নদীতে মায়ের সঙ্গে মাছ ধরছিলাম। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। অস্থির আচরণ করছে মাছের দল। ছোটাছুটি করছে খুব। তাই ধরাও পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে। আকাশের গায়ে শিল্পীর তুলির মতো লালিমার পোঁচ। আমার মায়ের মুখে পড়ছে সেই ‘কন্যাসুন্দর’ আলো। পড়ছে তাঁর গায়ে। ঝলমল করছে তার আবরণ। দেখে মনে হচ্ছে, কেউ বুঝি তাঁর গায়ে রক্ত ঢেলে দিয়েছে।
ঠিক এ সময় বিশালকায় এক লোক বেরিয়ে এল পানিতে ভেসে বেড়ানো নলখাগড়ার স্তূপ থেকে। পিঠের ওপর বসানো একটা সিলিন্ডার থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা নল। মুখে গিয়ে ঢুকেছে। ওটার শেষ মাথায় কাচ বসানো, বোঝা যাচ্ছে। ঝিলিক দিচ্ছে সূর্যালোকে। খানিকক্ষণ দেখার পর বুঝলাম, যেমনটা ভেবেছিলাম, সে রকম মোটা নয় মানুষটা। মাথায় একটা কাচের বোলের মতো পরা, গায়ে পরেছে মোটা একটা স্যুট।
মা লোকটাকে নদীতে মাছের মতো সাঁতরে বেড়াতে দেখছিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মেরিন, চলো, যাই।’
কিন্তু আমি নড়লাম না। মিনিটখানেক পর দেখা গেল, লোকটা আর আগের মতো নড়ছে না। হাঁসফাঁস করছে। চেষ্টা করছে পিঠের সিলিন্ডারটা ধরতে।
‘ও তো নিশ্বাস নিতে পারছে না।’
আমার কথা শুনে মা বললেন, ‘তুমি ওকে সাহায্য করতে পারবে না। এখানকার বাতাস, পানি—সবকিছু তার জন্য বিষাক্ত।’
আমি ঝুঁকে পড়লাম নদীর ওপর। লোকটার মুখে লাগানো কাচের আবরণের মধ্য দিয়ে তাকালাম। ওর নিচে তার মুখটা নগ্ন। আমাদের মতো ত্বক নেই। নিশ্চয়ই ‘ডোম’ থেকে এসেছে। কুৎসিত বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ছে একদম। লোকটা কেমন কুঁকড়ে যাচ্ছে। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। পিঠের সিলিন্ডারটা ধরে তুলে আনলাম তাকে পানি থেকে।
***
ইশ্, ক্যামেরাটা যদি না হারাত! ছবি তুলে রাখতাম। ওদের মসৃণ, চকচকে দেহে বনে জ্বালানো আগুনের আলো যেভাবে নেচে বেড়াচ্ছে, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। ওদের বিকৃত হাত, ভঙ্গুর কাঠামো, ভয়ংকর বিকৃতি—এই আলোয় মনে হচ্ছে, সব হারিয়ে গেছে। আলো-ছায়ার খেলায় কী সুন্দর লাগছে! দেখে আমার বুক কেমন করে উঠল।
আমাকে যে মেয়েটা বাঁচিয়েছে, সে আমাকে এক গামলাভর্তি খাবার দিল। সম্ভবত মাছ। কৃতজ্ঞ মনে হাত বাড়িয়ে নিলাম।
