চাঁদে যাত্রা ও চন্দ্র প্রদক্ষিণ

ভাবী মহাকাশজয়ী, সপ্তম 'ক' শ্রেণীর ছাত্র গেনা কারাতভের পর্যবেক্ষণ-ডায়েরি থেকে

মানুষ চিরকাল পৃথিবীতে বাঁধা থাকবে না, সে ছুটে যাবে আলো ও শূন্যদেশ লক্ষ্য করে, প্রথমে ভেদ করে যাবে বায়ুমণ্ডলীর সীমা, তারপর জয় করবে সৌরমণ্ডলীয় সমস্ত মহাজগত —ক. এ. ৎসিওলকভস্কি

চাঁদে যাত্রা ও চন্দ্র প্রদক্ষিণ ভাবী মহাকাশজয়ী, সপ্তম 'ক' শ্রেণীর ছাত্র গেনা কারাতভের পর্যবেক্ষণ-ডায়েরি থেকে মানুষ চিরকাল পৃথিবীতে বাঁধা থাকবে না, সে ছুটে যাবে আলো ও শূন্যদেশ লক্ষ্য করে, প্রথমে ভেদ করে যাবে বায়ুমণ্ডলীর সীমা, তারপর জয় করবে সৌরমণ্ডলীয় সমস্ত মহাজগত। ক. এ. ৎসিওলকভস্কি সেপ্টেম্বর, ১৯৫৯ আমি ঠিক ধরেছিলাম! ৎসিওলকভস্কিও অবশ্য ঠিকই বলেছিলেন। চাঁদে উড়ে গেল রকেট। জুল ভার্নের কথামত যারা ভেবেছিল কামান থেকে দাগা গোলার মধ্যে বারবিকেনের সঙ্গে উড়বে তারা, তাদের দেখে হাসি পায়। ইতিহাস প্রমাণ করে দিল। পৃথিবী থেকে প্রথম চাঁদে যাওয়া, এটা কাল ঘটেছে আমাদের বাড়িতে, অবশ্য কোনো সাক্ষী ছিল না। এটার তোড়জোড় আমি করেছি সপ্তাহেরও বেশি দিন ধরে। ১২ই ১৪ই সেপ্টেম্বর 'লুন্নিক-২' যে ভাবে গেছে আমাদের চন্দ্র যাত্রাতেও ঠিক সেই সব গতিরই পুনরাবৃত্তি হয়েছে। দায়িত্ব ভাগ করা হয়েছিল এই রকম: বরকা - বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির কনটেনর আর পেনডেন্ট, আমি কম্যান্ড পোস্ট ও কম্পিউটর কেন্দ্র, ল্যবকা রেকর্ডার-স্টেনোগ্রাফার। -আশ্চর্য', লোকে একই সময়ে কীভাবে রেকর্ড নিতে নিতেই ওরই মধ্যে আবার মহাকাশযাত্রার ব্যাপারে নাক গলাতে আসে সেটা ও ভালোই দেখিয়ে দিয়েছে। ওর হিজিবিজি নোট থেকে পাকাপাকি সব হিসেব বার করা গেছে।

রকেটড্রোমে উদগ্র অপেক্ষায় নিথর হয়ে আছে রকেট। বোকা দর্শকরা মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চাঁদ দেখার চেষ্টা করছিল। কিন্তু চাঁদ নেই আকাশে। বুঝিয়ে বলতে হল রকেট স্টার্ট নেবার সময় চাঁদ থাকবে চক্রবালে। তবেই রকেট চাঁদে গিয়ে পৌঁছবে ঠিক তখন যখন চাঁদ উঠে আসবে দিগন্তের ওপরে সবচেয়ে উচু বিন্দুতে। চাঁদে অবতরণ পৃথিবী থেকে পর্যবেক্ষণ করাও সম্ভব হবে।

শেষ মুহূর্তের তোড়জোড় সব চলল। বিশেষজ্ঞরা (আমি আর ল্যবকা) কনটেনর (বরকা) স্টেরিলাইজ করে নিল: করিডরে বুরুশ দিয়ে ঝাড়া হল তাকে কোনো রকম জীবাণু যাতে চাঁদে গিয়ে পৌঁছতে না পারে। পরে একটা ভুল করে বসা তো বিচিত্র নয়: অস্বাভাবিক একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে জীবাণু হয়ত একটা চান্দ্র হাতী হয়ে উঠতে পারে। পরে বৈজ্ঞানিকেরা চাঁদে গিয়ে হয়ত সিদ্ধান্ত করবেন বহুকাল আগে থেকে হাতী আছে চাঁদে...

