খে'কুরে

কুকুরের প্রদর্শনীতে এই যাদের দেখা গিয়েছিল তাদের ফের দেখা গেল পরদিন সকালে

দোতলা একটা পুরনো একটেরে বাড়িতে, লোহার জালি বেড়া আর পপলার গাছে বাড়িটা

রাস্তা থেকে আলাদা করা।

'নমস্কার ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ!' দূর থেকে চেচিয়ে বললে ভালিয়া, 'বে'চে গেছি। আমি আগেই এসেছি, দেখলাম কুকুর হাজির।'

'তাই নাকি, এল কোত্থেকে?'

'কাল আপনার মুখ থেকে একেবারে দৈববাণী বেড়িয়েছিল: ভবঘুরে কুকুর। টাকাও লাগবে না, অ্যাকাউন্টেন্টের সঙ্গে ঝগড়াও করতে হবে না।'

'হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওইতো ডাক শুনছি!' সানন্দে বলে উঠল তরুণটি।

গেটের দিকে গেল ওরা। সিড়ি দিয়ে উঠে একটা ছোট্ট ঘরে শাদা ওভারঅল পরলে। তারপর বারান্দা দিয়ে হেটে গেল কালো অয়েলক্লথে মোড়া দরজাটার দিকে।

আরও পড়ুন

কুকুরের করুণ ডাক ভেসে এল ওদের দিকে। লম্বা হলঘরটায় দুই সারি খাঁচা। কালও এ সব ছিল ফাঁকা, আর আজ লোহার শিকের ওপাশে ঘুরছে ফিরছে, গোঁ গোঁ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে এক পাল কুকুর।

বিনা পাসপোর্টের এই ভবঘুরেগুলো কিন্তু মোটেই খুশি নয়। স্বাধীন জীবনে অভ্যস্ত ওরা, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে, ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে ডাকতে লোকের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে, আঙিনায় মরিয়া লড়ালড়ি করতে ওরা অভ্যস্ত। যাই বল না কেন স্বাধীন জীবন বড়ো কঠোর: খাওয়া নেই, বৃষ্টি বাদলা আছে, শীতে জমে যায় পায়ের থাবা। কিন্তু তবু সে যে স্বাধীন এই অনুভূতি, তাদের দেখে ঘরোয়া সোহাগী কুকুরদের ভয়ে কাঁপুনি সে যে এক মস্ত ব্যাপার!

'ঘেউ ঘেউ করছে দেখুন ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ, একেবারে মরিয়া হয়ে,' নালিশ জানালে জমাদার।

'কুকুর বলেই তো ঘেউ ঘেউ করছে,' আধা রহস্য আধা গুরুত্বের স্বরে বললে ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ।

'ছয় নম্বর খাঁচাটার কুকুরটা কিন্তু বেশ বাধ্য পোষমানা,' বলে চলল জমাদার, 'রাস্তার কুকুর হলে কী হবে, ভারি সোহাগী। আমায় এর মধ্যেই চিনে ফেলেছে...'

খাঁচার ওপর ফলক আঁটা আছে। তা থেকে মেয়েটি সানন্দে নাম পড়ে শোনাল, "গুবরে"- কী চমৎকার কুকুর!'

গুবরের চেহারাটা মিষ্টি। শিকের ওপাশে লাফালাফি করল সে, পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল, লেজ নাড়তে লাগল, বোঝা যায় সোহাগ কাড়ার ইচ্ছে।

'সে কী, প্রফেসর এখানে আগেই এসেছিলেন?' জিজ্ঞেস করলে ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ। 'এসেছিলেন একেবারে ভোর সকালে,' জমাদার জানাল, 'সুন্দরীকে দেখা মাত্রই নাম দিয়ে দিলেন "গুবরে”।'

আরও পড়ুন

শাদা ওভারঅল গায়ে ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ ধীরে সুস্থে খাঁচা থেকে খাঁচায় এগিয়ে গেল, ক্ষীণদৃষ্টি চোখ কুচকে নজর করে দেখতে লাগল প্রতিটি কুকুরকে। খাঁচার ভেতর থেকে বন্দীরাও তাকে পর্যবেক্ষণ করতে ছাড়ল না।

আগন্তুকদের দিকে সবার চেয়ে বেশি করে তাকিয়ে দেখল কিন্তু লম্বামুখো একটা শাদা কুকুর। এখানকার সব কুকুরের মতো এটিও রাস্তার কুকুর। কিন্তু দৈবক্রমে স্বাধীনতা পেয়ে ভবঘুরে হবার আগে তার ছিল এক মনিব, আর নাম ছিল তিয়াপা।

চশমা পরা তরুণ আর মেয়েটিকে সে দেখেই চিনেছিল। কাল দিনের বেলা ওদের কাছ থেকেই পালিয়ে রেলিঙের তলে গিয়ে ঢুকেছিল সে। সেখানে কারা যেন তাকে জাপটে ধরে,

গলায় দড়ি বেধে টেনে তোলে এক ঝরঝরে মোটর ভ্যানে, ধরা পড়া কুকুরের ডাকে সে ভ্যান তখন ভরপুর। রাত্তিরে তিয়াপা কাটিয়েছে কুকুরের খোঁয়াড়ে, সকালে মালটানা মোটর ভ্যানে করে এসেছে এই বাড়িতে।

