১.
ছোট্ট একটা স্টেশন, বাসটা আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে অনেকক্ষণ। নীল গেছে বোয়ালধরা গ্রামে কীভাবে যাওয়া যায় তার খোঁজখবর করতে। নীল হলো আমার চার বছরের বড় ভাই। আমার কাছে সে শুধু সমবয়সীই না, মাঝে মাঝে ও আমার চেয়ে ছোটও, কারণ আমার চোটপাট শুরু হলে নীল ভাই মুখটা আমসি করে শুধু বলে যাবে, ‘দেখ্ জারা, ভালো হচ্ছে না, বড় ভাইকে সম্মান করে কথা বল!’ আর আমি? ধ্যাৎ, কে কার কথা শোনে! আমার চিৎকার-চেঁচামেচি, অভাব-অভিযোগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কি ওর নিস্তার আছে!
আসল কথায় আসি: এখানে আসার আগে যতটুকু খোঁজখবর করে জেনেছি; বোয়ালধরায় (কী অদ্ভুত নাম রে বাবা!) যেতে নৌকাই ভরসা। নেত্রকোনা-সিলেট অঞ্চলের বিখ্যাত ভাটি এলাকা এটা—বছরের একটা সময় এই অঞ্চলের প্রায় পুরোটাই পানির নিচে চলে যায়। লোকজন তখন একরকম গৃহবন্দী হয়ে পড়ে। আর যদি বেরোতেই চাও, তো নৌকা নিয়ে বেরোও। ঠিক এ রকমই একটা সময়ে এসেছি আমরা, ভাটি অঞ্চলে এখন পানির একেবারে ভর-ভরন্ত অবস্থা, যেদিকে তাকাও খালি পানি আর পানি। সেই বিখ্যাত ‘কূল নাই কিনার নাই’ গানের মতো (গানটা কার, এই প্রশ্ন করে আবার বিপদে ফেলো না যেন!)। বাসে সুনামগঞ্জ পার হওয়ার পর থেকেই জানালা দিয়ে দেখেছি, পানির মধ্যে সবুজ একেকটা গ্রাম মাথা তুলে আছে, তারপর গ্রামের ওই কালচে রেখাও একটা সময় অস্পষ্ট হতে হতে হারিয়ে গেল পানির অকূল পাথারে। বাস থেকে নামার আগে নীল ভাইয়া কন্ডাক্টর লোকটিকে বোয়ালধরা গ্রামের কথা জিজ্ঞেস করতেই তার দুই ভুরু গিয়ে কপালে ঠেকল, ‘তোমরা বাই বোয়ালধরা যাইতানি! বাক্কা দূর রে বাই, নৌকা ছাড়া ত যাইতাই ফারতায় না!’
কন্ডাক্টরের মতো এখানকার দুই দোকানিরও একই কথা—গরুর হাট পেরিয়ে গেলেই পড়বে বটগাছের ঘাটলা, ওখানেই নৌকার ঘাট, বোয়ালধরার কেরায়া (ভাড়া) নৌকা মিলবে ওখানেই।
নৌকার সন্ধানে যাওয়ার আগে বোয়ালধরায় আসার মূল কারণ আমার হাতে গছিয়ে দিয়ে গেছে নীল। একটা হলদে খাম। পকেটে থাকায় অনেক ভাঁজ পড়া।
একটা বন্ধ দোকানের সামনে বাঁশ ফালি করে কাটা একটা বেঞ্চির ওপর বসে আছি আমি। চিঠিটায় চোখ বোলানোর আগে আমার চারপাশের প্রায় জনহীন বাসস্টপের দিকে একবার চোখ বোলালাম। হঠাৎ মনে হলো আলফ্রেড হিচককের নর্থ বাই নর্থ ওয়েস্ট-এর সেটে ভুল করে ঢুকে পড়েছি। সেলুলয়েডের সেই হলুদ রঙের একটা দুপুর, একেবারে জনশূন্য স্টেশন, সময় যেন থমকে আছে; হিচককের ছবিতে এর পরের দৃশ্যে একটা পুরোনো আমলের কালো মরিস গাড়ি এসে হাজির হবে...এখানে সেসবের কোনো সম্ভাবনা নেই! জানি। এখানে একটু পর পথের দিশা নিয়ে হাজির হবে আমার গ্রেট ব্রাদার মিস্টার নীল। যার মাথায় গোয়েন্দাগিরির ভূত আছে। আমি নিশ্চিত, বোয়ালধরায় সে এ রকমই কোনো একটা পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হয়েছে। এ-ও জানি, এই মুহূর্তে আমার হাতে ধরা চিঠিটা খুললেই তার কিছু ক্লুও পেয়ে যাব আমি। তবে রওনা দেওয়ার আগে ও শুধু বলেছিল, ‘তোর স্কুল বন্ধ না? চল্...ব্যাগ গুছিয়ে নে...’ আমি ঘোরাঘুরির ব্যাপারে এমনিতেই নাচুনে বুড়ি, কাজেই কী, কেন—এসব প্রশ্নের ধার দিয়ে না গিয়ে ‘জয়বাবা ফেলুনাথের’ পরিবর্তে ‘জয় ভাইয়া নীল’ বলে ব্যাগ গোছাতে শুরু করলাম।
আর তারই ফল হলো গত রাতে আমাদের ঢাকা টু সিলেট হয়ে আজ সকালে সুনামগঞ্জে পৌঁছানো, এখন গন্তব্য বোয়ালধরা।
চিঠিটা খুললাম। অচেনা গোটা গোটা অক্ষরের একটা হাতের লেখা:
বাবা নীল,