হঠাৎ সিগন্যাল বেজে উঠল (এলার্ম ঘড়ির শব্দ)। আমরা ছুটে গেলাম রকেটে। তাহলেও স্টার্ট নিতে দেরি হয়ে গেল এক সেকেন্ড।

রকেটে চাপানো হয়েছে কনটেনর (বরকা ধপ করে গিয়ে বসল চেয়ারে), শোনা গেল বজ্রাঘাতের মতো বিস্ফোরণ (চেয়ারের পায়ের নিচে ফুটতে লাগল ফাঁকা পটকা), রকেটড্রোম ভরে গেল ধোঁয়ায়। যতটা ত্বরায়ন দরকার তা পাওয়া গেল। বায়ুমণ্ডল ভেদ করে উঠে গেল রকেট: ঝাড় দিয়ে চেয়ারে ঠেলা মারলাম আমি, সেটা যেতে লাগল অন্য ঘরে (ওই ঘরটা মহাজগত)।

'দ্বিতীয় মহাজাগতিক গতি টের পাচ্ছিস?' রেডিও যোগে আমি জিজ্ঞেস করলাম বরকাকে।

'না,' ও জবাব পাঠাল।

আরো জোর দিতে হল আর একবার যথোপযুক্ত ধাক্কা দিলাম।

'এবার টের পাচ্ছি,' রাগ করেই বললে বরকা, কিন্তু লাফিয়ে উঠল না, কেননা ততক্ষণে মহাজাগতিক শূন্যে সে পৌঁছে গেছে।

আরও পড়ুন

তাহলেও আর একবার জিজ্ঞেস করলাম। বরকা বললে, প্রতি সেকেন্ডে ও এবার ১১.২ কিলোমিটার করে এগুচ্ছে, মহামতি নিউটন যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ঠিক সেই রকম। কী শক্তি এই বিজ্ঞান! সতের শতকেই নিউটন মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম আবিষ্কার করেছিলেন, শান্তভাবে হিসেব করে দিয়েছিলেন পৃথিবী ছেড়ে যেতে হলে কী পরিমাণ গতি দরকার- দ্বিতীয় মহাজাগতিক গতি। আর আমাদের কনটেনর এখন ঠিক সেই গতিতেই ছুটছে।

ব্যাপারে নাক গলাতে আসে সেটা ও ভালোই দেখিয়ে দিয়েছে। ওর হিজিবিজি নোট থেকে পাকাপাকি সব হিসেব বার করা গেছে।

রকেটড্রোমে উদগ্র অপেক্ষায় নিথর হয়ে আছে রকেট। বোকা দর্শকরা মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চাঁদ দেখার চেষ্টা করছিল। কিন্তু চাঁদ নেই আকাশে। বুঝিয়ে বলতে হল রকেট স্টার্ট নেবার সময় চাঁদ থাকবে চক্রবালে। তবেই রকেট চাঁদে গিয়ে পৌঁছবে ঠিক তখন যখন চাঁদ উঠে আসবে দিগন্তের ওপরে সবচেয়ে উচু বিন্দুতে। চাঁদে অবতরণ পৃথিবী থেকে পর্যবেক্ষণ করাও সম্ভব হবে।

শেষ মুহূর্তের তোড়জোড় সব চলল। বিশেষজ্ঞরা (আমি আর ল্যবকা) কনটেনর (বরকা) স্টেরিলাইজ করে নিল: করিডরে বুরুশ দিয়ে ঝাড়া হল তাকে কোনো রকম জীবাণু যাতে চাঁদে গিয়ে পৌঁছতে না পারে। পরে একটা ভুল করে বসা তো বিচিত্র নয়: অস্বাভাবিক একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে জীবাণু হয়ত একটা চান্দ্র হাতী হয়ে উঠতে পারে। পরে বৈজ্ঞানিকেরা চাঁদে গিয়ে হয়ত সিদ্ধান্ত করবেন বহুকাল আগে থেকে হাতী আছে চাঁদে...

