রাশেদার মা কাঁদছেন। রাত এখন কত কে জানে? বাইরে চাঁদের আলো একটা ফরসা শাড়ির মতো পড়ে আছে আঙিনাজুড়ে। দূরে শিয়াল ডাকছে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডাকছে কুকুর। ঝিঁঝির একটানা ডাক তো আছেই। রাশেদার মায়ের পাশে নাক ডেকে ঘুমুচ্ছেন রাশেদার বাবা। তাঁর কোনোই দুশ্চিন্তা নেই। কী আশ্চর্য মানুষ। বিছানায় শুল আর ঘুমিয়ে পড়ল।
রাশেদার মায়ের চোখে ঘুম নেই। তাঁর মেয়ে গেছে শ্রীলঙ্কায়। ফুটবল খেলতে। তাঁদের সুন্দরপুর গ্রাম থেকে গেছে ১০টা মেয়ে। ক্লাস ফাইভে পড়া মেয়েগুলো বিদেশ চলে গেল?
রাশেদার মা তাঁদের টিনের ঘরের খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। চাঁদের আলোয় উঠানটাকে তাঁর নদীর চর বলে মনে হয়।
ধু ধু চর।
তাঁর বুকের মতো ধু ধু।
তাঁর মেয়েটা কই?
তিনি হু হু করে কাঁদতে আরম্ভ করলেন।
কয়টা বাজে? তিনি মোবাইল ফোনে হাত দিলেন। রাত বাজে সাড়ে নয়টা। বেশি রাতও তো হয় নাই। এই গ্রামে সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। অনেক ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। এখনো বিদ্যুৎ আসে নাই এই গ্রামে। কোনো টেলিভিশন নাই। মোবাইল ফোনও নাই সবার কাছে।
হঠাৎই ফোন বেজে উঠল।
অচেনা নম্বর।
রাশেদার মা ফোন হাতে তুলে নিয়ে সবুজ বোতামটায় চাপ দিলেন।
হ্যালো, মা...
রাশেদা, কই তুই...
আমি? আমি কলম্বো।
এইটা কোন জায়গা?
এইটা শ্রীলঙ্কার রাজধানী।
কেমন আছিস, মা?
খুব ভালো আছি, মা। এই মাত্র আমরা সবাই মিলা খাইয়াদাইয়া হোটেলের রুমে ফিরলাম। আমার রুমে আমার লগে আছে সাবিনা। কথা কইবা?
আগে তোর সাথে কথা কই। কী খাইছিস?
ভাত খাইছি।
কী দিয়া খাইছিস?
মাছ দিয়া। মা, এরা সবকিছুতে নারকেল দেয়। আর খুব ঝাল দেয়।
ও হো, তুই তো আবার ঝাল খাইতে পারিস না।
না মা, ঝাল খাইতে পারি। ঝোলও খাইতে পারি। খালি গোল খাইতে পারি না।
গোল কী জিনিস? গোলমরিচ?
না। ফুটবলের গোল। ওইটা খাইতে ভালো লাগে না। মা দোয়া করো, কাইলকা খেলা আছে। কলম্বো গার্লস ক্লাবের লগে খেলা। দোয়া করো য্যান জিততে পারি।
আচ্ছা দোয়া করি। মা রে তোরে দেখতে ইচ্ছা করে...
আরে মা আমি তো আসুমই। আর কয়টা দিন...কাইন্দো না তো...
ফোন রেখে বাইরে গেলেন মা। টিউবওয়েলের হাতল চেপে পানি বের করে অকারণেই চোখমুখ ধুলেন। সেই পানির সঙ্গে মিশে গেল তাঁর চোখের জলও।
তিনি এসে শুয়ে পড়লেন। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া। ঘরের জানালা দিয়ে বাতাস আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।
ঘুম ভাঙল মোবাইল ফোনের রিংয়ের শব্দে। টু টু টু টু।
তিনি ঘুমভরা চোখে মোবাইল ফোন তুলে নিয়ে কল রিসিভ করলেন।
হ্যালো, মা...
কী রাশেদা? এত রাতে?
মা আমার তোমার কথা মনে পড়তাছে।
ও হো...ক্যান...
মা গো...আমারে বাড়ি নিয়া যাও। বিদেশ আমার ভালো লাগে না।
মা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, আরে মেয়ে কী যন্ত্রণা। কান্দে কেন? কান্দিস না। মনটারে শক্ত কর। এই তো আর মাত্র কয়টা দিন।
শ্রীলঙ্কা থেকে ফোন এসেছে মইন স্যারের কাছে।
ফোন করেছে মারিয়া।
স্যার, স্যার...
