শ্যেনদৃষ্টি

অলংকরণ: এআই আর্ট

‘আচ্ছা, ভাইয়া। আমার একটা কথা ছিল।’

কেবল বার্গারে কামড় বসাতে যাচ্ছিল সুহান, ছোট ভাইয়ের কথায় থমকে গেল।

‘কী কথা ছিল তোর?’ বার্গারটা হাতে নিয়েই জিজ্ঞেস করল সুহান।

‘এই যে মুভিতে যা দেখানো হয়, এসব কি বাস্তবেও ঘটে?’ জিজ্ঞেস করল সুহানের ছোট ভাই রোহান। একটা ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের টুকরা চিবুতে চিবুতে সরু চোখে উত্তরের আশায় তাকিয়ে থাকল ভাইয়ের দিকে।

সুহান এবার বার্গারটা নামিয়ে রেখে পানির বোতলটা টেনে নিল। ‘মুভিতে তো অনেক কিছুই দেখায়। তুই কিসের কথা জিজ্ঞেস করছিস?’

ওরা দুই ভাই মাত্রই মাল্টিপ্লেক্স থেকে একটা হলিউডের সিনেমা দেখে বেরিয়েছে। এরপর বসেছে অদূরের এক ব্যস্ত ফুডকোর্টে। ধুমধাড়াক্কা অ্যাকশনের ছড়াছড়ি যাকে বলে একেবারে। এই নায়ক পাঁচ-ছয়জনকে একা পেটাচ্ছে তো এই গাড়ি নিয়ে শাঁ শাঁ করে ছুটে চলছে। নজরকাড়া সব অ্যাকশন দৃশ্য দিয়ে একদম ভরপুর ছিল সিনেমাটি।

‘আগে বল, আজকের এই মুভিটা তোর কেমন লেগেছে?’ ভাইকে জিজ্ঞেস করল সুহান।

‘অ্যাকশনগুলো সুন্দর ছিল, তবে সিনেমার কাহিনি খুব একটা গাঢ় কিছু ছিল না। আমি প্রথমেই ধরে ফেলেছি যে নায়কের শাগরেদই আসলে দুষ্টলোক।’

‘প্রথমেই ধরে ফেলেছিস?’ সবিস্ময়ে বলল সুহান, ‘কীভাবে?’

‘একটু মন দিয়ে দেখলেই বোঝা যায়। নায়ক যখন প্রথমবার গুন্ডাদের ডেরায় আঘাত করে, তখন এই বন্ধুকে কোথাও দেখা যায়নি, লোকটা এল একদম সবার শেষে। আর এরপর নায়ককে ওই ভুল দিক দেখিয়ে দেয় কিন্তু এই বন্ধুই।’

ব্যাপারটা সুহান যে খেয়াল করেনি, এমন নয়। ছোট ভাইয়ের অনুসন্ধানী দৃষ্টি ওকে মুগ্ধ করেছে।

‘বাহ্‌, অনেক কিছুই তো ধরে ফেলেছিস দেখছি। তা আমার কাছে আবার নতুন করে কী জানতে চাচ্ছিস?’

‘অনেক কিছুই জানতে চাচ্ছি, ভাইয়া। এর আগে আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসতে পারি?’

‘তা পারিস। সাথে যাওয়া লাগবে?’

আরও পড়ুন

‘নাহ্‌। বড় হয়ে গেছি, ভুলে গেছ? আমি ঠিকঠাক যেতে পারব।’

‘আচ্ছা, আচ্ছা। বাথরুমের পর কিন্তু ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে আসবি। মনে থাকবে?’

‘মনে থাকবে, ভাইয়া। এখন গেলাম।’ বলল রোহান। কিছুটা অস্থির হয়ে উঠেছে সে, সুহানের মনে হলো। জোর বেগ চেপেছে বেচারার। তবে রোহান উঠে হাঁটা শুরু করল একদম ধীরেসুস্থে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বসল ভাইয়ের কাছে।

‘হাত ধুয়েছিলি?’ প্রশ্ন করল সুহান।

‘হ্যাঁ।’ আনমনা কণ্ঠে উত্তর দিল রোহান।

‘কী ভাবছিস এত? আমাকে না কী কী যেন প্রশ্ন করবি বলে ঠিক করেছিলি?’

