সন্ধ্যায় যখন কুকুরদের বিশ্রামের সময় তখন ভারি একঘেয়ে লাগত খাঁচার মধ্যে। আড়িমুড়ি ভাঙত কুকুরগুলো, পা টান টান করে দিত। প্রথমে চুপি চুপি হাই উঠত একটা দুটো। এক মিনিট পরে খোলাখুলিই হাই তুলত সকলে। কেউ ডেকে উঠত একটু, কেউ হাঁচত, করুণ সুরে গান ধরত কেউ।
কিন্তু যেই এসে দাঁড়াত ডাক্তারটি, অমনি মেজাজ বদলে যেত সকলের। বন্ধুর মতো আলাপ করত মানুষটা, রসিকতা করত, খেতে দিত চিনি।
সবচেয়ে মজার গল্প হত খোকনের সঙ্গে। মাথাটি একটু হেলিয়ে বেশ মনোযোগ ফুটিয়ে ভালো মানুষের মতো তাকাত খোকন।
ডাক্তার বলত, 'ছি ছি ছি খোকন, কী হচ্ছে এসব বলো তো।'
"কী হচ্ছে?” নিরীহের মতো চোখে জিজ্ঞেস করত খোকন।
'কাল কোনো বকুনির কাজ করোনি, সেন্ট্রিফিউগে বেশ ভালোই দেখালে...'
"সে আর বলতে,” কালো নাকটা তুলে সগর্বে যেন সায় দিত খোকন।
'কিন্তু আজ? ল্যাবরেটরিতে যেতে না যেতেই আমার টেবলের ওপর লাফিয়ে উঠে ভিজিয়ে দিলে কাগজপত্রগুলো?'
"সে কী?” খোকনের সমস্ত চেহারায় ফুটে উঠত ভারি অবাক একটা ভাব।
'তা করতে হলে কি টেবলের ওপরেই উঠতে হবে?' জিজ্ঞেস করল ভুক্তভোগী।
"নিশ্চয় নয়,” বোদ্ধার মতো লেজটা নড়ত খোকনের।
'আমার একটা চেনা পুডল কুকুর আছে,' বলে চলত ডাক্তার, 'ভারি বুদ্ধিমান কুকুর। অমন ব্যাপার সে কদাচ করে না, যদিও থাকে সাধারণ বাসা বাড়ির ফ্ল্যাটে। আর তুই খোকন- একেবারে ইনস্টিটিউটের মধ্যে, ছি ছি!'
ইচ্ছা থাক না থাক শিকারের গল্প চালাতে হল ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচকে, ছেদ যা পড়ল সে শুধু কুকুরগুলোকে মাঝে মাঝে যথাস্থানে বসিয়ে রাখার জন্যে। বুড়োকে তো আর বলা যায় না যে এরা সাধারণ ভবঘুরে কুকুর নয়, মহাকাশযাত্রী। বিশ্বাসই করত না যে অমন সব কেউকেটারা চলেছে নাকি এক সাধারণ ট্রেনে।
যত বেশি "ছি ছি”, ততই ঘন ঘন চোখ মিটমিট করত খোকন। আস্তে আস্তে উঠে সে কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, ঝোলা লেজটি ফিরিয়ে রাখত সকলের দিকে।
অলক্ষ্যে কেটে যেত সন্ধ্যা, ঘুম নেমে আসত চোখে। রোজ রাত্রে ঝুপঝুপ করে পড়ত বরফ, আর ক্রমেই বাড়তে লাগল নিটোল বরফের স্তূপ, উচু হয়ে উঠতে লাগল জানলার দিকে। বরফের স্তূপের ওপর পা ফেলে ফেলে যেদিন নববর্ষ এসে ঢুকবে ঘরে, তার আর বেশি বাকি নেই।
একদিন ট্রেনিঙের বদলে খেকুরে ও আরো দুটি কুকুর, ফুটকি আর খোকন, আঙিনায় বরফের ওপর দৌড়াদৌড়ি করার অনুমতি পেল। পরে ওজন নেওয়া হল তাদের, রক্ত পরীক্ষা
হল, এস্ত্রে ঘরে নিয়ে গিয়ে ছবি তোলা হল বুকের। এসবই আগেও হয়েছে। কিন্তু এবার যেন ডাক্তারদের মধ্যে ভারি একটা সমারোহ।
যে ঘটনাটার জন্যে ইনস্টিটিউটে এতদিন ধরে তোড়জোড় চলেছে, এবার সেটা ঘটার পালা।
'ভালিয়া ফুটকির রক্তের রিপোর্টটা আর একবার পরীক্ষা করে দেখুন। স্বাভাবিক থেকে ওর খানিকটা ব্যতিক্রম কেন?' উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ।
'ভারি আশ্চর্য',' ভালিয়া বললে, 'খাবার ব্যবস্থায় অনেক জোর দেওয়া হয়েছে, ভালোই ঘুময়, অথচ এ কী!'