কে রে?
আমি মারিয়া, স্যার।
কী খবর? খেলা না আইজকা?
খেলা শেষ স্যার। আমরা ৪-০ গোলে জিতছি।
আলহামদুলিল্লাহ।
স্যার, আমাদের ন্যাশনাল টিমের কোচ বাবলু স্যার বলছেন, সুন্দরপুরের মেয়েরা আছে বইলাই আমরা এত ভালো খেলতে পারছি...
আচ্ছা, তা-ই নাকি। বলছেন উনি এই কথা...বলতেই হইব...
ফোন রেখে মইন স্যার উদাস হয়ে উঠানের দিকে তাকিয়ে থাকেন। একটা মা-মুরগি তার বাচ্চাগুলোকে পাখার নিচে সামলানোর চেষ্টা করছে। একটা কুকুর জামগাছের নিচে অলসভাবে ৩-এর মতো আকার নিয়ে শুয়ে আছে। তাঁর নিজ হাতে গড়া মেয়েগুলো আজ বিদেশে গেছে ফুটবল খেলতে। সেই মেয়েরা জয়লাভ করেছে। কী আনন্দ। কী আনন্দ।
কিন্তু তারা নতুন কোচ পেয়েছে। বিদেশে ট্রেনিং পাওয়া দামি কোচ। ঢাকার ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে চুক্তি করা কোচ। তাঁর মতো গ্রামের কোচের আর মূল্য কী?
মন খারাপ করে জামগাছের নিচে গেলেন তিনি। একটা টং আছে সেখানে। সেটির ওপরে গিয়ে বসেন। ঘুঘু ডাকছে। এই রকম বিকেলে ঘুঘু ডাকে কেন আবার! মইন স্যারের মনের ভেতরটা যেন কেমন করে।
এই সময়ে ফোন এল। বীণা। তিনি কাঁপতে কাঁপতে ফোন ধরলেন। হ্যালো...
হ্যালো, স্যার। আপনার মেয়েরা তো জিতে গেছে।
তাই নাকি? মইন স্যার এমন ভাব করলেন, যেন তিনি এই প্রথম শুনলেন খবরটা।
হ্যাঁ। শ্রীলঙ্কাতে ফোন করেছিলাম। ওরা ৪-০ গোলে জিতে গেছে। হা হা হা। আমার কী যে আনন্দ হচ্ছে।
তাই নাকি?
আপনার আনন্দ হচ্ছে না?
জি হচ্ছে।
কই আপনার গলায় কোনো আনন্দ নাই কেন?
জি না, আছে।
থাকলে প্রকাশ করেন। একটা ছড়া বানান।
না। এখন ছড়া আসছে না।
আপনার কী কোনো সমস্যা হয়েছে?
না, সমস্যা কী?
আপনার কি মন খারাপ?
না, মন খারাপ না।
আচ্ছা, আপনি কোথায় এখন বলেন। আমি আসছি...
আমি বাড়িতেই। না না, আপনাকে আসতে হবে না।
একটু পরে দেখা গেল, একটা রিকশাভ্যানে চড়ে বীণা এসে হাজির মইন স্যারের বাড়ির খোলায়।
মইন স্যার তাঁকে দেখে কী করবেন, কোথায় বসাবেন বুঝে উঠতে পারেন না।
আপনার মেয়েরা জিতেছে, আর আপনি টঙের ওপরে বসে বাতাস খাচ্ছেন? ব্যাপার কী? বীণার মুখে খুশি যেন আর ধরে না।
ব্যাপার নাই কোনো। এমনি বসে আছি।
এই দেখেন আমার মোবাইলে। ওদের বিজয়ের ছবি। অনলাইনে এরই মধ্যে ছবি এসে গেছে।
মইন স্যার বীণার স্মার্টফোন দেখতে লাগলেন। দেখে তাঁর মন আরও খারাপ হলো। রাশেদা, মারিয়া, তহুরা, সাবিনা—সবাই আছে। কিন্তু তিনি নাই ছবিতে। আরেকটা লোক আছে। এই লোকটা কি বাবলু স্যার...
বীণা বললেন, আপনার মন খারাপের কারণ কী?
মইন স্যার জোরে একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, আজকে আমি যদি ঢাকার মানুষ হইতাম, তাইলে এইখানে আমার ছবিও থাকত!