‘না...না, তেমন কিছু ভাবছি না। বাই দ্য ওয়ে, এই যে যেভাবে নায়ক গাড়ি চালিয়ে এতগুলো খারাপ লোকের হাত থেকে পালিয়ে গেল, এটা কি সম্ভব ভাইয়া?’

‘খুব জটিল প্রশ্ন করে ফেললি রে রোহান।’ কয়েক ঢোঁক পানি পান করে বলল সুহান, ‘উত্তর দেওয়ার আগে একটা প্রশ্ন করি, তুই প্লট আর্মার মানে জানিস?’

‘নাহ্‌। তবে ইন্টারনেটে খুব সহজেই সার্চ করে নিতে পারব।’

‘আচ্ছা করিস সার্চ। এখন আমি যতটুকু জানি, বলছি। তোর কি মুভি দেখার সময়ে কখনো মনে হয়েছে যে নায়ক হেরে যাবে?’

‘আজকের মুভিটিতে? না, এ রকম একদম মনে হয়নি। বরং মনে হচ্ছিল কখন নায়ক ভিলেনকে একদম ক্যাক করে ধরবে...’

‘ওটাই। ওটাই হচ্ছে প্লট আর্মারের কামাল।’

‘মানে?’

‘মানে হলো, এই মুভিটার গল্পে নায়ক মূল চরিত্র। তাকে যে গল্পে লেখক সব ধরনের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে, এই প্লট আর্মারের মাধ্যমেই।’

‘কিন্তু নায়ক যে সিনেমার মধ্যে ভিলেনের হাতে প্যাদানি খেল, তখন?’

‘তাতে তো নায়ক একদম পুরোপুরি হেরে যায়নি; বরং পরে উল্টো ভিলেনকেই আচ্ছামতো শায়েস্তা করেছে। এই যে নায়কদের জিতিয়ে দেওয়া হয় শেষে, এটাই হচ্ছে প্লট আর্মারের ভেলকি। এখন প্রশ্ন শেষ হয়েছে, জনাব? এখন লক্ষ্মীর মতো এই স্যান্ডউইচটাও শেষ করুন, শুধু ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেলে হবে?’

‘বাপ রে বাপ! আর বলিস না। থার্টি এইট ডিগ্রি সেলসিয়াস দেখাচ্ছে অ্যাপ। তার ওপর ফিলস লাইক ফর্টি থ্রি! এটা কেন জিজ্ঞেস করছিস? আইসক্রিম খাবার ধান্দা? একদমই না! তোর ঠান্ডার ধাঁত আছে। বাসায় গিয়েই শুরু হবে কাশি...’

ভাইয়ের কথা শুনল রোহান। স্যান্ডউইচে এক কামড় বসিয়ে দিয়ে বিজ্ঞের মতো চোখ মুদে ভাবল কী যেন। তারপর পানি খেয়ে আবার ফিরল ভাইয়ের দিকে। ‘আমার প্রশ্নের অ্যানসার কিন্তু দাওনি, ভাইয়া।’

‘কোন প্রশ্ন? ও! মনে পড়েছে। সিনেমায় যা হয়, সেটা বাস্তবে কতটুকু ঘটে, এই তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘অনেকটাই ঘটে, আবার অনেকটাই ঘটে না। এই যে প্লট আর্মার নিয়ে বকবক করলাম, এই বর্মের মাধ্যমে সিনেমার মুখ্য চরিত্রগুলো অনেক আজগুবি কাজ করে বসতে পারে। মুখ্য চরিত্র মানে বুঝিস তো?’