আমার মেয়ে সুবর্ণা তোমার সহপাঠী ছিল, তাহার কাছে শুনিয়াছি তুমি পড়াশোনা ছাড়িয়া দিয়া শখের গোয়েন্দাগিরি করিতেছ, তোমার কিছু সফল উদ্ঘাটনের ঘটনায় সুবর্ণার দৃঢ় প্রত্যয় হইয়াছে যে আমাদের উপস্থিত সংকটেও তুমি ত্রাণকর্তার ভূমিকা লইতে পারিবে। শুরুতে তোমার কাছে বিষয়টি অত্যাশ্চর্য ঠেকিতে পারে, কিন্তু সব শুনিলে আমার প্রত্যয় হয় তুমি অবিশ্বাস করিতে পারিবে না। আমার পতিদেবতা মানে সুবর্ণার বাবা মৃগাঙ্ক রায়চৌধুরী, একসময় পুরাকীর্তি বিষয়ে বিস্তর পড়াশোনা করিয়াছেন, তবে বিগত আট বছর ধরিয়া তাঁহার সমস্ত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল গুপ্তবিদ্যা, দিনমান তিনি ইহা লইয়াই পড়িয়া থাকিতেন, ভারতবর্ষ ঢুঁড়িয়া এই বিদ্যার যাবতীয় পুস্তকাদি সংগ্রহ করিয়া আমাদের গৃহে বিশাল এক লাইব্রেরিও গড়িয়া তুলিয়াছেন, দিবারাত্রির অধিকাংশ সময় তাঁহার এই লাইব্রেরিতেই কাটে। কিন্তু এই চিঠি যখন লিখিতেছি তাহার দিন দুই আগে লাইব্রেরি হইতে রায়সাহেব গৃহে না আসায় আমি লাইব্রেরিতে খোঁজ লইতে যাইয়া তাঁহাকে মেঝেতে অচেতন অবস্থায় আবিষ্কার করি। আমি সর্ব রকম চেষ্টা করিয়াও তাঁহাকে জাগাইতে পারি নাই। ডাক্তার-বৈদ্যি করা হইয়াছে বিস্তর, কিন্তু তাঁহারাও কোনো নিদান করিতে পারেন নাই। চিকিৎসকেরা তাঁহার জাগিয়া না উঠিবার কোনো কারণ নির্ণয় করিতে সমর্থ হন ত না-ই, উপরন্তু তাঁহারা বলিতেছেন আমার স্বামীর এই অবস্থাকে ঠিক অচেতন বলা যায় না; তিনি স্বাভাবিক মানুষের মতো ঘুমাইয়া আছেন, তবে গাঢ় দুঃস্বপ্নের নিদ্রা ইহা। স্থানীয় পুলিশও তাহাদের হাত ধুইয়া লইয়াছে, যেহেতু এখানে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয় নাই, কোনো অনুপ্রবেশকারীর আগমন ঘটে নাই, তাই তাহাদেরও করণীয় কিছু নাই।
এক্ষনে আমি সন্দেহ করিতেছি, রায়সাহেবের পাঠাগার হইতে কোনো একটি মূল্যবান পুস্তক খোয়া গিয়াছে, যাহা তিনি কোনো গোপন প্রকোষ্ঠে লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন।
তবে সঠিক কোন পুস্তকটি খোয়া গিয়াছে আমি নিশ্চিত নই। তবে কোনো দুরাত্মা যে পুস্তক চুরি করিবার সময়েই রায়সাহেবের এই হাল করিয়াছে, সেই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
সুবর্ণা ব্যাপক কান্নাকাটি করিতেছে, কিন্তু আমি তাহাকে ঢাকা ছাড়িয়া এখানে আসিতে নিষেধ করিয়াছি, তাহাতে পরিস্থিতি কেবল জটিলই হইবে। এখন তোমার বিচক্ষণতাই আমাদের ভরসা।
ইতি তোমার মাসিমা
সুলতা চৌধুরানি
চিঠি পড়ে আমি খুব যে কিছু বুঝলাম তা বলব না। বোঝার মধ্যে এইটুকু বুঝলাম, নীলের কলেজের বান্ধবী, যার নাম সুবর্ণা, পিতার নাম মৃগাঙ্ক রায়চৌধুরী (নাম শুনে আগেকার আমলের জমিদারদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে কেন যেন, যদিও এই সময়ে বাংলাদেশে জমিদারদের অস্তিত্ব আছে কি না, আমার জানা নেই), যাহোক, মৃগাঙ্ক রায়ের স্ত্রী মানে সুবর্ণার মা সুলতা চৌধুরানি নীলকাকে লিখেছেন চিঠিটা, সাহায্য চেয়ে। সুবর্ণার বাবা মৃগাঙ্ক রায়চৌধুরী এক আশ্চর্য ঘুমে অচেতন হয়ে আছেন, চিকিৎসকেরা তাঁকে জাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর (সুলতা রায়ের চিঠি থেকে যা বোঝা যাচ্ছে) তাতে মৃগাঙ্কবাবুর লাইব্রেরিতে লুকিয়ে রাখা একটি পুস্তক চুরি হয়ে গেছে। কিন্তু মৃগাঙ্কবাবুর এই আশ্চর্য ঘুম আর পুস্তক চুরির ঘটনায় নীলের করণীয় কী হবে, আমি ঠিক বুঝলাম না। সে কি কোনো গুপ্তবিদ্যাবিশারদ? আশ্চর্য রোগের বৈদ্যি, নাকি এলেম দ্বারা রোগের চিকিৎসা করার কেউ! এখানে ওর নাকাল হওয়ার ষোলো আনা সম্ভাবনা দেখছি আমি, বিষয়টা মাথায় আসতেই ভেতরে-ভেতরে একটা বিমল আনন্দ বোধ করতে শুরু করলাম। এইবার সবজান্তা শমসের তুমি বুঝিবে, চাঁদু কত ধানে কত চাল!
চিঠিটা ভাঁজ করে আবার খামে ভরে রাখার সময় দেখলাম, মিষ্টির দোকানের সরু পথটা ধরে কালো শার্ট পরা নীল হন হন করে কালো মরিস গাড়ির পরিবর্তে নর্থ বাই নর্থ ওয়েস্ট-এর সেটে ঢুকে পড়ছে! বুঝলাম বোয়ালধরায় যাওয়ার সমস্ত বন্দোবস্ত করেই ফিরছে সে!
২.