ফুটকির অসুখ করেনি তো?
ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ পরীক্ষা করে দেখল কুকুরটাকে। তারপর চিন্তিতভাবে পায়চারি করতে লাগল ঘরময়। ব্যাপারটা সে বুঝতে পারছে না।
আধঘণ্টা পরে ভালিয়া জানালে, 'ধরতে পেরেছি কী হয়েছে। গুবরে ওকে কামড়ে দেয়। জিনা ভরোবিওভা একটা লজেন্স দিয়েছিল ফুটকিকে, গুবরে সেটা কেড়ে নেবার জন্যে ছুটে যায়। কিন্তু ভয় নেই, কাল সব ঠিক হয়ে যাবে।'
ইওলকিন ভর্ৎসনার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ভালিয়া কিন্তু ভারি খুশি এই জন্যে যে ফুটকির কোনো অসুখ করেনি; খুবই একটা সাধারণ ব্যাপারই ঘটেছে।
সেদিন রাতে শীতের মাথায় কী খেয়াল চাপল, জানলার কাচে বরফের নক্সা যথাসম্ভব ফুটিয়ে তুলল সে।
সকালে ইওলকিন খাটো ওভারকোট, ফার টুপি আর হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা ফেল্ট বুট পরে খেকুরে ফুটকি আর খোকনকে বেল্ট বেঁধে নিয়ে এল আঙিনায়। সেখানে তাদের জন্যে দাঁড়িয়ে ছিল তিনজন ডাক্তার। আর জানলা দিয়ে দেখছিল সমস্ত সহকর্মীরা। ভালিয়া, জিনা, দ্রোনভ, প্রফেসর এবং আরো যত লোকের সদয় হাত দিয়ে এই পরীক্ষাধীনেরা এতদিন গেছে তারা সবাই বিদায় জানাল তাদের। হাত নাড়ল তারা, জানলার ওপাশ থেকে কেউ বা চেচিয়েও উঠল।
গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল দুটি 'পাবেদা' মোটরগাড়ি। কুকুরগুলোকে নিয়ে ইওলকিন উঠল একটা গাড়িতে, ডাক্তাররা উঠল অন্যটিতে। যাত্রা শুরু হল একেবারে অটুট নীরবতায়, বিশেষ রকম সমারোহের মুহূর্তে সাধারণত যা হয়। গুঞ্জন উঠল ইঞ্জিন থেকে। তরতরিয়ে গাড়ি ছুটল।
মোটরের যখন দরজা খোলা হল, তখন চারিদিকের খেলামেলায় অবাক হয়ে গেল এই চারপেয়ে দলটা। চারিদিকে চেয়ে চেয়ে ওরা কিছুতেই বুঝতে পারল না ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট,
বলতে কি গোটা শহরটাই কোথায় উধাও হয়ে গেছে। সামনে তাদের কেবল বরফে ঢাকা মসৃণ প্রান্তর, তার ওপর জেগে আছে কয়েকটা ডানাওয়ালা যন্ত্র।
"এরোপ্লেন ওরা এই প্রথম দেখল কিনা," শঙ্কিত হয়ে ভাবল ইওলকিন, "তাতে আবার খোলা মাঠ... ফের ওদের ঐ ভবঘুরে ভাবটা জেগে উঠবে না তো? ঘেউ ঘেউ শুরু করবে না তো?”
