রকেট উড়ে গেল

গত বছরের শুকনো বাদামী হয়ে ওঠা ঘাসে একটা প্রহরীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে রকেট। ছাঁচলো মুখটা আকাশের দিকে, নীল গম্বুজটার ঠিক মধ্য বিন্দুতে। ওপর থেকে খোলা গবাক্ষের কালো চোখটা তাকিয়ে আছে মসৃণ প্রান্তরের দিকে, ব্যস্তসমস্ত মনুষ্যমূর্তিগুলোর দিকে, রকেটের সুঠাম দেহ বরাবর লাইন বেয়ে ওঠা লিফটের কেবিনের দিকে, নিচু নিচু মোটরগাড়ির দিকে।

কাজ করছে না শুধু একটি মানুষ, কোনো তাড়াহুড়ো যেন তার নেই। উচু হাই বুট পরে পা ফাঁক করে সে নিচ থেকে চেয়ে আছে ওপরে, কালো চোখ গবাক্ষটার দিকে।

লোকটি দ্রোনভ। কিছুই সে করছে না কারণ সে ইঞ্জিনিয়র নয়, টেকনিশিয়ানও নয়। তারা ছোটাছুটি করছে রকেটের চারপাশে, উঠছে লিফটে, পর্যবেক্ষণ করছে, চারিদিক থেকে পরখ করে দেখছে তাদের আদরের বাচ্চাটিকে। ডাক্তার অপেক্ষা করছে তার নিজের সময়ের জন্যে। শুধু তো দেখবার জন্যে সে আসেনি!

"একচক্ষু দানব!” কালো গবাক্ষওয়ালা বিরাট রূপোলী নলটার দিকে সানন্দে তাকিয়ে ভাবছিল দ্রোনভ, "অপরূপ একচক্ষু মহাকায়! কত যে তোর আপন জনক জননী ধাত্রীর সংখ্যা... দিন রাত্রি ধরে তোর কথা ভেবেছে বৈজ্ঞানিকরা। ইঞ্জিনিয়র টেকনিশিয়ানরা তোর এই চেহারায় তোকে গড়ে তুলেছে কাগজের পাতায় ড্র্যাফট হিসাবে, ছক হিসাবে, সংখ্যা হিসাবে। তোর মস্ত ইস্পাতের দেহটায় এখনো লেগে আছে শ্রমিকদের হাতের তাপ। আর তোর মজৎ হার্ট তোর যে ইঞ্জিনে জ্বলছে হাজারো ডিগ্রির তাপ, সেটাকে বানিয়ে তোলা হয়েছে ধাতুবিদ্যার চুল্লিতে। আর রক্ত তরল আগুনে রক্তটা তোর দেহে ঢেলে দিয়েছে রাসায়নিকরা। কিন্তু মাথাটা যদি তোর না থাকত, তাহলে কোথায় উড়তিস তুই মহাদেহী? পদার্থবিদদের চমৎকার সব সরঞ্জাম আর স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতিগুলোকে ধন্যবাদ দে। গাণিতিকদের স্তুতিও করতে হবে বৈকি, তোর প্রতিটি পদক্ষেপ তারা গুণে রেখেছে।

"রকেট, দ্যাখ কত তোর মা বাপ। সবাইকে মনে রাখাই দায়। রকেট মানে ইতালীয় ভাষায় সাধারণ একটা নল, এই নাম যখন ইতালিয়ানরা তোকে দেয়, তখন নিশ্চয় তারা ভাবতে পারেনি এমন পরাক্রান্ত হয়ে উঠবি তুই। এক্ষুনি থর থর করে কেপে উঠবে মাটি। দুনিয়া কাঁপবে রুশী রূপকথার সেই মহাবীর ইলিয়া মুরোমেৎস ঘোড়ায় চড়ে ক্ষেতে ছুটে এসেছে বলে নয়, কাঁপবে কারণ তুই মাটি ঠেলে দিয়ে উঠে যাবি ওপরে, তোর একটা চোখ দিয়ে আরো কাছ থেকে তাকিয়ে

দেখবি তারাগুলোকে। চমৎকার!"

