বিশ বছর পর

অলংকরণ: এস এম রাকিব

চৈত্র মাসের থমথমে বিকেল। চারদিকে কেমন যেন গুমোট ভাব। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হচ্ছে যখন–তখন। প্রয়োজন ছাড়া রাস্তায় বের হচ্ছে না মানুষ।

এ রকম এক সময়ে হারুনকে চোখের সামনে দেখে আমি চমকে উঠলাম। রাস্তার ওপারে একটা চটপটির ভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে চটপটি খাচ্ছে। পরনে লাল-কালো চেকের হাফহাতা শার্ট। ছোট ছোট করে চুল কাটা, মুখের আদলের চেয়ে বড় একটা চশমা পরা। মাথা নিচু করে চটপটি খাওয়ার সময় চশমাটা প্রায় খুলে পড়ে যাচ্ছে, আঙুল দিয়ে বারবার সেটাকে ঠিকঠাক করতে হচ্ছে। এই দৃশ্য আমার বহু চেনা, চোখের সামনে দেখেছি অনেকবার। নইলে এটাকে দেজাভ্যু বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু শেষবার দেখেছি, সেটাও মনে হয় বিশ বছর আগে। তারপর এখন যখন আবার দেখছি, ওর বয়স একটুও বাড়েনি!

প্রাথমিক চমকটা কাটতে বেশ কিছুক্ষণ লাগল। বুকের ভেতর হৃৎস্পন্দনের গতি টের পাচ্ছি। দ্রুত পায়ে রাস্তা পার হলাম। সামনে গিয়ে বললাম, ‘তুই? এখানে?’

আমি ওকে দেখে যতটা অবাক হয়েছিলাম, ও বোধ হয় বিরক্ত হলো ততটাই। ঝাল দেওয়া চটপটি খেতে গিয়ে ফরসা মুখ লাল হয়ে গেছে, ঘাম জমেছে কপালে। ঝাল খেতে পারে না ও, তাও জোর করে খায়। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপাল মুছে বলল, ‘সরি...!’

দুই সেকেন্ড সময় নিয়ে আবার বলল, ‘আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না...’

আমি একটু হাসলাম। চেনার তো কথাও নয়। বিশ বছরে আমি তরুণ থেকে মধ্যবয়স্ক এক মানুষে পরিণত হয়ে গেছি। মুখে বলিরেখা দেখা যায়, গোঁফটা বড় রাখি, আধপাকা দাড়িটাও খোঁচা খোঁচা, কাঁচাপাকা চুল, শরীর হয়ে গেছে ভারী। এ রকম একটা মানুষের সঙ্গে সদ্য গ্র্যাজুয়েট হওয়া হালকা–পাতলা গড়নের তরুণকে চট করে মেলানো কঠিনই। তা-ও সে ক্ষেত্রে স্মৃতি বেশ জীবন্ত হতে হবে।

আমি ওকে মনে করানোর চেষ্টা করলাম, ‘আরে আমি! কালাম। ল-এর ছিয়াশি ব্যাচ, মনে নেই?’

ছেলেটা আক্ষরিক অর্থেই খাওয়া থামিয়ে আমার কথা বোঝার চেষ্টা করছে। চশমার কাচ ভেদ করে আমার চেহারা পড়ার চেষ্টা করছে, মনে করতে চাচ্ছে, কোথায় আমাকে দেখেছে। পারল না। বলল, ‘সরি, আমি আপনাকে চিনতে পারছি না। আপনি আমাকে কীভাবে চেনেন?’

এবার আমি একটু ধাক্কা খেলাম। অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বের হলো। হারুনকে আমি কীভাবে চিনি? এই ইতিহাস তো ঠিক মনে নেই। দুজন আলাদা ডিপার্টমেন্টে ছিলাম। কিন্তু সে সময় ভার্সিটিতে রাজনীতি করতে গিয়ে আমরা বন্ধু হয়ে যাই। কত সভা, মিছিল-মিটিং করা হয়েছে একসঙ্গে! আজ অমুক এলাকায় যাওয়া, তো কাল তমুক নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। কাজ করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেলে মাঝেমধ্যে ওর বাসায়ও থেকে গেছি। সেসব স্মৃতি আমার মাথায় নাহয় গুরুত্ব নিয়ে থেকে গেছে, তাই বলে ওর মাথায়ও একইভাবে থাকবে, এমন তো না-ও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ঠিক কোন ঘটনা বলে নিজের পরিচয় দিলে ও চিনবে, বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

আরও পড়ুন

মরিয়া হয়ে বলে উঠলাম, ‘ওই যে... টিএসসির বাইরের দেয়ালে এক রাতে চিকা মারতে গিয়ে ধরা পড়লাম যে...পুলিশ তোকে আর আমাকে ধরে নিয়ে গেল। পরদিন সকালে আঙ্কেল এসে ছাড়িয়ে নিয়ে গেলেন...’