না ডাকল না। শান্তভাবেই গেল এরোপ্লেনের কাছে, হালকা পায়েই উঠল সিড়ি বেয়ে।
যাত্রী যারা, তারা হল রকেট ইঞ্জিনিয়র, টেকনিশিয়ান, কনস্ট্রাক্টর, আগেই বসে ছিল সিটে খে'কুরে, ফুটকি আর খোকনকে তারা অভিনন্দিত করল এমন সোরগোল তুলে যে ওরা বিব্রত হয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে আশ্রয় নিলে ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচের পায়ের কাছে। মোটর গর্জন করে উঠল, প্লেন দুলে উঠে আস্তে আস্তে স্টার্ট নিল। তারপর দাঁড়িয়ে যেন বা মোটরের শব্দটা শুনল একটু, আর ছুটতে শুরু করল সবেগে, প্রতি সেকেন্ডে স্পীড বাড়তে বাড়তে যাত্রীদের অলক্ষ্যে মাটি ছেড়ে উড়তে লাগল। -
ঘণ্টা দুই পরে বিশেষ নির্দেশে বাধ্য হয়ে অবতরণ করতে হল বিমানকে রেডিওয় খবর - এল যে সামনে ভয়ানক তুষার ঝটিকা শুরু হয়েছে। যাত্রীরা আর বিমানের খালাসীরা গিয়ে উঠল এরোড্রোমের অনতিবৃহৎ হোটেলটায়। অচিরেই বাড়িটার চারধার ঘিরে শুরু হল বরফের ঝাপটা, ওড়বার মাঠ ঘাট সারা দুনিয়া যেন হারিয়ে গেল দৃষ্টি থেকে।
সকালেও দেখা গেল তুষারের উন্মাদ নৃত্য। দিনটা ছিল ৩১শে ডিসেম্বর। সবাই ভাবল,
ছোট্ট হোটেলটায় নববর্ষ উদ্যাপন করা যাবে, কিন্তু হঠাৎ অপ্রত্যাশিত খবরে মুখ আঁধার হয়ে গেল সবার: আবহাওয়ার কারণে রকেট ছাড়া হবে না।
মস্কোয় ফেরা যেতে পারে হয় ট্রেনে করে, নয়ত তুষার ঝটিকা থামলে বিমানযোগে। জানলা দিয়ে আবহাওয়ার হাল দেখে মস্কোবাসীরা রায় দিলে, "ট্রেনই ভালো।" গোছগাছ শুরু হল।
খে'কুরে, খোকন আর ফুটকির পরামর্শ চাইল ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ, 'কী করা যায় এখন? মাত্র এক ঘণ্টা সময়, বুফে বন্ধ, এদিকে রাক্ষসের মতো ক্ষিদে পেয়েছে। স্যুটকেস এখানে রেখে দিয়ে তোদের সঙ্গে নিয়ে যাব ভোজনালয়ে? উ'হ, তোদের ঢুকতে দেবে না... নাকি তোদের এখানে রেখে স্যুটকেস নিয়ে ছুটব খাবারের সন্ধানে? উ'হ, ফেরার সময় হবে না... তাহলে এই করা যাক! স্যুটকেস সঙ্গে নিয়েই সবাই চল যাই ভোজনালয়ে। যা হবার হবে!..'
ভোজনালয়ে ওভারকোট রাখার লোকটি সন্দিগ্ধ কটাক্ষপাত করলে কুকুরগুলোর দিকে, কিন্তু চেন বাঁধা আছে দেখে কিছু বললে না; স্যুটকেসটাও রাখতে রাজী হল।
ওয়েট্রেস টেবলের কাছে ছুটে আসতে গিয়ে আর একটু হলেই বসে থাকা কুকুরগুলোর গায়ে পা লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল আর কি। উবু হয়ে বসে তিনটি 'সোনামণির' গায়েই হাত বুলিয়ে উল্লাস প্রকাশ করলে সে।
ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচের জন্যে সে সুপ এনে দিলে প্লেটে আর কুকুরগুলোর জন্যে লোহার বাটিতে। প্রথম সুপটা দেওয়া হল টেবলেই, বাকিগুলো সরাসরি মেঝের ওপর।
লোহার বাটিতে যবের সুপ উচিত মতোই ঠান্ডা। বুদ্ধিমান বাবুর্চি তার মধ্যে অন্য কোর্স থেকে কিছু হাড়ও ফেলে দিয়েছিল। ডিনারের মতো ডিনার হল বটে!