'সময় হয়ে এসেছে,' দ্রোনভের ভাবনার সূত্র ছি'ড়ে গেল কার একটা কণ্ঠস্বরে।

এসে দাঁড়াল ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ আর ভালিয়া। কোলে তাদের কুকুর। দুজনের গায়েই ল্যাবরেটরির শাদা আলখাল্লা: কিছুক্ষণ আগে রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে আকাশযাত্রীদের, ওজন নেওয়া হয়েছে, ফিতের ওপর রেকর্ড করা হয়েছে হার্টের স্পন্দন, টেম্পারেচার মাপা হয়েছে। খেকুরে আর পাম ইতিমধ্যেই ট্রে'র সঙ্গে বেল্ট বেধে তৈরি- দেখাচ্ছে দুটি ছোটো ছোটো প্যারাশুটিস্টের মতো বেশ শান্ত হয়েই আছে তারা। দ্রোনভকে দেখে চিনতে পেরে একটু লেজ নাড়লে কেবল।

দ্রোনভ বললে, 'সময় হয়ে এসেছে।'

রকেটের দিকে এগিয়ে গেল তারা।

লিফটের কেবিন উঠে গেল ওপরে। কুকুররা দেখল কেবল হলদে ঘাসগুলো কী দ্রুত সরে যাচ্ছে তাদের কাছ থেকে, আর তাদের বিদায় দিতে এসেছে যারা তারা কিন্তু তাকালে ওপরের দিকে।

খোলা গবাক্ষের সামনে থামল লিফট। কেবিনের ভেতর ট্রে ফিট করল ডাক্তাররা। পোষাকের তল থেকে আসা কানেকটিং তারগুলোকে যোগ করলে যন্ত্রের সঙ্গে। সব কিছু যাচাই করে দেখলে। ফের আর একবার মন দিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হল যাত্রী কেবিন।

টুপির মতো দেখতে এই ছোটো কেবিনটার ভেতরে সব কিছুরই আয়োজন রাখা হয়েছে। সে যেন একটা আলাদা দুনিয়া। তাপ থেকে বাঁচানোর জন্যে ফেল্টের স্টাফিং ওড়বার সময় রকেট উনুনে - চাপানো কেটলির চেয়ে কম গরম হবে না। নিঃশ্বাস নেবার জন্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার, তাতে বাতাস মেশানো। কন্ট্রোলার কলকব্জা।

কুকুরের দৈহিক অবস্থা সব তাতে রেকর্ড হয়ে যাবে টেপে, আর রেডিও যোগে পাঠাবে নিচে। আর আছে মহাকাশযাত্রীর লড়য়ে সহচর অ্যাক্সেলেরোগ্রাফ; বিদ্যুৎ তরঙ্গে স্পন্দিত রেখা ফুটবে তার টেপের ওপর, বোঝা যাবে অদৃশ্য শক্তির চাপটা কেমন। আর যাত্রীদের ঠিক মাথার ওপরেই ঝুলছে কিনো ক্যামেরা - ওড়বার প্রথম থেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের ছবি তুলে যাবে এ ক্যামেরা। সেই সঙ্গে ছবি তুলবে ঘড়ির ডাক্তাররা যাতে বুঝতে পারে, ঠিক কোন সময়ে কী ঘটেছিল; ফিল্মের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারবে কলকব্জার রেকর্ড।

প্যারাশুটটা কিন্তু ডাক্তারদের চোখে পড়ল না। মেঝের নিচে শক্ত করে সেটা ফিট করা আছে কোথাও। যখন দরকার পড়বে আপনি খুলে যাবে।

'তা কেমন দেখলে?' জিজ্ঞেস করলে দ্রোনভ।

'আমার মতে তো চমৎকার,' উত্তর দিলে ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ, 'তু-১০৪ প্যাসেঞ্জার

এরোপ্লেনের চেয়ে খারাপ নয়। তাহলে কী, স্ট্যুয়ার্ডেস? চলি।'