হারুন হাতের আধখাওয়া চটপটির প্লেটটা রেখে দিল। চশমা খুলে হাতে নিয়ে ভ্রু আরও কুঁচকে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এ ঘটনা আপনি জানেন কী করে? কে বলল আপনাকে? কার হয়ে কাজ করেন?’

বললাম, ‘আরে আমি তোর সঙ্গেই তো ছিলাম... কার হয়ে কাজ করব আবার? ভুল ভাবছিস কেন?’

এর মধ্যে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে গেছে। একটু পরই পুলিশ টহল দিতে শুরু করবে এদিকে। ভার্সিটির ছাত্রদের বয়সী কাউকে দেখলেই আটকাবে, তুলে নেবে। এসব খবর পুলিশের সোর্স হিসেবে আমার কাছে থাকে। এই ছেলে হারুন না হলেও যে রাজনীতির সঙ্গে আছে এবং মাঝখানে ধরাও খেয়েছে, সেটা স্পষ্ট। বাইরে থাকা ওর জন্য বিপজ্জনক।

ও মাথা নেড়ে বলল, ‘আপনি থাকতে যাবেন কোন দুঃখে? ছিল তো হাবীব। আপনি কি ওর কেউ? ওর বাড়ি থেকে আসছেন?’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই... তুমি হারুন না?’

বলল, ‘না তো। আমি মামুন। আপনার মনে হয় কোনো ভুল হচ্ছে।’

থমকে গেলাম। এই মুহূর্তে কী ঘটছে, সেটা মাথার মধ্যে প্রসেস হচ্ছে না। আমি যে ঘটনার রেফারেন্স টানলাম, সেটার সঙ্গী হিসেবে ওর মাথায় আমি নেই। কিন্তু আমার মাথায় ও-ই আছে। দ্রুত মেলানোর চেষ্টা করলাম, ভুলটা কোথায় হচ্ছে?

হারুনের যে চেহারা স্মৃতিতে আছে, সেটার সঙ্গে সামনে থাকা ছেলেটা যে হুবহু মিলে যাচ্ছে, এটায় কোনো ভুল নেই। শুধু ওর বয়স বাড়েনি। কিন্তু সেটা তো বাড়ার কথাও নয়। তাই বলে হারুনের নাম কেন মামুন হবে?

এর মধ্যে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে গেছে। একটু পরই পুলিশ টহল দিতে শুরু করবে এদিকে। ভার্সিটির ছাত্রদের বয়সী কাউকে দেখলেই আটকাবে, তুলে নেবে। এসব খবর পুলিশের সোর্স হিসেবে আমার কাছে থাকে। এই ছেলে হারুন না হলেও যে রাজনীতির সঙ্গে আছে এবং মাঝখানে ধরাও খেয়েছে, সেটা স্পষ্ট। বাইরে থাকা ওর জন্য বিপজ্জনক।

শুকনো হাসি দিয়ে বললাম, ‘আমার চেনা এক ছেলের সঙ্গে তোমাকে মিলিয়ে ফেলেছি। কিছু মনে কোরো না। পুলিশ টহল দেবে, তুমি বরং হলে ফিরে যাও।’

চটপটির দাম দিতে দিতে ছেলেটা বলল, ‘হলে ফিরব না কোথায় ফিরব, এ নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না, আর আমি হলে থাকিও না...’

মুখ ফসকে বলে ফেললাম, ‘কোথায় থাকো? পিলখানায়?’

আরও পড়ুন
এর মধ্যেই ওর ফোনটা বেজে উঠল। ওপাশ থেকে কী বলল শোনা যাচ্ছে না, তবে আন্দাজ করতে পারছি। কোনো একটা জায়গায় যেতে বলছে ওকে, যেখানে হুট করে একটা মিটিং ডাকা হয়েছে। ঠিক আমি যেভাবে লোকমারফত হারুনকে খবর পাঠিয়েছিলাম।

এবার ভূত দেখার মতো চমকে উঠল ছেলেটা। রাস্তায় লোকজন আরও কমে গেছে। আশপাশে তাকিয়ে ভড়কে যাওয়া গলায় জোর এনে জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যি করে বলেন, কে আপনি? আমাকে চেনেন কীভাবে আর এত কিছু জানেন কীভাবে?’