নীলের পেছন পেছন ছোট একটা ছইঅলা নৌকায় এসে উঠলাম আমি। ব্যাকপ্যাক পাটাতনে নামিয়ে রাখতে রাখতে ও বলল, ‘ছইয়ের বাইরেই বস্। রোদ পড়ে যাচ্ছে...বাইরেই বাতাস পাবি।’ তারপর ইঙ্গিতপূর্ণভাবে দুই হাত মুখের কাছে নিয়ে নিঃশব্দে হালুম শব্দটা উচ্চারণ করে চোখ টিপল। অর্থাৎ, ভেতরে ভীতিকর কিছু আছে, আমাকে যেতে নিষেধ করছে। ভ্রু কোঁচকালাম। তবে মুখে কিছু বললাম না।
তারপর গলুইয়ের কাছে পাটাতনে বসতে গিয়ে আড়চোখে ছইয়ের ভেতরে তাকিয়েই স্রেফ জমে গেলাম।
ছোটখাটো বিকটদর্শন একটা লোক, মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, তাতে তার চাপা গায়ের রং আরও গাঢ় মনে হচ্ছে যেন, মাথায় লম্বা বাবরি চুল, একেবারে তেল চুপচুপে। খুব ঘন ভুরুযুগলও তেলে চকচক করছে। খালি গা, কাঁধে একটা কমলারঙা যাকে গেরুয়া বসনও বলে বোধ হয়—আলগোছে জড়ানো; তাতে শুধু পিঠের কিয়দংশ ঢাকা পড়েছে। আর গলায় ওই যে জয়বাবা ফেলুনাথের বিখ্যাত রুদ্রাক্ষের মালা (ওই বস্তু আমি এই প্রথমবার দেখলাম), কালচে ছোট ছোট নরমুণ্ডুর মতো লাগল আমার কাছে। ওই একই রঙের সেলাই ছাড়া একটা ধুতি কিংবা লুঙ্গি পরে আছে বাবাজি (এই সম্বোধনটা আপনা-আপনিই কীভাবে যেন মনে চলে এল), বাবাজির হাতে ছোট একটা সোনারঙা পাত্র (এই জিনিস কষ্মিনকালেও দেখিনি), সম্ভবত কাঁসার তৈরি, বেশ ঝাঁ চকচকে জিনিস।
এখন বুঝলাম লোকটার ওই বিকটদর্শন চেহারার কারণেই আমাকে ওই হালুম ভঙ্গি করে সতর্ক করতে চেয়েছে নীল। একটু পরে এ-ও জানলাম: এই জটাধারী বাবাজির নাম নবা ফকির। তার প্রায় দেড় হাজার শিষ্য, বছরে চৈত্রসংক্রান্তির সময় বিশ্বনাথে তার বাড়িতে বিরাট মেলা বসে। আর সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হলো সে ভূত-প্রেত কিংবা অশুভ আত্মা তাড়ানোর জন্য বিশেষভাবে বিখ্যাত এবং সে বোয়ালধরায় মৃগাঙ্ক রায়ের বাড়িতেই যাচ্ছে, যেখানে যাচ্ছি আমরাও।
‘চিঠিটা পড়েছিস? মৃগাঙ্কবাবুর এই রহস্যময় ঘুমের ব্যাপারটা আজব না?’ প্রশ্নটা আমাকে করলেও বুঝলাম, নীল আসলে নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। ‘ডাক্তার বলছে, দুঃস্বপ্নের মধ্যে ঘুমিয়ে আছেন রায়সাহেব—চিঠির কথামতো দু-তিন দিন কিংবা তারও বেশি সময় ধরে ঘুমিয়ে আছেন মৃগাঙ্কবাবু।...সাধারণ ঘুমেরও কতগুলো পর্যায় থাকে শুনেছি...এটা কী ঘুম?’
‘জাদুতে দেখা যায় না, ম্যাজিশিয়ান মন্ত্র পড়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে...এটা সে রকম কিছু কি হতে পারে!’ ঠোঁট কামড়ে ধরে বললাম আমি।
‘হুম্! মেসমারিজম...যাকে এখন বলা হয় হিপনোটিজম, মানে সম্মোহন। মন্দ বলিস নাই। মৃগাঙ্কবাবু লাইব্রেরিতে একলা ছিল। তার মানে, এটা শুধু বই চুরির ঘটনাই না!’
‘নেশাটেশার ব্যাপারও তো হতে পারে, মৃগাঙ্কবাবুর নামের মধ্যে কেমন জমিদার জমিদার ব্যাপার আছে না? আগে জমিদারদের সিদ্ধি, আফিম—এসব নেশার কথা পড়েছি না গল্প-উপন্যাসে!’ হেসে বললাম।
মাথা নাড়ল নীল। ‘নেশায় মানুষ বেহুঁশ হয়, কিন্তু এত লম্বা সময় বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকার কথা না। এটা অন্য কিছু। নেশার ব্যাপার হলে ডাক্তার ধরতে পারত। আর তোর ধারণা ঠিক আছে, সুবর্ণারা একসময় সত্যিই জমিদার ছিল।’
‘কোনো বিষপ্রয়োগের ঘটনা না তো? স্থানীয় ডাক্তার যা বুঝতে পারেনি!’
‘হ্যাঁ, হতে পারে। কিন্তু আমার মাথায় ওই সম্মোহনের ব্যাপারটাই ঘুরপাক খাচ্ছে। বুঝতে পারছি বোয়ালধরায় বেশ একটা উত্তেজনাকর সময়ই কাটবে বলে মনে হচ্ছে রে।’ বলে মাথা ঝাঁকাল নীল।
পেছনে, ছইয়ের ভেতরে এ সময় গলা খাকারির আওয়াজ শোনা গেল, তারপরই দাড়ি-গোঁফের নবা ফকিরের বিশাল মুণ্ডুটা উঁকি দিল বাইরে। ‘আপনারারে তো ডাক্তর মনে অইছে না, মৃগাঙ্কবাবুর কাছে কিতার লাগি যাইথাই? আমার ডাক পড়ছে তাইনরে খারাপ জিনিসে পাইছে, ইতা তাড়ান লাগি। তোমরার কাম কিতা?’
‘আমরা তো ডাক্তার না। মৃগাঙ্কবাবুর মেয়ে আমাদের বন্ধু। তাঁর স্ত্রী ডেকেছেন।’ জবাব দিল নীল।
আমরা যখন বোয়ালধরায় মৃগাঙ্কবাবুর বাড়ি পৌঁছালাম, তখন সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। বাড়ির ঘাটেই নৌকা ভিড়ল। শান বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে ছোট একটা ধাক্কাই খেলাম, দূর থেকে গাছের জড়াজড়িতে ঢাকা থাকায় নৌকা থেকে বুঝতেই পারিনি জামিদারি প্রথার বিদায় ডঙ্কা বহুকাল আগে বাজলেও, মৃগাঙ্কবাবুদের জমিদারি ঠাটবাট সবই বজায় আছে। বিশাল উঁচু খিলানঅলা দালান, পাশেই মন্দির, কারুকার্যময়। আরেক পাশে একটু নিচু ছাদের আরেকটা দালান, সম্ভবত জমিদারের পাইক-পেয়াদাদের ব্যবহারের জন্য বানানো হয়েছিল।
‘ইটা অইল গিয়া রায়গ পোস্তান...ইয়া মাবুদ! খিতা বিল্ডিং দেখছনি।’ পেছন থেকে বলে উঠল নবা ফকির। ‘ওউ ফিছনের মন্দিরের কান্দাত রায়বাবুর লাইবেরি। কী এলাহি কারবার রে বাবা!’
তখুনি বাড়ির উঠানের দিক থেকে একটা শোরগোলের মতো শোনা গেল, তীব্র গলায় একটা কুকুরের ডাক আর সঙ্গে একটা পুরুষ কণ্ঠের আহাজারি, থেকে থেকে সে বলে উঠছে, ‘বউদি, ইতা আমি খি দেখলাম! মন্দিরের ওই কান্দাত হেই মুখ—কোনো বুল নাই...কোনো বুল নাই, বিশ্বাইস খরুন...’