'ফের দেখা হবে খে'কুরে, আসি পাম!' বিদায় জানালে ভালিয়া, 'ছটফট করিস নে, ভালোই উৎরোবে।'

'ফের দেখা হবে,' বললে অন্যেরা।

গবাক্ষ বন্ধ হল ঢাকনায়। ভ্রমণের সময় দেখবার জন্যে যাত্রীদের রইল শুধু ক্ষুদে প্লেটের চেয়েও ছোট্ট একটু জানলা। তার ভেতর দিয়ে একে একে উ'কি দিয়ে দেখল ভালিয়া, দ্রোনভ, ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ। তারপর নিচে নেমে এল তারা। ছোট্ট বৃত্তটা দিয়ে দেখা যেতে থাকল কেবল নীল আকাশ।

ট্রে'র ওপর মাথা টান করে পাশাপাশি শুয়ে রইল কুকুরদুটো। শান্তভাবে তাকিয়ে দেখতে লাগল খোকুরে। পামের মুখখানা নির্বিকার - জোর করে হাই তুলছে সে। এমনি ভাবেই অনেকক্ষণ ধরে বসে রইল তারা, সন্দেহই হল না যে ঘটনাটার জন্যে তাদের এতদিন ধরে তৈরি করা হয়েছে, সেটা শুরু হয়ে গেছে: ইনস্ট্রুমেন্টগুলো শুরু করে দিয়েছে তাদের রিপোর্টাজ, অক্সিজেন সিলিন্ডার বাতাস ছাড়ছে, মাথার ওপর টিকটিক করতে শুরু করেছে কিনো ক্যামেরা।

রকেটের চারপাশের মাঠটা জনশূন্য হয়ে গেল। কংক্রিট সিড়ি দিয়ে লোকেরা নেমে এল শেলটারে, তার ওপর ঝিক ঝিক করছে স্টেরিওটিউবের কাচ। টেকনিশিয়ানরা চলে এল সবচেয়ে শেষে।

শেলটারটায় বেশ ভিড়। তাহলেও দ্রোনভ ভাবলে, "কী ভালোই হত যদি ওভারঅল পরা, মজুরের পোষাক পরা আরো লোক আসত এখানে।

এক মিনিটের জন্যেও যদি তারা লেদ মেশিন ছেড়ে, চুল্লি ছেড়ে, ল্যাবরেটরির ফ্লাস্ক ছেড়ে, ড্র্যাফটিং'এর বোর্ড ছেড়ে এসে দেখে যেতে পারত তাদের নিজের হাতের এই কীর্তিটাকে, ক্লান্ত মুখ ভরে উঠত হাসিতে। না, আসবে না ওরা। কাজে ব্যস্ত। ওদের সন্তান তো শুধু এই একটি নয়..."

রকেট ছাড়ার সময় হয়ে এল। ইঞ্জিনিয়ররা চলে গেছে তাদের নিজের নিজের জায়গায়, ইনস্ট্রুমেন্টের কাছে, সুইচের কাছে। মুখ তাদের শান্ত। অপেক্ষা করে আছে কেবল চোখ আর হাত - কম্যান্ডার গখন প্রধান সুইচটায় চাপ দেবে - স্টার্ট।

সব মনোযোগ তার দিকে। কোনো কথা নেই কারো মুখে। অটুট নীরবতা। বড়ো বড়ো সেকেন্ড ঘড়ির কাঁটাটা কেবল লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে টিকটিক করে।

ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ বুঝে উঠতে পারে না কম্যান্ডারের কোনো চাঞ্চল্য নেই কেন। স্কুলের অঙ্কের মাস্টার হিসেবে তাঁকে মনে আছে তার: কামানো মাথা, পুরুষ্টু চেহারা, গায়ে একটা ঘরোয়া জ্যাকেট। অঙ্কের মাস্টার সর্বদাই শান্ত, এমন কি ইনস্পেকশনের সময়েও, যখন সারা ক্লাস গুন গুন করত। অঙ্কের মাস্টারকে তবু বোঝা যায়, কিন্তু এই অচঞ্চল কম্যান্ডার রকেটের কোথাও কিছু গোলমাল হবে না এমন স্থির বিশ্বাস উনি পেলেন কোথা থেকে?