বীণা বললেন, আপনি তো ডেঞ্জারাস মানুষ। আপনার ছাত্রীরা ভালো করবে, বড় হবে, এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে, বড় স্কুলে পড়বে, বড় কলেজে পড়বে, বড় ক্লাবে যাবে, দেশ-বিদেশে খেলবে, তাতেই তো আপনাকে খুশি হতে হবে। আপনি কেন আপনার মেয়েদের সাকসেস দেখে মন খারাপ করবেন? আমি আপনার সঙ্গে আর কোনো দিনও কথা বলব না।
মইন স্যার বললেন, আমি কী দোষ করলাম?
অনেক বড় দোষ করছেন। আর কথাই বলবেন না।
বীণা উঠলেন টং থেকে। গিয়ে বসলেন তাঁর রিকশাভ্যানে। এই রিকশাওয়ালা ভাই, চলেন আমাকে নিয়ে সোজা বাড়ি চলেন।
***
চার বছর পর। মেয়েরা অনূর্ধ্ব ১৪ ফুটবল খেলতে গেছে নেপালে। বাংলাদেশ দল। ১৬ জনের দলে সুন্দরপুর উচ্চবিদ্যালয়ের ১০টা মেয়ে আছে। ১১ জনের দলে অন্তত ৬টা মেয়ে থাকে সুন্দরপুর গ্রামে।
মেয়েরা প্রায়ই খেলতে বিদেশে যায়, ঢাকা যায়, টাঙ্গাইল যায়, কক্সবাজার যায়। এটা আর কোনো ব্যাপার নয় গ্রামবাসীর কাছে।
তাদের গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ আসে নাই। তবে বেশ কয়েকটা বড়লোক বাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ আছে। সেখানে টেলিভিশন চলে। আবার হাটের মধ্যের দোকানেও ব্যাটারি দিয়ে টেলিভিশন চালানো হয়।
আজকে নেপালে বাংলাদেশের মেয়েরা প্রথম খেলবে। খেলা হবে ইরানের বিপক্ষে।
বাজারে জিলাপি আর চায়ের দোকানের সামনে ভিড়। টেলিভিশনের সামনে বসে আছে সবাই। খেলা দেখাচ্ছে বিটিভি। সরাসরি নেপাল থেকে।
টেলিভিশনের ধারাভাষ্যকারেরা বলছেন, এই ইরানকে বাংলাদেশ কোনো দিনও কোনো ধরনের ফুটবলে হারাতে পারেনি। ইরান ফুটবলে খুব উন্নত। তারা বিশ্বকাপে খেলেছে। বাংলাদেশে ইরানের খেলোয়াড়েরা আগে খেলতে আসত। তাদের ফুটবলের ঐতিহ্য খুবই উন্নত।
আজকে দেখা যাক কী হয়।
হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হচ্ছে। এর মধ্যে টেলিভিশন ঝিরঝির করতে লাগল।
গ্রামবাসীর সবাই হতাশ। এই টেলিভিশনটারে আছাড় মার। তাইলে ঠিক হইব।
চায়ের দোকানের মালিক ভবতোষ। তিনি বললেন, কানাই, দে তো টিভিটারে একটা বাড়ি। মার।
কানাই বেশ মোটাসোটা। চায়ের দোকানের বেঁচে যাওয়া খাবার রোজ রাতে তাকে খেতে হয়। খেয়ে খেয়ে তার পেটটা তিন মণি চালের বস্তা হয়ে গেছে।
কানাই সত্যি সত্যি টিভির পিঠে মারল এক চাপড়। অমনি ছবি ঠিক হয়ে এল।
গোল হয় না, গোল হয় না।
গোল...গোল দিয়েছে বাংলাদেশের রাশেদা...মিজান ভাই আপনাকে যা বলছিলাম, এই রাশেদা কিন্তু সুন্দরপুর গ্রামের রাশেদা...
পুরো গ্রাম হইহই করে উঠল। রাতের বেলা মোরগ উঠল ডেকে, গরুগুলো গোয়াল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইল, বিড়ালগুলো লাফিয়ে উঠল বাড়ির চালে, আর একঝাঁক পায়রা ডেকে উঠল বাক-বাকম।
রাশেদা রাশেদা...গ্রামবাসী চিৎকার করছে।
আবারও গোল। গোল করল মারিয়া...
২-০ গোলে জিতেছে বাংলাদেশ। সবাই মইন স্যারকে ঘাড়ে তুলে মিছিল শুরু করল।
রাতের বেলা একাকী ঘরে শুয়ে মইন স্যার ফোন দিলেন বীণাকে। হ্যালো, বীণা...