আমরা খানিকটা এগিয়ে দেখলাম: মধ্যবয়সী একটা পুরুষ সামনের দিকে ঝুঁকে বারবার ওই কারও মুখ দেখতে পাওয়ার কথা আউড়ে যাচ্ছে, সমানে দুই হাত নেড়ে নেড়ে, তার পেছনেই তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে একটা কালো কুচকুচে কুকুর। আর লোকটার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন শাড়ি পরা এক মহিলা। মাথায় ঘোমটা থাকার কারণে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না।
‘কিথা হইছে মা-সখল?’ গমগমে গলায় জানতে চাইল আমাদের সঙ্গে আসা সাধুবাবা।
শাড়ি পরা মহিলা এবার সচকিত হয়ে উঠলেন, মাথা সোজা করে আমাদের দেখতে পেয়ে লোকটিকে রেখে এগিয়ে এলেন, ‘ওহ্! তোমরা পৌঁছে গেছ। এসো এসো!’
হাতের ইশারায় তখনো মৃদুস্বরে বিড়বিড় করা লোকটিকে দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘উনি ছোট কর্তা, সোমনাথ রায়চৌধুরী। মৃগাঙ্কবাবুর ছোট ভাই। খানিক আগে ও নাকি নির্মলা, মানে ওর স্ত্রীকে দেখেছে। নির্মলা গত হয়েছে প্রায় ছ বছর আগে।’
সুলতা রায়চৌধুরীকে প্রথম দেখাতেই বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বলে মনে হলো আমার। চিঠিটা পড়ে যতটা নরম বলে মনে হয়েছিল, সামনাসামনি মহিলাকে দেখে সেই ধারণা একদম পাল্টে গেল। খাড়া নাক আর উঁচু চোয়ালে বেশ দৃঢ় একটা ব্যাপার আছে। কালো বড় বড় চোখ, এই মুহূর্তে সেখানে নানা দুশ্চিন্তা মিশে থাকলেও বোঝা যায় মহিলা একসময় ভীষণ রূপসী ছিলেন। ‘নির্মলা...বৈঠকখানার জানালার শিক ধরে নাকি এসে দাঁড়িয়েছিল...আমাদের দেখছিল।’ খানিকটা ভয়ার্ত, বিব্রত গলায় বললেন সুলতা রায়চৌধুরী। তারপর দ্রুত সামলে নিয়ে বললেন, ‘চলো, তোমরা মৃগকে দেখবে এসো।’
খানিক আগে আহাজারি করা সোমনাথবাবু এখন অনেকখানিই শান্ত। মৃত স্ত্রীকে দেখার ধাক্কা কাটিয়ে উঠে তিনি এখন কুকুরটাকে পরম যত্নে আদর করছেন। কালো একটা কুকুর, ছোটখাটো, কিন্তু ভীষণ তীব্র তার চাহনি। হঠাৎ খেয়াল করলাম, সোমনাথবাবুর আদর নিতে নিতে ধকধকে চোখে কুকুরটা চেয়ে আছে আমার দিকে। ছোটবেলা থেকেই কুকুর আমার অপছন্দ। এটার স্থির হিংস্র চাহনিতে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল, আমূল।
‘আমি নীল, সুবর্ণার বন্ধু। আর ও আমার ছোট বোন, জারা।’ বলল গোয়েন্দা নীল। তারপরই সে মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, ‘সোমনাথবাবুর স্ত্রীকে কি আপনিও দেখেছেন?’
মানে? নীল তুমি সোমনাথবাবুর পরলোকগতা স্ত্রীকে দর্শনলাভের ঘটনা বিশ্বাস করছ না, তাই না? মনে মনে হাসলাম আমি।
সুলতা চৌধুরী জবাব দিতে সময় নিলেন, ‘না, আমি ছোট কর্তার চিৎকার শুনে জানালায় এসে কাউকে দেখতে পাইনি।’
নীল কিছু বলার আগেই পাশ থেকে কথা বলে উঠল নবা ফকির। ‘মরা মাইনষেরে তোমরা এর আগেও দেকছইনি?’
‘না।’ তীব্রভাবে মাথা নাড়লেন সুলতা চৌধুরী, ‘এসব এ বাড়িতে আগে কখনোই দেখা যায়নি।’
‘মরা আত্মার নজর লাগি গেছে অয়।’ আস্তে, বিড়বিড় করার মতো বলল সাধুবাবা।
‘পুরো ব্যাপারটা খুলে বলুন তো মাসি আমাদের।’ বিরক্ত গলায় বলল নীল।
‘পুরো ব্যাপার আর কী! আমি তো দরজা খুলে বাইরে গিয়ে কিছু দেখিনি। দেখেছে ছোটবাবু, সোম। ওই নির্মলাকে জানালায় দেখার পর থেকেই তো চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। নির্মলা নাকি জানালায় এসে দাঁড়িয়েছিল, ডাকছিল তাকে।’
‘আমি আসলে মৃগাঙ্কবাবুর কথা জানতে চেয়েছি।’ খানিকটা অধৈর্যের গলায় বলল নীল।
‘আমি, মা সখল...’ হাসি হাসি মুখ করে বলল সাধুবাবা, ‘অনুমতি দিলে রায়সাবের বইয়ের গরখান দেখি লাই...ইতা আমার কামো লাগব।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ!’ দ্রুত গলায় বললেন সুলতা চৌধুরী, ‘আপনি সোমকে বলেন, ও নিয়ে যাবে আপনাকে।’
সাধুবাবাকে ইতস্তত করতে দেখে সুলতা চৌধুরী অভয় দেওয়ার মতো করে বললেন, ‘না, না, ও ঠিক আছে, আপনি যান। সোমনাথ, একে তোমার দাদার লাইব্রেরিতে নিয়ে যাও।’
হাসিমুখে এগিয়ে এলেন সোমনাথ চৌধুরী। পাতলা সিড়িঙ্গে চেহারা লোকটার। পুরো মাথাই কামানো। তেলে চকচক করছে। সোমনাথবাবু যে টাকের কারণে মাথা কামায় সে রকম না, সম্ভবত ইচ্ছে করেই নিয়মিত মাথা কামান তিনি। মুখে কোনো দাড়ি-গোঁফ নেই। গলায় শুধু চিকন পুঁতির মালার মতো একটা মালা দুলছে। মালাটা পুঁতির কি না, আমি নিশ্চিত না।
হাসিমুখে নবা সাধুকে নিয়ে চলে গেলেন সোমনাথ রায়চৌধুরী, অতি স্বাভাবিক একজন মানুষের মতোই—খানিক আগের আহাজারি, মৃত স্ত্রীকে দেখার আতঙ্কের ছিটেফোঁটা নেই তাঁর চেহারায় এখন।
নীল সুলতা চৌধুরীর দিকে ফিরে খাটো গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘মাসিমা, এই লোক এখানে কেন?’
‘কে, ফকির সাহেব! তোমার মৃগমেসোর পরিচিত, মাঝে মাঝে হুটহাট চলে আসেন। কদিন থেকে গল্পগুজব করে চলে যান। এবার তোমার মেসোর খবর শুনে আসতে চাইল, এখন আমাদের যা অবস্থা, বোঝোই তো কার অছিলায় কী হয়!’