ট্রেন ধরা গেল একেবারে কাঁটায় কাঁটায়। কুকুর সমেত ডাক্তার ছুটে গেল ৮ নং ওয়াগনের দিকে। কনডাক্টর টিকিট চেক করে ফিরিয়ে দিয়ে কুকুরবাহী যাত্রীটিকে কড়া গলায় বললে:
'ওহে ছোকরা, তিনটে কুকুর সঙ্গে নেওয়া চলবে না। রেগুলেশনে আছে ওয়াগনে দুটো কুকুরের বেশি নয়। কোনো উপায় নেই।'
ট্রেন দাঁড়ায় মাত্র দু মিনিট, ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ তা জানলেও ধৈর্য না হারিয়ে শান্তভাবে বললে:
'মাপ করবেন, দুটো ওয়াগনে ভাগাভাগি হওয়া আমার পক্ষে তো সম্ভব নয়, তাই রেগুলেশনটা ভাঙতেই হচ্ছে।'
এই বলে সে স্যুটকেস উপরে ঠেলে দিয়ে প্রথমে খোকন, তারপর ফুটকি আর শেষে খে'কুরেকে তুলে দিলে। ছেড়ে দিল ট্রেন।
ওয়াগনটা 'কুপে' ওয়াগন নয়, লোকে একেবারে ভরপুর। তিনটে মনোরম কুকুর নিয়ে লোকটা নিজের সিটের দিকে এগুতেই খুশি আর কৌতূহলের একটা কোলাহল উঠল। হঠাৎ কোথা থেকে এমন ছেলে মেয়ে জুটে গেল যে মনে হল যেন সব বাক্স প্যাঁটরা থেকে বেরিয়ে এসেছে। ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ জায়গা নিয়ে বসতে না বসতেই পাশের একটা বুড়ো তার ফেল্ট বুট আর খাটো ওভারকোটের দিকে কটাক্ষপাত করে প্রশ্ন করতে শুরু করলে:
'আপনি শিকারী বুঝি? কিন্তু মাপ করবেন, এমন বেজাত কুকুর রেখেছেন যে? নাকি ভালুক শিকারে বেজাত কুকুরেও চলে? এস্কিমো কুকুরের চেয়ে বিশেষ খারাপ হয় না?'
ইচ্ছা থাক না থাক শিকারের গল্প চালাতে হল ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচকে, ছেদ যা পড়ল সে শুধু কুকুরগুলোকে মাঝে মাঝে যথাস্থানে বসিয়ে রাখার জন্যে। বুড়োকে তো আর বলা যায় না যে এরা সাধারণ ভবঘুরে কুকুর নয়, মহাকাশযাত্রী। বিশ্বাসই করত না যে অমন সব কেউকেটারা চলেছে নাকি এক সাধারণ ট্রেনে।
শিকারের গল্প এমনই দীর্ঘ হল যে মস্কো পর্যন্ত ফুরল না।
স্টেশনে নেমে ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ অবাক হয়ে দেখলে ঘড়িতে বারোটা বাজতে কেবল আধঘণ্টা বাকি।
সহচরদের সে জানালে, 'নববর্ষ'টা আমার বাড়িতেই উদ্যাপন করা যাবে। সসেজ খাইয়ে শুইয়ে দেব তোদের।'
বাড়িতে ওরা পৌঁছল ঠিক নববর্ষের সঙ্গে সঙ্গে। খুশি হয়ে উঠল সবাই ইওলকিনের বৌ, মা, আর আটবছরের ছেলে সাশা। একে একে সবাইকে চুমু খেল ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ, তারপর একসঙ্গে সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে বললে:
'কী চমৎকার গন্ধ ছাড়ছে নববর্ষের ফার গাছ থেকে!'
আর খেকুরে, খোকন আর ফুটকির কথা যদি ধরি, তবে বলতেই হবে যে ওদের কাছে সবচেয়ে চমৎকার বলে মনে হয়েছিল কিন্তু সসেজের গন্ধটা। সে সসেজ সানন্দে লেহন করতে লাগল তারা। তারপর ক্ষিদে ঠান্ডা হতে খেলা জুড়ল সাশার সঙ্গে, সফরের কথা আর একটুও মনে রইল না।
সকালে ইওলকিন কুকুরদের নিয়ে এল ইনস্টিটিউটে। দেখা গেল ওদের খাঁচায় এসে
আড্ডা গেড়েছে ভেটেরনারি কেন্দ্র থেকে পাঠানো নতুন বেজাতেরা। পর্যটকদের জায়গা হল
অন্য একটা কামরায়, একটা অনতিবৃহৎ খাঁচার মধ্যে তিন জন সবাই। মোটেই প্রীতিকর হল
না ব্যবস্থাটা। বিশেষ করে এই জন্যে যে কামরায় খালি খাঁচা আরো একটা ছিল।
কিন্তু সে খাঁচা খোলার কোনো লক্ষণ দেখালে না ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ। ফাঁকা খাঁচাটার সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে পরিচিত ফলকটার দিকে সে তাকাল একবার, তারপর চলে গেল।
ফাঁকা খাঁচাটার ওপরে লেখা ছিল: "লাইকা থাকত এখানে।"