অন্য কুকুরগুলোর মতো ডাকছিল না সে, কিছু তার চাই না, কাউকে সে বিশ্বাস

করে না। 'আরে দেখুন তো ভালিয়া, এটা সেই প্রদর্শনীর সেই কুকুরটা না?' তিয়াপার সামনে থেমে

জিজ্ঞেস করলে ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ।

ভবঘুরেটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল ভালিয়া।

'তাই নাকি? আরে হ্যাঁ, ঠিক। ওইটাই, স্পিৎসের মতো দেখতে। তবে কাল ছিল আরো নোংরা।'

মানুষটা দরজার হাতল ধরতেই তিয়াপা খাঁচার কোণ থেকে চাপা গলায় গরগর করলে।

'সাবধান কমরেড ইওলকিন,' জমাদার বললে, 'কুকুরটা ভারি রগচটা।' ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ হেসে ঢুকল খাঁচার মধ্যে।

'আমরা যে পূর্বপরিচিত...'

হাতটা বাড়িয়ে দেওয়া মাত্রই তিয়াপা খপ করে এসে কামড়ে দিল তার হাতের তালুতে। 'ঐ! মাগো!' চেচিয়ে উঠল ভালিয়া, যেন ওকেই বুঝি কামড়েছে। যন্ত্রণায় মুখটা একটু কুচকে উঠল ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচের।

'আরে শয়তান, খে'কুরে!'

'বটেরে বেয়াদব!' চেচিয়ে উঠল জমাদার, 'কামড় দেখাচ্ছিস, দাঁড়া তোকে এই ঝাড়ু দিয়ে দেখাচ্ছি!'

ঝাড় নিয়ে এগিয়ে গেল সে।

ভবঘুরেটি কোণ ঘে'সে গিয়ে ওঁৎ পাতল, লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠল তার ঘাড়ের ওপর।

ছোট্ট একটা গর্জন শোনা গেল, তারপর শুরু হল এমন ঘেউ ঘেউ যে মনে হল এই বুঝি দমবন্ধ

হবে কুকুরটার। গোটা পালও সঙ্গে সঙ্গে গলা মেলাল। ঝাড়ু দেখেই অসম্ভব ক্ষেপে উঠল

কুকুরগুলো।

'ঝাড়ু সরিয়ে নিন বলছি!' কড়া গলায় বললে ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ। 'আমারই দোষ।

আর কুকুরের ওপর চোটপাট করবেন না। ঝাড়ুটা বরং সাধারণত লুকিয়েই রাখবেন। আমাদের দরকার চুপচাপ, শান্তি।'

রুমাল দিয়ে ডাক্তারের হাত বেধে দিলে ভালিয়া। তারপর চলে গেল দুজনে। জমাদার কিন্তু শুনিয়ে শুনিয়ে আরো অনেকক্ষণ বকবক করলে এই বলে যে এমন কুকুরও

আরও পড়ুন

আছে যারা ভালোমানুষির মূল্য দেয় না, মোটেই বোঝে না কে কেমন ধারা লোক, এমন কি সম্মানী বৈজ্ঞানিক ডাক্তারদেরও কামড়াতে ছাড়ে না।

বকবক করতে করতে খাঁচাগুলো খুলে হোসপাইপ দিয়ে প্রতিটি কুকুরকে জল দিলে, খড় পাতলে, তারপর ডিশে করে নিয়ে এল সুস্বাদু যবের সুপ। তিয়াপার খাঁচাতেও একটা ডিশ সে রাখলে, তারপর সঙ্গে সঙ্গেই চলে গেল গুবরের কাছে।

'কী রে গুবরে, কেমন লাগছে আমাদের এখানে?' নিজের পেয়ারের কুকুরটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলে জমাদার, গুবরে অবিশ্যি ততক্ষণে তৃপ্তিসহকারে হাড় চিবাতে শুরু করেছে, 'খুব এসে পড়েছিস যা হোক। রাস্তা থেকে একেবারে সরাসরি ইনস্টিটিউটে, সরকারী টাকায় খাবি থাকবি। কিন্তু কেন জানিস? কারণ তুই দেখতে ছোটো। আমাদের এখানে ছোটোরই কদর।'

অদ্ভুত সব কথা বলছিল লোকটা। কুকুরের দুনিয়ায় এতদিন ধরা হত, যে কুকুর সবচেয়ে বাড়া সেই সুখী। তার ভাগ্যেই সর্বদাই আঁচড় মেলে কম, মুখরোচক হাড় মেলে বেশি। একটা গ্রেট ডেইন বা ভেড়া-খেদানো কুকুর হবার সাধ কোন ছোটো কুকুরটার না আছে? আর এ জমাদারের দেখছি সবই উলটো...

নিজের সুপটি চেটেপুটে খেলে তিয়াপা, কিন্তু খুব একটা শান্তি পেলে না। সত্যি কেমন করে পাবে। ভেবেছিল অপরাধের জন্যে শাস্তি পেতে হবে। তার বদলে এসে গেল খাবার। কিছুই বুঝে উঠতে পারল না তিয়াপা। হয়ত বা অন্ধকারের অপেক্ষায় আছে সব, তখন জাপটে ধরে গলায় দড়ি বেঁধে ঝাড়পেটা করবে?

নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ল ও। বেশ সতর্ক' লঘু ঘুম হলেও সে টের পেলে না কখন জমাদার তার খাঁচার ওপর খড়ি দিয়ে লিখে দিল "খে'কুরে"।

আরও পড়ুন