে আমরা এই ধরনের মাইন দিতে পারুম না। যেইটা করতে পারো, তোমরা খাবার দিবার লাইগা টিফিন ক্যারিয়ার লইয়া যাইবা। সাথে রাখবা গ্রেনেড। খাবার দিয়া আসার সময় গ্রেনেডের পিন খু্ইলা ভিতরে রাইখা আসবা। ১৫ সেকেন্ড সময় পাইবা। ১৫ সেকেন্ড অনেক সময়। দৌড়ায়া সেফ প্লেসে আইসা শুইয়া পড়বা। তবে খুই রিস্কি অপারেশন। অরা তোমাদের গ্রেনেড দেইখাই তোমাদের গুলি করতে পারে। তোমরা শহীদ হইতে পারো।’

বাবু বলল, আমরা তো শহীদ হইতেই আইছি। হমু। দেন এই অপারেশনের কাম আমগো। আমরা করুম।’

পুরনো বড় বড় টিফিন ক্যারিয়ার ক্যাম্পেই ছিল। রাত চারটার সময় আমরা তিনজন ছয়টা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে পৌঁছে গেলাম স্টেশনের কাছে। আখের খেতের মধ্যে বসে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম ভোরের ট্রেন আসার জন্য।

আমাদের পরনে খাকি সোয়েটার। তারওপর গায়ের চাদর। পরনে লুঙ্গি। আমাদের দেখতে লাগছে পাকিস্তানি সৈন্যদের লঙ্গরখানার কিশোর শ্রমিকদের মতো। রাত চারটার সময় আমরা তিনজন ছয়টা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে পৌঁছে গেলাম স্টেশনের কাছে। আখের খেতের মধ্যে বসে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম ভোরের ট্রেন আসার জন্য।

ট্রেন এল। আবার চলে গেল। স্টেশনটা একবার জেগে আবার ঘুমিয়ে পড়তে লাগল। ভোর হচ্ছে। সকাল হচ্ছে। আমরা জানি, একটু পরে খাবার নিয়ে আসবে রাজাকার দুজন। তার আগেই আমরা তিনজন ছয়টা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে পৌঁছে গেলাম বাংকারের কাছে। আমাদের মাথা খাকি মাফলারে ঢাকা।

আমি যে বাংকারে গেলাম, সেখানে তিনজন সৈন্য দাঁড়িয়ে অস্ত্র ধরে আছে। তারা ঘুমে ঢুলছিল। আর তিনজন মেঝেতে কম্বলের নিচে ঘুমুচ্ছে। আমি টিফিন ক্যারিয়ার ভেতরে রেখে আগের টিফিন ক্যারিয়ার দুটো হাতে নিয়ে নিরাপদে বেরিয়ে এলাম। এখন কঠিন কাজটা করতে হবে। চাদরের নিচে বেঁধে রাখা গ্রেনেডটা বের করে উল্টো দিকে মুখ করে গ্রেনেডের পিন খুললাম। তারপর গড়িয়ে পাঠিয়ে দিলাম বাংকারের দরজা বরাবর। আরেকটা গ্রেনেড বের করে পিন খুলে ছুড়েই মারলাম বাংকার বরাবর। তারপর দিলাম দৌড়। তারপর শুয়ে পড়লাম স্টেশনের টিকিট কাউন্টারটার আড়ালে। গুড়ুম করে আওয়াজ হলো।

আবারও ভবনের আড়াল নিয়ে দৌড় ধরলাম। আমাদের মিটিং পয়েন্ট আখ খেতে চলে এলাম। আমার বুকের আওয়াজ আমি নিজের কানে শুনতে পাচ্ছি। বাবুও চলে এল একটু পরে। শুধু মাহবুব ফিরছে না। ব্যাপার কী, বোঝার জন্য আমি আর বাবু ওর বাংকারটার দিকে গেলাম। বুঝতে পারলাম, মাহবুব ধরা খেয়েছে। ‘তুম কৌন হ্যায়? মুক্তিকা বাচ্চা হ্যায়?’ ভেতরে ধস্তাধস্তি হচ্ছে।

আমি আর বাবু কর্তব্য ঠিক করে ফেললাম। রিভলবার হাতে ধরে ছুটে গেলাম ওই বাংকারে। একটা হারিকেনের আলো ভেতরে জ্বলছে। যদিও সকালের আলোয় সবকিছু দেখা যাচ্ছে। আমরা দ্রুত দুইজন মিলিটারিকে লক্ষ্য করে দুইটা গুলি করলাম। তৃতীয় জন কাঁধের বন্দুক কাঁধ থেকে নামানোর চেষ্টা করছিল। আমরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করলাম। গুলির শব্দ হতেই আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ফায়ার শুরু করল। আমরা ক্রলিং করে বাংকার থেকে তিনজনই বেরোচ্ছি।

আমি আর বাবু আগে। মাহবুব পেছনে। একটা পাকিস্তানি সৈন্য তখনো বেঁচে ছিল। সে তার অস্ত্র তাক করল মাহবুবের দিকে। একটা মাত্র শব্দ হলো গুলির। গুলিবিদ্ধ হলো মাহবুব। আমাদের মাথার ওপর দিয়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ছোড়া গুলি উড়ে যাচ্ছে।

আমি আর বাবু ক্রলিং করে একটা নালার ভেতরে এসে নামতে পারলাম। তারপর নালা ধরে দৌড়ে খানিকটা দূরে গিয়ে পজিশন নিতে সমর্থ হলাম।

