কুয়াশার উপহার
‘ভাই আসেন আসেন!’
‘এই মালিবাগ বনানী!’
‘চা লাগব চা?’
অন্যান্য দিনের মতোই কর্মব্যস্ত গঙ্গাবুড়ি। গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে ভিড় লেগেই আছে। শীত শুরু হওয়ায় সূর্যের গরম তাপে পোড়া লাগবে না, এই যা। রাফি আজ প্রথমবারের মতো একা ট্রাভেল করবে। বয়স ১৯, কলেজে পড়ছে। তা-ও এত দিন ওকে একা ছাড়তেন না মা–বাবা। আজ একা চলাফেরার গুরুত্বের বিষয়ে দীর্ঘ বক্তৃতাদানের মাধ্যমে দুজনকে রাজি করাতে পেরেছে সে। এই জায়গাটা ওর চেনা, প্রতিদিনই এখান থেকে বাসে ওঠে। আজও একই সময়ে বাসে উঠে পড়ল সে। ওর সিটের পাশের দেয়ালটাকে দেখলে মুড়ির টিনের কথা মাথায় আসে। জানালা দিয়ে বাইরের কুয়াশা দেখা যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর খানিকটা টলতে থাকা হেলপার এল। পকেট হাতড়াতেই ধুপ করে উঠল রাফির বুক। তাড়াহুড়ায় আজ ওয়ালেটটা আনেনি সে!
হেলপারের লাল চোখে বিরক্তি ঘনাল। ‘কী হইল?’
মনে মনে নিজেকে এক শটা জুতাপেটা করতে থাকল রাফি। ওর মা-বাবার কথাই ঠিক, এখনো একা চলার যোগ্য হয়ে ওঠেনি রাফি। এখন ভাড়া দেবে কীভাবে? ওর পাশের সিটে বসা ভদ্রলোক এতক্ষণ সবকিছুই দেখছিলেন। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে পকেট থেকে টাকাটা বের করলেন তিনি। রাফি লজ্জায় পড়ে গেছে, ভদ্রলোককে নিষেধ করল। হেলপারকে বলল টাকা আনতে ভুলে গেছে, এখনই নেমে যাচ্ছে সে। তা-ও জোর করে ভাড়া দিয়ে দিল লোকটা।
পাশে বসে থাকলেও এতক্ষণ খেয়াল করেনি রাফি। ধন্যবাদ দিতে দিতে লোকটাকে ভালো করে দেখে নিল সে। ঢাকা শহরে এমন মানুষ পাওয়া কঠিন বটে। বেশির ভাগই স্বার্থপর, এক ফ্ল্যাটে কেউ মরে পড়ে থাকলেও পাশের ফ্ল্যাটের কারও খবর নেই। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। চুল-দাড়ি অর্ধেক পেকেছে। পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি। নিজের পরিচয় দিল রাফি।
‘পরেরবার ভালো করে দেখে নিয়ো সঙ্গে টাকা আছে কি না,’ স্মিত হাসল লোকটা। ‘সব সময় কেউ এগিয়ে আসবে না।’
মাথা ঝাঁকাল রাফি। ‘আপনার নাম–ঠিকানা যদি দিতেন...যত দ্রুত পারি টাকাটা ফিরিয়ে দিতে চাই।’
‘আরে রাখো! টাকার দরকার নেই আমার। তোমাকে একটা কথা বলব শুধু। শুনবে?’
‘বেশ, বলুন না!’
‘আজ রাতে পার্টিতে যেয়ো না।’ ফিসফিস করে বলল সে।
শুনে অবাক হলো রাফি, আজকে রাতে তো ওর কোনো পার্টিই নেই! জিজ্ঞেস করতে যাবে, তখনই কলেজে নেমে গেল বাস। আজ খানিকটা দেরি হয়ে গেছে, কথা না বাড়িয়ে তাকে বিদায় জানিয়ে নেমে গেল রাফি। একরাশ কালো ধোঁয়া নির্গত করে চলে গেল বাসটা।
*
রাতে টুকটাক পড়ছিল রাফি। হঠাৎ সৌরভের ফোন। ‘মামা, ফরহাদের বার্থডে আজকে। ভুলে গেলি?’
মাথা চুলকাল রাফি। ভুলেই গেছিল সে।
‘এখনই চলে আয় ওদের বাসায়। পার্টি শুরু হলো বলে।’ ফোন রেখে দিল সৌরভ।
ফোনটা রাখতেই বৃদ্ধ লোকটার কথা মনে পড়ল রাফির। রাতে যে পার্টি হবে, সেটা তিনি কীভাবে জানতেন? রহস্যটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, শেষে তার সতর্কবাণীর কথা ভেবে না যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিল সে। সৌরভকে টেক্সট করে দিল জরুরি কাজে আটকে গেছে, আসতে পারবে না তাই।
*
পরদিন সকাল। ফোনটা চালু করতেই টুংটাং শব্দে আসতে লাগল মেসেজ। গতকালের পার্টিটায় দুর্ঘটনা হয়েছে। সব ঠিকই চলছিল, হঠাৎ ফরহাদের বাসার কারেন্টের লাইনে শর্টসার্কিট হয়। লেগে যায় আগুন। সৌরভসহ ছয়জনের দেহে পুড়ে গেছে অনেকটা।
শকটা খেয়ে মাথা নষ্ট হওয়ার জোগাড় রাফির। পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে যেন সে। কিছুক্ষণ পর কোনোমতে ধাতস্থ হতে পারল সে।
বাসস্ট্যান্ডটা আজও অন্য সাতটা দিনের মতো। তবে আজ কলেজে না, দগ্ধ বন্ধুদের দেখতে যাচ্ছে হাসপাতালে। বাসে চড়ে বসার আগেই পকেট চেক করে নিল রাফি, আছে ওয়ালেটটা। বাসে উঠে প্রথমেই চোখজোড়া খুঁজল ওই লোকটাকে, পেল না।
সিটে পড়ে ছিল পুরোনো একটা পত্রিকা। তিন দিনের বাসি খবর। তা-ও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে পড়তে ইচ্ছে, করল ওটা। হঠাৎ চোখ আটকে গেল একটা শোক সংবাদে। কোনো এক ভার্সিটির প্রফেসর মারা গেছেন। এমনিতে এ রকম সংবাদে কোনো আকর্ষণ বোধ করে না রাফি, তবে এবারের কেসটা ভিন্ন।
খবরে ছোট করে তার সাদা-কালো ছবি ছাপা হয়েছে, সেটাই মূল বিষয়।
ছবিটা সেই ভদ্রলোকের।
লেখক: শিক্ষার্থী, দশম শ্রেণি, রামগড় সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, খাগড়াছড়ি