‘আপনি কোনো একটা বই খোয়া গেছে বলে সন্দেহের কথা লিখেছেন চিঠিতে?’ জিজ্ঞেস করল নীল। চোখ কুঁচকে আছে ও। খেয়াল করলাম, সন্দেহ কথাটা ও বেশ জোর দিয়ে উচ্চারণ করেছে। অর্থাৎ, নীল বই চুরি যাওয়ার কথাটা এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি।
‘হ্যাঁ, সন্দেহ না।’ তীক্ষ গলায় বললেন সুলতা চৌধুরী, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কারণ মৃগ যখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে ওর লাইব্রেরিতে, পাশেই দেয়ালের একটা গোপন কুঠুরির দরজা খোলা পেয়েছি, ভেতরে কিছুই ছিল না। ওখানে কিছু একটা ছিল নিশ্চিত। আর সেটা বই ছাড়া আর কী হবে?’
জবাবটা মোক্ষম। নীল ক’মুহূর্ত যেন কোনো কথা খুঁজে পেল না। তার চেহারাটা হঠাৎ কাঁচা মরিচে কামড় দিয়ে ফেলার মতো অবস্থা হয়েছে—আমি আগেই বলেছি, সুলতা চৌধুরীকে দেখে আমার বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে হয়েছে—তবে নীলও দ্রুতই সামলে নিল অবস্থাটা।
‘মাসিমা, চলুন এখন মেসোমশাইকে দেখি একবার।’
সুলতা চৌধুরী আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন, মূল দালানে প্রবেশ করলাম আমরা, সামনের বেশ বাঁধানো একটা পৈঠান পেরিয়ে, প্রশস্ত একটা করিডর ধরে একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে পৌঁছালাম। দরজা খুলে আমাদের নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। ঘরটা বেশ বড়সড়। মৃগাঙ্কবাবু ঘরের এক কিনারে দেয়ালসংলগ্ন একটা খাটে শুয়ে আছেন, গায়ের ওপর একটা ভুটকম্বল টানা। মাথাভর্তি ঘন চুল তাঁর, নাকের নিচে পাকানো গোঁফের মতোই কালো, কোথাও একটা পাকা চুলের রেশ নেই। চিকন, পাতলা চেহারা, খানিকটা বিবর্ণ আর স্তব্ধ দেখাচ্ছে। নীল কাছে গিয়ে একটু ঝুঁকতেই নড়ে উঠলেন মৃগাঙ্কবাবু, বালিশের মধ্যে প্রবল বেগে এপাশ-ওপাশ করতে লাগলেন মাথা, আর মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ ধরনের একটা শব্দ বেরিয়ে আসতে শুরু করল।
‘উনি কি কিছু খেতেটেতে পারছেন?’ নীল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল।
মাথা দোলালেন সুলতা চৌধুরী। ‘শান্ত থাকলে এক-দুই ঢোঁক পানি বা শরবত খাচ্ছেন, কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই তা না গেলায় কষ বেয়ে নেমে আসছে। ঘুমটা ভাঙছে না কিছুতেই।’
আবার ঝুঁকে মৃগাঙ্কবাবুর গায়ে হাত রাখল নীল, নাড়ি পরীক্ষা করার মতো ডান হাতের কবজির কাছটায় ধরে থাকল খানিকক্ষণ। ‘ওনার তাপমাত্রা তো স্বাভাবিকই আছে মনে হচ্ছে। নাড়ির গতি কিছুটা ধীর, তবে নিশ্বাসের ধরন বলছে উনি গভীর ঘুমে আছেন। প্রশ্ন, তাঁকে এ রকম সম্মোহন করল কে?’
‘সম্মোহন?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন সুলতা চৌধুরী।
‘হ্যাঁ, আমার ধারণা, ওনাকে কেউ সম্মোহিত করে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে।’ বলল নীল।
‘এ কাজ কে করবে?’ বিড়বিড় করে বললেন সুলতা চৌধুরী।
নীল আবার ঝুঁকল মৃগাঙ্কবাবুর দিকে, বেশ চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মেসোমশাই, আপনাকে কে সম্মোহন করেছে?’
সাড়া নেই। পরপর দুবারের মাথায় নড়াচড়া শুরু করলেন মৃগাঙ্কবাবু। পাশ ফিরলেন। মাথা নাড়লেন বার কয়েক। আবার গোঁ গোঁ শব্দটা ফিরে এল। কিন্তু আস্তে আস্তে শব্দটা মনে হলো: একটা কোনো নাম উচ্চারণ করছেন, খানিকটা জড়ানো, কিন্তু একটা নাম, বারবার আউড়ে চলেছেন, তন্ত্রশাস্ত্র একটু কান খাড়া করে শুনলে শব্দটা যেন এ রকমই শোনাচ্ছে।
নীল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সুলতা চৌধুরীর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, তন্ত্রশাস্ত্র?
‘এটা একটা প্রাচীন গুপ্তবিদ্যার বই। হাতে লেখা। নিষিদ্ধ লোকবিদ্যা আরকি।’ জানালেন সুলতা চৌধুরী। ‘এই বইটা নিয়েই কিছুদিন যাবৎ সকাল-সন্ধ্যা পড়ে থাকত মৃগ। ও বোধ করি নিজেই চর্চা করার চেষ্টা করত। প্রতিদিন ধূপ-ধুনা জ্বালত। তখন এখানে আসা একদম বারণ ছিল আমাদের।’
‘এই বইটাই কি খোয়া গেছে?’
সুলতা চৌধুরীর মুখচোখ মৃতের মতো সাদা হয়ে গেল। হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠলেন। ‘তাই তো! ...এই বইয়ের মন্ত্রফন্ত্র দিয়ে কি কারও ক্ষতি করা সম্ভব বাবা?’
নীল কিছু বলার আগেই বিছানায় শায়িত মৃগাঙ্কবাবু আচমকা হুংকার দিয়ে উঠলেন, ‘দেব না আমি। দেব না!’ বলতে বলতে প্রবলভাবে মাথা নাড়তে শুরু করলেন, শরীর বাঁকা হয়ে গেল, যেন তিনি উঠে বসবেন। মুখ চলছে, কিন্তু কী বলছেন স্পষ্ট না। তবে তন্ত্রশাস্ত্র কথাটা খানিকটা বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু বাকি কথাগুলো ভীষণ রকম জড়ানো আর অস্পষ্ট, সঙ্গে আবার কাশির দমক উঠে গেল।
‘মৃগবাবু?’ ডাকল নীল, ‘আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?’