‘বুঝব না কেন?’ ভ্রু কুঁচকে বলল রোহান। ভাইয়ের প্রশ্নে বেশ অপমানিত বোধ করেছে। ‘তোমার কালেকশনের বাংলা বইগুলো আমার পড়া হয়, ভুলে গেছ? মুখ্য চরিত্র মানে মেইন ক্যারেক্টার।’

‘গুড! ঠিক ধরেছিস।’ সপ্রশংস দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল সুহান। ‘বই পড়ে আমাদের রোহান কত কিছু জেনে যাচ্ছে। তোর এই বয়সে আমি এত কিছু জানতাম না। যাকগে, কী যেন বলছিলাম?’

‘মুখ্য চরিত্ররা আজগুবি কাজ করতে পারে।’

‘ও, হ্যাঁ। ঠিক তাই। মুভি বলে মুখ্য চরিত্ররা অনেকটা যা খুশি তা-ই করতে পারে। তবে তোকে এটাও মাথায় রাখতে হবে, মুভি বলিস, নাচ বলিস, গান বলিস বা ড্রয়িং বলিস—এসবের অনুপ্রেরণা কিন্তু আমাদের বাস্তব জীবন থেকেই আসে। এসব শৈল্পিক কাজে আমাদের মনের ভাবগুলো প্রকাশ পায়। তাই ধরে নেওয়া যায় মুভির অনেক কিছু বাস্তবে ঘটে। বা হয়তো ঘটেও গেছে। “বেইজড অন আ ট্রু স্টোরি” কথাটা কোনো মুভিতে দেখিসনি?’

আরও পড়ুন

‘খুব দেখেছি। জোডিয়াক ছবিটা অমন না?’

‘তুই জোডিয়াক দেখেছিস?’ বিস্ময়ের সঙ্গে বলল সুহান। দ্বিতীয়বারের মতো বার্গারটা নামিয়ে রাখল, ‘ওটা তো বাচ্চাদের মুভি নয়।’

‘ভাইয়া, আমি কি আর এখন বাচ্চা আছি? ক্লাস সেভেনে পড়ি।’

‘আচ্ছা, বাবা, আচ্ছা। তুই বড় হয়ে গেছিস। মানলাম। তোকে তো স্বাধীনতা দেওয়া হয়। কী দেখবি না দেখবি একটু আমাকে বলে দেখিস, তাহলেই হবে।’

‘ঠিক আছে, ভাইয়া। তবে এই ক্ষেত্রে কি মুভি যারা বানিয়েছে, তারা গল্প নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে?’

‘ঠিক তাই। “বেজড অন আ ট্রু স্টোরি” মানে কিন্তু সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে, একদম হুবহু সত্য ঘটনা দেখানো হয় না। সম্ভবও না মনে হয়।’

‘বুঝতে পেরেছি, ভাইয়া।’

‘আর জোডিয়াক কিন্তু মূলত ওই কার্টুনিস্ট ভদ্রলোকের কল্পনাপ্রসূত একটা কাজ। কী যেন নাম তাঁর?’

‘রবার্ট গ্রেস্মিথ। সান ফ্রান্সিসকো ক্রনিকেলস-এ কাজ করতেন।’

‘ও, হ্যাঁ। আর ওই যে যাকে সন্দেহ করা হচ্ছিল। তার নাম যেন কী?’

‘আর্থার লি অ্যালেন।’

‘হুম। এই কার্টুনিস্ট ভদ্রলোক কিন্তু একটা বইও লিখেছেন এই জোডিয়াককে নিয়ে।’

‘একটা নয়, ভাইয়া। দুটো।’ ভাইয়ের কথার ভুল ধরিয়ে দিয়ে বলল রোহান।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। দুটো। এবং এই রবার্ট গ্রেস্মিথ কিন্তু তাঁর বইয়ে এই অ্যালেনকেই দোষী দেখিয়েছেন যদ্দুর জানি, তাই না?’