হঠাৎ কম্যান্ডারের গলা শোনা গেল: 'রেডি!'

সেকেন্ডের কাঁটার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও চেচিয়ে গুণতে শুরু করলেন:

'পাঁচ... চার... তিন... দুই... স্টার্ট!'

টেলিভিশনের স্ক্রীনে দর্শকরা দেখল, আগুনের ঝলকে আলোকিত হয়ে উঠল রকেটের নিচটা, ধোঁয়ার মেঘে ঢেকে গেল তার গা। তারপরেই উড়ে এল বিস্ফোরণের আওয়াজ - আছড়ে পড়ল শেলটারের দুয়োরে। হ্যাঁ, জোর বটে।

রকেট ধীরে ধীরে, যেন আপন মনে, খানিকটা উপরে উঠে গেল ধোঁয়ার মেঘ ভেদ করে, আগুনের ধারা ছাড়ল, তারপর উত্তপ্ত গ্যাসের ঝকঝকে গোলাপী একটা থামের ওপর ভর দিয়ে ছুটল আকাশে, প্রতি সেকেন্ডে বাড়তে থাকল তার গতি। বিদ্যুতের মতো সোনালী ঝিলিক দিয়ে ছোট্ট হয়ে গেল একটা ঝকমকে বিন্দুতে।

সঙ্গে সঙ্গে ইওলকিনের মনে পড়ল তার নিজের যন্ত্রের কথা। সে দিকে ছুটে যেতেই বাধা পেল মানুষের দেয়ালে।

পরাক্রান্ত এই ক্ষেপণকের সেবকেরা - মজুর টেকনিশিয়ান ইঞ্জিনিয়ররা, সবাই গিয়ে

ভিড় করে ঘিরে দাঁড়াল সবজে মতো স্ক্রীনটার সামনে, চঞ্চল আলোক তরঙ্গ থেকে মুহূর্তের জন্যেও চোখ ফেরাল না। কিছুই বুঝল না তারা কিন্তু দেখতে থাকল গভীর মনোযোগে। ছুটন্ত তরঙ্গে খবর আসছে যাত্রীদের।

পা মাড়িয়ে মাপ চেয়ে ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ এগিয়ে যাচ্ছিল তার যন্ত্রের দিকে। পিঠে তার কিল মারলে ভালিয়া: তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি! ক্ষোভে তার চোখে জল এসে পড়েছিল আর কি: যন্ত্রের ভাষা আয়ত্ত করার শিক্ষা নিয়েছে সে, ইনস্টিটিউটের পরীক্ষায় পাশ করেছে, কিন্তু কিছুই দেখার উপায় নেই। যন্ত্র অবশ্য সবই রেকর্ড করে চলবে, টেপ সে পরেও বারবার করে পড়বে, কিন্তু ও যে নিতান্তই একটা হাঁদা তাতে সন্দেহ নেই। দ্রোনভের বেশ মজা, আগে ভাগে সে আন্দাজ করে গিয়ে জায়গা নিয়েছে।

শেষ পর্যন্ত স্ক্রীনের সামনে গিয়ে পৌঁছল দুজনে, তারপর থেকে জায়গা ছেড়ে নড়েনি। রকেটে তখন ঘটছিল এই।

আচমকা প্রচণ্ড একটা গর্জন এসে পড়ল যাত্রীদের ওপর। এদিক ওদিক মাথা নাড়াতে লাগল তারা, ধরবার চেষ্টা করছিল কোত্থেকে আসছে এই বিদঘুটে উত্ত্যক্ত করা আওয়াজটা। কিন্তু টের পেল না যে এটা তাদের যাত্রার সঙ্গীত, আকাশে উড়ছে তারা!