পরিশোধন কিটটা বের করে নিলাম দ্রুত। তারপর খাবারের ওপর ন্যানোবট স্প্রে করে দিলাম। এগুলোকে বিশেষভাবে বানানো হয়েছে। কাজ শেষের পর ভেঙে যাবে। শরীরের কোনো ক্ষতি করবে না। এককালে যে ভয়ংকর কাণ্ড ঘটেছিল, পৃথিবী হয়ে উঠেছিল বসবাস অযোগ্য, সে রকম কিছু হবে না।
কিন্তু ওরা যদি কিছু মনে করে? তাই তাড়াতাড়ি বললাম, ‘এগুলো স্পাইস।’
মেয়েটা কেমন যেন হিসিয়ে উঠল, ‘ম-ব্লছ-এখনাক্র-খব-তম্র-জ্যন-ক্ষতক—’, না, এ রকম ভাঙা ভাঙা শব্দ বলাটা দোষের কিছু না। আমি কিচ্ছু মনে করিনি। অসুস্থ এই মানুষগুলোর বহু কষ্টে উচ্চারিত শব্দ যে কবিতা বা দর্শনের মতো নান্দনিক হবে না, তা আমি জানি। আমি বুঝেছি, মেয়েটা বলেছে, ‘মা বলেছে, এখানকার খাবার তোমার জন্য ক্ষতিকর।’
তাই জবাবে বললাম, ‘স্পাইস এগুলোকে নিরাপদ করে তোলে।’
কচলে নিয়ে পরিশুদ্ধ খাবারটা যখন আমার হেলমেটে বসানো খাদ্যনলে ঢুকিয়ে দিলাম, মেয়েটার মুখে ঢেউ উঠল। আমার প্রতিচ্ছায়াটাও জেনে হেসে উঠল নানা বর্ণে। হ্যাঁ, মেয়েটা হাসছে।
***
অন্যরা ডোম থেকে আসা লোকটাকে মোটেও বিশ্বাস করতে পারছে না। লোকটা এখনো স্যুট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
‘সে বলেছে, ডোমের মানুষজন আমাদের ভয় পায়। কারণ, তারা আমাদের বুঝতে পারে না। সে এ পরিস্থিতি বদলে দিতে চায়।’
মা শুনে হেসে ফেললেন। মনে হলো, যেন পাথরে কয়েক ফোঁটা পানি টুপটুপ করে পড়ল। গায়ের আবরণের নকশা কেমন বদলে গেছে। আলো পড়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছে, বিচিত্র নকশা ফুটিয়ে তুলেছে।
লোকটা আমার কাজকর্ম দেখে কেন যেন খুব অবাক হয়েছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে আছে আমাকে নিয়ে। এই আমার পেটে রেখা আঁকছে কিংবা নাড়া দিচ্ছে একটা কাঠি দিয়ে। শরীরের আবরণে ঢেউ উঠছে, সেটাই দেখছে মনোযোগ দিয়ে। আবার আমাদের কেউ কোনো কথা বললে সেটা টুকে নিচ্ছে সযত্নে।
লোকটা আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমার বাবা কোথায়। তাঁকে আমি চিনি কি না।
শুনে মনে হলো, ডোম নিশ্চয়ই খুব অদ্ভুত জায়গা। তার কথার জবাবে বললাম, ‘না, আমি চিনি না। আমাদের ত্রৈমাসিক মেলায় আগ্রহী নারী-পুরুষেরা হাজির হয়। সেখানেই আবরণ যথাযথভাবে মিলিয়ে তৈরি করে ফেলে আমাদের বীজ।’
শুনে লোকটা জানাল, সে দুঃখিত।
‘কেন?’