বাসার ঠিকানাও কি তাহলে মিলে গেছে? এটা জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। বেশি বেশি হয়ে যায়। মাথা নাড়িয়ে বললাম, ‘আন্দাজে ঢিল ছুড়েছি। ভয় পেয়ো না। সন্ধ্যার পর তো বাইরে থাকা নিরাপদ নয়, এ জন্য এভাবে বললাম।’

এর মধ্যেই ওর ফোনটা বেজে উঠল। ওপাশ থেকে কী বলল শোনা যাচ্ছে না, তবে আন্দাজ করতে পারছি। কোনো একটা জায়গায় যেতে বলছে ওকে, যেখানে হুট করে একটা মিটিং ডাকা হয়েছে। ঠিক আমি যেভাবে লোকমারফত হারুনকে খবর পাঠিয়েছিলাম।

ফোন রেখে আমার দিকে ঘুরে বলল, ‘ঠিক আছে, আমার যেতে হবে। চলি। সাবধান করার জন্য ধন্যবাদ।’

বলেই গটগট করে হাঁটা শুরু করল, আমার জবাবের অপেক্ষা করল না। প্রায় নিভে আসা সন্ধ্যার আলোয় দেখতে পাচ্ছি, ছেলেটা সামনের মোড়ের দিকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। জোর গলায় হাঁক দিলাম, মামুন!

ডাক শুনে থেমে গেল। আমি দ্রুত পা চালিয়ে কাছাকাছি গেলাম। বললাম, ‘তোমাকে যেখানেই ডেকেছে, যেয়ো না। বিপদ আছে। অন্য কারও বাড়িতে যাও।’

‘দেখেন, আপনি আগাগোড়া সেই তখন থেকে কী বলে যাচ্ছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি কখন থেকে আমাকে ফলো করছেন? সত্যি করে বলেন।’

‘তোমাকে আমি আজই প্রথম দেখলাম। আর তিন-চার বছর পর ঢাকায়ও এলাম আজ। ফলো করার প্রশ্নই ওঠে না। দেশের পরিস্থিতি তো খুব একটা ভালো নয়, সেই কারণে বলা...’

আরও পড়ুন

‘ঠিক আছে, আপনি আপনার চিন্তা করেন। আমার যেটা ভালো মনে হয়, সেটা করছি। থ্যাঙ্ক ইউ। আমাকে আর ফলো করবেন না দয়া করে।’

এরপর ও আর দাঁড়াল না। সত্যিই অদৃশ্য হয়ে গেল। আমার আর কিছু বলার থাকল না। হারুনকেও সেদিন রাস্তায় কেউ একজন সতর্ক করেছিল। ও শোনেনি। আমার দেওয়া খবর শুনে চলে গেল, মোহাম্মদপুরে, বিশ্বাস করেই। পুলিশ সেখানে ছিল। এ ছাড়া তো আর কোনো উপায়ও আমার ছিল না। আমি না থাকলে কে দেখত আমার মা-বাবাকে? তারপর আর কেউ ওকে দেখেনি।

কোথা থেকে বহু পুরোনো এক অপরাধবোধ এসে এলোমেলো করে দিল আমাকে। যে কাজ হারুনকে সতর্ক করা লোকটা করেনি কিংবা আমিও কোনো দিন করিনি, সেটাই করলাম। ফোনে ডায়াল করলাম, ‘বস, যে ছেলের কথা বলছিলেন, হলে গা ঢাকা দিসে। চলে আসেন।’

আমি বিশ্বস্ত লোক। আমার কথা সন্দেহ করে না ওরা। গাড়ি নিয়ে এসে হলে রেইড দেবে এখন। ছোট্ট এই মিথ্যা বলার বাইরে আর কোনো ক্ষমতা নেই আমার। তবে এটার কারণে যা হবে, সেটার জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তি পাব।

ছেলেটার কানে হলের রেইডের কথা পৌঁছে যাবে। সেটা শুনে ও হয়তো কোথাও পালিয়ে যাবে। ফোন করা বন্ধুটাকে হয়তো আর বিশ্বাস করবে না। আর?

ওর বয়সটা কোথাও আটকে থাকবে না!