আরও পড়ুন

শক্ত করে বন্ধ করা কেবিনটাকে ওদিকে কেবলি উড়িয়ে নিয়ে চলেছে রকেট। নিজের যাত্রাপথে সে অটল, সে পথ গেছে বিমানের উচ্চতা ও রুট ছাড়িয়ে; মেঘ ফাঁড়ে উঠে রকেট পৌঁছল স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের সেই উচ্চ স্তরে, যেখানে ফুলকিতে ফুলকিতে জ্বলে ওঠে উল্কা আর আমাদের রাস্তার নিওন ল্যাম্পের বিজ্ঞাপনের মতোই অনায়াসে ঝলক দেয় মেরুজ্যোতির রঙ বদল। কিন্তু এই সব অদ্ভুত চিত্তাকর্ষক জায়গাগুলোতেও থামল না রকেট, নিজের পথ ধরে উঠে গেল আরো উচুতে যেখানে আমাদের পরিচিত বাতাসের বদলে আছে কেবল অদৃশ্য গ্যাস কণিকা; নিরেট করে বন্ধ কেবিনের মধ্যে লুকিয়ে না থাকলে যেখানে মুহূর্তের মধ্যে আমাদের যাত্রীদের মৃত্যু অনিবার্য।

খুবই দুঃখের কথা যে খেকুরে আর পাম তাদের গোল জানলাটা দিয়ে বাইরে দেখতে পারছিল না। প্রথমে ওরা কেবল থর থর করেছে ভাইব্রেশনের কাঁপুনিতে, তারপর অদৃশ্য গুরুভার কে যেন তাদের মাথাটা নিচে ঠেসে বিনা বাক্যব্যয়ে উঠে বসেছে তাদের ওপর। বুক চেপে গেল কুকুরগুলোর, ঢিপ ঢিপ করতে লাগল হার্ট, সমস্ত দেহ হয়ে উঠল লোহার মতো ভারি। কিন্তু ভয় পেলে না তারা, শান্ত হয়ে শুয়ে রইল। হঠাৎ থেমে গেল ইঞ্জিন...

কল্পনা করো, হঠাৎ যেন তুমি উড়ে গেলে সিলিঙের কাছে বেলুনের মতো। মেঝের ওপর দাঁড়াতে যাবে হঠাৎ উড়ে গেলে বাতাসে।

আমাদের যাত্রীদের ব্যাপারেও ঠিক তাই ঘটল। আশ্চর্য নরম সবল হাতে কে যেন তুলে নিল তাদের। পা মাথা লেজ কিছুই যেন তাদের নেই। পালকের চেয়েও হালকা। বেল্টে বাঁধা না থাকলে উড়ে বেড়াতে পারত পাখির মতো।

রগড় দ্যাখো! এমন অভিজ্ঞতা লোকের হয় কেবল স্বপ্নে।

এই অদ্ভুত ব্যাপারে খুশি হয়ে উঠল খেকুরে, চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল ফুর্তিতে। জানলা দিয়ে তাকাল সে। দেখা গেল মিশ কালো একটা আকাশ আর ঝকঝকে চোখ ধাঁধানো সূর্য। যেমন ভীষণ, তেমনি সুন্দর।

তারপর কেবিনের চারদিকে তাকাল খেকুরে, গবাক্ষ দিয়ে রোদ এসে পড়েছে। সে রোদ গিয়ে পড়েছে সামনের দেয়ালে, সেখান থেকে ঝলক দিচ্ছে। রোদের ছোপটা কিছুক্ষণ এক জায়গায় থেকে দেয়াল বেয়ে এসে পড়ল খেকুরের বাঁ চোখে। চোখ মিটমিট করলে খে'কুরে, ঘোঁৎ ঘোঁৎ করল, মাথা ঝাঁকাল, তারপর যখন চোখ মেলল, দেখল রোদ্দুরের পোঁচটা গিয়ে বসেছে সিলিঙে। সেখানেও স্থির হয়ে রইল না, কেবলি জায়গা বদলাতে লাগল।

খোকুরের চোখদুটো হয়ে এল আধবোঁজা, লেজ নড়তে লাগল সানন্দে আর গলা দিয়ে ছোট্ট যে আওয়াজটা বেরল সেটা ঠিক 'হিহি' করে হাসির মতো।