আচমকা চোখ খুলে গেল তাঁর। গলা দিয়ে তখনো জড়ানো শব্দ বেরোচ্ছে। কিন্তু শরীরটা যেন লাফিয়ে উঠল, বাঁকা হয়ে গেল। দ্রুত এগিয়ে গেলেন সুলতা চৌধুরী।
এ সময় ‘বাবা!’ না ‘দাদা!’ কেউ একজন অস্ফুটে বলে উঠল কোত্থেকে যেন।
একটা পুরুষ কণ্ঠ বলে মনে হলো। কিন্তু এতটাই চাপা আর দূরের যে ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না কোন দিক থেকে এল ডাকটা, আর সত্যিই কি পুরুষ কণ্ঠ? তা-ও নিশ্চিত না আমি! মৃগাঙ্কবাবুর দিকে আমাদের মনোযোগ এতটাই নিবদ্ধ ছিল যে ডাকটা অন্যরা শুনেছে কি না, সন্দেহ হলো আমার।
তখনই মনে হলো ঘরের জানালায় একটা টোকা পড়ল, আমি চমকে ফিরে তাকিয়েই—আমার কলজে যেন লাফ দিয়ে গলায় উঠে এল—জানালায় একটা মুখ জোর করে কাচের সঙ্গে চেপে রাখা, ফরসা নাকটা চ্যাপ্টা হয়ে সেঁটে আছে কাচের সঙ্গে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, তার চোখের জায়গা দুটো ফাঁকা। যেন দুটো কালো কোটর শুধু। সহসাই বুকটা ধক করে উঠল: এই মুখ তো আমার চেনা, নীলেরও খুব চেনা।
‘বাবা!’ অস্ফুটে বলে উঠলাম আমি, নিজের অজান্তেই।
একই সঙ্গে মনে হলো মেরুদণ্ড বেয়ে যেন এক টুকরা বরফকুচি নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে, ঘর দুলতে শুরু করেছে, জানালায় বাবার মুখটা অদৃশ্য হয়ে গেছে; কিন্তু আমি, আমার চেতনা যেন এক গভীর অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। দূর, বহু দূর থেকে অস্পষ্টভাবে হলেও যেন কানে আসছে, মৃগবাবু ক্রমাগত বলে চলেছেন: ‘তন্ত্রশাস্ত্র...তন্ত্রশাস্ত্র...’ অনেক দূর থেকে ঢেউয়ের মতো, বাতাসের মতো যেন ভেসে ভেসে আসছে ওই স্বর। তখনই নীলের মেঝেতে প্রবলভাবে পা ঠোকার শব্দ শুনলাম, অস্ফুট একটা শব্দও করল যেন ও, ওই আওয়াজটুকুই আমাকে বাঁচিয়ে দিল। অতল গহ্বর থেকে হঠাৎ যেন আমি সংবিৎ ফিরে পেলাম, নীল আমাকে কনুইয়ের ঠেলা দিয়েই জানালার দিকে দৌড়ে গেল, ত্বরিতবেগে জানালা খুলল সে, বাইরে তাকাল, ততক্ষণে আমি ও সুলতা চৌধুরী দুজনেই ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু জানালার ওপাশটা ফাঁকা। কেউ নেই—না কোনো মুখ, কোনো মই, না কোনো দড়ি—কিছুই না। বাইরে শুধু নিকষ কালো অন্ধকার।
‘ভাইয়া, তুইও দেখেছিস?’ আমি অস্ফুট গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
‘বাবাকে,’ কেমন অদ্ভুত শোনাল নীলের কণ্ঠ, প্রাণপণে সে কিছু একটা অবিশ্বাস করতে চাইছে।
‘আমি বাবাকে দেখেছি, নীল।’ আমি গলায় জোর ফুটিয়ে বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু গলা কেঁপে গেল। ‘আমাদের বাবা!’
‘না।’ তীব্র গলায় বলল নীল, তারপর হাত নেড়ে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘নাহ্...বাবা আট বছর আগে মারা গেছেন।’
এক মুহূর্ত আমরা পরস্পরের দিকে স্থির চোখে চেয়ে রইলাম। তারপর চোখ নামিয়ে নিল নীল। শান্ত গলায় বলল, ‘মাসিমা, এই জানালায় আপনি কিছু দেখেছেন?’
‘না।’ জবাব দিলেন সুলতা চৌধুরী, তাঁর এই জবাব পুরো ব্যাপারটাকে আরও রহস্যময় করে তুলল। তিনি চোখে-মুখে খানিকটা বিস্ময় ফুটিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন। ‘জানালায় কে আসবে? আর মাটি থেকে এই ঘরের জানালা প্রায় আট-নয় ফুট ওপরে।’
‘তাই?’ সাদামাটা গলায় বলল নীল, ‘জারা, চল্, আমরা মেসোমশাইয়ের লাইব্রেরিটা একবার দেখি।’ আমার দিকে তাকাল না ও।
৩.
ভাটি অঞ্চলের অন্ধকার কি বেশি গাঢ়! সোমনাথবাবুর পেছনে পেছনে লাইব্রেরির দিকে যেতে যেতে কথাটা মনে হচ্ছিল। আকাশে মেঘ থাকায় চাঁদ বা তারা আছে কি না, বোঝার উপায় নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সামনে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সোমনাথবাবু। আসা অবধি এই লোকটার সঙ্গে আমাদের একটা কথাও হয়নি।
‘তুই ভুলে গেছিস! এখানে সম্মোহনের খেলা চলছে, তুই বাবাকে দেখিসনি!’ ফিসফিস করে বলল নীল। ‘ওই সাধু মিয়াকে একা একা লাইব্রেরিতে যেতে দেওয়া ঠিক হয়নি। এখানে যা কিছু ঘটছে, সব ওই গুপ্তবিদ্যার বইটার জন্য...’
নীল তার কথা পুরো শেষ করতে পারল না। আচমকা অন্ধকারে আমাদের পেছন থেকে তীব্র একটা আর্তচিত্কারের মতো ভেসে এল। তীক্ষ। কিন্তু মানুষের না কোনো জানোয়ারের, বোঝার আগেই মনে হলো পেছনে দুদ্দাড় করে কেউ দৌড়ে আসছে। আর তখনই হঠাৎ আমার কাঁধে একটা হাত এসে পড়ল। চিৎকার আটকে রাখতে পারলাম না আমি। তারপরই হাঁপাতে শুরু করলাম।
‘শুনতায় আছোনি!’ একগাল হেসে বললেন সোমনাথবাবু। যেন কিছুই হয়নি! উনি এক মুহূর্ত আগেও আমার সামনেই ছিলেন। আমার কানের কাছে এসে প্রায় ফিসফিসে গলায় বললেন, ‘শুনতায় আছোনি বা? ওউ যে আয়ে...’