‘হ্যাঁ। উনি মূলত গ্লাভস-জুতার সাইজ আর সময়গুলো মিলিয়ে এই নির্ণয়ে পৌঁছান। যদিও প্রমাণ করার কোনো উপায় পাওয়া যায়নি।’

‘যদিও বলা হয় গ্রেস্মিথ অনেক কল্পনার আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাকে কিন্তু তারিফ জানাতে হয়।’

‘অবশ্যই। ভাইয়া, মোবাইলে চার্জ আছে তোমার?’ আচমকা প্রশ্ন করে বসল রোহান।

‘কেন? গেম খেলবি? এখন সোজা বাসায় চল। এরপর মোবাইল ঘাঁটিস।’

‘গেম খেলব না, ভাইয়া। ট্রিপল নাইনে কল করব।’

‘পুলিশে কল দিবি কেন?’ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল সুহান।

‘আমার পর্যবেক্ষণ বলছে কোনো একটা গড়বড় আছে।’

‘কেমন গড়বড়?’

‘সামনে দেখো, ওই যে ওই টেবিলটা।’

‘কী ওখানে?’

‘আমি মোটামুটি শিয়োর, ওই লোক বাচ্চাটার বাবা নয়।’

‘এই কথা কেন বলছিস?’

‘ঠিকঠাকমতো খেয়াল করো। এই যে এতক্ষণ ধরে বসে আছি, বাচ্চটিকে একবারও নড়তে দেখেছ?’

‘আমি আসলে ওভাবে খেয়াল করিনি।’ স্বীকার করল সুহান।

ওদের থেকে দুই টেবিল দূরে একজন লোক আর একটি বাচ্চা ছেলে বসে আছে। বাচ্চাটা বসে আছে বললে ভুল হবে। ছেলেটা একদম অনড় হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে আছে। চার-পাঁচ বছর বয়স হবে বড়জোর। ফরসা, গোলগাল চেহারা। মুখটা ঈষৎ হাঁ হয়ে আছে। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছা করে।

আরও পড়ুন

ভালো করে খেয়াল করার পর সুহান বলল, ‘এখন সন্দেহের বশে একদম পুলিশে ফোন করে বসবি? পুলিশকে ভুল তথ্য দেওয়া যে আইনত দণ্ডনীয়, জানিস?’

‘সেটা জানি, ভাইয়া। আমার কথা পুরোপুরি শোনো তো আগে!’

‘বল, কী বলবি।’

‘বাবুটা একবারও নড়েনি। ধরে নিতে পারো গভীর ঘুমে আছে। একটু ভালো করে দেখো, বাবুর মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। অথচ লোকটা একটিবারের জন্যও সেটা মুছিয়ে দিচ্ছে না। তার বাচ্চাটার দিকে খেয়ালই নেই।’

‘আচ্ছা, মানলাম। বাবা নয় ওই লোক। চাচা-মামাও তো হতে পারে।’

‘যাও, তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম তোমার কথা ঠিক। তাহলে প্রশ্ন আসে, এই লোক এইখানে কী করছে?’

‘কী করছে আবার? খাচ্ছে। ওই দ্যাখ, কফি আর কী যেন নিয়ে বসেছে। পাস্তাই তো মনে হচ্ছে।’

‘পাস্তা অ্যারাবিয়াত্তা। সাড়ে চার শ টাকা করে রাখছে পার বোল।’

‘বাব্বাহ! তুই এত কিছু খেয়াল করে ফেলেছিস?’

‘আরও একটু চিন্তা করে দেখো। আজকের ওয়েদারের অবস্থা কেমন?’

‘বাপ রে বাপ! আর বলিস না। থার্টি এইট ডিগ্রি সেলসিয়াস দেখাচ্ছে অ্যাপ। তার ওপর ফিলস লাইক ফর্টি থ্রি! এটা কেন জিজ্ঞেস করছিস? আইসক্রিম খাবার ধান্দা? একদমই না! তোর ঠান্ডার ধাঁত আছে। বাসায় গিয়েই শুরু হবে কাশি...’

‘উফ, ভাইয়া! ডিটেকটিভ কাজের মধ্যে বকবক করছ।’

‘আবহাওয়ার সাথে ডিটেকটিভের সম্পর্ক কী?’