হঠাৎ সিগন্যাল বেজে উঠল (এলার্ম ঘড়ির শব্দ)। আমরা ছুটে গেলাম রকেটে। তাহলেও স্টার্ট নিতে দেরি হয়ে গেল এক সেকেন্ড।

রকেটে চাপানো হয়েছে কনটেনর (বরকা ধপ করে গিয়ে বসল চেয়ারে), শোনা গেল বজ্রাঘাতের মতো বিস্ফোরণ (চেয়ারের পায়ের নিচে ফুটতে লাগল ফাঁকা পটকা), রকেটড্রোম ভরে গেল ধোঁয়ায়। যতটা ত্বরায়ন দরকার তা পাওয়া গেল। বায়ুমণ্ডল ভেদ করে উঠে গেল রকেট: ঝাড় দিয়ে চেয়ারে ঠেলা মারলাম আমি, সেটা যেতে লাগল অন্য ঘরে (ওই ঘরটা মহাজগত)।

'দ্বিতীয় মহাজাগতিক গতি টের পাচ্ছিস?' রেডিও যোগে আমি জিজ্ঞেস করলাম বরকাকে।

'না,' ও জবাব পাঠাল।

আরো জোর দিতে হল আর একবার যথোপযুক্ত ধাক্কা দিলাম।

'এবার টের পাচ্ছি,' রাগ করেই বললে বরকা, কিন্তু লাফিয়ে উঠল না, কেননা ততক্ষণে মহাজাগতিক শূন্যে সে পৌঁছে গেছে।

আরও পড়ুন

তাহলেও আর একবার জিজ্ঞেস করলাম। বরকা বললে, প্রতি সেকেন্ডে ও এবার ১১.২ কিলোমিটার করে এগুচ্ছে, মহামতি নিউটন যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ঠিক সেই রকম। কী শক্তি এই বিজ্ঞান! সতের শতকেই নিউটন মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম আবিষ্কার করেছিলেন, শান্তভাবে হিসেব করে দিয়েছিলেন পৃথিবী ছেড়ে যেতে হলে কী পরিমাণ গতি দরকার- দ্বিতীয় মহাজাগতিক গতি। আর আমাদের কনটেনর এখন ঠিক সেই গতিতেই ছুটছে।

'চাঁদ আর কতদূর?' জিজ্ঞেস করলাম বরকাকে।

কিন্তু লুল্যবকা ব্যাঘাত ঘটাল, মুখস্থ করা সংবাদটা সে জানিয়ে দিলে:

'চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে যে কক্ষে আবর্তন করে সেটা অনেকটা গোলাকার। পৃথিবী থেকে তার সর্বাধিক দূরত্ব অথবা কক্ষপথের অপভূ হল ৪,০৬,৬৭০ কিলোমিটার, সর্বনিম্ন দূরত্ব বা অনুভূ ৩,৫৬,৪০০ কিলোমিটার।'

অবিচলিতভাবেই আমি জানালাম:

'কিন্তু আমরা চাঁদের দিকে যাচ্ছি সোজা রেখায় নয়, হাইপারবোলার রেখায়, বাঁকা পথে। ইলেকট্রনিক কম্পিউটর যন্ত্র থেকে দেখছি আমাদের রকেটের পথ ৩,৭১,০০০ কিলোমিটার।'

'সবই বোঝা যাচ্ছে,' মহাজগত থেকে চেচিয়ে বললে বরকা, 'তার মানে আমাকে উড়তে হবে ৩,৭১,০০০ কিঃমিঃ: ১১.২ কিঃমিঃ/সেকেন্ড অথবা ৩,৭১,০০০ কিঃমিঃ ৪০,০০০ কিঃমিঃ/ঘণ্টা...'

'মস্ত ভুল,' আমি বললাম, 'পৃথিবীর টান? সে কথা ভুলে গিয়েছিস? রকেটের গতি কেবলি কমছে!'