খেকুরে নির্ভয়ে খেলায় মাতল, রোদ্দুরের ছোপটার ইঙ্গিত কিন্তু সে বুঝল না। ওর জায়গায় মানুষ থাকলে সে অবিশ্যি সঙ্গে সঙ্গেই বুঝত আলোর ছোপটা সিলিং থেকে মেঝেয় যে নেমে এসেছে সেটা অকারণে নয়। ভারহীনতার অবস্থায় মহাকাশযাত্রী বুঝবে কী করে কোনটা 'ওপর' কোনটা 'নীচ', নিজে থাকে নিশ্চল হয়ে, গতি টেরই পায় না। সূর্যের রোদটা কিন্তু বলছিল, "ইঞ্জিন বন্ধ হবার পর তোমাদের রকেটটা প্রথমে উচুতে উঠছিল তারপর থেমে গিয়ে ঘুরে নাক নিচের দিকে করে এখন মাটিতে নামছে। এবার এসে পড়বে বায়ুমণ্ডলের ঘন স্তরের দিকে। সাবধান! সাবধান কিন্তু!"

রোদ্দুরের ছোপটা ঠিকই বলেছিল। মস্ত একটা বাঁক দিয়ে সূর্যের সামনে সারা দেহটা ঘুরিয়ে নিল রকেটটা, তারপর পাক খেতে খেতে নামতে শুরু করল।

মাটির ওপর ডাক্তাররাও জানত, এইবার সবচেয়ে বিপদের লড়াই। নামবার সময় রকেট জটিল পাক খেতে লাগল। পাহাড় গড়িয়ে একটা পিপে নামবার সময় যেমন হয়, তেমনি। ভেতরে যারা আছে তাদের কী হবে?

এক্ষুনি, এক্ষুনি যদি প্যারাশুটটা খুলে যায়, তবেই রক্ষা।

আরও পড়ুন

আর সত্যিই তাই। কী একটা যেন গোপন সংকেত পেয়ে অদৃশ্য শত্রু ঝাঁপিয়ে পড়ল খেকুরে আর পামের ওপর; হাত পা বাঁধা কুকুরদুটোকে পিটতে তার একটুও লজ্জা হল না, ঘুসির পর ঘুসি পড়তে লাগল তাদের ওপর। ধকধক করতে লাগল বুক, ব্যথা করতে লাগল পিঠ, পেটের ভেতর সব যেন খামচে ধরল। মাথায় ঘা খেয়ে অন্ধকার হয়ে এল চোখ। আর পিছন থেকে ঘা খেয়ে রক্ত আবার ছুটে এল মাথায়, আর লালচে ছোপ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল দৃষ্টির সম্মুখে। ।। নভোযাত্রায় ভারহীনতার কয়েক মিনিটের আনন্দের জন্যে এবার যেন প্রতিশোধ নিতে শুরু করল অদৃশ্য শত্রুরা। কুকুরদুটো কিন্তু সবই সহ্য করে গেল, এমন

কি অমন উদাসীন বিধাতা যে যন্ত্র, সেই যন্ত্রও যখন অত বেদম ধাক্কা সইতে না পেরে রেকর্ডিং বন্ধ করে দিলে, তখনও সয়ে গেল তারা।

শেলটার থেকে ছুটে বেরিয়ে এল ডাক্তাররা। তাদের পেছু পেছু বাকিরা। শান্ত পরিষ্কার আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তাদের চোখ টনটন করতে লাগল; পড়ন্ত রকেটটার চিহ্ন নেই কোথাও।

মাথার শিরা দপদপ করতে লাগল: কোথায়, গেল কোথায়?