বীণা তখন ঢাকায়। তিনি আর গ্রামে থাকেন না। মইন স্যার তাঁকে ফোন করতে ভয় পান। শহরের মেয়ে। বড়লোকের মেয়ে। তাঁকে কি যখন-তখন ফোন করা যায়?
বীণা ধরলেন। হ্যালো স্যার, কী খবর।
আজকে আমি খুব খুশি। আমাদের মেয়েরা ইরানকে হারাইছে। ইতিহাসে এই প্রথম বাংলাদেশ ইরানকে হারাতে পারল।
তাই নাকি? খুব ভালো খবর। আপনি খুশি? খুশি হলে একটা ছড়া বলেন।
আজকে আমি খুশি
আজকে আমি হাসি
আজকে আমার প্রাণে
বাজে মধুর বাসি
আজকে আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি...
বীণা বললেন, আপনার ওপরে আমি রাগ করেছিলাম। আজকে আমার রাগ অর্ধেকটা কমে গেছে।
নেপালে আবারও খেলা। এবার ভুটানের সঙ্গে। এই খেলাও টেলিভিশনে সরাসরি প্রচার করা হচ্ছে। সুন্দরপুরের মানুষেরা আজকে টেলিভিশন নিয়ে এসেছে একটা সুন্দরপুর স্কুলের মাঠে। বিশেষ ব্যবস্থায় বড় অ্যানটেনা দিয়ে বিটিভি দেখা হচ্ছে। ছবিও এসেছে ঝকঝকে। আর টেলিভিশনটাও রঙিন।
মাঠভরা মানুষ আর মানুষ। পুরা সুন্দরপুর গ্রাম চলে এসেছে যেন স্কুলের মাঠে।
খেলা শুরু হলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই গোল। গোল দিল তহুরা।
আবার গোল। গোল দিল রাশেদা।
আবার গোল। আবারও রাশেদা।
আবারও গোল। গোল দিল সাবিনা।
আবারও গোল। গোল দিল মারিয়া...
১৪ গোল। ১৪-০। রাশেদার হ্যাট্রিক। মারিয়ার হ্যাট্রিক।
সুন্দরপুর গ্রাম আজকে পাগল হয়ে গেছে। তারা ঢোল-ঢাক-ঘটি-বাটি-থালা-গেলাস নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। মিছিল আর মিছিল। মিছিলে স্লোগান হলো বাংলাদেশ বাংলাদেশ। সুন্দরপুর সুন্দরপুর।
ধলু মাতুব্বর নতুন মোটরসাইকেল কিনেছেন। মোটরসাইকেলের হেডলাইট জ্বালিয়ে তিনি মিছিলের সামনে গেলেন। ঘোষণা করলেন, আগামীকাল ১০০ কেজি জিলাপি তিনি নিজ হাতে বিতরণ করবেন। গ্রামের সবাই জিলাপি খাবে।
মিষ্টির দোকানি খুব খুশি। আজকে আট হাজার টাকার জিলাপি বিক্রি হলো।
বীণা ফোন করেছেন মইন স্যারকে।
হ্যালো!
হ্যালো!
স্যার শুনেছেন, মেয়েরা ১৪ গোল দিয়েছে।
হ্যাঁ। আমরা মিছিল করলাম। মইন স্যারের মুখে হাসি...
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আপনার আব্বা আগামীকাল ১০০ কেজি জিলাপি খাওয়াবেন সবাইকে।
তাই নাকি?
আপনি কী খাওয়াবেন?
আমি? আমি কী খাওয়াব? ছড়া বলি?
বলেন...
আমার মনে বাজে বীণা
আমি আজ খুশি কিনা...
কী বললেন?
সরি। ভুল বলে ফেললাম নাকি?
হ্যাঁ। আপনি অনেক বড় ভুল করেছেন।
আচ্ছা সরি। আমি কারেকশন করছি।
কীভাবে?
আরেকটা ছড়া বানাচ্ছি।
আচ্ছা বানান দেখি।
মইন স্যার বলতে লাগলেন,
আমার নাম মইন
আপনি আমার বইন
কী? আমি আপনার বোন? বীণা ফোন কেটে দিলেন।
কী মুশকিল। আবার কী ভুল করলাম? মইন স্যার বুঝতে পারেন না। আবার তাঁর খুশি খুশিও লাগে।
হঠাৎ গ্রামে শোকের ছায়া। নেপালে ভূমিকম্প হয়েছে। পুরা কাঠমান্ডু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
পাশের নাগরকোটেও অনেক বাড়িঘর ভেঙে পড়েছে। হাজার মানুষ নাকি মারা গেছে।
রাশেদার মা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেলেন মারিয়ার মায়ের কাছে। এখন কী হবে গো...তহুরার বাবা-মা-বোন এসেছে এই বাড়ির সামনে। আমাদের মেয়েগুলা না জানি কেমন আছে গো...