প্রমাণ করে দেবার জন্যে বরকার চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা দড়িটা ধরে একটু পেছনে টানতে লাগলাম। তারপর আমার নোটগুলো নিয়ে অবাক হয়ে যাওয়া শ্রোতাদের দেখিয়ে দিলাম সঠিক গাণিতিক হিসেব কী জিনিস।

বললাম, 'ধর দশমিক দুই আমাদের কালে এর তাৎপর্য কী বল দেখি। ধর, বরকা তোর গতি এখন ১১.২ কিলোমিটার নয় ১১ কিলোমিটার। তাহলে চাঁদে পৌঁছবি? রকেটের ক্ষেপণ পথের হিসাব থেকে দেখা যায় গতিতে সেকেন্ডে এক মিটার পরিমাণ ভুল হলেই রকেট তার লক্ষ্যচ্যুত হয়ে যাবে ২৫০ কিলোমিটার। তার মানে সেকেন্ডে ০.২ কিলোমিটার অর্থাৎ সেকেন্ডে ২০০ মিটার ভুল মানে ২০০×২৫০ বা ৫০,০০০। ৫০,০০০ কিলোমিটার বিচ্যুতি! আর চাঁদের ব্যাসার্ধ তো মাত্র ১,৭০০ কিলোমিটার! সবাই জানে। তার মানে যতই করো চাঁদে গিয়ে আর পড়তে হবে না, পাশ কেটে বেরিয়ে যাবে। আরো একটা জিনিস মনে রাখা দরকার, স্টার্টের সময় যে এক সেকেন্ড দেরি হয়ে গেছে তার ফলে ২০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে পড়বে। অবিশ্যি আমাদের পক্ষে সেটা ভয়ানক কিছু নয়।'

'সাবাস ব্যাপার!' ল্যবকা বললে, আর বরকা চ্যাঁচাল যে চেয়ারে বসে থাকতে ওর ব্যাজার লাগছে: কনটেনর গিয়ে পৌঁছন চাই চাঁদে, অথচ কোনো চাঁদই নেই।

আমি কিন্তু সবই আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলাম। জায়গা না ছেড়েই টান দিলাম একটা দড়িতে আর বরকার ডান দিকের দেয়ালে খুলে গেল চাঁদের একটা মানচিত্র: সাগরের আঁকাবাঁকা তটরেখা একেবারে নিখুঁত করে আঁকা, গভীর সব ফাটলের বলি রেখায় ভরা চাঁদের গোল গোল গহর, গোটা চাঁদটা বিষণ্ণ, নির্জন, রহস্যময়।

আর মেঝের ওপর খড়ি দিয়ে আঁকা ছিল সাক্ষাতকারের বিন্দু, দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছনো ক্ষেপণ পথটা। দড়িতে ঝোলা চাঁদ আর বরকার চেয়ারটা সেই বিন্দুতে একই সময়ে এসে পৌঁছানোর কথা।

বরকা যে চেয়ারে বসেছিল সেটা ঠেলতে লাগলাম আমি, ও জানাতে লাগল উড্ডয়নের সময় আর খবরের কাগজের সঙ্গে তার গতির সময়টা মিলিয়ে দেখতে লাগল ল্যবকা। "২১টা বেজেছে, ১২ই সেপ্টেম্বর,” বরকা জানাল। আমি কম্যান্ড দিলাম, "কৃত্রিম ধূমকেতু পর্যবেক্ষণের জন্যে তৈরি হও!"

একটা প্লেটের মধ্যে ম্যাগনেসিয়াম-এ আগুন ধরিয়ে দিল বরকা। মহাজাগতিক শূন্যদেশ আলোকিত করে অপরূপ ঝলক দেখা গেল। কৃত্রিম ধূমকেতু পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হওয়া গেল রকেটের গতিপথে ভুল হয়নি।

বরকার চোখের সামনে বড়ো হয়ে উঠতে থাকল

চাঁদ আর পেছন দিকে পৃথিবী ছোটো হয়ে পরিণত

হল একটা গোলকে। বরকা একেবারে গিয়ে পৌঁছেছে

দেয়ালের কাছে, মানচিত্রটাও এসে পড়েছে বরকার

কাছে... এইবার সেই রেখাটা, তাতে লেখা: "০০

ঘণ্টা ০২ মিনিট ২৪ সেকেন্ড, ১৪ই সেপ্টেম্বর,

চাঁদে অবতরণ।"