নীল শূন্যে শেষপর্যন্ত দেখা গেল একটা সরু ধোঁয়াটে ফিতে রকেটের জ্বলন্ত মাথাটার প্রায় অদৃশ্য একটা রেখা। একবার চোখে পড়েই মিলিয়ে গেল। আকাশ ফের ফাঁকা, একেবারে আকাশের নিচের মাঠটার মতোই।

তারপর দপ করে উচুতে ঝলক দিয়ে উঠল একটা শাদা রুমাল। ঝলক দিল, কিন্তু অদৃশ্য হল না। আস্তে আস্তে একটা পালের মতো ফুলে উঠল তা, ধীরে ধীরে নামতে লাগল মাটির দিকে ব্রেক কষছিল। প্যারাশুটের আঁটো - গম্বুজ, আর যে মহার্ঘ বোঝাটা সে নামিয়ে দিচ্ছিল রকেটের তিনকোণা সেই প্রান্তটুকু - আরো পরিষ্কার করে এবার দেখতে পেলে সবাই।

চারিদিকে রোদ্দুর, উৎকর্ণ নীরবতা। অনেক উ'চুতে কোথায় যেন গান গাইছে একটা ভরত পাখি।

কথা নেই লোকগুলোর মুখে, জায়গা ছেড়ে মাঠের মধ্যে দিয়ে ছুটতে লাগল তারা। সবার আগে ধবধব করছিল ডাক্তারদের উড়ন্ত শাদা ওভারঅলগুলো। ঐ যে তাড়াতাড়ি রকেট রক্ষার পালটার দিকে!

মোটর গোঁ গোঁ করে এসে পৌঁছল ছুটন্ত লোকেদের কাছে। কেউ কেউ উঠে বসল জীপ গাড়িতে, কেউ হাত নেড়ে পায়ে হেটেই ছুটতে লাগল।

ইঞ্জিনিয়ররা এসে প্যারাশুটটা খুলে ফেলল। দ্রনোভ আর ইওলকিন একই সঙ্গে গবাক্ষের কাচের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে দেখল: বে'চে আছে কি?

'বে'চে আছে?' সশঙ্কে জিজ্ঞেস করল ভালিয়া, ধৈর্য রাখতে না পেরে পা ঠুকতে লাগল সে, 'আরে, কিছু বলছেন না কেন, তাড়াতাড়ি!'

উত্তর দিলে না ডাক্তাররা। তাড়াতাড়ি করে তারা ঢাকনা সরাতে লাগল, যাত্রী সমেত ট্রেদুটোকে বার করে আনল। বেল্ট খুলতে লাগল।

আরও পড়ুন

'হিপ হিপ হুররে! বে'চে আছে!' চে'চিয়ে উঠে সামনের একটা লোকের কাঁধ ঝাঁকাতে লাগল ভালিয়া, লোকটা সম্ভবত ইঞ্জিনিয়র, 'হিপ হিপ হুররে, কমরেডরা!'

ইঞ্জিনিয়র উবু হয়ে বসে পরখ করছিল তার রকেটটাকে, বোঝা যায় আর কোনো দিকে তার চোখ নেই। ভালিয়ার কথা কিছুই তার মাথায় ঢুকল না যেন, বিব্রতের মতো চোখ মিটমিট করল কেবল।

'আচ্ছা লোক আপনি!' আহতভাবে বললে

ভালিয়া। 'ওরা বে'চে আছে যে! কিচ্ছু হয়নি।' 'হ্যাঁ, খুবই ভালো কথা বৈকি!' সজাগ হয়ে শেষপর্যন্ত উঠে দাঁড়াল ইঞ্জিনিয়র, 'অভিনন্দন নিন।' ভালিয়ার করমর্দন করল সে, তারপর

ডাক্তারদের। 'অভিনন্দন! অভিনন্দন নিন সবাই! সত্যিকারের উৎসব আজ! তবে মাফ করবেন, আমায় এমন যেতে হচ্ছে।'

ইঞ্জিনিয়র ফের গিয়ে বসল নলটার কাছে, মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল ক্ষুব্ধ হয়েছে সে। দ্রনোভ ইঞ্জিনিয়রের অবস্থাটা বুঝেছিল রকেটের নামাটা পুরোপুরি সফল হয়নি; বিশেষজ্ঞরা যা বলে সাবলীল নয়।