এরপর অনেকগুলো ঘটনা ঘটল।
আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে তখনো। দ্রুত, ধাতস্থ হওয়ারও সময় পেলাম না। মনে হলো সোমনাথবাবু শুধু নয়, চারপাশটায় যেন অসংখ্য ভুতুড়ে ফিসফাস, নিশ্বাস ফেলার শব্দ, মনে হলো অজ্ঞাত অশরীরী কী যেন বাতাসে ভর করে ধেয়ে আসছে। তার বিশাল কালো ছায়া ঢেকে দিয়েছে রাতের অন্ধকার। আচমকা আবিষ্কার করলাম, সোমনাথবাবু কোথাও নেই। তার পরিবর্তে কোত্থেকে ভোজবাজির মতো এসে হাজির হলো নবা ফকির, আমাদের সাধুবাবা। তার হাতে ধরা একটা পাটকাঠির আগুন। মুখের সামনে তুলে ধরা আগুনে তার মুখটা ভীষণ ভীতিকর দেখাচ্ছে।
‘আফনেরার খিতা ডরবয় নাইনি! আইজকু অইল আমাবস্যার রাইত, বুলি গেছনি? আমি ত ফাওর আওয়াজ শুইন্যা চিন্তা করলাম খিতা না খিতা আইল...’
৪.
লাইব্রেরিতে আসার পর থেকেই ভীষণ রকম গম্ভীর হয়ে গেছে নীল। এক কোনায় বসে আছে সে। এদিকে নবা ফকির ঘরের মাঝখানে বিশাল এক চক্র তৈরি করেছে, মেঝেতে মোটা খড়িমাটির সাদা দাগ। চক্রের মাঝখানে ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছে সে। এক পাশে জ্বলছে ধূপ-ধুনোর মাটির বড় একটা মালসা। ধূপের ধোঁয়া, তীব্র গন্ধ আর সাধুর বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণে গোটা লাইব্রেরিতে ভীষণ এক অপার্থিব আবহ তৈরি হয়েছে। নবা ফকির চক্রের ভেতর ধ্যানস্থ হওয়ার আগে ঘোষণার মতো জানিয়েছে: মৃগবাবুর ওপর যে অশুভ শক্তি আসর করেছে, আজই সে তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে, এই অমাবস্যার রাতে আরও দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ভর করতে চাইবে সে। কিন্তু নবা ফকির যে চক্র তৈরি করেছে, এই প্রতিরোধব্যূহ ভেঙে শেষ পর্যন্ত সে সফল হতে পারবে না। শুধু আজ রাতটা ঠেকিয়ে রাখতে পারলেই হবে।
আমাকে নবা ফকির চক্রের ভেতর ডেকে নিলেও নীল তার ডাকে সাড়া দেয়নি। তবে নবা ফকিরের এসব অদ্ভুত কর্মকাণ্ডের কোনো প্রতিবাদও সে করছে না। বরং আমাকে অবাক করে দিয়ে সুলতা চৌধুরীকে সে জানিয়েছে, এখানে আসলে তার কিছুই করার নেই। এটা স্রেফ গুপ্তবিদ্যার একটা বই চুরির ঘটনা। আর তার ধারণা চোর বই নিয়ে সটকে পড়েছে। সুলতা চৌধুরীর উচিত হবে পুলিশকে ঘটনা খুলে বলা আর যত দ্রুত সম্ভব মৃগাঙ্কবাবুকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া। তার জরুরি চিকিৎসা দরকার। এ কথা শোনার পরই মুখ কালো করে চলে গেছেন ভদ্রমহিলা। নীল তাকে জানিয়েছে ভোরে ফিরে যাব আমরা।
বৃত্তের মতো চক্রটার চারপাশে রসুনের মালা সাজিয়ে ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছে নবা সাধুু, আর সমানে বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য ভাষায় মন্ত্র আউড়ে যাচ্ছে। নীল তখনো তার আগের জায়গাতেই, তবে কোন ফাঁকে যেন একটা হারিকেন জোগাড় করে এনেছে সে। সলতে নামিয়ে দিয়ে প্রায় নিবুনিবু করে জ্বালিয়ে রেখেছে হারিকেনটা। নজর করে না দেখলে ওটার অস্তিত্ব বোঝার উপায় নেই। কিন্তু আমার কোনো কিছুই ভালো ঠেকছে না। বাইরে বাতাসের জোর বেড়েছে। বোধ হয় গুড়গুড় করে মেঘও ডাকছে। তখনই বিদ্যুৎ চমকের আচমকা আলোয় আমার মনে হলো দরজায় সোমনাথবাবুকে দেখলাম।
‘দরজায় কে যেন দাঁড়িয়ে?’ ফিসফিস করে বললাম আমি নবা সাধুকে।
‘ওরা চ্যলে আসছে!’ আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল সে। ‘খান পাতি শুনি লও...আসছে!’
সত্যিই, অশুভ কিছু একটা যেন ঘিরে ফেলছে আমাদের, আমি কোনো আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি কিছু একটা এগিয়ে আসছে।
‘নীল ভাইয়া!’ চাপা স্বরে ডাকলাম। কোনো সাড়া এল না। ধূপের ধোঁয়ায় পুরো ঘর আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আবছায়াভাবে শুধু দেখলাম নীল মেঝেতে এসে বসেছে, দেয়ালের বুকসেলফে পিঠ ঠেকিয়ে রেখেছে, সে-ও কিছু একটা ঘটার জন্য অপেক্ষা করছে।
দুঃসহ! এই অনিঃশেষ রাত যেন আর শেষ হবে না। কোনো শব্দ নেই, থেকে থেকে বাইরের বাজ পড়ার শব্দ ছাড়া। আমি, সাধুবাবা এত কাছাকাছি বসে আছি, কাঁধে কাঁধ ছুঁয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পরস্পরের নিশ্বাসের শব্দটুকুও যেন শুনতে পাচ্ছি না।
তখনই, প্রায় বাঘের মতো তীব্র গলায় একটা কুকুর কাছেপিঠেই হুংকার দিয়ে উঠল, তারপর সে লাইব্রেরির চারপাশে চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করল। কখনো সামনে, কখনো ডানে-বাঁয়ে, যেন ওই জান্তব শক্তি প্রবল আক্রোশে ঘরের ভেতরে প্রবেশের একটা কোনো ছিদ্রপথের সন্ধান করছে। আচমকা আমার সোমনাথবাবুর কুকুরটার কথা মনে পড়ল।
এ সময়েই মনে হলো খট করে একটা শব্দ হলো, তারপরই পুরোনো কবজার লাইব্রেরির দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে যেতে শুরু করল। একটা পদশব্দ এগিয়ে আসছে, তারপরই মনে হলো ছায়ার মতো একটা কিছু বাতাসে ভর করে এসে ঘরে ঢুকল।
মেঝেতে ধাতব কিছু একটা ঘষা খাওয়ার আওয়াজ হলো, তখনই নীলের হারিকেনটা জ্বলে উঠল, ও চাবি ঘুরিয়ে হারিকেনের সলতে বাড়িয়ে দিয়েছে, পাতলা ফিনফিনে এক আলোয় দেখলাম, নীলের কয়েক হাত তফাতে উবু হয়ে বসে অছেন মৃগাঙ্কবাবু। মেঝের কার্পেট সরিয়ে কিছু খুঁজছেন।
‘মৃগবাবু, কী খুঁজছেন?’ উঠে দাঁড়িয়েছে নীল। ‘এটা?’ ওর হাতে ধরা একটা বইয়ের মতো কিছু।
মৃগবাবু ওই অবস্থাতেই ছোটখাটো একটা ঝাঁপ দিলেন যেন, নীল লাফিয়ে সরে গিয়ে বলল, ‘থামুন, থামুন! আপনার গুপ্তশাস্ত্র কেউ নেয়নি।’
কিন্তু মৃগাঙ্কবাবু নীলের কথা শুনেছেন বলে মনে হলো না। দুহাত বাড়িয়ে সামনের দিকে এগোতে শুরু করলেন। যেন ঘুমের মধ্যে হাঁটছেন তিনি।
‘মৃগবাবু!’ চেঁচাল নীল।
এবার থমকে দাঁড়ালেন মৃগাঙ্ক রায়চৌধুরী। চোখ খুলে গেল তাঁর। বস্ফািরিত চোখে ঘরের চারপাশে তাকালেন, যেন কিছুই চিনতে পারছেন না। তারপরই কাশির দমক শুরু হলো তাঁর, কাশতে কাশতে বাঁকা হয়ে গেলেন।
কাশির দমক থামার পর ফিসফিসে গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কে? এখানে কী করছ? কী হয়েছে? তুমি...তুমি ওই বই কোথায় পেলে?’ তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে সাধুবাবা ও আমার ওপর চোখ পড়তেই দ্বিগুণ অবাক গলায় বললেন, ‘তোমরা কারা? এই মেয়ে?’