রাতের বেলা ফোন এল। রাশেদা ফোন করেছে। মা, জানো, নেপালে ভূমিকম্প হইছে। আমরা ভালো আছি। আমাদের হোটেলের কিছু হয় নাই...
সত্যি হয় নাই তো মা? সত্যি তো...
না মা। এই যে কথা বলতেছি...
মারিয়া, তহুরা, সাবিনা সবাই কেমন আছে...
আমরা সবাই ভালো আছি, মা...
বাংলাদেশ দল ফিরে আসে নেপাল থেকে। ফাইনাল খেলাটা হলো না। বাংলাদেশ দল ফাইনালে উঠেছিল। নেপালের সঙ্গে ফাইনাল খেলা ছিল। ভূমিকম্পে পুরা নেপাল লন্ডভন্ড। এই সময় খেলার প্রশ্নই আসে না।
ঢাকায় এয়ারপোর্টে সাংবাদিকেরা ভিড় জমালেন। মেয়েরা প্লেন থেকে নামল। তাদের সাক্ষাৎকার নিলেন সাংবাদিকেরা।
সুন্দরপুর গ্রামের হাটে সেই খবর দেখল গ্রামবাসী। আমাদের মেয়েরা ফিরে এসেছে।
গ্রামে এল মেয়েদের মাইক্রোবাস। সবাই গিয়ে মেয়েদের বরণ করে নিল। কী দুশ্চিন্তাতেই না ছিল গ্রামবাসী।
রাশেদা গিয়ে সোজা তার মাকে জড়িয়ে ধরল।
মা বললেন, আমরা কত চিন্তা করছি।
আমরাও চিন্তা করছি। আমরা ভাবছি, যদি বাংলাদেশেও ভূমিকম্প হয়, তোমরা না জানি কেমন আছ? রাইতে স্বপ্ন দেখছি...
***
বীণা বললেন, মইন স্যার, আমাদের দেশ যদি ফাইনালে নেপালকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হতে পারে, তাহলে আপনাকে একটা জিনিস দিতে হবে।
কী জিনিস? ফোন ডান কান থেকে বাম কানে এনে মইন স্যার বললেন।
আপনার কাছে আমি যা চাইব তা দেবেন?
জি, কী জিনিস?
আরে দেবেন কি না বলেন।
জি, দিব। কী জিনিস...
আপনি কি আমাকে বিয়ে করতে পারেন?
কী...জি...
কী জি জি করছেন। করবেন?
আলহামদুলিল্লাহ...
কিন্তু শর্ত একটাই। বাংলাদেশকে জিততে হবে...
মইন স্যার বললেন, এইটা কী শর্ত দিলেন। এইটা আমার ওপরে না।
না হোক। তবু এইটাই আমার শর্ত।
হায় হায়...খেলায় তো হার-জিত থাকেই।
জীবনের খেলাতেও হার-জিত থাকে। নেপালকে হারাতে পারলে আমরা বিয়ে করব। তা না হলে করব না।
কী সমস্যা কী সমস্যা...
***
এক মাস পরে নেপালের সঙ্গে খেলা বাংলাদেশের। সুন্দরপুর থেকে ১০টা মেয়ে আছে টিমে। ৬টা অন্তত খেলবেই। ওরা এসেছে গ্রামে।
গ্রামে যেতে কোচ বাবলু স্যার ওদের কিছুতেই অ্যালাও করেন না। কারণ গ্রামে গেলেই মেয়েগুলো খাবার পায় না। শুকিয়ে যায়। ওদের ফিটনেস নষ্ট হয়। তবু ওদের যেতে দিতেই হলো। কোরবানির ঈদ। ঈদ বলে কথা...
ঈদে বাড়ি আসবেন বীণাও। মইন স্যারের ঘুম আসে না। তিনি সারা রাত বিছানায় ছটফট করেন। কাল সকালে বাসে উঠবেন বীণা। কত দিন পরে বীণার সঙ্গে দেখা হবে।
এবারের দেখা অন্য বারের মতো না। এবার বীণা তাঁকে বিয়ের কথা বলেছেন...