আরও পড়ুন

বরকা লাফিয়ে উঠে পেস্টবোর্ড পেনডেন্টটি ছুড়ে মারল চাঁদের উপরিভাগে। চাঁদের 'স্বচ্ছ' সাগরের এলাকায় অবতরণ নিষ্পন্ন হল পরিপূর্ণ সাফল্যে, অবশ্য প্লেট ভেঙে যাওয়ার ব্যাপারটা না ধরলে। বরকা একদম ভুলে গিয়েছিল প্লেটটার কথা। এখন আমি বুঝতে পারছি, কোনো রকম হিসাবপত্র না করে পোড়ো জমিটা থেকে লোহার টিউবকে রকেট করে যে ছেড়ে দিলাম, সেটা কী বোকামিই না হয়েছিল। অমন বিয়োগাত্মক পরিণতি তো তার হবেই। আমাদের যে অল্প ক্যালোরির জালানি ছিল তা থেকে কি আর ক্ষেপণকে প্রথম মহাজাগতিক গতি দান করা যেত? ওটা হয়েছে একেবারেই গোমূর্খামি। এবার দেখলাম, সবচেয়ে আগে দরকার তত্ত্বগত প্রস্তুতি। নভেম্বর, ১৯৫৯ আন্তগ্রহ স্বয়ংক্রিয় কেন্দ্র ৭ই অক্টোবর চাঁদের অদৃশ্য দিকটার ফোটো তুলল পৃথিবীতে সর্বপ্রথম। তার ওড়াটা ভালো করে বুঝে দেখলাম। 'পৃথিবীতে সর্বপ্রথম' একথাটা কতবারই যে লিখলাম, তবু বিরক্ত ধরছে না, বরং আগ্রহই বাড়ছে! এবার 'লুন্নিক-৩' রকেট চাঁদ প্রদক্ষিণ করে ফিরে এল পৃথিবীতে। মোট সে উড়েছে ১০,০০,০০০ কিলোমিটার! ৬৫ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে লেন্সের ঢাকনি খোলা হয়েছে- তারপর 'রেডি! রেডি!' চল্লিশ মিনিট ধরে ফোটো তুলে গেছে জিনিসটা। ভারহীন অবস্থায় এটা একটা কাজের মতো কাজ! রকেটের ভেতরে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে নিখুঁতভাবে ডেভেলপ করা হয়েছে সে ফিল্মকে, ফিক্স করে শুকিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ সব কাজ চলেছে ১,৩০০ মিলিমিটার লম্বা একটা সিলিন্ডারের মধ্যে। আমি লম্বায় ১,৬২০ মিলিমিটার, তার মানে অতখানি জায়গায় আমিও ডেভেলপ করতে পারতাম নিশ্চয়, তবে অনেক খারাপ হত বৈকি। আমাদের বাথরুমটা লম্বায় ২,৫০০ মিলিমিটার। তাহলেও সেখানে ডেভেলপ করতে গিয়ে ফিল্ম আর শট প্রায়ই তো নষ্ট করে ফেলি। চাঁদের অদৃশ্য দিকটার ব্যাকগ্রাউন্ডে আমি বরকা আর ল্যবকা তিনজনে মিলে যে ছবিটা তুলেছি সেটা অবশ্য মন্দ হয়নি। ফোটোগ্রাফির সমস্ত নিয়ম হুবহু মেনে ওটা করা হয়েছে, অটোমেটিক একম্পোজার লক টিপে আমরা ঠিকঠাক হয়ে বসি, ডেভেলপ ও প্রিন্ট করা হয়েছে একেবারে ঘড়ি ধরে কাঁটায় কাঁটায়। চাঁদের নতুন মানচিত্রটা আমরা আঁকি একসঙ্গে মিলে। গহ্বরগুলো আঁকি আমি ৎসিওলকভস্কি, জোলিও কুরি ও লমোনসভ জালামুখ, আর সোভিয়েৎস্কি পর্বতমালা। মস্কো সাগর আর স্বপ্ন সাগর ল্যবকা আঁকে সবুজ রঙে। আর মালভূমিগুলোকে বরকা আঁকে হলদে রঙ দিয়ে। বেশ ভালোরকমই খাটতে হয়েছে ওকে চাঁদের এ পিঠে মালভূমি বেশি আর তথাকথিত সাগর কম। এ সাগর ধুলোয় ভরা, জল নেই। জুল ভার্নের কল্পন্যাসের মহাসাগর আর অসীম বন হল এই। আগে সে সব কথা বিশ্বাস করে বসেছিল কেবল বরকার মতো পটুয়ারা।