‘আছে। সম্পর্ক আছে।’ বিজ্ঞের মতো হাসি হেসে বলল রোহান, ‘লোকটার বেশভূষা খেয়াল করো তো, ভাইয়া। একে ঘরের ভেতর পরে আছে সানগ্লাস আর ক্যাপ। আচ্ছা তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম ওটা খুলতে ভুলে গেছে। কিন্তু অমন চালবাজের মতো ভুসভুসে মাস্কটা ওই লোক পরে আছে কেন?’

আচমকা তাকে দুদিক থেকে এসে ধরে ফেলল দুজন শক্তপোক্ত যুবক। হাত-পা ছুড়ে ছোটার চেষ্টা করল লোকটা, লাভ হলো না। যুবক দুজন সুহানের বন্ধু: রাজিন আর সোহেল। এর মধ্যে ওদের দুজনকে ফোন দিয়ে ডেকে ফেলেছে সুহান। অল্প কথায় বুঝিয়ে দিয়েছে অবস্থা।

এই প্রথম সুহানের চেহারায় সিরিয়াস একটা ভঙ্গি ফুটে উঠল। লোকটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে রোহানের কথার সত্যতা যাচাই করে নিল। আসলেই তো! এই গরমের মধ্যে ও রকম একটি জিনিস পরে থাকার তো কথা নয়! ও রকম মাস্ক সাধারণত বাইকাররা পরে। সুহান নিজেও বাইক চালায়। জানে, জিনিসটা খামাখা পরে থাকাটা মোটেও আরামদায়ক নয়। এই গরমের মধ্যে তো নয়ই।

‘ঠিক কথা বলেছিস রে রোহান!’

‘আরও ব্যাপার আছে। খেয়াল করেছিলে যে লোকটা ক্যাশে দাম দিয়েছে খাবারের?’

‘বাব্বাহ! এইটাও খেয়াল করে বসে আছিস?’

‘এখন প্রশংসার সময় নয়, ভাইয়া। এটা আমি বললাম কারণ আমি জানি এখানে বিশেষ ব্যাংকের কার্ড দিয়ে পে করলে একটা বিশাল ক্যাশব্যাক অফার আছে, জানোই তো। তুমি নিজেও তো কার্ডে পে করেছ।’

‘তা করেছি। কিন্তু এটা দিয়ে তো কিছুই প্রমাণিত হয় না। এই লোকের হয়তো কার্ড নেই।’

‘আছে।’

‘আছে মানে?’

‘কার্ড আছে।’

‘তুই জানিস কী করে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল সুহান।

‘লোকটার মানিব্যাগটা টেবিলের ওপর রাখা। তার কোনা দিয়ে বের হয়ে আছে সবুজ কালারের একটা কার্ড। একই ব্যাংকের একই রকম কার্ড...’

‘আমারও আছে।’ রোহানের কথাটা শেষ করল সুহান।

রোহানদের দিকে খেয়াল নেই সম্ভাব্য অপহরণকারী লোকটার। সে একমনে মোবাইলে কার সঙ্গে যেন কথা বলে যাচ্ছে। বেশ উৎকণ্ঠিত মনে হচ্ছে তাকে।

‘লাভ নেই রে, রোহান।’ বলল সুহান।

‘কী করে লাভ নেই?’

‘পুলিশকে ফোন করে লাভ নেই।’

‘কেন, ভাইয়া?’

আরও পড়ুন

‘কী বলব পুলিশকে? চালচলন দেখে একজনকে কিডন্যাপার মনে হচ্ছে? পুলিশ আমলে নেবে? আর যদিও নেয়ও, সময়মতো আসতে পারবে? আমার তো মনে হচ্ছে এই লোক দ্রুত মুভ করবে।’ শান্ত কণ্ঠে প্রায় ফিসফিস করে বলল সুহান।

‘তাহলে উপায়?’ অসহায় কণ্ঠে বলল রোহান।

‘উপায় তো আছেই।’ বলে উঠে দাঁড়াল সুহান, এরপর রোহানের দিকে ঝুঁকে যেন কী বলল।

মিনিট পাঁচেক পর দুই ভাই ওদের টেবিল ছেড়ে ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়াল। হেঁটে হেঁটে ওই লোকটার টেবিলের কাছাকাছি যাওয়ামাত্র রোহান চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে! এটা রুশলান না?’

লোকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। সে উঠে বাচ্চাটিকে কোলে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, আচমকা দুই ভাই এসে হাজির।

‘হ্যাঁ হ্যাঁ! রুশলানই তো!’ বাচ্চাটাকে দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সুহান, ‘কিন্তু সাথে ইনি কে? অ্যাই আপনি কে?’

এবার লোকটা পুরোপুরি ভড়কে গেল। বাচ্চাটাকে রেখেই ভোঁ–দৌড় দেওয়া শুরু করল এক্সিটের দিকে।

তবে ব্যর্থ হলো।

আচমকা তাকে দুদিক থেকে এসে ধরে ফেলল দুজন শক্তপোক্ত যুবক। হাত-পা ছুড়ে ছোটার চেষ্টা করল লোকটা, লাভ হলো না। যুবক দুজন সুহানের বন্ধু: রাজিন আর সোহেল। এর মধ্যে ওদের দুজনকে ফোন দিয়ে ডেকে ফেলেছে সুহান। অল্প কথায় বুঝিয়ে দিয়েছে অবস্থা।

হট্টগোল লেগে গেল। অনেকেই এগিয়ে এল। পুলিশকে ফোন দেওয়া হলো, কথা বলল সুহান। বেশিক্ষণ লাগল না তাদের চলে আসতে। বাচ্চাটিকে খুব সম্ভবত কড়া কোনো ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। তার ঘুম ভাঙল না। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। এর মধ্যে ওর বাবা-মার পরিচয় বের করার চেষ্টা করা হবে।

‘বাহ্‌, পুলিশ তো বেশ তৎপর হয়ে গেছে বাংলাদেশের!’ বলল রাজিন, ‘ছেলেধরা ধরে খিদে লেগে গেছে রে! কিছু অর্ডার দে তো সুহান!’

আরও পড়ুন

ভাইয়ের সামনে সুহানকে এই নামে ডাকায় রাজিনের দিকে ও কটমট করে তাকাল। সেটা দেখে কিছুটা চুপসে গেল রাজিন। তবে খাবার অর্ডার করল ঠিকই দুই বন্ধুর জন্য।

‘এখন বল তো! ফুডকোর্টে এসে ছেলেধরা ধরে ফেললি কেমনে রে তোরা দুই ভাই?’ স্যান্ডউইচে কামড় বসাতে বসাতে বলল সোহেল।

‘ক্রেডিট আসলে আমার না, রোহানের।’ বলল সুহান, ‘ও খেয়াল করেছে যে এই লোকের অ্যাটিচুড যথেষ্ট অফ। এবং আমাকেও কনভিন্স করেছে।’

‘মোটেই ক্রেডিট শুধু একা আমার নয়, ভাইয়া।’ প্রতিবাদ করল রোহান, ‘রাজিন ভাইয়াদের ডাকার প্ল্যানটা তোমার ছিল। ওই লোকের মুখোমুখি হওয়ার পুরো প্ল্যানটা তোমার ছিল। আরও একটা সূত্রও তোমার মাধ্যমে পেয়েছি।’

‘আমার মাধ্যমে সূত্র পেয়েছিস? কী সূত্র?’ কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল সুহান।

‘মনে আছে, আমরা যে গত শীতে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলাম?’

‘খুব মনে আছে।’

‘বাসে বাবা-মা একসাথে বসেছিল আর তুমি–আমি একসাথে, তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমার মনে আছে, বাসে আমার তন্দ্রা চলে এসেছিল। আজকের এই বাবুটার মতোই মাথা আমার একদিকে হেলে গিয়েছিল। আমার মনে আছে কী পরম যত্নে তুমি আমার মাথা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলে। লোকটার যদি আসলেই কেউ হতো বাবুটা, সে–ও কি একই কাজ করত না?’

আরও পড়ুন