তাহলেও সাবাস এই রকেট স্রষ্টারা: যাত্রীরা অটুট, অক্ষত! আমেরিকান রকেট 'ফাউ-২' 'আয়েরোবি' কতবারই তো ভেস্তে গেছে, মারা পড়েছে তার ভেতরকার বাঁদররা। কিন্তু খে'কুরে আর পাম এই তো হাজির। পাশে তাদের রক্ষক, রকেট। না, যাই বলো না কেন, এই কালো হয়ে আসা তপ্ত নলটার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করা উচিত। বিগড়ে যাওয়া বিমানকে ল্যান্ড করিয়ে তার গায়ে যেভাবে চাপড় মেরে আদর করে বৈমানিক...

মাটির ওপর বসে আছে পাম, হাঁপাচ্ছে। লকলক করছে লম্বা লালচে 'জিভটা ঘটনাটা - কাঁপিয়ে দিয়েছে তাকে। খেকুরে কিন্তু পায়ের ওপর খাড়া, চান করার পর যেমন করে তেমনি করে সতেজে গা ঝাড়া দিচ্ছে, রোদ্দুরের গরম, বাসন্তী মাটির গন্ধ, সবুজ ঘাস, পরিচিত সোহাগী গলার স্বরে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে সে। ডাক ছেড়ে সে ছুটে আসে ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচের কাছে, তার ট্রাউজারের ওপর লাফিয়ে পড়ে, জটিল সব লাফঝাঁপ শুরু দেয় সে, কেবিনের মধ্যে রোদ্দুরের সেই ছোপটার মতো। ভেতরে তার যেন একটা স্প্রীং খুলে যাচ্ছে, যা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

আনন্দের এই উদ্দাম নাচ দেখে ভালিয়া খিলখিল করে হেসে ওঠে। ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচও

চুপ করে থাকে না, তার সঙ্গে তাল রেখে হঠাৎ মোটা গলায় হাসতে থাকে সে। আর চোখ

জ্বল জ্বল করে দ্রনোভের। এসে দাঁড়ায় ক্ষুব্ধ ইঞ্জিনিয়র। তার মুখেও হাসি ফোটে। তারপর এসে জোটে আরো আরো অনেক লোক। ফুর্তি'র সংক্রমণ লাগে সবার মধ্যে। 'কীরে বেটি, তাহলে লাগাই আমাদের রুশী নাচ!' কে যেন চেচিয়ে উঠল উল্লাসে আর সবাই তাকিয়ে দেখে: এ সেই সবচেয়ে নির্বিকার মানুষটা, রকেট ক্ষেপণের কম্যান্ডার।

কিন্তু ঘণ্টা বাজিয়ে দিলে ভালিয়া, বন্ধ হল নাচ। বাধ্যের মতো খেকুরে ছুটে গেল তার ডিশের দিকে। পামও উঠল মাটি ছেড়ে, খুট খুট করে চলল তার পিছু পিছু। তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়া শুরু করল কুকুরদুটো। আহারের শেষ হল এক টুকরো সসেজে, তার লোভে খেকুরে সাগ্রহে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল ঠিক সার্কাসের ট্রেনিং পাওয়া কুকুরের মতো। ও যেন বলতে চায়, "দেখলেন তো, যাত্রার কষ্টেও আমার ক্ষিদে মরেনি।"

'ভারি চিটিংবাজ তুই খোকুরে,' ভর্ৎসনা করে মাথা দোলায় ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ।

'সে কী, কেন?' জিজ্ঞেস করেন ক্ষেপণের কম্যান্ডার, 'খে'কুরে? খেকুরে কেন? এমন বাহাদুর, ফুর্তিবাজ কুকুর - আর তার নাম কিনা খে'কুরে?'

কী বলবে ভেবে পেল না ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ। ওকে বাঁচাল দ্রোনভ, বললে, 'ব্যাপার কী জানেন, ওটা হল সাবেকী নাম। আসলে ওকে এখন ডাকে অন্য নামে... বেপরোয়া। সত্যি মন্দ নয়, কী বলেন, বেপরোয়া!'

আরও পড়ুন