লোকটা কী ভাবছে, তা আমি জানি না। বোঝা যায় না। নগ্ন মুখে কোনো অভিব্যক্তি ফোটে না আমাদের আবরণের মতো।
লোকটা জবাব দিল, ‘এই সবকিছুর জন্যই আমি দুঃখিত।’
৫০ বছর আগে পাগলাটে ন্যানোবট এবং বায়োএনহ্যান্সার পৃথিবীতে প্লেগ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, খেয়ে ফেলে মানুষের ত্বক। তারপর এই প্লেগ ধীরে ধীরে দখল করে নেয় ত্বকের জায়গা। আবৃত করে নেয় তাদের, ভেতরে-বাইরে সবখানে। ঠিক খুদে রোবোটিক জোঁকের মতো। দখল করে নেয় মানুষের দেহ, গড়ে তোলে ব্যাকটেরিয়ার মতো কলোনি।
যাদের টাকাপয়সা ছিল, আমার পূর্বপুরুষ অস্ত্র কিনে নেয়, গড়ে তোলে ডোম। সেখান থেকে শরণার্থীদের মারা যেতে দেখে শয়ে শয়ে।
কিন্তু কেউ কেউ বেঁচে যায়। টিকে যায়। জীবন্ত এই পরজীবী মানুষের সঙ্গে মিথোজীবীর মতো মিশে যায়। আশ্রিত মানুষটির বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়া, বিষাক্ত পানি পান কিংবা খাবার খাওয়া সম্ভব করে তোলে।
ডোমের মানুষজন এই অসুস্থদের নিয়ে মজা করত। মাঝেমধ্যে দুঃসাহসী কেউ কেউ তাদের সঙ্গে ব্যবসাও করেছে। কিন্তু কেউ তাদের আর মানুষ বলে গণ্য করত না।
কেউ কেউ দাবি করত, অসুস্থরা যেভাবে আছে, সুখেই আছে। কিন্তু ওটা আসলে দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। দুর্ঘটনাক্রমে আমার জন্মের কল্যাণে আমি ডোমে জায়গা পেয়েছি, মেয়েটার জায়গা হয়েছে বাইরে। দার্শনিক চিন্তা করার বদলে পরজীবী আবরণ নিয়ে বেঁচে আছে মেয়েটা। অথচ ওতে তার কোনো দোষ নেই। ভাগ্যের ফেরে তাকে এখন হিসহিসিয়ে ভাঙা ভাঙা কথা বলতে হয়। সে বুঝতে পারে না পরিবার কী, ভালোবাসা কী।
তার মতোদের বাঁচানো আমাদের ডোমবাসীর দায়িত্ব।
আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘তুমি আমার আবরণ নিয়ে যেতে চাও?’
‘হ্যাঁ। তুমি, তোমার মা এবং অসুস্থ সবার চিকিৎসা খুঁজে বের করার জন্য।’
ওকে আমি এত দিনে বুঝে ফেলেছি। জানি, সে কথাটা বলেছে মন থেকে। ওর চোখে আমি মমত্ব দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট। এই আবরণ যে আমার কানের মতোই দেহের অংশ, তাতে ওর কিছু যায়–আসে না। এই মমত্বের কারণে ও আমাকে ছিলে ফেলতে চায়। নগ্ন করে দিতে চায়। ওর কাছে ওটাই আমার উন্নতি।
সে আবারও বলল, ‘আমার উচিত তোমাকে সাহায্য করা।’
ও আমার সুখকে কষ্ট মনে করে। আমার ভাবনাকে মনে করে ডিপ্রেশন। আমার ইচ্ছাকে মনে করে ভ্রান্তি। মানুষ যা দেখতে চায়, তাই যে দেখে, এটা খুব হাস্যকর একটা বিষয়। সে আমাকে তার মতো করে নিতে চায়। কারণ, সে ভাবে সে আমার চেয়ে ভালো। উন্নত।
দ্রুত হাতে আমি একটা পাথর তুলে নিয়ে ওর মাথার কাচের বোলটা ভেঙে ফেললাম। ও কোনো প্রতিক্রিয়া জানানোর সময়ই পেল না। চিৎকার করে উঠল গলা ফাটিয়ে। আমি ওর নগ্ন মুখ ছুঁয়ে দিলাম। আমার আবরণ ওকে ঢেকে নিচ্ছে। চুপচাপ দেখছি তাকিয়ে।
মা ঠিক বলেছিলেন। ও শিখতে আসেনি। কিন্তু ওকে শিখিয়ে দেওয়াটা আমার দায়িত্ব। কী আর করা!