‘আমি নীল, আপনার মেয়ে সুবর্ণার সহপাঠী। আর ও আমার বোন জারা। নবা ফকিরকে আপনি চেনেন।’ হাতের লণ্ঠন উঁচিয়ে ধরল নীল।
‘এই খানিক আগেও আমি লাইব্রেরিতে কাজ করছিলাম...’ বললেন মৃগাঙ্কবাবু। তাঁর গলায় এখনো বিস্ময়। ‘এই তো কয়েক মিনিট আগে...’
‘না। মেসোমশাই, আপনি লাইব্রেরিতে কাজ করছিলেন...সেটা কয়েক দিন আগের কথা।’ বলল নীল।
সন্দিগ্ধ চোখে নীলকে দেখলেন মৃগাঙ্কবাবু। ‘না, না! আমি এখানেই কাজ করছিলাম, আমার বেশ মনে আছে...একবার মনে হলো লাইব্রেরির দরজা খুলে কেউ ঢুকল, একটা কুকুর, আর তারপর, তারপরই...কোত্থেকে তোমরা এসে হাজির হলে!’
‘আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন বেশ কয়েক দিন। আপনাকে সম্মোহন করে আপনার গুপ্তবিদ্যার বই কেউ হাতিয়ে নিতে চেয়েছিল।’ জানাল নীল। ‘আপনি একটা পর্যায় পর্যন্ত প্রতিরোধ করতে পেরেছিলেন, তারপর আর পারেননি, ঘুমিয়ে পড়েছেন। তবে ঘুমিয়ে পড়ার আগেই আপনি মেঝের ওই জায়গায় বইটা লুকিয়ে রাখতে সফল হয়েছিলেন। নবা ফকির যখন চক্র তৈরি করছিল, তখন বইটা নজরে পড়ে আমার...’
থামল নীল, তার চোখ দরজায় স্থির। ওর নজর অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি ধূপ-ধুনোর ধোঁয়ার পর্দা ভেদ করে একটা না-মানুষ না-জানোয়ারের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
গর্জন ছাড়ল ওটা, কিছুটা বাঘ, কিছুটা মানুষ আর কুকুরের মিলিত অপার্থিব ভয়াবহ এক হুংকার...
‘চক্করে ঢুকতাই না তোমরা!’ চেঁচিয়ে উঠল নবা সাধু। ‘বাছতাই ছাওনানি?’
দরজার দানব ওই একই সময়ে ঝাঁপ দিল নবা সাধুর কণ্ঠস্বর লক্ষ করে, কিন্তু অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা ঘটল, মনে হলো কোনো বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো কিছু একটা ঘটল, শূন্যে লাফানো অবস্থাতেই অদৃশ্য কিছুতে বাধা পেয়ে ছিটকে দরজার কাছে গিয়ে আছড়ে পড়ল জানোয়ারটা।
নবা ফকির এ সময় আরেক দফা চেঁচাল: ‘নীলসাব, জমিদার সাবরে লই চক্খরে ঢুকিলান।’
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে, জন্তুটা ভয়াল আরেকটা গর্জন ছেড়ে এক লাফে নীল আর মৃগাঙ্কবাবুর মাঝখানে পৌঁছে গেল...আচমকা কী ঘটতে যাচ্ছে চিন্তা করেই চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, ‘ভাইয়া দৌড়া!’
তখনই আমাদের পেছনে দরজার দিক থেকে একটা বন্দুক গর্জে উঠল। নীলের ওপর লাফিয়ে পড়া জন্তুটা শূন্যে থাকতেই একটা ঝাঁকুনি খেল, শরীরটা বাঁকাচোরা হয়ে গেল; তারপর সশব্দে আছড়ে পড়ল। মেঝেতে পড়েও হামাগুড়ি দিয়ে এগোনোর চেষ্টা করল একবার জন্তুটা, তীক্ষ নখরের থাবা আঁচড় কাটল বাতাসে কয়েকবার। তারপর নেতিয়ে পড়ল।
ওদিকে তখনো দরজায় বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে সুলতা রায়চৌধুরী।
আরও আলো জ্বালার পর মেঝের অপার্থিব জন্তুটাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। পরদিন সকালে মন্দিরের কাছে সোমনাথবাবুর মৃতদেহ পাওয়া গেল। তাঁর বাঁ হাতে ধরা একটা পাটের পুতুল, অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক নেকড়ে আকৃতির। সর্বক্ষণ তাঁর সঙ্গে থাকা কুকুরটাও উধাও হয়ে গেছে।
সুলতা চৌধুরীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নৌকায় ওঠার সময় মৃগাঙ্ক রায়চৌধুরী জানালেন, দীর্ঘ পঁচিশ বছর নিরুদ্দেশ থাকার পর মাস তিনেক আগে বাড়ি ফিরেছিল তাঁর ছোট ভাই সোমনাথ রায়চৌধুরী।