একবার একশ কি দুশ বছর আগে যদি এই মানচিত্রটা নিয়ে উদয় হতে পারতাম তাহলে কী হত ভেবে দ্যাখো?.. জ্যোতির্বিদরা ভেবে বসত আমি একেবারে চাঁদ থেকেই বুঝি নেমে এসেছি!

এপ্রিল, ১৯৬০

স্কুলে রেডিও-গেজেট খোলা হয়েছে। আমি বরকা আর ল্যবকার ওপর ভার পড়েছে ক্লাসের পক্ষে থেকে সংবাদ দেবার। কিন্তু ক্লাসের সংবাদ আবার কী হবে? আমরা ঠিক করলাম নতুন নতুন সমস্ত আবিষ্কারের কথা ব্রডকাস্ট করব মহাশূন্য থেকে।

প্রায় মাস দুই কাটাতে হল পাড়ার লাইব্রেরিতে। বেশ জায়গা, প্রত্যেকেরই নিজের নিজের টেবল, তাতে ল্যাম্প। 'জ্ঞানই শক্তি', 'কিশোর টেকনিক', সংবাদপত্র, বৈজ্ঞানিক পত্রিকা 'প্রকৃতি', এ সব পড়লাম। বাবার কাছ থেকে এ বিষয়ের বিশেষ বইপত্তর নিয়েও পড়া গেল। ব্রডকাস্টের দিন ধার্য ছিল ২০শে এপ্রিল। আমরা তৈরি: ঐতিহাসিক কাহিনী, ডায়াগ্রাম, মানচিত্র পুরো এক একটা একসারসাইজ খাতা ভরে ফেলেছি সবাই। শতকরা ৯৯ ভাগ কাজই রেডি। বাকি কেবল লিখে ফেলে রিহার্সাল দেওয়া।

হঠাৎ সব পণ্ড হয়ে গেল।

ঘরে আমরা তিনজন জুটে রিপোর্ট লেখার বদলে কী স্টাইল হবে সেই নিয়ে তর্ক শুরু করে দিলাম। পরে মিটিয়ে নেওয়া গেল। কিন্তু ল্যবকা ফের আবার বাতাস সম্বন্ধে তার লেখা একটা কবিতা জোরে জোরে আবৃত্তি করতে শুরু করলে। আমি ওকে বললাম, আমাদের মনিটর ল্যেভকা পমেরাচিকের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করাই তার উচিত। চোঁতা কাগজ দেবার সময় আবেগ ভরে নিজের কবিতাও সে দিয়ে দেয়। লুল্যবকা কে'দেই ফেলল। বরকা তখন টেবল চাপড়ে বললে, প্রকৃতির খুব রঙীন বর্ণনা করা চাই, নাইটিঙ্গেল, রামধনু ইত্যাদি সব দরকার। আমার সহ্য হল না। চাঁটি মারলাম ওকে। ও মারলে আমাকে। কোনো কথা না বলেই মারামারি চলল আমাদের কেননা কথা বললে লোকের দৃষ্টি পড়বে সে দিকে। যখন আবার মিটমাট হল, ততক্ষণে বাবা এসে ভাগিয়ে দিলে আমাদের সবাইকে।

ভয়ানক মন খারাপ, একলা একলা বসে এই সব লিখছি। এখন কী উপায় হবে আমাদের?.. এইখানেই ডায়েরির সূত্র ছিন্ন হয়েছে...

আরও পড়ুন