আর কোনো গুলির শব্দ নেই। আমরা গেলাম পোড়া পাকুড়তলায়। সেখানে আমাদের রেসকিউ টিম আছে। তাদের কাছে খবর দিলাম, আমাদের মিশন সাকসেসফুল হয়েছে। তিন বাংকারের আঠারো জন পাকিস্তানি সৈন্য সবাই মারা পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ওয়্যারলেসে খবর পাঠানো হলো আমাদের ক্যাম্পে।

রেসকিউ টিমের ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধাদের স্টেশনে এলাম। আমরা পুরা স্টেশনটার দখল নিয়ে নিতে পেরেছি। একটু পর কমান্ডার আকবর আলী স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে চলে এলেন। স্টেশনের কর্মচারী সব মেঝেতে শুয়ে ছিল। তারা আত্মসমর্পণের জন্য হাত তুলল।

মাহবুবকে খুঁজতে লাগলাম আমরা। ওর টার্গেট বাংকার থেকে রক্তের ফোঁটা চলে গেছে পাশের শর্ষের খেতে। সেখানে পাওয়া গেল মাহবুবকে। সে আর্তনাদ করছিল। বলছিল, ‘আমার কাপড়চোপড়গুলো আমার মাকে পৌঁছিয়ে দিও।’ গুলি লেগেছে ওর কাঁধে। ওকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটছে আমাদের মুক্তিবাহিনী। যুদ্ধ হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে তাকে। এর মধ্যে অন্য দুটো বাংকারে সৈন্যরা তাদের টিফিন ক্যারিয়ার খুলে ফেলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলেছে। সব কটা পাকিস্তানিই মারা পড়েছে।

আমরা পুরা স্টেশনটার দখল নিয়ে নিতে পেরেছি। কমান্ডার আকবর আলী স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে চলে এলেন। স্টেশনের কর্মচারী সব মেঝেতে শুয়ে ছিল। তারা আত্মসমর্পণের জন্য হাত তুলল। সকাল হয়ে গেছে। মাহবুবের রক্তে মাটি লাল হয়ে আছে। গুলি লেগেছে ওর কাঁধে। তাকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটছে আমাদের মুক্তিবাহিনী। যুদ্ধ হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে তাকে।

১০

মেজর হায়দারের নির্দেশ, ‘তোমরা ঢাকা চলে যাও। যেভাবে পারো, ঢাকায় ঢুকে পড়ো।’

আমরা তখন ঢাকার পাশে, সাভার এলাকায়। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে একটা জিপ দখল করে নিয়ে আমরা ছুটছি ঢাকার দিকে। আমি আর বাবু। গাড়ি চালাচ্ছেন সফদার ভাই। তিনি গাড়ি চালাতে জানেন। দুপুর নাগাদ মিরপুর দিয়েই আমরা পৌঁছে গেলাম শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে। রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধা আর মানুষ। গাড়ি নিয়ে এগোনো যায় না। শাহবাগ রেডিও সেন্টারে তখনো পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। বাবু ছুটে গেল। দেয়াল টপকে সে উঠে পড়ল ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডে। পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে উড়িয়ে দিল বাংলাদেশের বিজয় পতাকা।

বিকালে আমরা ঢাকা ক্লাব থেকে চেয়ার–টেবিল আনতে সাহায্য করলাম বড় ভাইদের। তারপর মেজর হায়দারের পেছনে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখলাম পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ। তারা সব অস্ত্র মাটিতে ফেলে দিল। কোমরের বেল্ট খুলে ফেলে দিল। আমার আর বাবুর কাজ হলো সেই অস্ত্রগুলো এক জায়গায় জড়ো করা। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। সফদার ভাই ডাকলেন, ‘বাদল, বাবু, আসো তোমরা। জিপে ওঠো। তোমাদের বাসায় নামিয়ে দিই।’

আমরা জিপে উঠলাম। জিপের সামনে বড় বাংলাদেশের লাল–সবুজ-হলুদ পতাকা। আমাকে আর বাবুকে সফদার ভাই আমাদের বিল্ডিংয়ের সামনে নামিয়ে দিলেন।

আমি আর বাবু দোতলায় উঠলাম। কড়া নাড়লাম। ততক্ষণে রাত নেমে এসেছে। দরজা খুললেন আম্মা। আমি আম্মাকে জড়িয়ে ধরতেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘বাদল এসেছে।’ তমাল আর বন্যা দৌড়ে এল। আমার হাতে তখন একটা স্টেনগান। বাবুর হাতে একটা মেশিন গান। আব্বা এলেন। বললেন, ‘অস্ত্র সামলে রাখো। দুর্ঘটনা যেন না ঘটে।’ আম্মা বললেন, ‘মাহবুব কোথায়?’ আমি বললাম, ‘মাহবুবকে কসবা সীমান্তে কবর দিয়ে এসেছি আম্মা।’ আম্মা কেঁদে উঠলেন। বললেন, ‘যা। মাহবুবের মায়ের সাথে দেখা করে আয়।’

আমি আর বাবু তিনতলায় গেলাম। দরজায় নক করলাম। ভেতর থেকে লেবু মামার গলার আওয়াজ। ‘কে?’ ‘আমি বাদল।’ লেবু মামা দরজা খুললেন। আমরা ভেতরে গেলাম।

মণি এসে দাঁড়াল বাইরের ঘরে। মাহবুবের মা এলেন। এলেন মাহবুবের বাবা। মাহবুবের মা বললেন, ‘বাদল, মাহবুব কই?’ আমি চুপ করে আছি। আমি কোনো কথা বলছি না। মাহবুবের মা আবার বললেন, ‘বাবু, আমার মাহবুব আসে নাই?’ বাবু মাথা নাড়ল।

আমি মণির চোখের দিকে তাকানোর জন্য সাহস খুঁজছি। সাহস পাচ্ছি না।